সম্পাদকের কলাম-শিক্ষকদের গায়েও হাত তুলছেন! by ইমদাদুল হক মিলন
গগনপুর নামটা শুনে আমার বুক হু হু করে উঠল। আমার বাবার ডাকনাম ছিল গগন। তিনি শিক্ষক ছিলেন না। ছোট চাকরি করে আমাদেরকে নিয়ে গগনপুরের আজিজুর রহমান স্যারের মতোই অতিকষ্টে জীবন চালাতেন। আজিজ স্যারের মতোই ছেলেমেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতেন।
বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণের দাবি নিয়ে ঢাকায় আসার দিন সকালবেলা আজিজ স্যার যেমন করে গিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র কন্যা রিক্তার শ্বশুরবাড়িতে রিক্তাকে দেখতে, আমরা বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে নানার বাড়িতে থাকতাম, মাস শেষে শনিবার রাতে বাবা আমাদেরকে দেখতে যেতেন। রবিবার ছুটির দিন। সেই দিনটি আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে সোমবার ভোররাতের লঞ্চ ধরে ঢাকায় এসে অফিস করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা মারা যান।
আজিজুর রহমান স্যার তখন আমার বয়সী। কৈশোর পেরোচ্ছেন। ওই বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন। কত স্বপ্ন তখন চোখজুড়ে। পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ। এখন তৈরি হবে সোনার বাংলা। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে।
আজিজুর রহমান স্যার মানুষ গড়ার শিল্পীর ভূমিকা নিলেন। পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতা। প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, ফুলকলির মতো শিশুদের ফুটে ওঠার পথ তৈরি করে দিতে লাগলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার ৩৪ নম্বর উত্তর চরভাটিয়ান রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ছেলেমেয়েদের যেমন ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসতেন ছাত্রছাত্রীদের, সহকর্মীদের। বুক দিয়ে আগলে রাখতেন সবাইকে। কারো কোনো সমস্যায়, বিপদ-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সমস্যা সমাধানের জন্য, বিপদে পড়া মানুষটিকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, স্বাধীনতাযুদ্ধ নিতে পারেনি যাঁর জীবন, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মহান মুক্তিযোদ্ধা, সেই মহান শিক্ষক পুলিশি নির্যাতনে প্রথমে অসুস্থ হলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ঢাকা থেকে গেলেন বাড়িতে, বাড়ি গিয়ে সেই রাতেই মৃত্যুবরণ করলেন। এই দুঃখ আমাদের সবাইকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। দেশের শিক্ষকসমাজ, ছাত্রসমাজ, অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষ বেদনার্ত হয়েছে। ন্যায্য দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারকলিপি দিতে যাওয়া শিক্ষকদের বেধড়ক পেটাবে পুলিশ, জলকামানের গরম পানিতে পুড়িয়ে দেবে মানুষ গড়ার এই শিল্পীদের! যেসব পুলিশ এ কাজ করল, তারাও কি কখনো ছাত্র ছিল না কোনো শিক্ষকের? তাদের জীবনও কি গড়ে দেননি কোন শিক্ষক? শিক্ষকদের যখন তারা লাঠিপেটা করছিল, তখন কি একবারও তাদের মনে পড়েনি সেসব কথা? একটুও কি কাঁপেনি তাদের হাত? আর যাঁদের আদেশে পুলিশ এই নির্যাতন চালিয়েছে শিক্ষকদের ওপর, তাঁরাও কি একবার ভাবেননি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার শিক্ষক তাঁদের ন্যায্য দাবি নিয়েই ঢাকায় এসেছেন। একত্র হয়েছেন শহীদ মিনারের পাদদেশে, সেখান থেকে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যেতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। তাঁদের দুঃখ-বেদনা আর বঞ্চনার কথা বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। তাঁরা তো কোনো অন্যায় করেননি, তাঁরা তো কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেননি কিংবা গাড়ি ভাঙচুর করেননি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁর রাজনীতির মূলে ছিল সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা ঘোচানোর চেষ্টা, তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই রাজনীতিই তিনি করে গেছেন। তাঁর যোগ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও পিতার রাজনৈতিক আদর্শই লালন করেন। ২০০৩ সালে, ২০০৫ সালে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, 'তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হবে।' এই দাবি বাস্তবায়নের আশা নিয়েই শিক্ষকরা এসেছিলেন তাঁর কাছে। বিনিময়ে পুলিশের লাঠি পড়ল তাঁদের পিঠে, জলকামানের গরম পানি পুড়িয়ে দিল তাঁদের যাবতীয় স্বপ্ন। জীবন দিলেন আজিজুর রহমান স্যার।
বাংলাদেশের বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক লাখখানেক। তাঁরা বেতন পান সর্বসাকল্যে ৫০০০ টাকা। দাবি পূরণ হলে তাঁদের দুঃখী জীবনে একটুখানি সচ্ছলতা আসত। আর এই দাবি পূরণে সরকারের ব্যয় হতো ৪৩০ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কটা কি খুব বেশি? অথচ রাজনীতির ব্যবসা করা আতি-পাতি নেতা, দলের স্তাবকরা নানা কায়দায় লুটে নিচ্ছে কত কত টাকা! মন্ত্রীদের পিএস-এপিএসদের কথা বাদই দিলাম, এমপিদের সঙ্গে থাকা স্তাবক দল বা এমপির পিএস ইত্যাদি পরিচয় দিয়েও গত সাড়ে তিন বছরে দু-দশ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে এমন নজিরও কম নেই। তার পরও শিক্ষক নেতারা জাতীয়করণের পর স্কেল কার্যকর করার জন্য তিন অর্থবছর সময় নিতে বলেছিলেন সরকারকে। তার মানে এক অর্থবছরে ৪৩০ কোটি টাকারও প্রয়োজন হতো না। ২২ মে মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের রাজনৈতিক ম্যাগাজিন 'রাজনীতি' এবং 'প্রিয় শিক্ষক' পাতায় এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং এই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে অন্য দু-একটি বিষয়ে কথা বলি।
আমার স্কুল পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া হাই স্কুল। সেই স্কুলের চারজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ছে। দুজন রহমান স্যার ছিলেন আমাদের। একজন এ. রহমান, আরেকজন বি. রহমান। এ. রহমান স্যার ছিলেন পাটিগণিতের সত্যিকার অর্থেই জাহাজ। ক্লাস নাইনে ওঠার পর পাটিগণিত নিয়ে আমরা একটু বিপাকেই পড়লাম। কেউ তেমন ভালো করতে পারছিলাম না। ১৯৬৯ সালের কথা। এ. রহমান স্যার স্কুল শেষ হওয়ার পর দুই ঘণ্টা করে আমাদের পাটিগণিত করাতে লাগলেন বিনা পারিশ্রমিকে। বি. রহমান স্যার বাংলা পড়াতেন। যারা বাংলায় কাঁচা, স্কুল ছুটির পর বা ছুটির দিনে বাড়িতে বসে তিনি তাদের বাংলা পড়াতেন। টাকাপয়সার কোনো প্রশ্নই নেই। ফখরুল স্যার ফিজিকস, কেমিস্ট্রি আর ইলেকটিভ ম্যাথমেটিঙ্ করাতেন ওই একইভাবে, ছুটির পরে বা ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে বসে। ক্লাসের