ভূমিকম্পের কোনো জাত বিচার নেই by মহসীন হাবিব

গত বছরের ১১-১২ জানুয়ারি হাইতিতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভয়াবহ ভূমিকম্পে দুই লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। ৩০ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়ে পড়ে। সে ধাক্কা এখনো কুলিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার পরও খাবার, ওষুধহীন অবস্থায় আজও বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে হাইতির জনগণ।


অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে একটি দেশ, একটি জাতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্টের ভবন পর্যন্ত সে ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ভাগ্য খুব কম জাতিকেই ভোগ করতে হয়েছে। এমনিতেই হাইতি একটি দরিদ্র কালো মানুষের দেশ; ক্ষুধা, দুঃশাসন তাদের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজে জন্মগ্রহণকারী এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বসবাসকারী কবি ম্যাঙ্নি বেনেবা ক্লার্ক ঈশ্বর এবং যিশুর প্রতি অভিমান ও ক্ষোভ প্রকাশ করে কবিতায় লিখেছেন_

Seems Jesus
& his big daddy
both white men/to me
else what the hell do that pair/have
against the poor
& brown
& free

the pale trinity
hy crushed Haiti in their fist
did it feel as good as phuket
tsunami/quake/or lava
what Jacks them off the best
....Jesus is a white man/I'm saying
Jesus is now a white man/to me

