সামরিক আধিপত্য কতদিন? by আকবর জাইদি
পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক বিশ্লেষণ অপরিহার্য। কারণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি ও এর রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর দেশটির সামরিক বাহিনী ও এর বিভিন্ন এজেন্সির প্রভাব রয়েছে।
সামরিক বাহিনী কীভাবে কাজ করে ও এর শ্রেণী বা জাতিগত ভিত্তি কী, অথবা বাজেটের ওপর এর প্রভাব কী রকম_ এসব জানা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা যথেষ্ট নয়। এর চাইতেও জরুরি বিষয় হলো, খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এই সামরিক প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে নির্ধারণ করে তা জানা।
মে মাসে সুবিদিত কয়েকটি ঘটনার মধ্যে ওসামা বা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ইস্যু, পাকিস্তান নৌঘাঁটি মেহরানে সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সেলিম শাহজাদ হত্যাকাণ্ডের দায় চেপেছে কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর ওপর। পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে এবং সামরিক স্থাপনা ও সাধারণ নাগরিকদের রক্ষাকর্তা হিসেবে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নাগরিক সমাজ, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলও এখন সমালোচনামুখর। সমালোচকরা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রসঙ্গও প্রকাশ্যে টেনে আনছে।
সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ্যে বিশেষত পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও খোলাখুলি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সম্ভবত এই প্রথমবার প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড, এর কর্মকর্তাদের লাইফ স্টাইল নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার সমর্থনেও বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেবল সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরই দেখা যাচ্ছে না, অনেক বেসামরিক কলাম লেখককেও দেখা যাচ্ছে। মনে করা হয়, যারা সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয় বা নিচ্ছে এতে তাদের বিশেষ স্বার্থ রয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সামরিক বাহিনীও এসব সমর্থককে কোনো না কোনোভাবে সুবিধা দিয়ে থাকে বলে সাধারণ একটা ধারণা রয়েছে। মনে করা হয় যে, এস্টাবি্লশমেন্টের মধ্যে সামরিক বাহিনী এতটাই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান যে, এরা কারও কাছে অনুরোধের ডালি নিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস কারোরই সাধারণত থাকে না। প্রত্যেক জেনারেল-প্রেসিডেন্টের নিজেদের জবানিতেই জানা যায়, বিভিন্ন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ তাদের কীভাবে সাহায্য করেছে ও সামরিক একনায়ত্ববাদী শাসনকে শক্তিশালী করেছে।
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোও সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সমর্থক এবং এরা সামরিক বাহিনীকে অনেক সময় নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য আহ্বানও জানিয়ে থাকে এবং এভাবে তারা সামরিক জান্তার বি-টিমে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই কয়েকদিন আগে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে সামরিক বাহিনীর তাঁবেদারি করা কোনো নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতায় থাকারই কোনো অধিকার নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অতীতে যারা সামরিক বাহিনীর ঘোর সমর্থক ছিল তারাও এখন এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সমালোচনামুখর। ১৯৬৫, ১৯৭১, কারগিল ইত্যাদি ব্যর্থ অভিযান নিয়ে কড়া সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য সমালোচনা করার সময় ভারসাম্য বজায় রাখার কথাও বলছেন। সামরিক বাহিনীর অপরিসীম ক্ষমতার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষ কেবল প্রতিষ্ঠানটির সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে বলেই যে এর হুকুম-বরদার হয় তা নয়, বেসামরিক রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সামরিক শাসকদের সমর্থনে এগিয়ে যাওয়ার কারণেও তা সম্ভব হয়। বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সামরিক একনায়কত্বকে সমর্থন করার মাধ্যমে সামরিক শাসন আনার জন্য বেশি দায়ী বলে যে সমালোচনা রয়েছে, তার একেবারে কোনো যে ভিত্তি নেই, তা কিন্তু নয়। তাই পাকিস্তানে সামরিক শাসন আনার জন্য এককভাবে সামরিক বাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না।
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কূটনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক সহায়তাদানও পাকিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের জন্য দায়ী। তবে বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সচেতন প্রচেষ্টা চালালে এ ধরনের পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা যায়। ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেই ১৯৫৭ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও এর রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর সামরিক বাহিনীর আধিপত্য বজায় থাকার পর এখন দেশটির বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টরদের সামনে এই বাহিনীকে রাজনৈতিক বাহিনীর পরিবর্তে একটি প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনীর হাতে এমন অনেক ক্ষমতা রয়েছে যেগুলো গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেগুলোকে বেসামরিক কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্র এবং সামরিক আধিপত্য পরস্পরের বিপরীত। গণতান্ত্রিক অ্যাক্টররা এটা যখন উপলব্ধি করতে পারবেন, তখনই এখানে তারা সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।
