ধর্ম-সমাজে পরমতসহিষ্ণুতার অনুশীলন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও ধর্মের অনুসারী মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের অভিমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতাকে পরমতসহিষ্ণুতা বলে। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘তাহাম্মুল’ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বহন করা, সহিষ্ণুপরায়ণ হওয়া, সহ্য করা, দায়িত্ব গ্রহণ করা, সহনশীল হওয়া প্রভৃতি।


ইসলামের পরিভাষায় কারও কথায়, কাজে বা আচার-ব্যবহারে কোনো রকম ক্রোধান্বিত বা উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্য, সংযম ও সহনশীলতার পন্থা অবলম্বন করে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করাই পরমতসহিষ্ণুতা। মানুষের পারস্পরিক আচার-আচরণে, কথাবার্তায় সংযতভাবে মধ্যম পন্থা অবলম্বন ও মনের সংকীর্ণতা দূর করে উদার মনোভাব ও প্রশান্ত চিন্তাধারার মাধ্যমে সংলাপ, সমঝোতা ও সহযোগিতার দ্বারা উদ্ভূত সমস্যাবলি নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং ধৈর্যের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমত-গোত্রনির্বিশেষে সবার অভিমত শ্রবণপূর্বক বিচার-বিশ্লেষণ করে পরামর্শের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য মতামত গ্রহণ করায় উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
পরমতসহিষ্ণুতার মধ্যে থাকবে না কোনো জাগতিক স্বার্থ, থাকবে না কোনো লৌকিকতা। এ সহিষ্ণুতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ পরকালে চরম সুখ ও পরম শান্তি লাভের প্রত্যাশায় পার্থিব জীবনে মৃত্যু পর্যন্ত অটলভাবে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবে ও ধৈর্যধারণ করবে। ইহজগতে এমন কোনো কাজ নেই যা সহিষ্ণুতা ব্যতিরেকে সমাধান করা যেতে পারে। তাই মানবজীবনে পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানবজাতির একটি মহৎ গুণ। মানুষ দুনিয়াতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে ছোটবড় বহু প্রকার দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, দ্বন্দ্ব-কলহ, বিবাদ-বিসংবাদের সম্মুখীন হয়। কিন্তু মানুষ ধৈর্যধারণপূর্বক এসব বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করে স্বীয় লক্ষ্য অর্জন করে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনগণ উটের মতো সহনশীল ও নরম; যদি আকর্ষণ করা হয় তবে সে আকৃষ্ট হয়, আর যদি পাথরের ওপর উপবিষ্ট করানো হয়, তবে সে উপবিষ্ট হয়।’
সফলতা ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার যথেষ্ট প্রয়োজন। মানবজীবনের চরম লক্ষ্য সফলতা অর্জন করা; কিন্তু যার মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব রয়েছে সে সফলতা অর্জন ও উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হয় না। পক্ষান্তরে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-কষ্ট ও হা-হুতাশে মানুষকে ভারাক্রান্ত না হয়ে সহিষ্ণুতার মাধ্যমে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে এবং বিপদ-আপদে ও বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণপূর্বক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না. যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৮৬) ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করলে তিনি খুশি হন এবং মানবজীবনে সফলতা আসে। সৎপথপ্রাপ্ত হওয়া মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। মানুষ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে আল্লাহর হিদায়াত লাভ করে। তাই হিদায়াত লাভ করার জন্য সহিষ্ণুতার প্রয়োজন রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আমারই জন্য সাধনা করে, অবশ্যই আমি তাদের আমার পথে হিদায়াত করব, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত-৬৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমগ্র জীবনই ছিল সহনশীলতার আদর্শ ও পরমতসহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। মহানবী (সা.) যখন আল্লাহর একত্মবাদ প্রচারে অটল, ইসলামের শত্রু মক্কার বিধর্মীরা তখন দেখল যে প্রলোভন, ভীতি ও অকথ্য নির্যাতন প্রভৃতি দিয়ে তাঁকে দমন করা যাচ্ছে না, বরং ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমতাবস্থায় তারা বিমর্ষ হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে সামাজিকভাবে বয়কট করল। তারা মহানবী (সা.)-এর বংশের লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা, বেচাকেনা, লেনদেন এমনকি খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরুদ্ধ করে দিল। এহেন দুর্দিনেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো ধৈর্যচ্যুতি ঘটল না। নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও মক্কাবাসীর জন্য বদদোয়া করলেন না, বরং তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে সব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করলেন। পরে কুরাইশরা নিজেদের ভুল বুঝে তাদের বর্জননীতি প্রত্যাহার করলে মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা আবার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। এ ঘটনা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে উদারতা ও সহিষ্ণুতার বিশেষ পরিচয় বহন করে।
মক্কাবাসীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অত্যাচার-নির্যাতন চরমে পৌঁছালেও তিনি সহিষ্ণুতা হারাননি। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা ও তায়িফ বিজয়ের সময় যে অতুলনীয় ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন বিশ্বের ইতিহাসে এর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। তাঁর সার্থক ও নির্মল ক্ষমাসুন্দর উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার সুমহান চরিত্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়, ‘বিজয়ের মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেলেন, সমস্ত অত্যাচার ক্ষমা করেন এবং মক্কাবাসীর প্রতি সর্বজনীন ক্ষমা ঘোষণা করেন।’
একজন ধর্মপ্রাণ উদার মানুষ পরমতসহিষ্ণু হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে একজন পরমতসহিষ্ণু মানুষকে উদার হতে হয়। ইসলামের আলোকে ধৈর্য, সংযম, উদারতা ও সহিষ্ণুতা মানুষের ঈমানকে পরিপক্ব করে। ঈমানের যতগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে তন্মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা অন্যতম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ঈমানের অর্ধাংশ।’ (আবু নাঈম) নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘সহিষ্ণুতার পুরস্কার জান্নাত।’ (বায়হাকি)
সমাজে ধনী-গরিব, সবল-দুর্বল, চালাক-বোকা, চঞ্চল-শান্ত বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করে বিধায় বিভিন্ন জনের চাল-চলন, ওঠা-বসা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও আদব-কায়দা নানা রকমের পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং কারও অন্যায় বা গর্হিত আচরণ দেখলে সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর রাগান্বিত না হয়ে বরং অত্যন্ত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে উদার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তার অন্যায় আচরণ সংশোধন করে দেওয়া উচিত। তাহলে সমাজে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে। যে সমাজে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা যত বেশি, সে সমাজে অপরাধপ্রবণতা তত কম। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার ক্ষমতাদান সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।’ (বুখারি)
সমাজ জীবনে মানুষ যেকোনো বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে পারে, সে জন্য তাকে পশ্চাৎপদ হলে চলবে না। বরং সহনশীলতার সঙ্গে সেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিরপেক্ষতার সঙ্গে যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করতে হবে। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষের যুক্তিসংগত মতামতকে পরামর্শের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। সংলাপ, আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এভাবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী যদি সর্বক্ষেত্রে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সহিষ্ণুতার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা যায় তাহলে সমাজ ও জাতীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ঐক্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সমাজে পরমতসহিষ্ণুতার অনুশীলন ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত জীবনে সাফল্য আশা করা যায় না।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.