বাইরে এই পরিশ্রম তাঁরা করতেন ছাত্রদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য। ছাত্রদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেবেন কী, উল্টো তাদের নাশতা খাওয়াতেন। পরোটা-হালুয়া, লুচি-মিষ্টি। কখনো কখনো শিঙাড়া, ডালপুরি। রউফ স্যারের কথা এই জীবনে ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে। বন্ধুরা সবাই এসএসসির ফি জমা দিয়ে ফেলেছে। ১১৬ টাকা লাগবে। আমার গরিব বাবা কিছুতেই টাকা জোগাড় করে দিতে পারছিলেন না। সবাই ফরম ফিলাপ করছে আর ক্লাসের ফার্স্ট বয়টি মন খারাপ করে বসে আছে। রউফ স্যার নিজের পকেট থেকে ১১৬ টাকা দিয়ে দিলেন। আর আমার হাতে দিলেন একটা পাঁচ টাকার নোট। মন খারাপ করিস না। যা বন্ধুদের নিয়ে মিষ্টি খা গিয়ে।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের শিক্ষকরা এখনো এমনই আছেন। ছাত্রদের জন্য এখনো এমনই মমত্ববোধ তাঁদের। আর এই শিক্ষকদেরই আমরা পেটাচ্ছি। পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশন পর্দায় এসব দেখে দেশের মানুষ প্রথমে বিস্মিত হয়েছে, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
যে মেয়েকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন আজিজুর রহমান স্যার, নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে যার নাম রেখেছিলেন 'আরজিনা খাতুন', ডাকনাম রিক্তা, বাবার মৃত্যুর পর মেয়ে বলেছেন, 'আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে আমরা কারো কাছে অভিযোগ করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, আমার বাবার প্রাণের বিনিময়ে যেন রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়।'
ঢাকায় পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে এসে সে কথা বাড়ির কাউকে বলেননি আজিজুর রহমান স্যার। শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও অনেক বেশি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেলেন। মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একদল পুলিশ তাঁকে গার্ড অব অনার দিল। একদিকে লাঠিপেটা, অন্যদিকে গার্ড অব অনার! হায় রে আমার দেশ!
একটি প্রাচীন সংস্কৃত গল্প বলি। ছাত্রকে তাঁর শিক্ষক বলেছেন, গ্রামের একটি ফসলি জমির আলের সামান্য একটু অংশ ভেঙে পানি ঢুকে যাচ্ছে। কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। তুমি গিয়ে কাদা দিয়ে ওই ভাঙনটুকু রোধ করো। ছাত্র ছুটে গেল কাজে। গিয়ে কাদা দিয়ে যতই চেষ্টা করে, বাঁধ থাকে না। শেষ পর্যন্ত সে নিজে কাত হয়ে আলের ভাঙা জায়গায় শুয়ে পড়ল। কাদা দিয়ে না পারুক নিজের শরীর দিয়ে সে পানি ঠেকাতে লাগল। কারণ শিক্ষকের আদেশ তাকে পালন করতেই হবে। দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শিক্ষক দেখেন ছাত্র ফিরছে না। ছাত্রের খোঁজে তিনি এলেন সেই জমির কাছে। এসে দেখেন ছাত্র তার শরীর দিয়ে পানি ঠেকাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে শিক্ষকের চোখে পানি এলো।
যাঁরা শিক্ষক পেটানোর আদেশ দেন আর যাঁরা শিক্ষক পেটান, তাঁরা অন্তত একবার ভাববেন আপনাদের শিক্ষকদের কথাও এইভাবে একদিন আপনারা পালন করেছেন, আর আপনাদের শিক্ষকরাও আপনাদের জন্য চোখের জলে ভাসতেন।
শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার সময় আপনাদের হাত কাঁপেনি কেন? আপনারা কেমন করে করলেন এই কাজ?
