এই দিনে-নাকুগাঁওয়ের একাত্তর by আবদুল মান্নান
দুরন্ত পাহাড়ি নদী ভোগাইয়ের তীর ঘেঁষে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও আর ভারতের ডালু। দেখলে মনে হয়, একই গ্রামের দুটি পাড়া। এ পথ দিয়েই মুক্তিকামী হাজার হাজার নারী-পুরুষ পাড়ি দিয়েছিল ভারতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মে, এই দিনে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও ও ভারতের ডালু সীমান্ত ভেসে যায় রক্তের বন্যায়।
একাত্তরে ২৫ মে দিনটি ছিল মঙ্গলবার। তখনো ভারতে শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে ওঠেনি। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলছে। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ ভারতের বারাঙ্গা পাড়া, ডালু বাজার, চান্দুভুঁই, মাছাংপানি, ছৈপানি, ডিমাপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গার মন্দির, রাস্তা, গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছে। ভোর কেটেছে মাত্র। চারদিকে পাখির কলরব। পূর্ব দিগন্তে তখনো লাল সূর্যের আভা কাটেনি। কিন্তু কে জানত, একটু পরই নিরপরাধ মানুষের তাজা রক্ত সূর্যের লাল আভার চেয়েও গাঢ় হয়ে উঠবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি হানাদারদের একটি বিরাট দল নদী পার হয়ে ডালু বিএসএফ ক্যাম্পসহ ভারতের প্রায় দুই কিলোমিটার সীমানা ঘিরে ফেলে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু অত্যাধুনিক সমর সাজে সজ্জিত শত্রুর কাছে সে প্রতিরোধ বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। এক এক করে নয়জন বিএসএফ সদস্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রতিরোধব্যূহ ভেঙে পড়ে। হানাদাররা নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে লুটিয়ে দেয় কয়েক শ তাজা প্রাণ। মাত্র এক ঘণ্টার তাণ্ডবে রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে ডালু ও নাকুগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বহমান ভোগাই নদীর স্বচ্ছ পানি। ওরা সেদিন কত লোককে হত্যা করেছিল, এর সঠিক পরিসংখ্যান কেউ জানে না। কেননা, নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশ লাশই ভেসে গিয়েছিল নদীর স্রোতে।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ৫০-৬০ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দুজনের লাশ বিএসএফ বাহিনী যথাযোগ্য মর্যাদায় ওয়েস্ট গারো হিলের একটি মসজিদ-সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করে। বাকি বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ নাকুগাঁওয়ে গণকবরে ও হিন্দুদের ভারতের মাটিতে সৎকার করা হয়। ওই দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে একজন ছিলেন শেরপুরের তৎকালীন সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমেদের ছোট ভাই আবদুল মোতালেব। তিনি নববিবাহিতা স্ত্রী রেখে ভারতে গিয়েছিলেন। অপরজনের নাম আশফাকুর রহমান। পরিচয় অজ্ঞাত। মৃত্যুর পর তাঁর পকেটে ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে খাবার পরিবেশন করার একটি ছবি পাওয়া গিয়েছিল। এতে মনে করা হয়েছিল, তিনি তাঁদের কারও ঘনিষ্ঠজন। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের চার দশক পরও নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি আজও অরক্ষিত। কেউ চিনিয়ে না দিলে গণকবরটি বের করা সম্ভব নয়। কারণ, সেটি এখন ধান-খড় শুকানোর মাঠে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পাশে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য শহীদ নয়জন বিএসএফ সদস্যের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণ ও অবহেলার কারণে নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি অবহেলিত।
মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ১৯৮২ সালে এখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের জন্য সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন একটি নকশা তৈরি করিয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী দায়িত্বে থাকাকালীন স্মৃতিফলক স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কার্যত কয়েক দিন তোড়জোড়ের পর আর কিছুই হয়নি। সেই দিনের গণহত্যায় শহীদদের স্বজনেরা ছাড়া বর্তমানে গণকবরটি সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ অনুভব করে না।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের কালের সাক্ষী নাকুগাঁও। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট রয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু শহীদদের কথা কেউ মনে রাখেনি। গণহত্যায় শহীদদের স্বজনেরা শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরার দাবি জানান।
আবদুল মান্নান
নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যে ৫০-৬০ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দুজনের লাশ বিএসএফ বাহিনী যথাযোগ্য মর্যাদায় ওয়েস্ট গারো হিলের একটি মসজিদ-সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করে। বাকি বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ নাকুগাঁওয়ে গণকবরে ও হিন্দুদের ভারতের মাটিতে সৎকার করা হয়। ওই দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে একজন ছিলেন শেরপুরের তৎকালীন সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমেদের ছোট ভাই আবদুল মোতালেব। তিনি নববিবাহিতা স্ত্রী রেখে ভারতে গিয়েছিলেন। অপরজনের নাম আশফাকুর রহমান। পরিচয় অজ্ঞাত। মৃত্যুর পর তাঁর পকেটে ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে খাবার পরিবেশন করার একটি ছবি পাওয়া গিয়েছিল। এতে মনে করা হয়েছিল, তিনি তাঁদের কারও ঘনিষ্ঠজন। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের চার দশক পরও নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি আজও অরক্ষিত। কেউ চিনিয়ে না দিলে গণকবরটি বের করা সম্ভব নয়। কারণ, সেটি এখন ধান-খড় শুকানোর মাঠে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পাশে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য শহীদ নয়জন বিএসএফ সদস্যের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণ ও অবহেলার কারণে নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি অবহেলিত।
মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ১৯৮২ সালে এখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের জন্য সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন একটি নকশা তৈরি করিয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী দায়িত্বে থাকাকালীন স্মৃতিফলক স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কার্যত কয়েক দিন তোড়জোড়ের পর আর কিছুই হয়নি। সেই দিনের গণহত্যায় শহীদদের স্বজনেরা ছাড়া বর্তমানে গণকবরটি সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ অনুভব করে না।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের কালের সাক্ষী নাকুগাঁও। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট রয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু শহীদদের কথা কেউ মনে রাখেনি। গণহত্যায় শহীদদের স্বজনেরা শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরার দাবি জানান।
আবদুল মান্নান
নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
No comments