এক লড়াকু দাবাড়ুর অভিযাত্রার শুরু by ডিয়ানা মিহাইয়োলোভা

দাবাড়ু ও চিত্রশিল্পী, জন্ম মেসিডোনিয়ায়, বর্তমান আবাস বুদাপেস্ট হাঙ্গেরি

বাংলাদেশের এক বিস্ময়বালক দাবাড়ু ফ্রান্সের অনূর্ধ্ব ১২ বয়সীদের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে দেখা দিয়েছে অন্য বিপত্তি। সে ছেলেটি, আরও নির্ভুলভাবে বলতে গেলে, ছেলেটির বাবা অবৈধ অভিবাসী।

কাগজপত্র ছাড়া অবৈধভাবে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। ফলে যেকোনো মুহূর্তে নিজ দেশের বিমানে তুলে দেওয়ার ঝুঁকিতে আছে তারা।
ফেসবুকে একটা পোস্টে এ খবরটা প্রথম জানলাম, যেটা আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। এই পোস্টটি মূলত দিয়েছিলেন ইয়োখিম য়ো—ফ্রান্সের এক দাবাড়ু। পরে যেটি অনেকেই শেয়ার করেছেন। পড়তে গিয়ে হুট করে মনে পড়ল, আরে, এই ছেলেটাকে তো আমি চিনি! তিন বছর আগে বুদাপেস্টে ওর সঙ্গে আমার দোস্তিও হয়েছিল!
২০০৮ সালের অক্টোবরে একটি টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে আট বছরের এক বাংলাদেশি বালককে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিলাম। চার ঘণ্টার লড়াই শেষে ও আমাকে বেশ ভালোভাবেই হারিয়ে দিয়েছিল। যেমনটা হেরেছিলেন এর আগে ওর মুখোমুখি হওয়া বাকি সব প্রতিপক্ষই। আমাদের খেলা শেষে ওই লিকলিকে, ভদ্র ছেলেটা আমার কাছে বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি আসলে বেশ ভালো খেলেছ। এদের মধ্যে তুমিই আমাকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলতে পেরেছ।’
ওর এসব কথা আমি প্রশংসা হিসেবেই নিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওর বাবা নূরে আলমের সঙ্গেও পরিচয় হয়। দাবা খেলতে যতটা সহজ হচ্ছিল, ততটাই কঠিন ছিল ওদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান। ওর বাবা ইউরোপের কোনো ভাষাই জানেন না। আর ছেলেটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। ওদের দুজনের ছবিও তুলেছিলাম। এই বাবা-ছেলের জুটিটা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার জেতা বিলে আগস্টের পেলে দ্য কনকুয়েরার ছবিটার কথা। ওই ছবির গল্পে আমরা দেখেছি, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় বাবা আর ছেলে কীভাবে বিদেশের মাটিতে সংগ্রাম করছে।
১৯ শতকের পটভূমিতে নির্মিত সেই ছবির গল্পটা একুশ শতকেও কীভাবে মিলে গেল! একজন বাংলাদেশি বাবা আর তাঁর ছোট্ট ছেলে কীভাবে ভালো আর নিরাপদ জীবনের আশায় ভিনদেশে এসে অন্য আরেক নির্মমতার মুখোমুখি হচ্ছেন, যার নাম অভিবাসন আইন।
২০০৯ সালের জুলাইয়ে ওদের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, তারা হয়তো ফরাসি রাজধানীতে বেশ থিতু হয়ে গেছে। কিন্তু পরে জানলাম, পরিস্থিতি আসলেই উল্টো। ফাহিম অবশ্য দাবা খেলা চালিয়ে গেছে। এবং এর সৌজন্যে ফরাসি দাবা ফেডারেশনের কোচ জেভিয়ার প্যারামিন্তেয়ারের নজরে পড়ে গেছে। ছেলেটির প্রতিভা বুঝতে পেরে তিনিই বিনা মূল্যে তার কোচিং করিয়েছেন। সঙ্গে বিনা মূল্যে ছেলেটিকে খাবার দিতে হয়েছে। দিতে হয়েছে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার ফি-ও।
ফাহিম হতাশ করেনি। পরের বছর একাধিক জয় এনে দিয়েছে। এর মধ্যে জিতেছে প্যারিস চ্যাম্পিয়নশিপের ওপেন বি টুর্নামেন্ট। এ বছর এপ্রিলে ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়নশিপে (বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায়) চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছে। ফ্রান্সের জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার তার আছে, ইউরোপিয়ান আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও ফ্রান্সকে প্রতিনিধিত্ব সে করতে পারে।
জাভিয়েরের নেতৃত্বেই ছেলেটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়। এরপর ফ্রান্সের অনেক দৈনিকে এ নিয়ে খবর বেরোয়। ৪ মে ফ্রান্স ইন্টার নামের রেডিওর একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঙ্কোইস ফিলোঁ মন্তব্য করেন: ‘ছেলেটার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ আশা করি। আমরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করব না। বরং দ্রুতই তা পর্যালোচনা করে দেখব।’ ফলে একটা আশা আছে!
জীবনের অদ্ভুতুড়ে সমীকরণের মুখোমুখি হয়ে ফাহিম এরই মধ্যে অসীম দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। সবকিছুর পরও সে সত্যিকারের এক লড়াকুর মতো লড়ে গেছে—বিজয়ী হয়েছে দাবার বোর্ডে। ওর একটাই ইচ্ছা, ফ্রান্সে একজন পেশাদার দাবাড়ু হওয়া। আসুন, প্রার্থনা করি, ওর স্বপ্ন যেন পূরণ হয়।
[সংক্ষেপিত]
অনুবাদ: রাজীব হাসান
সূত্র: চেসবেইস নিউজ অনলাইন

No comments

Powered by Blogger.