আমাদের শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে অভাব-অনটন আর বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। শিক্ষক বলতেই এক ধরনের নিরীহ ভদ্র কিন্তু অতি দরিদ্র মানুষের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। নিজের ঘর গভীর অন্ধকারে রেখে অন্যের ঘর চিরকাল আলোকিত করে আসছেন তাঁরা। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি শিক্ষা, শিক্ষিত মানুষ। এই শিক্ষার আলো যাঁরা জ্বালছেন, শিক্ষিত মানুষ যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদেরকে পিটিয়ে, অভাব-অনটন আর বঞ্চনার মধ্যে রেখে রাষ্ট্র কত দূর এগোবে? শিক্ষিত জাতি তৈরির মূল মানুষগুলোকে, শিক্ষক শ্রেণীকে যথাযথ মর্যাদা না দিলে, তাঁদের জীবনের অন্ধকার দূর করার ব্যবস্থা না করলে আমাদের চারপাশের আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে আসবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা মারা যান।
আজিজুর রহমান স্যার তখন আমার বয়সী। কৈশোর পেরোচ্ছেন। ওই বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন। কত স্বপ্ন তখন চোখজুড়ে। পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ। এখন তৈরি হবে সোনার বাংলা। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে।
আজিজুর রহমান স্যার মানুষ গড়ার শিল্পীর ভূমিকা নিলেন। পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতা। প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, ফুলকলির মতো শিশুদের ফুটে ওঠার পথ তৈরি করে দিতে লাগলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার ৩৪ নম্বর উত্তর চরভাটিয়ান রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ছেলেমেয়েদের যেমন ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসতেন ছাত্রছাত্রীদের, সহকর্মীদের। বুক দিয়ে আগলে রাখতেন সবাইকে। কারো কোনো সমস্যায়, বিপদ-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সমস্যা সমাধানের জন্য, বিপদে পড়া মানুষটিকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, স্বাধীনতাযুদ্ধ নিতে পারেনি যাঁর জীবন, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মহান মুক্তিযোদ্ধা, সেই মহান শিক্ষক পুলিশি নির্যাতনে প্রথমে অসুস্থ হলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ঢাকা থেকে গেলেন বাড়িতে, বাড়ি গিয়ে সেই রাতেই মৃত্যুবরণ করলেন। এই দুঃখ আমাদের সবাইকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। দেশের শিক্ষকসমাজ, ছাত্রসমাজ, অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষ বেদনার্ত হয়েছে। ন্যায্য দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারকলিপি দিতে যাওয়া শিক্ষকদের বেধড়ক পেটাবে পুলিশ, জলকামানের গরম পানিতে পুড়িয়ে দেবে মানুষ গড়ার এই শিল্পীদের! যেসব পুলিশ এ কাজ করল, তারাও কি কখনো ছাত্র ছিল না কোনো শিক্ষকের? তাদের জীবনও কি গড়ে দেননি কোন শিক্ষক? শিক্ষকদের যখন তারা লাঠিপেটা করছিল, তখন কি একবারও তাদের মনে পড়েনি সেসব কথা? একটুও কি কাঁপেনি তাদের হাত? আর যাঁদের আদেশে পুলিশ এই নির্যাতন চালিয়েছে শিক্ষকদের ওপর, তাঁরাও কি একবার ভাবেননি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার শিক্ষক তাঁদের ন্যায্য দাবি নিয়েই ঢাকায় এসেছেন। একত্র হয়েছেন শহীদ মিনারের পাদদেশে, সেখান থেকে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যেতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। তাঁদের দুঃখ-বেদনা আর বঞ্চনার কথা বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। তাঁরা