আফ্রিকা তথা অনেক কালো সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে, তাদের চার্চ সমাজে বিশ্বাস আছে, ঈশ্বর এবং তাঁর পুত্র সাদা নন, তাঁদের গায়ের রং কালো। তাই কবি মনে করছেন, যে ঈশ্বর কালোদের ওপর এত বড় দুর্যোগ চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি কালো নন, সাদা। ক্লার্কের এ কবিতাটির মধ্যে আরো অন্তর্নিহিত একটি বার্তা এবং অভিযোগ আছে সাদা মানুষের বিরুদ্ধে। সে কারণেই এ কবিতা সাদা চামড়ার খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের (সবাইকে নয়, সাদা চামড়ার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ এখন ধর্ম নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন না।) ব্যথিত করেছে। এর প্রত্যুত্তরে ঈশ্বরকে কালো ব্যাখ্যা দিয়ে কবিতাও লেখা হয়েছে, কিন্তু সে আলোচনা এখানে মুখ্য নয়। প্রকৃত এসব কবিতার পঙ্ক্তি, অথবা কোনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধার ধারে না। সেটাই প্রমাণ করে দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ জাপানের উপকূলে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্প হয় গত শুক্রবার। সাগরে সে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮.৯। ভূমিকম্পের কারণে সাগর থেকে যে বিশাল আকারের ঢেউ ওঠে তা ছিল ৩০ ফুটেরও বেশি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখে মনে হয়েছে যেন হলিউড বা বলিউডের স্টুডিওতে তৈরি কোনো দৃশ্য। ঘরবাড়ি, গাড়ি, এমনকি বড় বড় আধুনিক বোট ম্যাচবাতির বাঙ্রে মতো ধুয়ে নিয়ে যায় শক্তিশালী সুনামি। এ ঘটনায় ইতিমধ্যেই শত শত মানুষের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তেল শোধনাগারে আগুন ধরে গেছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। একটি প্লান্ট বিস্ফোরিত হয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তার মানে এখানেই শেষ নয়, এ ভূমিকম্প এবং সুনামির জের টানতে হবে অনেক দিন। জাপানের মতো দেশ এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। ভূমিকম্পের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের ধনী দেশগুলো জাপানকে জানিয়েছে, তারা যেকোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। যত দ্রুত সম্ভব সামর্থ্যবান দেশগুলো সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
প্রায়ই ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবী গত ২০০ বছরে অনেক এগোলেও এখনো প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায় তার একটি উদাহরণ এই ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের আগাম কোনো সতর্কতা অবলম্বনের উপায় এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে একটি প্রাকৃতিক সংকেত পাওয়ার উপায় আছে। ভূমিকম্পের ঠিক আগ মুহূর্তে ইঁদুর মাটির গর্ত থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসে। ভূমিকম্পের ঠিক আগে ইঁদুরের গর্ত এত স্বল্প পরিমাণ সংকুচিত হয়ে যায়, যা পরিমাপ করা দুষ্কর। আর ইঁদুরের ত্বক ও পশম এতটাই সংবেদনশীল যে ইঁদুর তা বুঝে ফেলে, 'দেয়ার ইজ সামথিং রং'। সমস্যা হলো, আমরা যারা ঢাকা শহরে ঝুলে আছি তাদের সুযোগ কোথায় ইঁদুর গর্ত থেকে বের হলো কি না তা জানার?
বাংলাদেশ ভূমিকম্পের একটি ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রায়ই ছোটখাটো ভূমিকম্প হচ্ছে, কিন্তু রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার (যা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়) একটি ভূমিকম্প হলে এ দেশ জ্ঞাত ইতিহাসের ভয়াবহতম প্রাণহানির মুখোমুখি হবে বলে সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এঙ্পার্টদের দু'-একজনের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি। একজন এমন মন্তব্য করেছেন, খোদা না করুক রিখটার স্কেলে ৮-৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে শুধু ঢাকা শহরেই ৫০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে!
১৯৩৫ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে একটি সিসমিক জোনিং ম্যাপ তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীনের পর আমরা নিজেরাও একটি ম্যাপ তৈরি করেছি। সে অনুসারে বাংলাদেশকে তিনটি পৃথক ঝুঁকির এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এতে ঢাকা কিন্তু অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস বিচার করে কিছু লক্ষণের কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট মৃদু ভূকম্পন হয়। সেটা হতে পারে থেকে থেকে ছয় মাস বা এক বছর ধরেও। লক্ষণীয়, আমরা কিন্তু প্রায়ই মৃদু ভূকম্পনের সম্মুখীন হচ্ছি।
আমার কথা থেকে অনেকের ধারণা হতে পারে, তাহলে কি কিছু করার নেই? একেবারে যে নেই তা নয়। এর মধ্যে প্রধান হলো, ভূমিকম্প সহ্য করার মতো শক্ত অবকাঠামো নির্মাণ এবং ধ্বংস মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা। লক্ষণীয়, হাইতিতে মাত্র ৭ মাত্রার ভূমিকম্প দেশটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। কিন্তু জাপানে সে তুলনায় অন্তত প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কম। কারণ জাপানে এমন ভবনও তৈরি আছে, যা ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁকা হয়ে আবার সোজা হতে পারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বহুতল অনেক ভবনের নিচে (নির্মাণ প্রকৌশলের ভাষা বুঝি না, মোটা দাগে এভাবেই বুঝি) এক ধরনের শক্তিশালী স্প্রিং বসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে প্রচণ্ড ঝাঁকি ওই স্পিংয়ের ওপর দিয়ে যায়। এড়িয়ে যেতে না পারলেও এভাবেই জাপান ঝুঁকি কমিয়ে এনেছে। ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাপানে যে ভয়াবহ কান্টো ভূমিকম্প হয়েছিল সেখানে কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৯। সে ভূমিকম্পে এক লাখ লোক প্রাণ হারায় এবং ৪৩ হাজার মানুষের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাঁচ লাখ ৭০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আজ তার চেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং জলোচ্ছ্বাসে মৃতের সংখ্যা, ঘরবাড়ি ধ্বংসের সংখ্যা অনেক কম।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, জাপানের মতো আমরা শহর নির্মাণে অর্থ কোথায় পাব? সত্যি কথা_অর্থ নেই, সামর্থ্য নেই। তবে ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে না দিলে, ঈশ্বর সাদা না কালো সে বিতর্কে আমরা জড়িয়ে না থাকলে জাপানের মতো অর্থ ও সামর্থ্য আমাদের শিগগিরই হয়ে যাবে_এ কথা হলফ করে বলতে পারি। আর যদি নিজেদের দুই হাত, নিজেদের মেধা সঠিক পথে পরিচালনা না করে ঈশ্বর সাদা না কালো, কোথায় তিনি বাস করেন এসব বিতর্কের মধ্যে পড়ে থাকি তাহলে শত বছরেও প্রকৃতি মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন করা যাবে না। প্রাচীনকালে, মধ্যযুগে এবং এখনো ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী প্রকৃতির নানা শক্তিকে ঈশ্বর বলে আরাধনা করেছে। নরবলি দিয়েছে, কুমারী বলি দিয়েছে প্রকৃতিকে তুষ্ট করতে। প্রকৃতি তাদের সামান্যতম অনুকম্পাও দেখায়নি। আমরা কিন্তু তাদের থেকে খুব বেশি দূর এগুইনি। সুতরাং আমাদেরও প্রকৃতিবৈরী হলে অনুকম্পা দেখাবে না। এর প্রমাণ ও অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে বেশি আর কার আছে?

লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.