ধর নির্ভয় গান-আবার এসেছে আষাঢ় by আলী যাকের
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সরকারগুলো কেবল তাদের ক্ষমতার সময়টি কোনোমতে কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে সবসময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তাদের ভাবার সময় কোথায়? আমরাই-বা কেন এত বিচলিত হই সমাজ নিয়ে তাহলে? এই আষাঢ়ে আসুন না আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে,
বৃষ্টির আশীর্বাদ মেখে নিতে সারা শরীরে। চলে যাই শহর থেকে গ্রামে কিংবা আরও দূরে! চলে যাই বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে কাদামাখা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। হয়তো কিছু ভাবি, হয়তো কিছুই ভাবি না
সাম্প্রতিককালে ঢাকাবাসী আমরা প্রায় বুঝতেই পারি না কখন আষাঢ় এলো, কখন শ্রাবণ গেল। বর্ষার সেই অবিরাম জলধারা, আকাশের জলস্পর্শে আধপোড়া মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ, চারপাশের বৃক্ষরাজি এবং সব ধরনের তরুলতার উজ্জীবিত হয়ে ওঠা, আকাশ ভরা কালো মেঘের ঘনঘটা, মানুষের মনে একধরনের উৎফুল্ল ভাব, সকলই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে। এমন এক সময় এসেছে এখন, যখন আলো অন্ধকারে অথবা যেখানেই যাই না কেন, মাথার ভেতরে কেবলই নিরানন্দ জাগতিক চিন্তা আমাদের উতলা করে। আমরা ভুলেই যাই আমাদের চারপাশে সকল উদ্দেশ্য এবং বিধেয় ছাপিয়ে, সকল কাজকে দূরে ঠেলে দিয়ে অকাজেরও এক সৌন্দর্যপ্রভা ঋতুতে ঋতুতে রঙ বদলায়। আমাদের আর দোষ কি বলুন? আষাঢ় আসে, আষাঢ় যায়, কোথায় সে অবিরাম বারিধারা? এই বছর অনেক দিন বাদে বঙ্গোপসাগরের কী মতিগতি হলো কে জানে, হঠাৎ এক নিম্নচাপে আকাশ ভারাক্রান্ত হলো এবং আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই শিপ শিপ্ করে ভিজতে লাগল বাড়িঘর, উঠোন, পুকুরের ঘাট, রাস্তা, গাছগাছালি, সবকিছুই। আষাঢ়ে সাধারণত কখনোই ঘন বর্ষা হয় না। হালকা অথবা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি দিনরাত চলতে থাকে। বাল্যকাল থেকে আমরা তা-ই দেখে এসেছি। কথায় কথায় বাল্যকালের কথাই মনে পড়ে আজকাল। আমার আপনজনরা ঠাট্টা করে বলে, এ হচ্ছে বয়স বাড়ার লক্ষণ। বয়স যত বাড়ছে, তত স্মৃতিনির্ভর হয়ে পড়ছি। এটাই নাকি নিয়ম। অথচ আমার বোধোদয় হওয়ার পর থেকেই আমি নিরন্তর স্মৃতির সাগরে অবগাহন করেছি। আমার পাঁচ বছরে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটে থাকে, যা স্মরণ রাখার যোগ্য, ছয় বছর বয়সেও সেই ঘটনার কথা আমার মনকে উতলা করেছে। তবে স্মৃতি আর স্মৃতিনির্ভরতা ভিন্ন বিষয়, এ সম্বন্ধে পরে অন্য একদিন বিস্তর আলোচনা করা যাবে। আজ যে প্রকৃতি সব ব্যাপারেই প্রায় অনিশ্চয়তায় ছেয়ে গেছে, তার পেছনে নাকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দায়ী। হতে পারে। তবে এ নিয়ে ভাববেন আবহাওয়াবিদরা। আমার দুঃখ, এই উষ্ণায়নের ফলে যা কিছু সুন্দর ছিল আমাদের বাল্যকালে কিংবা যৌবনে, নিসর্গনির্ভর, সব আজ হারিয়ে বসেছি আমরা।