আকবর জাইদি :রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ডন থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
মে মাসে সুবিদিত কয়েকটি ঘটনার মধ্যে ওসামা বা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ইস্যু, পাকিস্তান নৌঘাঁটি মেহরানে সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সেলিম শাহজাদ হত্যাকাণ্ডের দায় চেপেছে কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর ওপর। পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে এবং সামরিক স্থাপনা ও সাধারণ নাগরিকদের রক্ষাকর্তা হিসেবে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নাগরিক সমাজ, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলও এখন সমালোচনামুখর। সমালোচকরা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রসঙ্গও প্রকাশ্যে টেনে আনছে।
সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ্যে বিশেষত পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও খোলাখুলি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সম্ভবত এই প্রথমবার প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড, এর কর্মকর্তাদের লাইফ স্টাইল নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার সমর্থনেও বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেবল সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরই দেখা যাচ্ছে না, অনেক বেসামরিক কলাম লেখককেও দেখা যাচ্ছে। মনে করা হয়, যারা সামরিক বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয় বা নিচ্ছে এতে তাদের বিশেষ স্বার্থ রয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সামরিক বাহিনীও এসব সমর্থককে কোনো না কোনোভাবে সুবিধা দিয়ে থাকে বলে সাধারণ একটা ধারণা রয়েছে। মনে করা হয় যে, এস্টাবি্লশমেন্টের মধ্যে সামরিক বাহিনী এতটাই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান যে, এরা কারও কাছে অনুরোধের ডালি নিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস কারোরই সাধারণত থাকে না। প্রত্যেক জেনারেল-প্রেসিডেন্টের নিজেদের জবানিতেই জানা যায়, বিভিন্ন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ তাদের কীভাবে সাহায্য করেছে ও সামরিক একনায়ত্ববাদী শাসনকে শক্তিশালী করেছে।
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোও সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সমর্থক এবং এরা সামরিক বাহিনীকে অনেক সময় নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য আহ্বানও জানিয়ে থাকে এবং এভাবে তারা সামরিক জান্তার বি-টিমে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই কয়েকদিন আগে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে সামরিক বাহিনীর তাঁবেদারি করা কোনো নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতায় থাকারই কোনো অধিকার নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অতীতে যারা সামরিক বাহিনীর ঘোর সমর্থক ছিল তারাও এখন এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সমালোচনামুখর। ১৯৬৫, ১৯৭১, কারগিল ইত্যাদি ব্যর্থ অভিযান নিয়ে কড়া সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য সমালোচনা করার সময় ভারসাম্য বজায় রাখার কথাও বলছেন। সামরিক বাহিনীর অপরিসীম ক্ষমতার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষ কেবল প্রতিষ্ঠানটির সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে বলেই যে এর হুকুম-বরদার হয় তা নয়, বেসামরিক রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সামরিক শাসকদের সমর্থনে এগিয়ে যাওয়ার কারণেও তা সম্ভব হয়। বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সামরিক একনায়কত্বকে সমর্থন করার মাধ্যমে সামরিক শাসন আনার জন্য বেশি দায়ী বলে যে সমালোচনা রয়েছে, তার একেবারে কোনো যে ভিত্তি নেই, তা কিন্তু নয়। তাই পাকিস্তানে সামরিক শাসন আনার জন্য এককভাবে সামরিক বাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না।
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কূটনৈতিক, সামরিক ও আর্থিক সহায়তাদানও পাকিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের জন্য দায়ী। তবে বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টররা সচেতন প্রচেষ্টা চালালে এ ধরনের পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা যায়। ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেই ১৯৫৭ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও এর রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর সামরিক বাহিনীর আধিপত্য বজায় থাকার পর এখন দেশটির বেসামরিক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টরদের সামনে এই বাহিনীকে রাজনৈতিক বাহিনীর পরিবর্তে একটি প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনীর হাতে এমন অনেক ক্ষমতা রয়েছে যেগুলো গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেগুলোকে বেসামরিক কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্র এবং সামরিক আধিপত্য পরস্পরের বিপরীত। গণতান্ত্রিক অ্যাক্টররা এটা যখন উপলব্ধি করতে পারবেন, তখনই এখানে তারা সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।
আকবর জাইদি :রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ডন থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments