কালের আয়নায়-বনের বাঘ নয়, আওয়ামী লীগ এখন ভুগছে মনের বাঘের ভয়ে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমার নিজের একটি ধারণা ছিল, পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে ইসলামী জঙ্গিদের অভ্যুত্থান এবং বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ও তৎপরতা চালানোর অবাধ সুযোগ দেওয়ার ফলে মৌলবাদের যে শক্তি বেড়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো মনে করে, দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ
ও রাষ্ট্রধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিতে গেলে মৌলবাদীরা অসত্য প্রচারণা দ্বারা জনমনকে বিষাক্ত ও বিক্ষুব্ধ করে আবার একটি অস্থিতিশীল ও অরাজক অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ নেবে। সুতরাং সরকার এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে কিছু করতে চায় না
বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী মন্ত্রিপরিষদের সভায় সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রাখার সুপারিশটি অনুমোদিত হওয়ার পর আমি দেশ-বিদেশ থেকে অনেকগুলো টেলিফোন এবং ফ্যাক্স মেসেজ পেয়েছি। ঢাকা থেকে ডাল্লাস, প্রাপ্ত টেলিফোনের সংখ্যা বিরাট নয়, উল্লেখযোগ্য। যারা টেলিফোন করেছেন অথবা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন, তারা কেউ আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের লোক নন। তাদের কেউ কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবার অনেকে বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম ও ডেমোক্রেসির আদর্শে, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা সরাসরি আওয়ামী লীগার নন।
আমিও তাদের মতো বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের একজন নগণ্য সমর্থক মাত্র। সরাসরি আওয়ামী লীগার নই এবং আওয়ামী লীগের সরকার ও দলের ওপর প্রভাব বিস্তারের কোনো ক্ষমতাও আমার নেই। তবু রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের পক্ষেই বেশিরভাগ লেখালেখি করি; সে জন্য অনেকেই ভাবেন, আমার লেখা বুঝি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা পড়েন এবং আমার পরামর্শকে কিছুটা হলেও গুরুত্ব দেন। তাই দেশের মানুষের অনেকে আমার কাছে আওয়ামী লীগের ভালো-মন্দ কাজ সম্পর্কে অনেক সময়ই চিঠিপত্র লেখেন, তাদের আশা-নিরাশা ব্যক্ত করেন।
আমি অসহায়ের মতো তাদের বক্তব্য শুনি। তারা জানেন না আমার অবস্থা বিখ্যাত গুড আর্থ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র 'বৃদ্ধ কৃষক পিতার' মতো। আমি চিৎকার করতে পারি। কিন্তু শোনার লোক নেই। আমি শুনেছি, আমার লেখাকে গুরুত্ব দেওয়া দূরে থাক, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো 'কচি মন্ত্রী' আড়ালে-আবডালে হাসাহাসি করেন। তা তারা হাসুন। শেষ হাসি হাসার সময়টি দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তখন দেখা যাবে কে হাসেন আর কে কাঁদেন?