এই আষাঢ়ে অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ছে। আষাঢ় এলে পরেই হালকা বৃষ্টি শুরু হতো এবং ক্রমে তা গাঢ়, ঘন হয়ে উঠত। আমরা প্রথম বৃষ্টির রাতে খিচুড়ি খেয়ে ঘুমাতে যেতাম। মাঝরাতে হঠাৎ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মত্ত হাওয়া মিলেমিশে এমন এক আবহের সৃষ্টি হতো যে, আমরা তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে বসতাম। ভারি ভালো লাগত। আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করত না। কিন্তু সেই বৃষ্টি ও হাওয়ার শব্দেই কখন যে ঢুলুনি আসত, কখন যে ঢলে পড়তাম ঘুমের ঘোরে, তা বুঝতেও পারতাম না। পরের দিন সকালে উঠলেই দেখতাম চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠত। বলেও বুঝি বসতাম, নিজের অজান্তে, 'বাহ, কী মজা!' এই রকম তাৎক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি মানেই জধরহু উধু উপলক্ষে স্কুল ছুটি। ক্লাস করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। নাশতা খাওয়ার পরে ৯টা বাজতে না বাজতেই ফুটবল হাতে হাজির হতাম বাড়ির কাছের মাঠে। সেখানে তখন জল জমে গেছে। শুরু হতো আমাদের খেলা। ফুটবল খেলা কতটুকু হতো তা জানি না। তবে ফুটবলকে কেন্দ্র করে একে অপরকে স্লাইড করে ফেলে দেওয়া, সবাই একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, কাদায় মাখামাখি, পানিতে ভিজে একসা হয়ে আমরা কারণে-অকারণে মহাআনন্দে চিৎকার করে হাসতাম। হঠাৎ দূরদিগন্তে একটি কালো ফোঁটা দেখা যেত। সেই ফোঁটা রূপান্তরিত হতো একটি মানুষের অবয়বে। সামান্য কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারতাম আমার ছোড়দা, আমার জেঠাতো ভাই এগিয়ে আসছেন। পানির ধারে এসে তিনি পানির স্পর্শ বাঁচিয়ে দাঁড়াতেন এবং আমাকে উদ্দেশ করে বলতেন, 'এই যে, অনেক হয়েছে, এবারে বাড়ি চল। আম্মার পাখার ডাণ্ডা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।' তেমন ভয় পেতাম না। কেননা আমার মায়ের হাতে তালপাখার ডাণ্ডাটি উদ্যত থাকলেও আমার পৃষ্ঠপ্রদেশ তা কখনোই স্পর্শ করত না। তবুও খেলায় ক্ষান্ত দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হতাম। বেচারা ফুটবল একাকী পড়ে থাকত জলের ওপর। বাতাসে তিরতিরিয়ে জল কাঁপত। কিছুক্ষণ পরে ছোড়দার ভয়ে একেবারে চুপসে যাওয়া আমার বন্ধুরা হৈহৈ করে বল নিয়ে রওনা দিত তাদের বাড়ির পথে। বাড়ি পেঁৗছতেই টের পেতাম চারদিক ম-ম করে উঠেছে সদ্য রান্না করা খিচুড়ির গন্ধে। সে সঙ্গে ভাজা ইলিশের সুবাস ভেসে আসত। এতক্ষণ যে খিদে ভোলানো খেলায় ভুলে ছিলাম খিদের কথা, সেই খিদে চনমনিয়ে উঠত পেটে।
ওই দিনগুলোতে বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছেই থাকতাম আমরা। তখন বুড়িগঙ্গার হাল আজকের এই নোংরা, এঁদো নর্দমার মতো হয়নি। আমরা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কোষা নৌকা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম নদীবক্ষে। অনেক সময় বৈঠা দিয়ে বাইতে বাইতে পেঁৗছে যেতাম ফতুল্লা। তারপর আবার উজান ঠেলে ফিরে আসতাম ফরিদাবাদে। অনেক রাতের অন্ধকারে যখন বৃষ্টির শব্দ আর বাইরের অন্ধকার এক ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করত, তখন আমরা আমাদের দিদিকে ঘিরে বসতাম ভূতের গল্প শোনার জন্য। কিসব রোমাঞ্চকর দিন ছিল সেসব! বাংলার বৃষ্টির এমন মাধুর্য, বাংলার বর্ষা এমন এক ঋতু, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকই আবেগপূর্ণ লেখা লিখেছেন। তবে এ সম্বন্ধে একবার আমার এক ব্রিটিশ বন্ধু আমায় বলেছিলেন, 'তোমরা এক অদ্ভুত জাতি বটে। তোমরা জান যে বর্ষাকালে অবধারিতভাবে বৃষ্টি আসবেই। তবুও তোমরা অপ্রস্তুত