পরিবেশ-ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, সচেতনতাও সৃষ্টি হচ্ছে by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

কেবল জলবায়ু পরিবর্তন নয়, সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে গত চার দশকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রমাগত ইতিবাচক অর্জন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কনভেনশন, চুক্তি ও সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান উজ্জ্বল।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও পরিবেশ বিষয়ে আমাদের আইনি সুরক্ষা যথেষ্ট। নীতিনির্ধারকরাও পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে আন্তরিক। উচ্চতর আদালতকেও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখছি আমরা। এখন প্রয়োজন পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় অবস্থান ও ভাবনা-চিন্তাকে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা


এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। ওই যুদ্ধই ছিল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান। বস্তুত যে কোনো যুদ্ধই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সেখানে যেসব গোলা-বারুদ ব্যবহৃত হয়, তার তেজস্ক্রিয়তা বাতাসে ও ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়; পরিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে এবং জাপানে আমরা যুদ্ধের ফলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশও ছিল এক বিপর্যস্ত রাষ্ট্র। প্রায় সব ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে গিয়েছিল। নদী পার হওয়ার জন্য ফেরিই ছিল ভরসা। মুক্তিযুদ্ধের পর সারাদেশে কয়েকশ' ফেরি চালু করতে হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় এটাকে পরিবেশ বিপর্যয় হিসেবে দেখা হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কারণ পরিবেশ সুরক্ষার ধারণাই তখনও বিকাশ লাভ করেনি। কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই পরিবেশের ব্যাপারে খুব একটা সচেতনতা ছিল না।
পরিবেশ সচেতনতার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট যদি ধরি, ১৯৭২ সালে স্টকহোমে 'হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট' বিষয়ে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে থেকেই অবশ্য একটু একটু করে পরিবেশবিষয়ক কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো বিষয়টি ইস্যু আকারে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছে। আমাদের মনে আছে, পরিবেশবাদী বৈশ্বিক সংগঠন গ্রিনপিস ওই সময়ই গঠিত হয়েছিল। কিন্তু স্টকহোম সম্মেলনের পর থেকে সরকারি পর্যায়েও পরিবেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। সরকারি পর্যায়ে ছাড়াও জাতিসংঘ এ সময় থেকে পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে।
নবীন রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ খুব দ্রুতই পরিবেশ সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথায়ই, ১৯৭৩ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ জারি করে। ওই বছরের শেষ দিকে সেটি আইনে পরিণত হয় এবং ১৯৭৪ সালে আইনটি সংশোধিত হয়। একটি নবীন দেশে এমন আইন তখন দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ সচেতনতার জন্যও সত্তর দশক ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে জেনেভায়। তখন কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপন করা হয় যে জলবায়ুতে কিছু পরিবর্তন ঘটছে এবং তার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ড দায়ী হতে পারে। তখন থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক, এমনকি রাজনীতিবিদ এবং অন্য যারা বিভিন্ন উন্নয়ন বিষয়ে কর্মকাণ্ড করেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। ফলে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়তে থাকে। এ সময় ঐতিহাসিকভাবে যা ঘটে তা হলো জাতিসংঘ এটাকে নজরে নিয়ে নরওয়ের প্রেসিডেন্ট ব্রুটল্যান্ডের নেতৃত্বে একটা কমিশন গঠন করে_ ওয়ার্ল্ড কমিশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট। ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘে যখন ব্রুটল্যান্ড কমিশন রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়, সৌভাগ্যবশত আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
সেখানে বলা হয়েছিল, উন্নয়ন কি অব্যাহত থাকতে পারবে? পরিবেশের বহন ক্ষমতা কতটুকু-বা কতটুকু উন্নয়ন ঘটাতে পারবে? কত মানুষকে বহন করতে পারবে বা কতদূর আমরা যেতে পারব? তারা বলেছিল, এর একটা লিমিট আছে, এর বাইরে যেতে পারবে না। ব্রুটল্যান্ডের একটা প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, আমরা যদি সচেতনভাবে এটা ব্যবহার করি তাহলে বহুদূর যেতে পারে। সব খেয়ে ফেলা উচিত হবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশকে ভালো রেখে যেতে হবে। এখানে সুকান্তের কবিতাটা স্মরণ করা যেতে পারে_ পৃথিবীটাকে যদি একটু ভালো করে রেখে যেতে পারি তবে সেটিই হবে আমার সার্থকতা। তো এই যে সচেতনতাটা বাড়ছিল, এ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এই সচেতনতা আরেক ধাপ ওপরে চলে যায়। চতুর্দিকে কনফারেন্স হতে থাকে। দেশে-বিদেশে কথাবার্তা হতে থাকে। সে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভাণ্ডারও বাড়তে থাকে। ওই সময়ে, ১৯৮৮ সালে আইপিসিসি গঠিত হয়। আইপিসিসি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রথম রিপোর্ট ১৯৯০ সালে, দ্বিতীয় রিপোর্ট '৯৭ সালে, তৃতীয় রিপোর্ট ২০০১ সালে এবং চতুর্থ রিপোর্ট ২০০৭ সালে প্রকাশ করে। এখন পঞ্চম রিপোর্টের প্রস্তুতি চলছে। আমি তৃতীয় এবং চতুর্থ রিপোর্টের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ১৯৯২ সালের মে মাসে গঠিত হয় ইউএনএফসিসি।
১৯৯২ সালেই ব্রাজিলের রিও-ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর্থ-সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন। অফিসিয়ালি এটার নাম ছিল ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। ওই সম্মেলন ছিল বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার জন্য মাইলফলক। সেখানে ১৭২টি দেশ অংশগ্রহণ করে। উপস্থিত ছিলেন ১০৮টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান এবং ২৪০০-এর বেশি বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি। ওই সম্মেলনে পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রথমটি ছিল জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশন স্বাক্ষর যা পরবর্তীকালে কিয়োটো প্রটোকলের জন্ম দেয়। ওই সম্মেলন জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত কনভেনশন রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এছাড়াও ধরিত্রী সম্মেলন থেকে যেসব আন্তর্জাতিক দলিল পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রিও ডিক্লারেশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এজেন্ডা টুয়েন্টি ওয়ান, ফরেস্ট প্রিন্সিপলস। বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল।
পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে আশি ও নব্বইয়ের দশক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি, বোঝাপড়া এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই দশকে আমরা দেখেছি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিবেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা, পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অগ্রগতি। বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই, ব্রিটিশ আমল থেকে বন বিভাগ ছিল। ১৯৭৭ সালে গঠন করা হয় পরিবেশ অধিদফতর। আশির দশকের গোড়া থেকেই আমরা পরিবেশ বিষয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের তাগিদ দিয়ে আসছিলাম। মূলত এর প্রতি সাড়া দিয়েই ১৯৮৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। পরিবেশ অধিদফতর ও বন বিভাগ এর অধীনে চলে যায়। নব্বইয়ের দশকে পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন এদেশে প্রণীত হয়।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমরা দেখেছি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা পরিবেশবিষয়ক বৈশ্বিক ক্ষেত্র দখল করে থাকে। এক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালে জাপানে কিয়োটোতে অনুষ্ঠিত হওয়া কপ-৩ বা কিয়োটো প্রটোকলের কথা বলতে হবে সবার আগে। কিয়োটো প্রটোকলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং এ দায়িত্বটা উন্নত বিশ্বকে দেওয়া। এটা কমানোর দায়িত্ব তাদের। কেননা ঐতিহাসিকভাবে তারাই এটার জন্য দায়ী। তারাই ১৫০-২০০ বছর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে উষ্ণায়ন পরিস্থিতিতে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। সুতরাং তাদেরই কমাতে হবে এবং তারা এটা মেনেও নিল। বলা হলো, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১৯৯০-এর তুলনায় তারা ৫ শতাংশ নিঃসরণ কমাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকল থেকে ২০০১ সালে বের হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় আইপিসিসির চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত হয় কপ-১৩। সেখানে পাঁচটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়। প্রথম বিষয় হচ্ছে, একটা ভিশন থাকতে হবে। শেয়ারড ভিশন। একটা কল্প আমাদের সামনে থাকতে হবে। এবং আমরা সবাই এই রূপ বা কল্প অনুযায়ী কাজ করব। দ্বিতীয় বিষয়, মিটিগেশন মেজারস। এটা না করলে পৃথিবী উষ্ণ হতে থাকবে। তৃতীয় বিষয়, অ্যাডাপ্টেশন মেজারস। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর ওপর যে অভিঘাত পড়ছে তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। চতুর্থ বিষয়, প্রযুক্তি ও তার উন্নয়ন। এবং সেগুলো উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে তা হস্তান্তর। পঞ্চম বিষয় হলো অর্থ। অর্থটার অর্থ হচ্ছে, উন্নত বিশ্ব থেকে অতি ক্ষতিগ্রস্ত দেশে অর্থের হস্তান্তর। শেষ বিষয়টি হলো সক্ষমতা বৃদ্ধি বা ক্যাপাসিটি বিল্ডিং।
বালিতে দুই বছরের মধ্যে একটা চুক্তি করার কথা বলা হয়। যেটা সবার কাছে আইনিভাবে প্রযোজ্য হবে। সে অনুযায়ী ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে হওয়ার কথা ছিল। ওই সময় সবাই এ ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কেননা ২০১২ সালে কিয়োটো প্রটোকল শেষ হয়ে যাবে। মানে ২০১২ সালের পর লিগ্যালি বাইন্ডিং বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু আশা ভঙ্গ হলো কোপেনহেগেনে। সেখানে আইনিভাবে গৃহীত কোনো চুক্তি হয়নি। হলো কোপেনহেগেন একোর্ড। একটা রাজনৈতিক ইচ্ছা পোষণ করা হলো। এর মানে, কোপেনহেগেন একোর্ড কি পুরোপুরি ব্যর্থ? অনেকেই মনে করেন, এটা পুরোপুরি ব্যর্থ। আমি মনে করি, কোপেনহেগেন একোর্ডে এমন কিছু কিছু জিনিস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার কারণে আমরা এখন যে দেনদরবার করছি, সেখানে ওই বিষয়গুলো যদি অন্তর্ভুক্ত