আমি গল্প লেখক ছিলাম, এখনও কালেভদ্রে গল্প লিখি। রাজনীতির আলোচনাতেও তাই গল্প এসে যায়। আজও পাঠকদের একটা গল্প উপহার দিচ্ছি। তবে এটি বানানো গল্প নয়। সত্য কাহিনী। পাকিস্তানের এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এক ঘনিষ্ঠ সভাসদের কাছে এটা শুনেছি। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আইয়ুব প্রেসিডেন্ট হাউসের সামনে রোজ ভোরে একটু পায়চারি করতেন। এটা ছিল তার মর্নিং ওয়াক। এ সময় তার বহু মন্ত্রী, দলনেতা, দলীয় এমপি, সরকারি-বেসরকারি মানুষ গেটে এসে দাঁড়াত এবং তাকে উঁচু হয়ে সালাম জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব জিন্দাবাদ, ছদরে রিয়াসত জিন্দাবাদ ইত্যাদি স্লোগান দিত। আইয়ুব তাদের দিকে তেমন ভ্রূক্ষেপও করতেন না। কেবল এগিয়ে এসে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডেনার বা মালির হাত থেকে একটি বিরাট লাল গোলাপ উপহার নিতেন। রোজ সকালে তিনি এই লাল গোলাপ মালির হাত থেকে পেতেন।
আইয়ুব লাল গোলাপ খুব ভালোবাসতেন। জ্যাকেটের বাটন হোলেও পরতেন। একবার লন্ডনে এসে তিনি সুন্দরী সোসাইটি গার্ল ক্রিস্টান কিলারের সঙ্গে এক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, তার কাছে দুটি অত্যন্ত প্রিয় জিনিস হচ্ছে লাল গোলাপ এবং সুন্দরী নারী। যা হোক পাকিস্তানের এই অসীম ক্ষমতাশালী ফৌজি প্রেসিডেন্টেরও একদিন ক্ষমতা থেকে পতন হলো। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসও ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন।
যেদিন প্রেসিডেন্ট হাউস তিনি ছাড়বেন, সেদিনও মর্নিং ওয়াকে বেরুলেন। দেখেন তার গেটের কাছে তার সভাসদ ও চাটুকারের দল কেউ নেই। কেবল লাল গোলাপ হাতে মালি দাঁড়িয়ে আছে। আইয়ুব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কেউ আসেনি? মালি বিষাদের হাসি হেসে বলল, 'না স্যার, কেউ আসেনি। কেবল আমি এসেছি।' সম্প্রতি আইয়ুব আমলের এই গল্পটি স্মরণ হওয়ায় মনে মনে ভেবেছি, আমাকে যেন একা লাল ফুল হাতে ঢাকার গণভবনের গেটে কোনোদিন দাঁড়াতে না হয়।
গল্প থাক, আসল কথায় আসি। আওয়ামী লীগ সরকার বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের নামে তাতে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে কাজটি করল, তাকে এক কথায় বলা চলে দেশের মানুষের সঙ্গে পরিমল রসিকতা। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সিপিএমের এক মন্ত্রীকে নির্বাচনের আগে কালীমন্দিরে গিয়ে কালীপূজা করতে দেখা গেছে। সাংবাদিকরা তাকে ধরে ফেলে প্রশ্ন করলে তিনি একগাল হেসে বলেছেন, 'আরে বাপু, আমি তো কেবল কমিউনিস্ট নই, হিন্দুও।' এখন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের বিধানের সংযোজন বহাল থাকায় আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী ও সাংসদই বলতে পারবেন, 'আরে বাপু, আমরা তো কেবল ধর্মনিরপেক্ষ নই, মুসলমানও।'
আওয়ামী লীগ সরকারের এই 'ঐতিহাসিক সুসিদ্ধান্ত' নেওয়ার পর যারা আমাকে টেলিফোন করছেন, ফ্যাক্স পাঠাচ্ছেন, তাদের সব কথার সার কথা হলো_ আমরা এখন কী করব? এই প্রশ্নকারীদের মধ্যে একজন মুহিবুর রহমান জালাল, এখন মার্কিন মুল্লুকের ডাল্লাসে থাকেন। তিনি একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে তখনকার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে জার্মান ডাক্তার হের গাস্ট কর্তৃক চিকিৎসিত হয়েছেন। এখন দীর্ঘকাল ধরে ডাল্লাসে আছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন। সেসব তথ্য তিনি এখন ঢাকায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ কমিশনের কাছে পাঠাচ্ছেন।
বেশ কয়েক বছর আগে আমি ডাল্লাসে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কিত এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম (তখন আহমদ ছফা বেঁচে, তিনি, ড. আনিসুজ্জামান, ড. কেতকী কুশারী ডাইসন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রমুখ অনেকেই গিয়েছিলেন)। সেখানে জালালের সঙ্গে দেখা। সে সম্মেলনে তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি চমৎকার চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। তার কথা আমি ভুলতেই বসেছিলাম। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রাখার পক্ষে আওয়ামী মন্ত্রিসভা সম্প্রতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আমি যখন দেশের এবং বিদেশের অনেকের কাছ থেকে টেলিফোন পেতে শুরু করি, তখন ডাল্লাস থেকে জালালের টেলিফোনও পাই। তাকে আবার মনে পড়ে।
অনেক ফোনকলের মধ্যে তার কলটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, তার প্রশ্নগুলোকে বাংলাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী সব মানুষের মনের কথা বলে মনে হয়েছে। আরও অনেকে একই কথা বলেছেন, কিন্তু তার মতো এত সরাসরি বলেননি। তিনি বলেছেন, গাফ্ফার ভাই, '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে জিয়া ও এরশাদের স্বৈরাচারী বিধানগুলো আওয়ামী সরকার সংবিধানে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমরা যারা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়াই করেছি, রক্ত দিয়েছি, স্বজন হারিয়েছি, আমরা এখন কী করব? দেশে পাকিস্তানপন্থি মৌলবাদীরা একাট্টা হয়ে মাথা তুলেছে। বামপন্থি দলগুলো দুর্বল, ছিন্নভিন্ন। আমাদের একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র ও রক্ষাবূ্যহ ছিল আওয়ামী লীগ। মনে হয় সেই আওয়ামী লীগও এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী চক্রের কাছে মাথানত করেছে। আমরা এখন আশ্রয়চ্যুত। কোথায় যাই বলুন? আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত হয়ে আমাদের কি বিএনপি-জামায়াত শিবিরে যেতে হবে? সেটা তো হবে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো। আমরা এখন কোথায় যাই?
নারায়ণগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র বিশ্বাস, একটি টেক্সটাইল মিলের সঙ্গে যুক্ত, তিনি ফ্যাক্স পাঠিয়ে তাতে লিখেছেন, 'আপনার ফ্যাক্স নম্বরটি ঢাকার পত্রিকা অফিস থেকে জোগাড় করেছি। আপনি সংখ্যালঘুদের পক্ষে লেখেন বলেই মনের দুঃখ জানানোর জন্য এই চিঠিটা লিখছি। কোনো প্রতিকার হবে এই আশায় লিখছি না। পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন শুরু হয়েছিল। ফলে তাদের সংখ্যা বিরাটভাবে কমে গিয়ে এখন আবার তিন কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন এবং আদিবাসী ও পাহাড়িয়াদের সংখ্যাও কম নয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য কেবল বাঙালি মুসলমানরাই লড়াই করেনি, বরং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ লড়াই করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারে বিশ্বাস করেছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সব ধর্মের মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকারের একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সেই অঙ্গীকার কি বর্তমান আওয়ামী লীগ ভঙ্গ করেনি? তিন কোটি হিন্দু এবং বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী এবং পাহাড়িয়াদের উচ্চ আদালতের রায় সত্ত্বেও কেবল দলীয় সিদ্ধান্তে দ্বিতীয় শ্রেণীর (কার্যত তৃতীয় শ্রেণীর) নাগরিকের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার অধিকার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে কে দিয়েছে? এই প্রশ্নটির জবাব আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। আওয়ামী লীগ কি এরপরও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভোট আশা করে?'