থাক। যখনই বৃষ্টি আসে, যেন অবাক হয়ে যাও তোমরা। ছোটাছুটি শুরু করে দাও ছাতা, রেইন কোট কিংবা অন্য কোনো আচ্ছাদনের জন্য। আগে থেকে প্রস্তুত থাকলে এমন শেষ মুহূর্তের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচা যায়।' আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে, এই অপ্রস্তুত কিংবা অবাক হয়ে যাওয়ায় যে অপার আনন্দ, সেটা তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা বাঙালিরা, এই রোমান্টিসিজম নিয়েই দিব্যি বেঁচে আছি হাজার বছর ধরে।
ফিরে আসি এবারের বৃষ্টিতে। আমি স্বীকার করি যে, দীর্ঘদিন বাদে এই আষাঢ়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশব, কৈশোরে আবার। দিন কয়েক ধরে বর্ষা নিয়ে দিবাস্বপ্নে মগ্ন ছিলাম যেন। হঠাৎ সেদিন বৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বাস করতে গিয়ে আমার এক তরুণ সহকর্মী আমায় স্মরণ করিয়ে দিল যে, বর্ষায় কেবল যে আনন্দ, তা নয়। সঙ্গে যথেষ্ট যন্ত্রণাও জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে আমাদের এই নাগরিক জীবনে। ঢাকা শহরে বৃষ্টি এলেই সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। জলমগ্ন হয় বেশিরভাগ এলাকা। যানবাহন চলাচল শ্লথ হয়ে যায় কিংবা থেমে যায়। সাধারণ যানবাহনের ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যায়। ফলে কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য বর্ষার আনন্দের বদলে যারপরনাই কষ্ট বয়ে নিয়ে আসে। আমি এই অত্যন্ত বৈধ মন্তব্যে থমকে দাঁড়াই। এই কথার সারবত্তা নিঃসন্দেহে অসীম। আমার বয়সী মানুষরা যখন তাদের শৈশব, কৈশোর নিয়ে স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে পড়ি, তখন আজকের রূঢ় বাস্তবকে ভুলে যাই যেনবা। ভুলে যাই যে, বছরের পর বছর ধরে নদীর ওপরে বাঁধ কিংবা রাস্তা খরস্রোতা নদীকে করে তোলে স্তিমিত। নদীবক্ষে পলিমাটি পড়ে পড়ে নদীগুলোর নাব্যতা কমে আসে ক্রমশ। খর বর্ষায় পানির তোড়কে ধারণ করতে পারে না আমাদের নদীগুলো। অতএব, দু'কূল ছাপিয়ে যায় জল। প্লাবিত করে দু'পাশের গ্রাম কিংবা শহর। এই বন্যায় অসীম দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের সাধারণ মানুষকে। এই ঢাকারই তো জনসংখ্যা বেড়েছে এর ধারণক্ষমতার বহুগুণ বেশি এবং তারা গড়ে তুলেছে নতুন নতুন আবাসিক বস্তি। এদের মাঝে কাজ করার মতো ইচ্ছা বা ক্ষমতা আমাদের পৌরসভার নেই। এসব মানুষের অধিকাংশই জানে না একটি নগরে থাকতে হলে কীভাবে বসবাস করতে হয়। যত্রতত্র তারা ছুড়ে দেয় পলিথিন কিংবা এমন সব বস্তু, যা জল নিষ্কাশনের সব ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দেয়। বেশ আগে থেকেই ঢাকার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। নিচে তৈরি করা হয়েছে ড্রেন। কিন্তু সেই ড্রেনও অকেজো হয়ে পড়েছে আবর্জনার আধিক্যে। অতএব, যে পরিমাণ জল নিষ্কাশন প্রয়োজন তার কিছুই হচ্ছে না ওই সব ড্রেন দিয়ে। ফলে বৃষ্টির জল আটকে গিয়ে বন্যা এখন নিত্য দৃষ্ট ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। জল জমে যাওয়ায় ক্ষণভঙ্গুর রাস্তাগুলো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ছে। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা শহর ক্রমশ বাসযোগ্য থাকছে না আর। এখানে কি আর আষাঢ়ের আগমনের দিবাস্বপ্ন দেখা যায়?
