প্রান্তজনের কথা-বাজেট :অস্থিতিশীলতার মুখে উন্নয়নের স্বপ্ন by আলী আহমদ
খুব স্বস্তির সঙ্গে একটি বিষয় বেশ ক'বছর ধরে লক্ষ্য করছি। জাতীয় বাজেট ঘোষণা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দুটি মিছিল বের হতো ঢাকার রাজপথে। দুটি মিছিলেরই সামনে শোভা পেত সুবিশাল ব্যানার।
বাজেটকে সরকারি দলের ব্যানারে 'গণমুখী' এবং বিরোধী দলের ব্যানারে 'গণবিরোধী' আখ্যা দেওয়া হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যানারগুলো লেখা হতো বাজেট ঘোষণার আগেই। আমাদের মতো দুর্জনরা মুচকি হেসে তখন প্রশ্ন করেছি_ আচ্ছা, বাজেট ঘোষণার আগেই তারা জেনে গেলেন কী করে যে ওটা গণমুখী না গণবিরোধী? স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে, অন্তত হাস্যকর বিষয়টি থেকে রাজনৈতিক নেতারা বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। আশা করছি, আরও হাস্যকর ও ক্ষতিকর বিষয়গুলোও তারা পেছনে ফেলে এগিয়ে আসতে পারবেন। বহু ত্যাগে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে এলেও, সেটাকে বারবার হুমকির মুখে ফেলছেন রাজনীতিকরা। তার একটি হচ্ছে সংসদে ধারাবাহিক অনুপস্থিতি। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির মধ্যেই এবার উপস্থাপিত হয়েছে বাজেট।
ক'বছর ধরে বাজেটের আকৃতিও ক্রমাগত বাড়ছে। অনেকেই সমালোচনা করছেন 'বৃহৎ', 'উচ্চাকাঙ্ক্ষী' বলে। এবারের বাজেট উপস্থাপনার শেষ পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী তার উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, অর্থনীতির আকৃতি যত বড় হবে, বাজেটও তত বড় হতে থাকবে। এটি যথার্থ। বড় হতেও হবে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে বাস্তবায়ন নিয়ে। ওইটিই মূল চ্যালেঞ্জ। বাস্তবায়ন মূলত দুটি বিষয়ের_ একটি হচ্ছে সুবিশাল অঙ্কের টাকার জোগান। এবারের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার এবং আপাতদৃষ্টিতে খটকা লাগলেও তার চেয়েও অধিকতর কষ্টসাপেক্ষ হচ্ছে এ টাকা ব্যয় করার। এই আয় ও ব্যয়ের খাতগুলো সুনির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত। আশঙ্কা থাকে প্রাক্কলন কিংবা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী অর্থ পাওয়া ও খরচ করা যাবে কি-না। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। গত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব বোর্ড অসাধারণ সাফল্য দেখিয়ে আসছে। চলতি অর্থবছরেও উচ্চাকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে আগের বছরের তুলনায় ২৭% বেশি রাজস্ব আয় করেছে। এ সাফল্য অর্থমন্ত্রীকে অনেক বেশি প্রত্যয়ী করে তুলেছে বলা যেতে পারে। নতুন বাজেটে আরও ২৪% অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে। এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের জন্য অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারের কথা বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব প্রশাসন বিস্তৃতির কথা বলেছেন এবং পাঁচ বছর মেয়াদি সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বাড়িয়ে ২০১৬ সাল নাগাদ কর-জিডিপির অনুপাত বর্তমানের ৯.৩ থেকে বাড়িয়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত করার কথাও বলেছেন। কর্মসূচি ও পরিকল্পনা হিসেবে এগুলো অবাস্তবও নয়, অসাধ্যও নয়। কিন্তু তা অর্জনের জন্য অনেক শর্ত পূরণ করা দরকার। রাজস্ব প্রশাসনের দেশব্যাপী বিস্তৃতি অবশ্যই অধিকতর রাজস্ব সংগ্রহে অবদান রাখবে; কিন্তু তার সুফল পেতে বেশ সময় লাগবে। আর বাজেট হচ্ছে এ বছরেরই ব্যাপার। তাছাড়া আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় তার প্রচলন যতদিন না করা যাবে ততদিন জাতীয় জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো রাজস্ব প্রশাসনেও তার কালো ছায়া পড়তেই থাকবে। এবারের বাজেট ঘোষণার অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি দিক হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রী-এমপিদের আয়ের ওপর কর আরোপ করা। কিন্তু কর প্রশাসন কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হওয়া ছাড়া কোনো মন্ত্রী-এমপি অথবা বড় ব্যবসায়ীর করদায়িতা পরীক্ষা করে দেখতে পারবে? আমার ধারণা, সবাই বলবেন তা পারবে না। এ বিশ্বাসটি কি সরকার গণমানুষের মনে সঞ্চার করতে পারবে যে, অবস্থান ও দলমত নির্বিশেষে কর প্রদানসহ আইনের সব বিষয় সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য হবে? এটি করতে পারলে, আমার বিশ্বাস, কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছা কখনও অসম্ভব হবে না।