রাজশাহী থেকে এক ফ্যাক্স প্রেরক করেছেন একটি মৌলিক প্রশ্ন। তিনি নাম প্রকাশের অনুমতি না দেওয়ায় তার কলেজ শিক্ষকের (মুসলমান) পরিচয়টিই এখানে তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, 'আওয়ামী লীগকে এখন একটি সেক্যুলারিস্ট দল হিসেবে আর গণ্য করা চলে কি-না? ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ সেক্যুলারিস্ট দলে পরিণত হওয়ার পর যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তন থেকে শুরু করে দেশটির জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান (১৯৭২) প্রণয়ন পর্যন্ত, এমনকি ধর্মীয় স্লোগানের বদলে জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলা গ্রহণ দ্বারা একটি প্রকৃত সেক্যুলারিস্ট দলের পরিচয়ে অটল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের এই পরিচয় থেকে পশ্চাদপসরণ। এই পশ্চাদপসরণ এত দ্রুত যে বিএনপির সঙ্গে তার পার্থক্য ক্রমেই প্রায় শূন্যের কোঠার দিকে চলে যাচ্ছে।
নিজের বক্তব্যের পক্ষে অনেক প্রমাণ উল্লেখ করেছেন এই কলেজশিক্ষক। জয় বাংলা স্লোগানের বদলে আল্লাহ সর্বশক্তিমান স্লোগান প্রবর্তন, জাতীয় সঙ্গীতের বদলে ধর্মীয় সূরা দিয়ে সভা-সম্মেলন শুরু করা, দাড়ি-টুপি রাখার ব্যাপারে জামায়াতিদেরও হার মানানো, এসব গেল বাহ্যিক ব্যাপার। আদর্শিক ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ কি সেক্যুলার দলের পর্যায়ে রয়েছে? অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলের ব্যাপারে তাদের ঢিলেমি, পাহাড়িয়া শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরেও তা কার্যকর করার ব্যাপারে অনাগ্রহ ও অক্ষমতা, সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা পাওয়ার পরও বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনে অনিচ্ছা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও নানা অজুহাতে দীর্ঘসূত্রতা_ পত্রলেখকের মতে, আওয়ামী লীগের চরিত্র বদলের প্রমাণ বহন করে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে অনেক ভালো করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে তার নীতিবিচ্যুতি তাকে ক্রমশই দল হিসেবে বিএনপির কাছাকাছি নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগ কী করে সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষের সমর্থন ও ভোট আশা করবে?
আমার নিজের একটি ধারণা ছিল, পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে ইসলামী জঙ্গিদের অভ্যুত্থান এবং বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ও তৎপরতা চালানোর অবাধ সুযোগ দেওয়ার ফলে মৌলবাদের যে শক্তি বেড়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো মনে করে, দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিতে গেলে মৌলবাদীরা অসত্য প্রচারণা দ্বারা জনমনকে বিষাক্ত ও বিক্ষুব্ধ করে আবার একটি অস্থিতিশীল ও অরাজক অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ নেবে। সুতরাং সরকার এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে কিছু করতে চায় না।
আমার মনের কথা জেনেই কি-না জানি না, রাজশাহীর কলেজশিক্ষক তার চিঠিতে এই ধারণার বিরুদ্ধেও যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ধর্মপ্রিয়, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতিও এখানে নেই। তাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখানকার জনপ্রিয় দাবি। এই দাবি পূরণে পেছালে আওয়ামী লীগের জন্য খবর আছে। জামায়াতিরা প্রচার করেছিল, তাদের গায়ে হাত দেওয়া হলে ইসলামের গায়ে হাত দেওয়া হবে। দেশে আগুন জ্বলবে। নিজামী থেকে সাঈদী পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের চ্যাঙদোলা করে জেলে ঢোকানোর পর বাংলাদেশে একটি ঘাসের পাতাও নড়েনি। তাদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হলে দেশে ঈদুল ফতেহের (বিজয়ের উৎসব) আনন্দের বন্যা বইবে। নারী অধিকার প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতিদের উস্কানিতে মুফতি আমিনীর দল বিক্ষোভ-আন্দোলনে নেমে কী লাভ করেছে, তা কি আওয়ামী লীগ সরকার দেখেনি? বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নেও জামায়াতিরা বাংলার মুসলমানের মনে আর 'ওয়াসওয়াসা' সৃষ্টি করতে পারবে না। এ কথাটা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সকলেই জানেন। তারপরও তারা ভয় পাওয়ার বাহানা করেন কেন? রাজশাহীর শিক্ষক বন্ধু বলেছেন_ 'বনে বাঘ নেই, আওয়ামী লীগ ভুগছে মনের বাঘের ভয়ে।'
লন্ডন, ২৪ জুন, শুক্রবার, ২০১১
No comments