এসব সমস্যা সমাধানে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন অচিরেই। প্রয়োজন ছিল ঢাকা শহর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহরে বেশিরভাগ সরকারি দফতর ইত্যাদি, এমনকি মন্ত্রণালয়ও সরিয়ে নেওয়ার। তাহলে সেসব জায়গায় যথাযথ অবকাঠামো তৈরি হয়ে যেত নিজ থেকেই। তৈরি হতো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং মানুষের প্রয়োজনে যেসব অনুষঙ্গের দরকার, তার সবই। ঢাকার ওপরে জনসংখ্যার চাপ যেমন কমত, তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠত। মোটামুটি একই রকম চেহারা ধারণ করত দেশের সর্বত্র। কিন্তু এই ঘটনার মুখ্য পরিচালক যারা হতে পারতেন, তাদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সরকারগুলো কেবল তাদের ক্ষমতার সময়টি কোনোমতে কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে সবসময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তাদের ভাবার সময় কোথায়? আমরাই-বা কেন এত বিচলিত হই সমাজ নিয়ে তাহলে? এই আষাঢ়ে আসুন না আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে, বৃষ্টির আশীর্বাদ মেখে নিতে সারা শরীরে। চলে যাই শহর থেকে গ্রামে কিংবা আরও দূরে! চলে যাই বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে কাদামাখা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। হয়তো কিছু ভাবি, হয়তো কিছুই ভাবি না!
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সাম্প্রতিককালে ঢাকাবাসী আমরা প্রায় বুঝতেই পারি না কখন আষাঢ় এলো, কখন শ্রাবণ গেল। বর্ষার সেই অবিরাম জলধারা, আকাশের জলস্পর্শে আধপোড়া মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ, চারপাশের বৃক্ষরাজি এবং সব ধরনের তরুলতার উজ্জীবিত হয়ে ওঠা, আকাশ ভরা কালো মেঘের ঘনঘটা, মানুষের মনে একধরনের উৎফুল্ল ভাব, সকলই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে। এমন এক সময় এসেছে এখন, যখন আলো অন্ধকারে অথবা যেখানেই যাই না কেন, মাথার ভেতরে কেবলই নিরানন্দ জাগতিক চিন্তা আমাদের উতলা করে। আমরা ভুলেই যাই আমাদের চারপাশে সকল উদ্দেশ্য এবং বিধেয় ছাপিয়ে, সকল কাজকে দূরে ঠেলে দিয়ে অকাজেরও এক সৌন্দর্যপ্রভা ঋতুতে ঋতুতে রঙ বদলায়। আমাদের আর দোষ কি বলুন? আষাঢ় আসে, আষাঢ় যায়, কোথায় সে অবিরাম বারিধারা? এই বছর অনেক দিন বাদে বঙ্গোপসাগরের কী মতিগতি হলো কে জানে, হঠাৎ এক নিম্নচাপে আকাশ ভারাক্রান্ত হলো এবং আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই শিপ শিপ্ করে ভিজতে লাগল বাড়িঘর, উঠোন, পুকুরের ঘাট, রাস্তা, গাছগাছালি, সবকিছুই। আষাঢ়ে সাধারণত কখনোই ঘন বর্ষা হয় না। হালকা অথবা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি দিনরাত চলতে থাকে। বাল্যকাল থেকে আমরা তা-ই দেখে এসেছি। কথায় কথায় বাল্যকালের কথাই মনে পড়ে আজকাল। আমার আপনজনরা ঠাট্টা করে বলে, এ হচ্ছে বয়স বাড়ার লক্ষণ। বয়স যত বাড়ছে, তত স্মৃতিনির্ভর হয়ে পড়ছি। এটাই নাকি নিয়ম। অথচ আমার বোধোদয় হওয়ার পর থেকেই আমি নিরন্তর