কর আরোপের আরও দু-একটি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করতে চাই। বেশ ক'বছরের অসহনীয় অবস্থা কাটিয়ে উঠে অর্থমন্ত্রী এবার সব ধরনের সিগারেটের ওপর কর বাড়িয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অর্থমন্ত্রী এবারও নতি স্বীকার করলেন বিড়ির স্বার্থরক্ষাকারী সংঘবদ্ধ চক্রটির কাছে। গ্রামাঞ্চলের অদক্ষ, নারী ও শিশু শ্রমিকরা কাজ করে বিড়ি কারখানায়। কিন্তু কয়েকটি পরিবার গোটা বিড়ি শিল্পের মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারী। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তারা বোঝাতে সমর্থ হন যে বিড়ির ওপর কর বাড়ালে দেশের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে মোটেই সে রকম নয়। বিড়ির ওপর কর না বাড়ানোর ফলে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় এবং তার ফলে অর্থনীতির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে চাপ বাড়ে তা সম্ভাব্য বেকারত্বের চেয়ে অনেক বেশি।
তামাকের ব্যবহার উৎখাত করতে সরকার আন্তর্জাতিক একটি কনভেনশনের দস্তখতকারী। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ নামে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বিড়িকে কর বাড়ানো থেকে অব্যাহতি দিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। অর্থমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে আরও দৃঢ় হতে হবে। আসবাবপত্র বা ফার্নিচার আমাদের একটি উঠতি শিল্প খাত। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি করে এ খাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করেছে। অর্থমন্ত্রী এর স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এ খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে চাইছেন। তারই ফল হলো একদিকে তৈরি আসবাবপত্র আমদানির ক্ষেত্রে ৫% রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা এবং স্থানীয় উৎপাদনের দুটি প্রধান উপাদান_ পার্টিকেল বোর্ড ও এমডিএফ বোর্ড আমদানির ক্ষেত্রে ৫% রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করা। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে সম্ভাবনাময় এ খাতটি উৎসাহ পাবে।
কর কর্তৃপক্ষের কাছে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার জন্য অনেক বছর থেকেই সুযোগ দিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু কখনও এ ব্যাপারে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। তার প্রধান কারণ অনুরূপ সুযোগের মেয়াদ শেষে কোনো কালো টাকার মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টাই হয়নি; শাস্তি দেওয়া দূরের কথা। সুতরাং এ অন্যায় সুযোগ প্রদানের কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না, আর অন্যদিকে সৎ করদাতাদের সততাকে শাস্তি দেওয়া হয়। এ বিষয়টি সরকারকে ভালো করে ভেবে দেখতে হবে। কর অবকাশের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।
ব্যয়ের দিকটায় আসা যাক। এবারের বাজেট একটি ঘাটতি বাজেট। এমনিতে ঘাটতি বাজেটে দোষের কিছু নেই। এর খুব সাধারণ অর্থ হচ্ছে, সরকারের যা বছরভিত্তিক মোট আয় ওই একই সময়ে খরচ তার চেয়ে বেশি। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি খুব ভালো লক্ষণ না হলেও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায়ই এটি ভালো জিনিস। সরকারের ব্যয়ের একটি অংশ উন্নয়নমূলক; আরেকটি অনুন্নয়নমূলক। আমাদের মতো কম আয়ের একটি দেশে বার্ষিক নিজস্ব আয় দিয়ে অনেক কষ্টে-সৃষ্টে হয়তো অনুন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করা যেতে পারে; কিন্তু উন্নয়নের জন্য আরও ব্যয় দরকার এবং তা করতে হলে প্রায়ই ঘাটতি বাজেট করতে হয়। বাজেটের এ ঘাটতি অংশের টাকা কিছু আসে সরকারি রাজস্ব আয় থেকে, কিছু বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ এবং কিছু প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে। এর কোনো দিকে একটু ঘাটতি পড়লেই সরকারকে হয় দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় নতুবা টাকা ছাপাতে হয়। শেষের ব্যাপারটি করা খুবই সহজ কিন্তু তাতে মুদ্রাস্ফীতি হয়ে অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের অবস্থা খুব খারাপ করে দিতে পারে। ব্যাংক ঋণ নেওয়া যায় এবং তা নেওয়ার কথা বলাও হয়েছে এ বাজেটে। কিন্তু অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া হলে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-বাণিজ্য খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ কমে গিয়ে দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবারের বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম এবং এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এ নিয়ে বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তার ফলাফল কোনো দিন জানা যায়নি। দুঃখের বিষয়, অর্থমন্ত্রী এবারও এ বিষয়ে একেবারে চুপ। তাকে অবশ্যই ভাবতে হবে।
২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হবো_ এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ষষ্ঠ পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। সে লক্ষ্যে পেঁৗছানোর অংশ হিসেবেই নতুন অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৭% বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে যে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ লাগবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়, বৈদেশিক ঋণ, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি থেকে আসবে বলে হিসাব করা হয়েছে। এগুলো সংগ্রহ করতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবে পরিশ্রম করে এ অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেও তা যদি যথাসময়ে যথাযথ খাতে দুর্নীতিবিহীনভাবে দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করা না যায় তাহলে ৭% প্রবৃদ্ধি হবে না। জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছানো অসম্ভব হবে। সে জন্য দক্ষ ও দুর্নীতিহীন প্রশাসন লাগবে, যারা ভয়-ভীতি ও পক্ষপাতিত্বের ঊধর্ে্ব থেকে উন্নয়ন খাতের ওই অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করতে পারেন। অর্থমন্ত্রী ও গোটা সরকারের সামনে বাজেট বাস্তবায়নের এটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাদের নেতৃত্বের মূল পরীক্ষাও আসলে এখানেই।
আলী আহমদ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য
ক'বছর ধরে বাজেটের আকৃতিও ক্রমাগত বাড়ছে। অনেকেই সমালোচনা করছেন 'বৃহৎ', 'উচ্চাকাঙ্ক্ষী' বলে। এবারের বাজেট উপস্থাপনার শেষ পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী তার উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, অর্থনীতির আকৃতি যত বড় হবে, বাজেটও তত বড় হতে থাকবে। এটি যথার্থ। বড় হতেও হবে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে বাস্তবায়ন নিয়ে। ওইটিই মূল চ্যালেঞ্জ। বাস্তবায়ন মূলত দুটি বিষয়ের_ একটি হচ্ছে সুবিশাল অঙ্কের টাকার জোগান। এবারের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার এবং আপাতদৃষ্টিতে খটকা লাগলেও তার চেয়েও অধিকতর কষ্টসাপেক্ষ হচ্ছে এ টাকা ব্যয় করার। এই আয় ও ব্যয়ের খাতগুলো সুনির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত। আশঙ্কা থাকে প্রাক্কলন কিংবা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী অর্থ পাওয়া ও খরচ করা যাবে কি-না। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। গত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব বোর্ড অসাধারণ সাফল্য দেখিয়ে আসছে। চলতি অর্থবছরেও উচ্চাকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে আগের বছরের তুলনায় ২৭% বেশি রাজস্ব আয় করেছে। এ সাফল্য অর্থমন্ত্রীকে অনেক বেশি প্রত্যয়ী করে তুলেছে বলা যেতে পারে। নতুন বাজেটে আরও ২৪% অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে। এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের জন্য অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারের কথা বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব প্রশাসন বিস্তৃতির কথা বলেছেন এবং পাঁচ বছর মেয়াদি সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বাড়িয়ে ২০১৬ সাল নাগাদ কর-জিডিপির অনুপাত বর্তমানের ৯.