তো কোনো অন্যায় করেননি, তাঁরা তো কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেননি কিংবা গাড়ি ভাঙচুর করেননি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁর রাজনীতির মূলে ছিল সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা ঘোচানোর চেষ্টা, তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই রাজনীতিই তিনি করে গেছেন। তাঁর যোগ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও পিতার রাজনৈতিক আদর্শই লালন করেন। ২০০৩ সালে, ২০০৫ সালে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, 'তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হবে।' এই দাবি বাস্তবায়নের আশা নিয়েই শিক্ষকরা এসেছিলেন তাঁর কাছে। বিনিময়ে পুলিশের লাঠি পড়ল তাঁদের পিঠে, জলকামানের গরম পানি পুড়িয়ে দিল তাঁদের যাবতীয় স্বপ্ন। জীবন দিলেন আজিজুর রহমান স্যার।
বাংলাদেশের বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক লাখখানেক। তাঁরা বেতন পান সর্বসাকল্যে ৫০০০ টাকা। দাবি পূরণ হলে তাঁদের দুঃখী জীবনে একটুখানি সচ্ছলতা আসত। আর এই দাবি পূরণে সরকারের ব্যয় হতো ৪৩০ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কটা কি খুব বেশি? অথচ রাজনীতির ব্যবসা করা আতি-পাতি নেতা, দলের স্তাবকরা নানা কায়দায় লুটে নিচ্ছে কত কত টাকা! মন্ত্রীদের পিএস-এপিএসদের কথা বাদই দিলাম, এমপিদের সঙ্গে থাকা স্তাবক দল বা এমপির পিএস ইত্যাদি পরিচয় দিয়েও গত সাড়ে তিন বছরে দু-দশ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে এমন নজিরও কম নেই। তার পরও শিক্ষক নেতারা জাতীয়করণের পর স্কেল কার্যকর করার জন্য তিন অর্থবছর সময় নিতে বলেছিলেন সরকারকে। তার মানে এক অর্থবছরে ৪৩০ কোটি টাকারও প্রয়োজন হতো না। ২২ মে মঙ্গলবার কালের কণ্ঠের রাজনৈতিক ম্যাগাজিন 'রাজনীতি' এবং 'প্রিয় শিক্ষক' পাতায় এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং এই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে অন্য দু-একটি বিষয়ে কথা বলি।
আমার স্কুল পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া হাই স্কুল। সেই স্কুলের চারজন শিক্ষকের কথা মনে পড়ছে। দুজন রহমান স্যার ছিলেন আমাদের। একজন এ. রহমান, আরেকজন বি. রহমান। এ. রহমান স্যার ছিলেন পাটিগণিতের সত্যিকার অর্থেই জাহাজ। ক্লাস নাইনে ওঠার পর পাটিগণিত নিয়ে আমরা একটু বিপাকেই পড়লাম। কেউ তেমন ভালো করতে পারছিলাম না। ১৯৬৯ সালের কথা। এ. রহমান স্যার স্কুল শেষ হওয়ার পর দুই ঘণ্টা করে আমাদের পাটিগণিত করাতে লাগলেন বিনা পারিশ্রমিকে। বি. রহমান স্যার বাংলা পড়াতেন। যারা বাংলায় কাঁচা, স্কুল ছুটির পর বা ছুটির দিনে বাড়িতে বসে তিনি তাদের বাংলা পড়াতেন। টাকাপয়সার কোনো প্রশ্নই নেই। ফখরুল স্যার ফিজিকস, কেমিস্ট্রি আর ইলেকটিভ ম্যাথমেটিঙ্ করাতেন ওই একইভাবে, ছুটির পরে বা ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে বসে। ক্লাসের বাইরে এই পরিশ্রম তাঁরা করতেন ছাত্রদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য। ছাত্রদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেবেন কী, উল্টো তাদের নাশতা খাওয়াতেন। পরোটা-হালুয়া, লুচি-মিষ্টি। কখনো কখনো শিঙাড়া, ডালপুরি। রউফ স্যারের কথা এই জীবনে ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে। বন্ধুরা সবাই এসএসসির ফি জমা দিয়ে ফেলেছে। ১১৬ টাকা লাগবে। আমার গরিব বাবা কিছুতেই টাকা জোগাড় করে দিতে পারছিলেন না। সবাই ফরম ফিলাপ করছে আর ক্লাসের ফার্স্ট বয়টি মন খারাপ করে বসে আছে। রউফ স্যার নিজের পকেট থেকে ১১৬ টাকা দিয়ে দিলেন। আর আমার হাতে দিলেন একটা পাঁচ টাকার নোট। মন খারাপ করিস না। যা বন্ধুদের নিয়ে মিষ্টি খা গিয়ে।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের শিক্ষকরা এখনো এমনই আছেন। ছাত্রদের জন্য এখনো এমনই মমত্ববোধ তাঁদের। আর এই শিক্ষকদেরই আমরা পেটাচ্ছি। পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশন পর্দায় এসব দেখে দেশের মানুষ প্রথমে বিস্মিত হয়েছে, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