না হতো তবে আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। সুতরাং আমাদের এখনকার যে দেনদরবার তার কিছু ভিত্তি ওইখানে রচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। মানে বেশ কিছু কাজ এগিয়ে গেছে। কিছু কিছু বিষয়ে অতি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যেমন বাংলাদেশ; এসব দেশের জন্য বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপের কথা বলা আছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনা ও সমঝোতা প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে যা তুলে ধরেছি তা হলো, আমরা এ বিষয়ে খুবই সচেতন। দলমত নির্বিশেষে এটাতে সবাইকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এটা কোনো দলের নয় বা সরকারের একক বিষয় নয়। এটা একটা জাতীয় ইস্যু এবং জাতীয় ইস্যু হিসেবেই আমার এটাকে দেখছি ও পালন করার চেষ্টা করছি। আমরা যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে এ বিষয়টি সেখানে তুলে ধরেছি। ২০০৫ সালে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান পরে অ্যাডাপ্টেশন করা হয়েছিল, সেটা ২০০৯ সালে আরও আপডেট করা হয়েছে। আমরা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। বাংলাদেশ সরকার ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯ সালে গ্রহণ করেছে। সেটার একটা ড্রাফট আগে হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। কিন্তু কেবিনেটে যাওয়ার পর গৃহীত হয়নি। তারপর আবার একটা কমিটি করা হয়েছিল, সে কমিটি আবার একটা টেকনিক্যাল কমিটি করেছিল। তারা এটাকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে দিলে সেটা গৃহীত হয়। এটা কিন্তু বিশ্বে সর্বপ্রথম। কোপেনহেগেনে এটা উপস্থাপিত হয়েছিল, সেখানে বাইরের যারা এসেছিলেন তারা সবাই স্বীকার করেছেন, অন্য কোনো দেশ এটা করেনি। এমনকি মার্কিন প্রতিনিধি যিনি এসেছিলেন তিনিও বলেছিলেন, তারা এটা থেকে শিখতে পারেন। বাংলাদেশ সরকার নিজেদের বাজেট থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত তহবিল গঠন করছে। যেমন প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাক্ট করা হয়েছে। একটা ট্রাস্ট ফান্ডও করা হয়েছে। সেই ফান্ডে সরকার গত বছরের বাজেটে ১০০ মিলিয়ন ডলার বা ৭০০ কোটি টাকার মতো দিয়েছে। চলতি বাজেটেও আরও ১০০ মিলিয়ন ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা দিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই অনেকগুলো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ৪৪টি সরকারি প্রকল্পে ৪৮৭ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে এখান থেকে। তাছাড়া এনজিওদের ২৪টি প্রজেক্টেও সাড়ে ১২ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে।
অ্যাডাপ্টেশন এবং মিটিগেশনে আমরা কী করব তা বিস্তারিতভাবে এখনও চিহ্নিত করতে পারিনি। আগামী পাঁচ বা দশ বছরে আমাদের কত টাকা লাগবে সেটা হিসাব করতে পারিনি। সেটা করারও আমরা চেষ্টা করছি। তবে আমরা মনে করছি, ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার লাগতে পারে। কিন্তু সেটা কীভাবে কোন পথে তা এখনই বিস্তারিত বলতে পারব না। তা আসলে কেউই বলতে পারবে না এখন। আমরা এটা করার চেষ্টা করছি। আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা যেটা করব সেটা হচ্ছে আমাদের যে দলিলগুলো আছে সেগুলো ভালোভাবে পড়ে আমাদের বক্তব্য ঠিক করে তুলে ধরব। আবার বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় উৎস থেকে অর্থ প্রাপ্তির দিকে নজর দেব। ইউএনএফসিসির আওতায় যেসব ফান্ড আছে সেসব থেকে কীভাবে বেশি করে অর্থ পাওয়া যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করব।
আর একটা জিনিস তা হলো, আমরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বা অন্যতম, তা বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রতিমন্ত্রী এবং আমাদের সব ডেলিগেশন সদস্য সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। কোপেনহেগেনে যেমন, কানকুনেও তেমনিভাবে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রয়োজনের কথা। বাংলাদেশ যে দায়ী নয়, দায়ী না হয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই কথা।
কেবল জলবায়ু পরিবর্তন নয়, সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে গত চার দশকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রমাগত ইতিবাচক অর্জন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কনভেনশন, চুক্তি ও সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান উজ্জ্বল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও পরিবেশ বিষয়ে আমাদের আইনি সুরক্ষা যথেষ্ট। নীতিনির্ধারকরাও পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে আন্তরিক। উচ্চতর আদালতকেও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখছি আমরা। এখন প্রয়োজন পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় অবস্থান ও ভাবনা-চিন্তাকে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা। এক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি এখনও রয়েছে। আমি আশা করি, আর দশ বছর পর বাংলাদেশ যখন সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে, তখন পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে আমরা আরও উজ্জ্বল ও ইতিবাচক অবস্থানে থাকব।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ : চেয়ারম্যান, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
 

No comments

Powered by Blogger.