আর্থিক খাতের সংস্কার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ড. মিহির কুমার রায়
অতি সম্প্রতি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস ও বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ সমিতির যৌথ উদ্যোগে টুয়ার্ডস বাংলাদেশ এ্যাট ৫০ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
উক্ত কর্মশালায় আটটি সেমিনারের মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ওপর এবং এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গবর্নর। প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচীগুলো যেমন বাজার সংস্কার ব্যবস্থাপনাÑযার আওতায় বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি, কঠিন চাপ পরীক্ষা ইত্যাদি সুন্দরভাবে তুলে ধরে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আগের চেয়ে যে বেশি গতিশীল তা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্কার কর্মসূচী শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে ইউএস এইডের আর্থিক সহযোগিতায়Ñযা এফএসআরপি নামে পরিচিত ছিল। এই কর্মসূচীর মুখ্য উপাদানগুলোর অন্যতম হলো প্রথমত, পরিবর্তিত সুদের হার নীতিমালা। এর আওতায় প্রত্যেকটি ব্যাংক নিজ নিজ অবস্থানের প্রেক্ষিতে স্ব-স্ব সুদের হার নির্ণয় করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারেÑযা পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ণয় করত। এর ফলে দেখা গেল, ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতামুখর ও গতিময়। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তিত ঋণ শ্রেণীবিন্যাসকরণ এবং শ্রেণীবিন্যাসকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থের জোগান সঠিক রাখা। এই প্রক্রিয়ায় ঋণের অবস্থানকে তিনটি ভাগ করা হয়, যেমন মানের নিচে, সন্দেহজনক এবং কুঋণ। এই পদ্ধতি কার্যকরকরণের ফলে ব্যাংকের সাঠিক আর্থিক অবস্থা গোচরে আসার সুযোগ পেলÑযা আগে এমনভাবে দেখা যায়নি। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জন্য কোন শাখার আর্থিক স্বাস্থ্য কতটুকু ভাল বা খারাপ তা সহজে বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হলোÑযা আগে তেমনটি দেখা যায়নি। তৃতীয়ত, মূলধন পর্যাপ্ততার হার বা পরিমাণÑযা প্রত্যেক শাখার মোট সঞ্চয়ের শতকরা ৫-৬ হারে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চতুর্থত, সিআইবিÑযার মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা বা আমানতকারীদের সব তথ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে দাফতরিক কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিংবা জাতীয় স্বার্থে, যেমন জাতীয় নির্বাচনেপ্রার্থী ঋণখেলাপি কিনা তা যাচাইয়ে ইত্যাদি। পঞ্চমত, মানব সম্পদ উন্নয়ন যার অংশ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআইবিএম-কে শক্তিশালী করে এমবিএস কোর্স চালুর মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। ষষ্ঠত, ব্যাংকের ব্যবহারিক কাজে কম্পিউটার চালুর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে অনলাইন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ইত্যাদি করা সম্ভব হয়েছে। সপ্তমত, ব্যাংকিং আইনের সংস্কার যার সুফল হিসেবে অর্থঋণ আদালত, মানি লন্ডারিং এ্যাক্টের বিভিন্ন ধারার সংস্কার ইত্যাদি সম্ভব হয়েছে। তাছাড়াও বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞাননির্ভর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে অনেকটা সরে এসেছে অর্থাৎ ব্যাংকের অবস্থান অনেকটা পল্লীমুখী কৃষক বান্ধব। তাছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৭২-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বায়ত্তশায়িত ব্যাংক, সেই স্বায়ত্তশাসন চর্চার ব্যাপারে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্বাহীগণ অনেকটা সজাগ রয়েছেন, যার ফল হিসেবে প্রায়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের মুখমুখি হতে দেখা যায়Ñযা এর আগে এতটা দেখা যায়নি। অতি সম্প্রতি সরকার নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অর্থ মন্ত্রণালয়কে লেখা চিঠি দুটি সংস্থাকে বিতর্কে জড়িয়ে রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর যেহেতু অনেকাংশে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত, সে ক্ষেত্রে রাজনীতির দেয়ালটি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন চর্চার ব্যাপারে অন্যতম বাধা বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কিনা তা বলা দুষ্কর, তবে পরিচালনাপর্ষদের সভাপতি এটা ভাল করে জানেন সে বোর্ড সভায় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, যা সরকারের বিরাগভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এখন মূল প্রবন্ধে আসা যাক এবং তার সঙ্গে বাস্তবতার কতটুকু মিল রয়েছে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোকপাত করা যাক। সমসাময়িক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে যে বিষয়গুলো দেশে আলোচনার ঝড় তুলেছে তার মধ্যে মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেট সর্বাগ্রে রয়েছে। দেশের পুঁজির বাজারে সে বেহাল দশা এবং বিশেষত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের রাস্তায় আন্দোলন যা সরকারের জনপ্রিয়তায় এক বড় ধরনের ঝুঁকি নামিয়ে দিয়েছে। কখনও সরকার স্টক মার্কেট নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে নন পারফরমিং হিসেবে আখ্যায়িত করে তা পুনর্গঠন করেছে, কিন্তু তাতে তেমন কোন ফল হয়নি। আবার সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষারোপ করেছে ব্যাংকগুলোর বেপরোয়াভাবে নীতিবহির্ভূত বিনিয়োগের কারণে অর্থাৎ যেখানে বিধিবদ্ধ নিয়মানুসারে বিশেষ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট আমানতের শতকরা দশ থেকে পনের ভাগ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগপ্রাপ্ত সেখানে কোন কোন ব্যাংক শতকরা পঁচিশ থেকে ত্রিশ ভাগ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে অতি মুনাফার আশায়। সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি চলে আসেÑযা কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তদারকি ও পরিবীক্ষণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত। এর ফলে বড় অঙ্কের বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ পুঁজিবাজারে আটকা পড়ে থাকে এবং ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে পড়ে যায়। এর ফলে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে এবং সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে অনেকটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির দুর্বলতা বিভিন্ন টক শোসহ গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের শূন্যতা প্রায়ই এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটিকে ভাবিয়ে তোলে। অপরদিকে সম্প্রতি উদ্ভূত পুঁজিবাজারের অস্থিরতা কাটিয়ে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বাজারকে যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য সরকার কিছু কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হয় এবং বাজারের তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আইসিসির উদ্যোগে ৫,০০০ কোটি টাকা ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি মেয়াদবিহীন মিচুয়াল ফান্ড গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এ ব্যাংকের কার্যক্রমগুলো সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের সকল দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল এবং বাংলাদেশেও তার কোন ভিন্নতা নেই। যদি কেউ মনে করেন রাতারাতি ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল থেকে উন্নয়নমুখী করে তুলবে, তবে তা হবে বড়ই ভুল। সরকারের আর্থিক উপদেষ্টা ও আর্থিক সম্পদের নিরাপত্তা বিধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল কাজের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আর্থিক খাতে যে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে তা ব্যাংকিং ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে যে বিবেচিত হবেÑএ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ব্যাংকাররা হঠাৎ করে এই কেলেঙ্কারির প্রতিযোগিতায় কেনইবা উৎসাহী হয়ে উঠল এবং ইহা দেশের সার্বিক দুর্নীতির আরেকটি অধ্যায় কিনা প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে সহসাই নাড়া দেয়। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা টিআইবি প্রায়ই তাদের গবেষণালব্ধ ফলগুলো কর্মশালার মাধ্যমে উপস্থাপন করে দুর্নীতির বিষয়গুলো জাতিকে অবহিত করে সরকারের বিরাগভাজন হয়ে চলছে প্রতিনিয়তই। সিপিডি প্রতিনিয়তই সরকারের আর্থিক নীতিমালা ও তার বাস্তবায়নসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অবস্থা নিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতির কাছে উপস্থাপন করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আর্থিক খাত যেহেতু অর্থনীতির চালিকাশক্তি, সেহেতু এই খাতটিকে নিয়ে ছলচাতুরী করা ঠিক না। কেবল আর্থিক খাতের সংস্কারের কথা বলে জনগণের ধ্যানধারণাকে গুরুত্ব না দিলে সাধারণ মানুষের আস্থা ব্যাংকিং খাত থেকে যে দূরে সরে যাবে বা যাচ্ছে তা ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কাজ হবে না। তাই সামনে চলার পথে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের মাত্রা কমানো, সঙ্কোচন মুদ্রানীতি পরিহার, মুদ্রাস্ফীতি এক ডিজিটে নামিয়ে আনা, নিরপেক্ষতার সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা, আর্থিক বাজার বিশেষত সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে পূর্ণনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাসহ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি আর্থিক খাতে নতুন প্রাণের আবেগ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব তেমনভাবে না পড়লেও এতে আত্মতৃপ্তির তেমন কিছুই নেই। কারণ আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি এমনটা শক্ত নয় যে, যেকোন সময় যে কোন পযধষষবহমব ছুড়ে দিতে পারে। গত বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত মাত্র ৬.৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকার প্রশাসনিক, রাজস্ব ও মুদ্রা খাতে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এর সুফল অবশ্যই আমাদের পেতে হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের আশার প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ থেকে সরকার বঞ্চিত হবেÑযার পরীক্ষা হবে আগামী নির্বাচনে।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, সিটি ইউনিভার্সিটি
No comments