যে মেয়েকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন আজিজুর রহমান স্যার, নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে যার নাম রেখেছিলেন 'আরজিনা খাতুন', ডাকনাম রিক্তা, বাবার মৃত্যুর পর মেয়ে বলেছেন, 'আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে আমরা কারো কাছে অভিযোগ করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, আমার বাবার প্রাণের বিনিময়ে যেন রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়।'
ঢাকায় পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে এসে সে কথা বাড়ির কাউকে বলেননি আজিজুর রহমান স্যার। শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও অনেক বেশি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেলেন। মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একদল পুলিশ তাঁকে গার্ড অব অনার দিল। একদিকে লাঠিপেটা, অন্যদিকে গার্ড অব অনার! হায় রে আমার দেশ!
একটি প্রাচীন সংস্কৃত গল্প বলি। ছাত্রকে তাঁর শিক্ষক বলেছেন, গ্রামের একটি ফসলি জমির আলের সামান্য একটু অংশ ভেঙে পানি ঢুকে যাচ্ছে। কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। তুমি গিয়ে কাদা দিয়ে ওই ভাঙনটুকু রোধ করো। ছাত্র ছুটে গেল কাজে। গিয়ে কাদা দিয়ে যতই চেষ্টা করে, বাঁধ থাকে না। শেষ পর্যন্ত সে নিজে কাত হয়ে আলের ভাঙা জায়গায় শুয়ে পড়ল। কাদা দিয়ে না পারুক নিজের শরীর দিয়ে সে পানি ঠেকাতে লাগল। কারণ শিক্ষকের আদেশ তাকে পালন করতেই হবে। দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শিক্ষক দেখেন ছাত্র ফিরছে না। ছাত্রের খোঁজে তিনি এলেন সেই জমির কাছে। এসে দেখেন ছাত্র তার শরীর দিয়ে পানি ঠেকাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে শিক্ষকের চোখে পানি এলো।
যাঁরা শিক্ষক পেটানোর আদেশ দেন আর যাঁরা শিক্ষক পেটান, তাঁরা অন্তত একবার ভাববেন আপনাদের শিক্ষকদের কথাও এইভাবে একদিন আপনারা পালন করেছেন, আর আপনাদের শিক্ষকরাও আপনাদের জন্য চোখের জলে ভাসতেন।
শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার সময় আপনাদের হাত কাঁপেনি কেন? আপনারা কেমন করে করলেন এই কাজ?
আমাদের শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে অভাব-অনটন আর বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। শিক্ষক বলতেই এক ধরনের নিরীহ ভদ্র কিন্তু অতি দরিদ্র মানুষের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। নিজের ঘর গভীর অন্ধকারে রেখে অন্যের ঘর চিরকাল আলোকিত করে আসছেন তাঁরা। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি শিক্ষা, শিক্ষিত মানুষ। এই শিক্ষার আলো যাঁরা জ্বালছেন, শিক্ষিত মানুষ যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদেরকে পিটিয়ে, অভাব-অনটন আর বঞ্চনার মধ্যে রেখে রাষ্ট্র কত দূর এগোবে? শিক্ষিত জাতি তৈরির মূল মানুষগুলোকে, শিক্ষক শ্রেণীকে যথাযথ মর্যাদা না দিলে, তাঁদের জীবনের অন্ধকার দূর করার ব্যবস্থা না করলে আমাদের চারপাশের আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে আসবে।
No comments