স্মৃতির সাগরে অবগাহন করেছি। আমার পাঁচ বছরে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটে থাকে, যা স্মরণ রাখার যোগ্য, ছয় বছর বয়সেও সেই ঘটনার কথা আমার মনকে উতলা করেছে। তবে স্মৃতি আর স্মৃতিনির্ভরতা ভিন্ন বিষয়, এ সম্বন্ধে পরে অন্য একদিন বিস্তর আলোচনা করা যাবে। আজ যে প্রকৃতি সব ব্যাপারেই প্রায় অনিশ্চয়তায় ছেয়ে গেছে, তার পেছনে নাকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দায়ী। হতে পারে। তবে এ নিয়ে ভাববেন আবহাওয়াবিদরা। আমার দুঃখ, এই উষ্ণায়নের ফলে যা কিছু সুন্দর ছিল আমাদের বাল্যকালে কিংবা যৌবনে, নিসর্গনির্ভর, সব আজ হারিয়ে বসেছি আমরা।
এই আষাঢ়ে অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ছে। আষাঢ় এলে পরেই হালকা বৃষ্টি শুরু হতো এবং ক্রমে তা গাঢ়, ঘন হয়ে উঠত। আমরা প্রথম বৃষ্টির রাতে খিচুড়ি খেয়ে ঘুমাতে যেতাম। মাঝরাতে হঠাৎ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মত্ত হাওয়া মিলেমিশে এমন এক আবহের সৃষ্টি হতো যে, আমরা তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে বসতাম। ভারি ভালো লাগত। আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করত না। কিন্তু সেই বৃষ্টি ও হাওয়ার শব্দেই কখন যে ঢুলুনি আসত, কখন যে ঢলে পড়তাম ঘুমের ঘোরে, তা বুঝতেও পারতাম না। পরের দিন সকালে উঠলেই দেখতাম চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠত। বলেও বুঝি বসতাম, নিজের অজান্তে, 'বাহ, কী মজা!' এই রকম তাৎক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি মানেই জধরহু উধু উপলক্ষে স্কুল ছুটি। ক্লাস করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। নাশতা খাওয়ার পরে ৯টা বাজতে না বাজতেই ফুটবল হাতে হাজির হতাম বাড়ির কাছের মাঠে। সেখানে তখন জল জমে গেছে। শুরু হতো আমাদের খেলা। ফুটবল খেলা কতটুকু হতো তা জানি না। তবে ফুটবলকে কেন্দ্র করে একে অপরকে স্লাইড করে ফেলে দেওয়া, সবাই একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, কাদায় মাখামাখি, পানিতে ভিজে একসা হয়ে আমরা কারণে-অকারণে মহাআনন্দে চিৎকার করে হাসতাম। হঠাৎ দূরদিগন্তে একটি কালো ফোঁটা দেখা যেত। সেই ফোঁটা রূপান্তরিত হতো একটি মানুষের অবয়বে। সামান্য কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারতাম আমার ছোড়দা, আমার জেঠাতো ভাই এগিয়ে আসছেন। পানির ধারে এসে তিনি পানির স্পর্শ বাঁচিয়ে দাঁড়াতেন এবং আমাকে উদ্দেশ করে বলতেন, 'এই যে, অনেক হয়েছে, এবারে বাড়ি চল। আম্মার পাখার ডাণ্ডা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।' তেমন ভয় পেতাম না। কেননা আমার মায়ের হাতে তালপাখার ডাণ্ডাটি উদ্যত থাকলেও আমার পৃষ্ঠপ্রদেশ তা কখনোই স্পর্শ করত না। তবুও খেলায় ক্ষান্ত দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হতাম। বেচারা ফুটবল একাকী পড়ে থাকত জলের ওপর। বাতাসে তিরতিরিয়ে জল কাঁপত। কিছুক্ষণ পরে ছোড়দার ভয়ে একেবারে চুপসে যাওয়া আমার বন্ধুরা হৈহৈ করে বল নিয়ে রওনা দিত তাদের বাড়ির পথে। বাড়ি পেঁৗছতেই টের পেতাম চারদিক ম-ম করে উঠেছে সদ্য রান্না করা খিচুড়ির গন্ধে। সে সঙ্গে ভাজা ইলিশের সুবাস ভেসে আসত। এতক্ষণ যে খিদে ভোলানো খেলায় ভুলে ছিলাম খিদের কথা, সেই খিদে চনমনিয়ে উঠত পেটে।
