খোলা চোখে-গরিবের ঘোড়ারোগ by হাসান ফেরদৌস
খবরে নিশ্চয় দেখেছেন ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই সফলভাবে নতুন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। একদিকে ভারত তার অগ্নি-৫ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান তার স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র গজনবির সফল পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই নিয়ে দুই দেশেই উৎসবের আতশবাজি ফোটানো হয়েছে দেদার।
ভারত বলেছে, অগ্নি-৫ হলো ‘গেম চেঞ্জার।’ অগ্নি-৫, যার নিশানা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি, তা অস্ত্রাগারে জমা হওয়ায় ভারত এখন শুধু পাকিস্তান নয়, চীনের রাজধানী পর্যন্ত হামলা করার যোগ্যতা অর্জন করল। অন্যদিকে গজনবির নিশানা মাত্র ২৯০ কিলোমিটার হলেও চিরশত্রু ভারতের বুকের গভীরে হামলা করার ক্ষমতা এখন পাকিস্তানের করায়ত্ত। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই দাবি করেছে, এই আণবিক অস্ত্র প্রতিবেশী কারও ওপর হামলার জন্য নয়, সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের জন্য। তার আণবিক অস্ত্র আছে, এই কথা মাথায় রাখলে প্রতিপক্ষ আক্রমণাত্মক হামলা চালানোর আগে দ্বিতীয়বার ভাববে, পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই তার আণবিক অস্ত্র পরীক্ষার পক্ষে এই যুক্তি দেখিয়েছে।
এই দুই দেশের হাতে ইতিমধ্যে কী পরিমাণ আণবিক অস্ত্র জমেছে, তার সঠিক সংখ্যা হলফ করে বলা অসম্ভব, তবে তা যে এই দুই দেশ একে অপরকে বার কয়েক ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত, তা বলাই বাহুল্য। একাধিক আন্তর্জাতিক সূত্রে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানের হাতে কম করে হলেও ৯০ থেকে ১১০টির মতো ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য আণবিক বোমা (ওয়ারহেড) রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের রয়েছে ৮০ থেকে ১০০টির মতো মোতায়েনযোগ্য আণবিক বোমা। এর মধ্যে ৫০টির মতো আণবিক অস্ত্র দেশটি মোতায়েন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলেছেন, ভারতের তুলনায় পাকিস্তান তার আণবিক অস্ত্রভান্ডার অধিক দ্রুততার সঙ্গে গড়ে তুলছে। তাদের নজর সংখ্যার ওপর। অন্যদিকে ভারত সংখ্যার ওপর জোর না দিয়ে এই অস্ত্রের কৌশলগত গুরুত্ব ও কার্যকারিতার ওপর নজর দিচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, আণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও তা সংরক্ষণের জন্য যে পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন, এই দুই দেশের একটিরও তা নেই। আণবিক বোমা নিয়ে সমস্যা হলো একবার বানানো হয়ে গেলে তার পেছনে আর কোনো খরচ নেই, তা নয়। এর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য যে ব্যয়, তা রীতিমতো হাতি পোষার মতোই ব্যাপার। আগামী এক দশকে এ দুই দেশ সে উদ্দেশ্যে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হবে, তা এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এক হিসাবে দেখছি, এই দুই দেশ আণবিক অস্ত্র খাতে এ পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে ফেলেছে। এই অর্থ দিয়ে যে ভারত ও পাকিস্তানের মতো গরিব দেশের লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য বদলানো যায়—তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতকে গরিব বলায় কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার নয়া বাঘ হিসেবে তার বিস্তর নাম হয়েছে, বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে তার অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। কিন্তু একদম কঠিন, কঠোর সত্য হলো, ভারতে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কোনো হিসাবে এই পরিমাণ মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, কোনো হিসাবে ৪০ শতাংশ। তার স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরেও ভারতের ৪০-৫০ কোটি মানুষকে শিক্ষা, সুপেয় পানি ও নিরাপদ বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ইউনেসকো কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্যাভাবে ক্লিষ্ট বিশ্বের এমন শিশুর এক-তৃতীয়াংশেরই বাস ভারতে। গত বছর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক লম্বা প্রবন্ধে অঙ্কের হিসাব দেখিয়ে বলেছিলেন, ভারত শুধু যে চীনের তুলনায় পিছিয়ে, তা-ই নয়, মানব উন্নয়নের নানা সূচকে সে বাংলাদেশ থেকেও পিছিয়ে। ভারতে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তিনগুণ হলেও সেখানে গড়পড়তা আয়ুষ্কাল বাংলাদেশের তুলনায় কম (৬৬.৯ বনাম ৬৪.৪)। শিশুমৃত্যুর হার বেশি (প্রতি হাজারে ৫০ বনাম ৪১)। বাংলাদেশে যেখানে ৯৪ শতাংশ শিশু প্রতিষেধক টিকা পেয়ে থাকে, সেখানে ভারতে তেমন শিশুর সংখ্যা ৬৬ শতাংশ।
পাকিস্তানের অবস্থা আরও কঠিন। সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার বলেছিলেন, ঘাস খেয়ে হলেও পাকিস্তান আণবিক অস্ত্র বানাবে। পাকিস্তানের অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে দু-দশ বছর পর ঘাস খাওয়ার মুরোদও তার থাকবে না। সে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাত ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। তার পরও বোমা বানানোর পথ ছাড়বে না। যেদিন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের জন্য প্রেসিডেন্ট জারদারি তাঁর দেশের বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানালেন, সেদিন (বা তার পরের দিন) প্রকাশিত খবরে দেখেছি, পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদক সাতটি কোম্পানি একযোগে সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছে। কারণ, সরকার গত এক বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে, তার জন্য ধার্য হিসাব মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের কাছে বকেয়া এমন অর্থের পরিমাণ ২৩২ বিলিয়ন রুপি। এর মধ্যে নিদেনপক্ষে ৪৫ বিলিয়ন রুপি অবিলম্বে শোধ করতে হবে। কিন্তু সে টাকা জোগাতে না পারায় কাগজে-কলমে পাকিস্তান এখন ঋণখেলাপি-ডিফল্টার। এক পত্রিকা লিখেছে, অচিরেই পাকিস্তানে বাতি নিভে আসবে।
সোজা কথায়, নিজের দেশের মানুষকে খেতে-পরতে না দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে হবে, এমন শৌখিনতা পাকিস্তান বা ভারতের শোভা পায় না।
আণবিক বোমার ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশেই একধরনের রোমান্টিক ভাবমূর্তি রয়েছে। যেসব বিজ্ঞানী এসব বোমা বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে লিপ্ত, দুই দেশেই তাঁরা বীরের মর্যাদায় ভূষিত। পাকিস্তানে যিনি আণবিক বোমার পিতা বলে পরিচিত, সে দেশের তাঁর স্থান মহান নায়ক হিসেবে। তাঁর নামে হাসপাতাল হয়েছে, রাস্তার নামকরণ হয়েছে। আণবিক প্রযুক্তি পাচারের অপরাধে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর গায়ে আঁচড়টুকু দেওয়ার সাহস সে দেশে কারোর নেই। অন্যদিকে ভারতে আণবিক বোমার জনক সম্মানিত হয়েছেন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। অথচ এই বোমা দিয়ে একটি অভুক্ত শিশুর পেটে খাদ্য জুটবে না, একজন অসুস্থ প্রসূতি সুস্থ হবেন না, একজন দুস্থ বালকের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে না। তার পরও বোমাকে গলার মালা বানানো হয়, তার নামে চড়ে পূজার ফুল।
অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান কেন পারমাণবিক বোমার পেছনে অর্থ ঢালছে, তার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে দেশের নামজাদা পদার্থবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার পারভেজ হুদোবয়। আণবিক অস্ত্রের পেছনে এই দৌড় আসলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের কাছে একধরনের জীবন বিমা। পাকিস্তান যাতে উত্তর কোরিয়ার মতো একঘরে ও বেয়াড়া না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে আগ্রহী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। তারা জানে, পাকিস্তানের হাতে শ খানেক আণবিক অস্ত্র আছে। এ দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা না থাকতে পারে, কিন্তু তার আণবিক অস্ত্রভান্ডার সুরক্ষিত নিয়ন্ত্রণে থাকুক, তা নিশ্চিত করা তাদের নিজেদের স্বার্থেই দরকার। এ অবস্থায় পশ্চিমা শক্তিগুলো পাকিস্তানের তলাহীন ঝুড়িতে মালকড়ি ঢালতেই থাকবে। পাকিস্তানের অস্ত্রভান্ডার যত বাড়বে, সে দেশে পশ্চিমাদের ডলারের ঝনঝনানিও তত বাড়বে।
এটা একধরনের ব্ল্যাকমেইল। অন্য আরেক ধরনের ব্ল্যাকমেইল হলো প্রতিবেশীকে জাত শত্রু বানিয়ে অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি। এ কাজটি পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের রাজনীতিকেরাই সানন্দে ও সাগ্রহে করে থাকেন। তার জন্মের শুরু থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরকে শত্রু ভেবে এসেছে। এ কাজটা নিজ থেকে আপনাআপনি ঘটেনি, দেশের মানুষকে সে কথা হজমি দাওয়াইয়ের মতো গেলানো হয়েছে। এই দুই দেশের আসল বিপদ বহির্গত হুমকি নয়, যার যার দেশের ভেতরেই রয়েছে প্রকৃত হুমকি, যার নাম দারিদ্র্য। এক পাঞ্জাব ছাড়া পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সচল রয়েছে, মূলত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার কারণেই। ভারতের এক বিশাল এলাকাজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সহিংস মাওবাদী আন্দোলন। সে দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, স্বাধীন ভারতে এর আগে তার অস্তিত্বের ওপর এমন হুমকি আগে কখনো আসেনি। মাওবাদী আন্দোলনের আসল শক্তিই হলো সমাজের অভাবী ও প্রান্তবর্তী মানুষের ভাত-কাপড়ের লড়াই, মৌলিক অধিকারের লড়াই। পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ভারত বা পাকিস্তান কেউই নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ সহিংস অস্থিরতা ঠেকাতে পারবে না।
উপমহাদেশের পারমাণবিক ও প্রচলিত অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, দুই দেশেই তার অভাব রয়েছে। কখনো কখনো বিবাদ মিটিয়ে ফেলার বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেসব অধিকাংশই পত্রিকার পাতায় খবর হওয়ার জন্য। দুই দেশেই একাধিক অভ্যন্তরীণ শক্তি রয়েছে, যারা চায় না বিরোধ মিটুক বা একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব কমুক। এ অবস্থা কেবল তখনই বদলাবে, যখন দেশের মানুষের কাছ থেকে পরিবর্তনের দাবি উঠবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা, তা আণবিক হোক অথবা প্রচলিত, তা গভীরভাবে অনৈতিক ও আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের পরিপন্থী, সবার আগে এ কথাটা উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের মানুষের মাথায় ঢোকাতে হবে। সে কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের প্রত্যেকের।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বলাই বাহুল্য, আণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও তা সংরক্ষণের জন্য যে পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন, এই দুই দেশের একটিরও তা নেই। আণবিক বোমা নিয়ে সমস্যা হলো একবার বানানো হয়ে গেলে তার পেছনে আর কোনো খরচ নেই, তা নয়। এর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য যে ব্যয়, তা রীতিমতো হাতি পোষার মতোই ব্যাপার। আগামী এক দশকে এ দুই দেশ সে উদ্দেশ্যে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হবে, তা এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এক হিসাবে দেখছি, এই দুই দেশ আণবিক অস্ত্র খাতে এ পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে ফেলেছে। এই অর্থ দিয়ে যে ভারত ও পাকিস্তানের মতো গরিব দেশের লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য বদলানো যায়—তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতকে গরিব বলায় কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার নয়া বাঘ হিসেবে তার বিস্তর নাম হয়েছে, বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে তার অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। কিন্তু একদম কঠিন, কঠোর সত্য হলো, ভারতে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কোনো হিসাবে এই পরিমাণ মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, কোনো হিসাবে ৪০ শতাংশ। তার স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরেও ভারতের ৪০-৫০ কোটি মানুষকে শিক্ষা, সুপেয় পানি ও নিরাপদ বাসস্থানের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ইউনেসকো কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্যাভাবে ক্লিষ্ট বিশ্বের এমন শিশুর এক-তৃতীয়াংশেরই বাস ভারতে। গত বছর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক লম্বা প্রবন্ধে অঙ্কের হিসাব দেখিয়ে বলেছিলেন, ভারত শুধু যে চীনের তুলনায় পিছিয়ে, তা-ই নয়, মানব উন্নয়নের নানা সূচকে সে বাংলাদেশ থেকেও পিছিয়ে। ভারতে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তিনগুণ হলেও সেখানে গড়পড়তা আয়ুষ্কাল বাংলাদেশের তুলনায় কম (৬৬.৯ বনাম ৬৪.৪)। শিশুমৃত্যুর হার বেশি (প্রতি হাজারে ৫০ বনাম ৪১)। বাংলাদেশে যেখানে ৯৪ শতাংশ শিশু প্রতিষেধক টিকা পেয়ে থাকে, সেখানে ভারতে তেমন শিশুর সংখ্যা ৬৬ শতাংশ।
পাকিস্তানের অবস্থা আরও কঠিন। সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার বলেছিলেন, ঘাস খেয়ে হলেও পাকিস্তান আণবিক অস্ত্র বানাবে। পাকিস্তানের অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে দু-দশ বছর পর ঘাস খাওয়ার মুরোদও তার থাকবে না। সে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাত ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। তার পরও বোমা বানানোর পথ ছাড়বে না। যেদিন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের জন্য প্রেসিডেন্ট জারদারি তাঁর দেশের বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানালেন, সেদিন (বা তার পরের দিন) প্রকাশিত খবরে দেখেছি, পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদক সাতটি কোম্পানি একযোগে সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছে। কারণ, সরকার গত এক বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে, তার জন্য ধার্য হিসাব মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের কাছে বকেয়া এমন অর্থের পরিমাণ ২৩২ বিলিয়ন রুপি। এর মধ্যে নিদেনপক্ষে ৪৫ বিলিয়ন রুপি অবিলম্বে শোধ করতে হবে। কিন্তু সে টাকা জোগাতে না পারায় কাগজে-কলমে পাকিস্তান এখন ঋণখেলাপি-ডিফল্টার। এক পত্রিকা লিখেছে, অচিরেই পাকিস্তানে বাতি নিভে আসবে।
সোজা কথায়, নিজের দেশের মানুষকে খেতে-পরতে না দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে হবে, এমন শৌখিনতা পাকিস্তান বা ভারতের শোভা পায় না।
আণবিক বোমার ব্যাপারে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশেই একধরনের রোমান্টিক ভাবমূর্তি রয়েছে। যেসব বিজ্ঞানী এসব বোমা বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে লিপ্ত, দুই দেশেই তাঁরা বীরের মর্যাদায় ভূষিত। পাকিস্তানে যিনি আণবিক বোমার পিতা বলে পরিচিত, সে দেশের তাঁর স্থান মহান নায়ক হিসেবে। তাঁর নামে হাসপাতাল হয়েছে, রাস্তার নামকরণ হয়েছে। আণবিক প্রযুক্তি পাচারের অপরাধে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর গায়ে আঁচড়টুকু দেওয়ার সাহস সে দেশে কারোর নেই। অন্যদিকে ভারতে আণবিক বোমার জনক সম্মানিত হয়েছেন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। অথচ এই বোমা দিয়ে একটি অভুক্ত শিশুর পেটে খাদ্য জুটবে না, একজন অসুস্থ প্রসূতি সুস্থ হবেন না, একজন দুস্থ বালকের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে না। তার পরও বোমাকে গলার মালা বানানো হয়, তার নামে চড়ে পূজার ফুল।
অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান কেন পারমাণবিক বোমার পেছনে অর্থ ঢালছে, তার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে দেশের নামজাদা পদার্থবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার পারভেজ হুদোবয়। আণবিক অস্ত্রের পেছনে এই দৌড় আসলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের কাছে একধরনের জীবন বিমা। পাকিস্তান যাতে উত্তর কোরিয়ার মতো একঘরে ও বেয়াড়া না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে আগ্রহী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। তারা জানে, পাকিস্তানের হাতে শ খানেক আণবিক অস্ত্র আছে। এ দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা না থাকতে পারে, কিন্তু তার আণবিক অস্ত্রভান্ডার সুরক্ষিত নিয়ন্ত্রণে থাকুক, তা নিশ্চিত করা তাদের নিজেদের স্বার্থেই দরকার। এ অবস্থায় পশ্চিমা শক্তিগুলো পাকিস্তানের তলাহীন ঝুড়িতে মালকড়ি ঢালতেই থাকবে। পাকিস্তানের অস্ত্রভান্ডার যত বাড়বে, সে দেশে পশ্চিমাদের ডলারের ঝনঝনানিও তত বাড়বে।
এটা একধরনের ব্ল্যাকমেইল। অন্য আরেক ধরনের ব্ল্যাকমেইল হলো প্রতিবেশীকে জাত শত্রু বানিয়ে অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি। এ কাজটি পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের রাজনীতিকেরাই সানন্দে ও সাগ্রহে করে থাকেন। তার জন্মের শুরু থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরকে শত্রু ভেবে এসেছে। এ কাজটা নিজ থেকে আপনাআপনি ঘটেনি, দেশের মানুষকে সে কথা হজমি দাওয়াইয়ের মতো গেলানো হয়েছে। এই দুই দেশের আসল বিপদ বহির্গত হুমকি নয়, যার যার দেশের ভেতরেই রয়েছে প্রকৃত হুমকি, যার নাম দারিদ্র্য। এক পাঞ্জাব ছাড়া পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সচল রয়েছে, মূলত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার কারণেই। ভারতের এক বিশাল এলাকাজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সহিংস মাওবাদী আন্দোলন। সে দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, স্বাধীন ভারতে এর আগে তার অস্তিত্বের ওপর এমন হুমকি আগে কখনো আসেনি। মাওবাদী আন্দোলনের আসল শক্তিই হলো সমাজের অভাবী ও প্রান্তবর্তী মানুষের ভাত-কাপড়ের লড়াই, মৌলিক অধিকারের লড়াই। পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ভারত বা পাকিস্তান কেউই নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ সহিংস অস্থিরতা ঠেকাতে পারবে না।
উপমহাদেশের পারমাণবিক ও প্রচলিত অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, দুই দেশেই তার অভাব রয়েছে। কখনো কখনো বিবাদ মিটিয়ে ফেলার বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেসব অধিকাংশই পত্রিকার পাতায় খবর হওয়ার জন্য। দুই দেশেই একাধিক অভ্যন্তরীণ শক্তি রয়েছে, যারা চায় না বিরোধ মিটুক বা একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব কমুক। এ অবস্থা কেবল তখনই বদলাবে, যখন দেশের মানুষের কাছ থেকে পরিবর্তনের দাবি উঠবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা, তা আণবিক হোক অথবা প্রচলিত, তা গভীরভাবে অনৈতিক ও আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের পরিপন্থী, সবার আগে এ কথাটা উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের মানুষের মাথায় ঢোকাতে হবে। সে কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের প্রত্যেকের।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments