শিক্ষা-শারীরিক শিক্ষায় অশরীরী ভূত by মোঃ হাফিজুর রহমান
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শারীরিক শিক্ষার অবস্থান যেন স্বপ্ন ও স্বপ্ন ছিনতাই হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক এক অধ্যায়। শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির শারীরিক উন্নয়ন, নেতৃত্ববোধ, বিদ্যালয়ের জীবতাত্তি্বক দৃষ্টিভঙ্গি, মনস্তাত্তি্বক সংযমতা, বাস্তব জ্ঞানলাভ, আত্মসচেতনতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব, যা উন্নততর দেশগুলোতে শিক্ষা কারিকুলামের একটি আবশ্যিক বিষয়।
কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শারীরিক শিক্ষা খুবই অবহেলিত। প্রাথমিক স্তরে শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয় এবং শরীর চর্চা শিক্ষক এখানে নেই। শুধু পিটিআই ট্রেনিংয়ের সময় নামমাত্র শারীরিক কার্যক্রমের একটি পাঠ্যবই আছে যা বিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমের কোনো প্রায়োগিক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় না। ঢাকা কেন্দ্রিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে শারীরিক শিক্ষার কিছু তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় কিন্তু এটি শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্র নয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। শুধু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষার একটি পাঠ্যবই আছে যা পাঠদানের ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষেই এর কার্যক্রম শেষ। শারীরিক শিক্ষার কার্যক্রম মাঠ পর্যন্ত গড়ায় না। কারণ অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান অযথা 'সময় নষ্ট' করতে চান না। ক্লাস রুমের বাইরে নিয়মিত শরীর চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায় প্রতিটি এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজ এবং সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শরীরচর্চা শিক্ষক আছেন কিন্তু তাদের কোনো পাঠ্যবই নেই এবং নিয়মিত ব্যবহারিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কলেজগুলোতে নিয়মিত কোনো সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যেই শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রম নিহিত। কোনো কোনো কলেজে আবার ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয় না। একাডেমিক কারিকুলামেও শরীরচর্চার কোনো স্থান নেই। শুধু ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অধীনে কিছু স্কুল ও ক্যাডেট কলেজগুলোতে শারীরিক শিক্ষার নিয়মিত কিছু কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা নামে একটি বিভাগ আছে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য দল গঠনে এই বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক শিক্ষার কার্যক্রম নেই বললেই চলে। আবার এখনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়নি। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ খোলা হলেও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমান্বয়ে খেলাধুলার কোটা বিলুপ্ত হচ্ছে। কিছুকাল পূর্বেও ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় উৎসাহী ছিল। কারণ উচ্চশিক্ষা করতে গিয়ে খেলাধুলার কোটায় যোগ্যতাসম্পন্ন খেলোয়াড়রা ভর্তি হতে পারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেলোয়াড় কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অখেলোয়াড়রা খেলোয়াড় হওয়ার সুযোগ লাভ করে। বস্তুত আমরা মাথাব্যথার উপশম না করে মাথাটাই কেটে ফেলেছি।
আমরা শারীরিক শিক্ষাকে শুধু প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। কিন্তু এটি যে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার একটি উলেল্গখযোগ্য দিক এদিকে কারও খেয়াল নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত শরীরচর্চা বাধ্যতামূলক করা ও এতে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই। আজ খুব অল্প বয়সেই আমাদের সন্তানরা বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে - ক্ষুধামন্দা, অজীর্ণ, গ্যাস্ট্রিক, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও শরীরচর্চা না করার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণেই উন্নততর দেশগুলোতে হাসপাতাল স্থাপনের চেয়ে জিমনেসিয়াম স্থাপনের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছি কিন্তু শারীরিক শিক্ষায় আউটপুট কি?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা বিভাগ তথা শরীর চর্চা শিক্ষকদের শারীরিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। শারীরিক শিক্ষার ওপর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাস থাকতে হবে, সে সঙ্গে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে নম্বরের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের মেধাক্রম যাচাই হবে। শারীরিক শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। শারীরিক শিক্ষায় চেপে বসা অশরীরী ভূত তাড়াতে না পারলে জাতিগত উন্নয়ন সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।
মোঃ হাফিজুর রহমান : শরীরচর্চা শিক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। শুধু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষার একটি পাঠ্যবই আছে যা পাঠদানের ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষেই এর কার্যক্রম শেষ। শারীরিক শিক্ষার কার্যক্রম মাঠ পর্যন্ত গড়ায় না। কারণ অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান অযথা 'সময় নষ্ট' করতে চান না। ক্লাস রুমের বাইরে নিয়মিত শরীর চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায় প্রতিটি এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজ এবং সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শরীরচর্চা শিক্ষক আছেন কিন্তু তাদের কোনো পাঠ্যবই নেই এবং নিয়মিত ব্যবহারিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কলেজগুলোতে নিয়মিত কোনো সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যেই শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রম নিহিত। কোনো কোনো কলেজে আবার ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয় না। একাডেমিক কারিকুলামেও শরীরচর্চার কোনো স্থান নেই। শুধু ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অধীনে কিছু স্কুল ও ক্যাডেট কলেজগুলোতে শারীরিক শিক্ষার নিয়মিত কিছু কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা নামে একটি বিভাগ আছে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য দল গঠনে এই বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক শিক্ষার কার্যক্রম নেই বললেই চলে। আবার এখনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়নি। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ খোলা হলেও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমান্বয়ে খেলাধুলার কোটা বিলুপ্ত হচ্ছে। কিছুকাল পূর্বেও ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় উৎসাহী ছিল। কারণ উচ্চশিক্ষা করতে গিয়ে খেলাধুলার কোটায় যোগ্যতাসম্পন্ন খেলোয়াড়রা ভর্তি হতে পারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেলোয়াড় কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অখেলোয়াড়রা খেলোয়াড় হওয়ার সুযোগ লাভ করে। বস্তুত আমরা মাথাব্যথার উপশম না করে মাথাটাই কেটে ফেলেছি।
আমরা শারীরিক শিক্ষাকে শুধু প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। কিন্তু এটি যে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার একটি উলেল্গখযোগ্য দিক এদিকে কারও খেয়াল নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত শরীরচর্চা বাধ্যতামূলক করা ও এতে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই। আজ খুব অল্প বয়সেই আমাদের সন্তানরা বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে - ক্ষুধামন্দা, অজীর্ণ, গ্যাস্ট্রিক, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও শরীরচর্চা না করার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণেই উন্নততর দেশগুলোতে হাসপাতাল স্থাপনের চেয়ে জিমনেসিয়াম স্থাপনের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছি কিন্তু শারীরিক শিক্ষায় আউটপুট কি?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা বিভাগ তথা শরীর চর্চা শিক্ষকদের শারীরিক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। শারীরিক শিক্ষার ওপর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাস থাকতে হবে, সে সঙ্গে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে নম্বরের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের মেধাক্রম যাচাই হবে। শারীরিক শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। শারীরিক শিক্ষায় চেপে বসা অশরীরী ভূত তাড়াতে না পারলে জাতিগত উন্নয়ন সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।
মোঃ হাফিজুর রহমান : শরীরচর্চা শিক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
No comments