ওই দিনগুলোতে বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছেই থাকতাম আমরা। তখন বুড়িগঙ্গার হাল আজকের এই নোংরা, এঁদো নর্দমার মতো হয়নি। আমরা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কোষা নৌকা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম নদীবক্ষে। অনেক সময় বৈঠা দিয়ে বাইতে বাইতে পেঁৗছে যেতাম ফতুল্লা। তারপর আবার উজান ঠেলে ফিরে আসতাম ফরিদাবাদে। অনেক রাতের অন্ধকারে যখন বৃষ্টির শব্দ আর বাইরের অন্ধকার এক ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করত, তখন আমরা আমাদের দিদিকে ঘিরে বসতাম ভূতের গল্প শোনার জন্য। কিসব রোমাঞ্চকর দিন ছিল সেসব! বাংলার বৃষ্টির এমন মাধুর্য, বাংলার বর্ষা এমন এক ঋতু, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকই আবেগপূর্ণ লেখা লিখেছেন। তবে এ সম্বন্ধে একবার আমার এক ব্রিটিশ বন্ধু আমায় বলেছিলেন, 'তোমরা এক অদ্ভুত জাতি বটে। তোমরা জান যে বর্ষাকালে অবধারিতভাবে বৃষ্টি আসবেই। তবুও তোমরা অপ্রস্তুত থাক। যখনই বৃষ্টি আসে, যেন অবাক হয়ে যাও তোমরা। ছোটাছুটি শুরু করে দাও ছাতা, রেইন কোট কিংবা অন্য কোনো আচ্ছাদনের জন্য। আগে থেকে প্রস্তুত থাকলে এমন শেষ মুহূর্তের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচা যায়।' আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে, এই অপ্রস্তুত কিংবা অবাক হয়ে যাওয়ায় যে অপার আনন্দ, সেটা তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা বাঙালিরা, এই রোমান্টিসিজম নিয়েই দিব্যি বেঁচে আছি হাজার বছর ধরে।
ফিরে আসি এবারের বৃষ্টিতে। আমি স্বীকার করি যে, দীর্ঘদিন বাদে এই আষাঢ়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশব, কৈশোরে আবার। দিন কয়েক ধরে বর্ষা নিয়ে দিবাস্বপ্নে মগ্ন ছিলাম যেন। হঠাৎ সেদিন বৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বাস করতে গিয়ে আমার এক তরুণ সহকর্মী আমায় স্মরণ করিয়ে দিল যে, বর্ষায় কেবল যে আনন্দ, তা নয়। সঙ্গে যথেষ্ট যন্ত্রণাও জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে আমাদের এই নাগরিক জীবনে। ঢাকা শহরে বৃষ্টি এলেই সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। জলমগ্ন হয় বেশিরভাগ এলাকা। যানবাহন চলাচল শ্লথ হয়ে যায় কিংবা থেমে যায়। সাধারণ যানবাহনের ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যায়। ফলে কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য বর্ষার আনন্দের বদলে যারপরনাই কষ্ট বয়ে নিয়ে আসে। আমি এই অত্যন্ত বৈধ মন্তব্যে থমকে দাঁড়াই। এই কথার সারবত্তা নিঃসন্দেহে অসীম। আমার বয়সী মানুষরা যখন তাদের শৈশব, কৈশোর নিয়ে স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে পড়ি, তখন আজকের রূঢ় বাস্তবকে ভুলে যাই যেনবা। ভুলে