৩ থেকে বাড়িয়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত করার কথাও বলেছেন। কর্মসূচি ও পরিকল্পনা হিসেবে এগুলো অবাস্তবও নয়, অসাধ্যও নয়। কিন্তু তা অর্জনের জন্য অনেক শর্ত পূরণ করা দরকার। রাজস্ব প্রশাসনের দেশব্যাপী বিস্তৃতি অবশ্যই অধিকতর রাজস্ব সংগ্রহে অবদান রাখবে; কিন্তু তার সুফল পেতে বেশ সময় লাগবে। আর বাজেট হচ্ছে এ বছরেরই ব্যাপার। তাছাড়া আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় তার প্রচলন যতদিন না করা যাবে ততদিন জাতীয় জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো রাজস্ব প্রশাসনেও তার কালো ছায়া পড়তেই থাকবে। এবারের বাজেট ঘোষণার অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি দিক হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রী-এমপিদের আয়ের ওপর কর আরোপ করা। কিন্তু কর প্রশাসন কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হওয়া ছাড়া কোনো মন্ত্রী-এমপি অথবা বড় ব্যবসায়ীর করদায়িতা পরীক্ষা করে দেখতে পারবে? আমার ধারণা, সবাই বলবেন তা পারবে না। এ বিশ্বাসটি কি সরকার গণমানুষের মনে সঞ্চার করতে পারবে যে, অবস্থান ও দলমত নির্বিশেষে কর প্রদানসহ আইনের সব বিষয় সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য হবে? এটি করতে পারলে, আমার বিশ্বাস, কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছা কখনও অসম্ভব হবে না।
কর আরোপের আরও দু-একটি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করতে চাই। বেশ ক'বছরের অসহনীয় অবস্থা কাটিয়ে উঠে অর্থমন্ত্রী এবার সব ধরনের সিগারেটের ওপর কর বাড়িয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অর্থমন্ত্রী এবারও নতি স্বীকার করলেন বিড়ির স্বার্থরক্ষাকারী সংঘবদ্ধ চক্রটির কাছে। গ্রামাঞ্চলের অদক্ষ, নারী ও শিশু শ্রমিকরা কাজ করে বিড়ি কারখানায়। কিন্তু কয়েকটি পরিবার গোটা বিড়ি শিল্পের মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারী। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তারা বোঝাতে সমর্থ হন যে বিড়ির ওপর কর বাড়ালে দেশের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে মোটেই সে রকম নয়। বিড়ির ওপর কর না বাড়ানোর ফলে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় এবং তার ফলে অর্থনীতির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে চাপ বাড়ে তা সম্ভাব্য বেকারত্বের চেয়ে অনেক বেশি।
তামাকের ব্যবহার উৎখাত করতে সরকার আন্তর্জাতিক একটি কনভেনশনের দস্তখতকারী। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ নামে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বিড়িকে কর বাড়ানো থেকে অব্যাহতি দিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। অর্থমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে আরও দৃঢ় হতে হবে। আসবাবপত্র বা ফার্নিচার আমাদের একটি উঠতি শিল্প খাত। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি করে এ খাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করেছে। অর্থমন্ত্রী এর স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এ খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে চাইছেন। তারই ফল হলো একদিকে তৈরি আসবাবপত্র আমদানির ক্ষেত্রে ৫% রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা এবং স্থানীয় উৎপাদনের দুটি প্রধান উপাদান_ পার্টিকেল বোর্ড ও এমডিএফ বোর্ড আমদানির ক্ষেত্রে ৫% রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করা। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে সম্ভাবনাময় এ খাতটি উৎসাহ পাবে।
কর কর্তৃপক্ষের কাছে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার জন্য অনেক বছর থেকেই সুযোগ দিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু কখনও এ ব্যাপারে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। তার প্রধান কারণ অনুরূপ সুযোগের মেয়াদ শেষে কোনো কালো টাকার মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টাই হয়নি; শাস্তি দেওয়া দূরের কথা। সুতরাং এ অন্যায় সুযোগ প্রদানের কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না, আর অন্যদিকে সৎ করদাতাদের সততাকে শাস্তি দেওয়া হয়। এ বিষয়টি সরকারকে ভালো করে ভেবে দেখতে হবে। কর অবকাশের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।
ব্যয়ের দিকটায় আসা যাক। এবারের বাজেট একটি ঘাটতি বাজেট। এমনিতে ঘাটতি বাজেটে দোষের কিছু নেই। এর খুব সাধারণ অর্থ হচ্ছে, সরকারের যা বছরভিত্তিক মোট আয় ওই একই সময়ে খরচ তার চেয়ে বেশি। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি খুব ভালো লক্ষণ না হলেও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায়ই এটি ভালো জিনিস। সরকারের ব্যয়ের একটি অংশ উন্নয়নমূলক; আরেকটি অনুন্নয়নমূলক। আমাদের মতো কম আয়ের একটি দেশে বার্ষিক নিজস্ব আয় দিয়ে অনেক কষ্টে-সৃষ্টে হয়তো অনুন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করা যেতে পারে; কিন্তু উন্নয়নের জন্য আরও ব্যয় দরকার এবং তা করতে হলে প্রায়ই ঘাটতি বাজেট করতে হয়। বাজেটের এ ঘাটতি অংশের টাকা কিছু আসে সরকারি রাজস্ব আয় থেকে, কিছু বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ এবং কিছু প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে। এর কোনো দিকে একটু ঘাটতি পড়লেই সরকারকে হয় দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় নতুবা টাকা ছাপাতে হয়। শেষের ব্যাপারটি করা খুবই সহজ কিন্তু তাতে মুদ্রাস্ফীতি হয়ে অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের অবস্থা খুব খারাপ করে দিতে পারে। ব্যাংক ঋণ নেওয়া যায় এবং তা নেওয়ার কথা বলাও হয়েছে এ বাজেটে। কিন্তু অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া হলে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-বাণিজ্য খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ কমে গিয়ে দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবারের বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম এবং এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এ নিয়ে বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তার ফলাফল কোনো দিন জানা যায়নি। দুঃখের বিষয়, অর্থমন্ত্রী এবারও এ বিষয়ে একেবারে চুপ। তাকে অবশ্যই ভাবতে হবে।
২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হবো_ এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ষষ্ঠ পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। সে লক্ষ্যে পেঁৗছানোর অংশ হিসেবেই নতুন অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৭% বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে যে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ লাগবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়, বৈদেশিক ঋণ, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি থেকে আসবে বলে হিসাব করা হয়েছে। এগুলো সংগ্রহ করতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবে পরিশ্রম করে এ অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেও তা যদি যথাসময়ে যথাযথ খাতে দুর্নীতিবিহীনভাবে দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করা না যায় তাহলে ৭% প্রবৃদ্ধি হবে না। জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছানো অসম্ভব হবে। সে জন্য দক্ষ ও দুর্নীতিহীন প্রশাসন লাগবে, যারা ভয়-ভীতি ও পক্ষপাতিত্বের ঊধর্ে্ব থেকে উন্নয়ন খাতের ওই অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করতে পারেন। অর্থমন্ত্রী ও গোটা সরকারের সামনে বাজেট বাস্তবায়নের এটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাদের নেতৃত্বের মূল পরীক্ষাও আসলে এখানেই।
আলী আহমদ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য
No comments