যাই যে, বছরের পর বছর ধরে নদীর ওপরে বাঁধ কিংবা রাস্তা খরস্রোতা নদীকে করে তোলে স্তিমিত। নদীবক্ষে পলিমাটি পড়ে পড়ে নদীগুলোর নাব্যতা কমে আসে ক্রমশ। খর বর্ষায় পানির তোড়কে ধারণ করতে পারে না আমাদের নদীগুলো। অতএব, দু'কূল ছাপিয়ে যায় জল। প্লাবিত করে দু'পাশের গ্রাম কিংবা শহর। এই বন্যায় অসীম দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের সাধারণ মানুষকে। এই ঢাকারই তো জনসংখ্যা বেড়েছে এর ধারণক্ষমতার বহুগুণ বেশি এবং তারা গড়ে তুলেছে নতুন নতুন আবাসিক বস্তি। এদের মাঝে কাজ করার মতো ইচ্ছা বা ক্ষমতা আমাদের পৌরসভার নেই। এসব মানুষের অধিকাংশই জানে না একটি নগরে থাকতে হলে কীভাবে বসবাস করতে হয়। যত্রতত্র তারা ছুড়ে দেয় পলিথিন কিংবা এমন সব বস্তু, যা জল নিষ্কাশনের সব ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দেয়। বেশ আগে থেকেই ঢাকার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। নিচে তৈরি করা হয়েছে ড্রেন। কিন্তু সেই ড্রেনও অকেজো হয়ে পড়েছে আবর্জনার আধিক্যে। অতএব, যে পরিমাণ জল নিষ্কাশন প্রয়োজন তার কিছুই হচ্ছে না ওই সব ড্রেন দিয়ে। ফলে বৃষ্টির জল আটকে গিয়ে বন্যা এখন নিত্য দৃষ্ট ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। জল জমে যাওয়ায় ক্ষণভঙ্গুর রাস্তাগুলো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ছে। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা শহর ক্রমশ বাসযোগ্য থাকছে না আর। এখানে কি আর আষাঢ়ের আগমনের দিবাস্বপ্ন দেখা যায়?
এসব সমস্যা সমাধানে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন অচিরেই। প্রয়োজন ছিল ঢাকা শহর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহরে বেশিরভাগ সরকারি দফতর ইত্যাদি, এমনকি মন্ত্রণালয়ও সরিয়ে নেওয়ার। তাহলে সেসব জায়গায় যথাযথ অবকাঠামো তৈরি হয়ে যেত নিজ থেকেই। তৈরি হতো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং মানুষের প্রয়োজনে যেসব অনুষঙ্গের দরকার, তার সবই। ঢাকার ওপরে জনসংখ্যার চাপ যেমন কমত, তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠত। মোটামুটি একই রকম চেহারা ধারণ করত দেশের সর্বত্র। কিন্তু এই ঘটনার মুখ্য পরিচালক যারা হতে পারতেন, তাদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সরকারগুলো কেবল তাদের ক্ষমতার সময়টি কোনোমতে কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে সবসময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তাদের ভাবার সময় কোথায়? আমরাই-বা কেন এত বিচলিত হই সমাজ নিয়ে তাহলে? এই আষাঢ়ে আসুন না আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে, বৃষ্টির আশীর্বাদ মেখে নিতে সারা শরীরে। চলে যাই শহর থেকে গ্রামে কিংবা আরও দূরে! চলে যাই বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে কাদামাখা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। হয়তো কিছু ভাবি, হয়তো কিছুই ভাবি না!
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments