হৃদয়নন্দন বনে-শুষ্ক কানন শাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে by আলী যাকের
এই যে অপরিকল্পিতভাবে উঁচু সব দালান তৈরি হচ্ছে, এর কারণে শহরের তাপও বন্দি হয়ে থাকছে একেকটি এলাকায়। আমাদের বাল্যকালে দেখেছি, এই ঢাকা শহরেই, দিনের বেলা গরম যত বেশিই হোক না কেন, সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে চারপাশ ঠাণ্ডা হতে থাকে।
আমার তো স্পষ্টই মনে আছে, আমাদের পরিবারের সবাই আমাদের পড়াশোনা এবং সবার খাওয়া-দাওয়ার পর ছাতে আশ্রয় নিতাম। সেখানে ঠাণ্ডা হয়ে তারপর যার যার শোবার ঘরে চলে আসতাম। কিন্তু এখন দিনে যে তাপ সঞ্চারিত হয়, সেটি উঁচু উঁচু ভবনের মাঝখানে আটকে থাকে
গ্রীষ্মের তাপদাহ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। ঢাকায় তো বটেই, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা অর্ধ ত্রিশের বেশি। সাধারণ মানুষ, যারা তাপানুকূল পরিবেশে দিন-রাত্রি কাটায় না, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পথে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস। যদিও আমরা প্রায় সবাই বলছি যে, আমাদের দেশের এই গরম বৈশ্বিক উষ্ণতার অবদান; ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। আজকাল ইন্টারনেটের কৃপায় আমরা জেনে গেছি যে, এই ঢাকার উষ্ণতা '৬০ এবং '৭০-এর দশকে ৪১, ৩৯ কিংবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। গ্রীষ্ম উত্তপ্ত হবে_ এটাই স্বাভাবিক এবং সেই উত্তাপের বিনিময়ে বোধ করি আমাদের সে পুষিয়ে দেয় নানা রকম সুমিষ্ট ফল-ফলাদি দিয়ে। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম_ আরও কত কী। এই জ্যৈষ্ঠ মাসকেই তো বলা হয় মধু মাস। বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে একবার কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় কোনটি। জবাবে ও বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে ভালোবাসতেন বোলপুরের গ্রীষ্মকাল। বলা বাহুল্য, শান্তিনিকেতন বোলপুরেই অবস্থিত। বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মকালে আশ্রমের সব দরজা-জানালা খুলে দিয়ে লেখালেখি করতেন। আগুনের হল্্কার মতো হাওয়া বয়ে যেত ঘরের ভেতর দিয়ে। তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। এ কথাটি যখন লিখছি, তখন দীর্ঘ চুল এবং দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি তিনি লেখায় ক্ষান্ত দিয়ে উত্তরায়নে তাঁর বাসস্থান থেকে বেরিয়ে বৃক্ষশোভিত লাল সুরকির রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। উদাস দৃষ্টিতে সামনের ধু-ধু মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন যেন। 'মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী।' রবীন্দ্রনাথের আবাসস্থল এবং সামনে লাল সুরকির রাস্তার কথা উল্লেখ করতেই আরও একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। কথিত আছে যে, কোনো এক গ্রীষ্মের সকালে রবীন্দ্রনাথ ওই রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। সেই সময় একদল সাঁওতাল মেয়ে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কানে গোঁজা ছিল সাদা টগর ফুল। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'ওটা কী ফুল রে?' এক সাঁওতাল কন্যা জবাবে বলল, 'বন-টগর বটে গো, বাবু।' রবীন্দ্রনাথ ঈষৎ হেসে বললেন, 'এত সুন্দর ফুল, যা তোদেরকে করে তুলেছে আরও সুন্দর, এর অমন বদখত নাম হয় কী করে? আজ থেকে এই ফুলের নাম দিলাম মহাশ্বেতা।'
সে কবেকার কথা। বয়সে আমি নিতান্তই কিশোর। আকাশবাণী কলকাতা থেকে একটি গান প্রায়ই বাজানো হতো। 'ও আমার কাজল পাখি, চৈত্র দিনের শেষে আমায় তুমি ডাক দিলে ঐ ...'। গানের বাকি কথাগুলো ভুলে গেছি। তবে সুরটি এখনও কানে বাজে। যদিও চৈত্র আক্ষরিক অর্থে গ্রীষ্মকাল নয়, কিন্তু গ্রীষ্মের তাপদাহ শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে এবং কাজল পাখির আহাজারি এই জ্যৈষ্ঠ মাসেও আমাকে উতলা করে। অতএব গ্রীষ্মের সঙ্গে এই গানটির একটি যোগসূত্র বোধ হয় কোথাও খুঁজে পাই। গ্রীষ্ম আমারও অত্যন্ত প্রিয় একটি ঋতু। যখন ভাবি যে, বাংলার গ্রীষ্মই আমাদের সবচেয়ে রঙিন ফুল উপহার দেয়, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, স্বর্ণচূড়া, সোনালু, রঙবেরঙের খই ফুল এবং আরও কত কী (এ ছাড়াও রসাল সব ফলের কথা তো আগেই বলেছি)_ তখন কী করে বলি যে গ্রীষ্ম একটি নিষ্করুণ ঋতু?
মনে পড়ে যায় বাল্যকালের কথা। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় থাকতাম আমরা। গ্রীষ্মকালে অবসর সময়ে আমরা ডিস্টিলারি রোডের মাথায় অবস্থিত পুকুর কিংবা যতীন দাশের দীঘিতে আশ্রয় নিতাম মহাআনন্দে। আমাদের বাসায় একটি মাত্র ফ্যান ছিল। তাও বাবা-মায়ের ঘরে। অতএব, আমরা হাতপাখা ভরসা করে বিছানায় আশ্রয় নিতাম গুমোট রাত্রিতে। কখনও এ নিয়ে কোনো চিন্তাও করিনি। ভাবতাম, গ্রীষ্মকালে গরম তো পড়বেই। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেসব দিন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আজ। এখন ঋতুকে পাল্টে দেওয়ার অনেক পদ্ধতি আমাদের আয়ত্তে এসেছে। আমরা অতি সহজেই আমাদের ঘরগুলোকে সুশীতল করে তুলতে পারছি। অতএব যখন বিদ্যুতের অভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রগুলো স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আমাদের সবারই প্রাণ আঁইঢাঁই করে বৈকি। তবে এই এখনকার সময়েও আমাদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনেই দৈহিক কষ্টকে লাঘব করতে পারা যায় হয়তো-বা। বছর তিনেক আগে এমন একটি পরীক্ষা আমি করেছিলাম নিজেকে নিয়ে। কোনো একটি নাটকের বহির্দৃশ্য গ্রহণের জন্য সকাল থেকে শুরু করে মাঝ রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছিল ঢাকার অদূরে পূবাইলের একটি গ্রামে। তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল। এক ফোঁটা হাওয়া ছিল না। কৃত্রিম আলোর মধ্যে সামান্যক্ষণ অভিনয় করতে করতেই ঘেমে নেয়ে উঠেছিলাম। নাটকের পরিচালক সদয় হয়ে অনুমতি দিচ্ছিলেন বাইরের অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে বসে ক্ষণিক সময় কাটিয়ে নিজেকে শীতল করার। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে, যেমন বাল্যকালেও ঘেমে ওঠার পর ভেজা গেঞ্জির শীতলতার আবরণে বড্ড আরাম লাগত, তেমনি এখনও ওই একই প্রক্রিয়ায় গরমকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখানো যায়। ভেবেই মনটা খুশি হয়ে উঠল। আমি আবার পূর্ণোদ্যমে শুটিংয়ের কাজ শুরু করলাম। এইভাবে আলো-আঁধারি এবং গ্রীষ্মের তীব্রতায় শুটিং শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন মনে হলো, আসলে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। ঠিক একই নিরীক্ষা আমি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে করেছি আমার দেশের বাড়িতে। এই ঋতুতে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না আমাদের গ্রামে। গরমে প্রাণ আঁইঢাঁই করে। তখন নিজের মনের ওপরে সংযমের আবরণটি জড়িয়ে নিই। শরীর শীতল হয়ে যায়।
তবে এটা সত্য যে, এখন বিদ্যুৎ সংকটের অবস্থা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দূরে যেতে হয় না। সেদিন আমার অফিসের ছাতের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম চারপাশ থেকে উঁচু উঁচু দালান আমাদের দালানটিকে গিলে খেতে আসছে। হঠাৎ মনে হলো, এসব দালানের প্রতিটিতে নূ্যনপক্ষে একটি লিফট লাগানো হয়েছে। ঢাকা শহরে এখন বস্তুতপক্ষে ছয় কিংবা তারও অধিক তলার বাড়ি দেখা যায় প্রধানত। এক, দুই বা তিনতলার বাড়ি প্রায় সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। এসব বাড়ির প্রতিটিতে যদি একটি লিফট থাকে, তাহলে গত দুই-তিন বছর ধরে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ তারা টানছে_ তার হিসাব কি আমাদের জানা আছে? তাছাড়া সেই বাড়িগুলোর লাইট এবং ফ্যান? তার হিসাব না হয় বাদই দেওয়া গেল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা ৬-৭ হাজার মেগাওয়াটের কথা বলছি বটে, কিন্তু প্রয়োজন আমাদের ১০, ১১ কিংবা ১২ হাজার মেগাওয়াট। এই যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা, এর খেসারত তো আমাদের দিতে হবেই। অতএব, মনকে শক্ত করাই ভালো। দেহের ক্লেশ ঘুচে যাবে।
এই যে অপরিকল্পিতভাবে উঁচু সব দালান তৈরি হচ্ছে, এর কারণে শহরের তাপও বন্দি হয়ে থাকছে একেকটি এলাকায়। আমাদের বাল্যকালে দেখেছি, এই ঢাকা শহরেই, দিনের বেলা গরম যত বেশিই হোক না কেন, সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে চারপাশ ঠাণ্ডা হতে থাকে। আমার তো স্পষ্টই মনে আছে, আমাদের পরিবারের সবাই আমাদের পড়াশোনা এবং সবার খাওয়া-দাওয়ার পর ছাতে আশ্রয় নিতাম। সেখানে ঠাণ্ডা হয়ে তারপর যার যার শোবার ঘরে চলে আসতাম। কিন্তু এখন দিনে যে তাপ সঞ্চারিত হয়, সেটি উঁচু উঁচু ভবনের মাঝখানে আটকে থাকে। ফলে রাতেও উষ্ণতা লাঘব হয় না একটুও এবং উঁচু ভবন ভেদ করে বাতাসের পক্ষে চলাচল করা সম্ভব হয় না কখনও।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা এবং আমাদের মানসিক গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হলো আজ। এবারে গ্রীষ্মের ওপরেই রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন দিয়ে এই কলামের ইতি টানছি। 'হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে/মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্্ সে ভাবের বশে।'
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
গ্রীষ্মের তাপদাহ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। ঢাকায় তো বটেই, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা অর্ধ ত্রিশের বেশি। সাধারণ মানুষ, যারা তাপানুকূল পরিবেশে দিন-রাত্রি কাটায় না, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পথে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস। যদিও আমরা প্রায় সবাই বলছি যে, আমাদের দেশের এই গরম বৈশ্বিক উষ্ণতার অবদান; ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। আজকাল ইন্টারনেটের কৃপায় আমরা জেনে গেছি যে, এই ঢাকার উষ্ণতা '৬০ এবং '৭০-এর দশকে ৪১, ৩৯ কিংবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। গ্রীষ্ম উত্তপ্ত হবে_ এটাই স্বাভাবিক এবং সেই উত্তাপের বিনিময়ে বোধ করি আমাদের সে পুষিয়ে দেয় নানা রকম সুমিষ্ট ফল-ফলাদি দিয়ে। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম_ আরও কত কী। এই জ্যৈষ্ঠ মাসকেই তো বলা হয় মধু মাস। বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে একবার কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় কোনটি। জবাবে ও বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে ভালোবাসতেন বোলপুরের গ্রীষ্মকাল। বলা বাহুল্য, শান্তিনিকেতন বোলপুরেই অবস্থিত। বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মকালে আশ্রমের সব দরজা-জানালা খুলে দিয়ে লেখালেখি করতেন। আগুনের হল্্কার মতো হাওয়া বয়ে যেত ঘরের ভেতর দিয়ে। তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। এ কথাটি যখন লিখছি, তখন দীর্ঘ চুল এবং দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি তিনি লেখায় ক্ষান্ত দিয়ে উত্তরায়নে তাঁর বাসস্থান থেকে বেরিয়ে বৃক্ষশোভিত লাল সুরকির রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। উদাস দৃষ্টিতে সামনের ধু-ধু মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন যেন। 'মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি/হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী।' রবীন্দ্রনাথের আবাসস্থল এবং সামনে লাল সুরকির রাস্তার কথা উল্লেখ করতেই আরও একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। কথিত আছে যে, কোনো এক গ্রীষ্মের সকালে রবীন্দ্রনাথ ওই রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। সেই সময় একদল সাঁওতাল মেয়ে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কানে গোঁজা ছিল সাদা টগর ফুল। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'ওটা কী ফুল রে?' এক সাঁওতাল কন্যা জবাবে বলল, 'বন-টগর বটে গো, বাবু।' রবীন্দ্রনাথ ঈষৎ হেসে বললেন, 'এত সুন্দর ফুল, যা তোদেরকে করে তুলেছে আরও সুন্দর, এর অমন বদখত নাম হয় কী করে? আজ থেকে এই ফুলের নাম দিলাম মহাশ্বেতা।'
সে কবেকার কথা। বয়সে আমি নিতান্তই কিশোর। আকাশবাণী কলকাতা থেকে একটি গান প্রায়ই বাজানো হতো। 'ও আমার কাজল পাখি, চৈত্র দিনের শেষে আমায় তুমি ডাক দিলে ঐ ...'। গানের বাকি কথাগুলো ভুলে গেছি। তবে সুরটি এখনও কানে বাজে। যদিও চৈত্র আক্ষরিক অর্থে গ্রীষ্মকাল নয়, কিন্তু গ্রীষ্মের তাপদাহ শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে এবং কাজল পাখির আহাজারি এই জ্যৈষ্ঠ মাসেও আমাকে উতলা করে। অতএব গ্রীষ্মের সঙ্গে এই গানটির একটি যোগসূত্র বোধ হয় কোথাও খুঁজে পাই। গ্রীষ্ম আমারও অত্যন্ত প্রিয় একটি ঋতু। যখন ভাবি যে, বাংলার গ্রীষ্মই আমাদের সবচেয়ে রঙিন ফুল উপহার দেয়, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, স্বর্ণচূড়া, সোনালু, রঙবেরঙের খই ফুল এবং আরও কত কী (এ ছাড়াও রসাল সব ফলের কথা তো আগেই বলেছি)_ তখন কী করে বলি যে গ্রীষ্ম একটি নিষ্করুণ ঋতু?
মনে পড়ে যায় বাল্যকালের কথা। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় থাকতাম আমরা। গ্রীষ্মকালে অবসর সময়ে আমরা ডিস্টিলারি রোডের মাথায় অবস্থিত পুকুর কিংবা যতীন দাশের দীঘিতে আশ্রয় নিতাম মহাআনন্দে। আমাদের বাসায় একটি মাত্র ফ্যান ছিল। তাও বাবা-মায়ের ঘরে। অতএব, আমরা হাতপাখা ভরসা করে বিছানায় আশ্রয় নিতাম গুমোট রাত্রিতে। কখনও এ নিয়ে কোনো চিন্তাও করিনি। ভাবতাম, গ্রীষ্মকালে গরম তো পড়বেই। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেসব দিন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আজ। এখন ঋতুকে পাল্টে দেওয়ার অনেক পদ্ধতি আমাদের আয়ত্তে এসেছে। আমরা অতি সহজেই আমাদের ঘরগুলোকে সুশীতল করে তুলতে পারছি। অতএব যখন বিদ্যুতের অভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রগুলো স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আমাদের সবারই প্রাণ আঁইঢাঁই করে বৈকি। তবে এই এখনকার সময়েও আমাদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনেই দৈহিক কষ্টকে লাঘব করতে পারা যায় হয়তো-বা। বছর তিনেক আগে এমন একটি পরীক্ষা আমি করেছিলাম নিজেকে নিয়ে। কোনো একটি নাটকের বহির্দৃশ্য গ্রহণের জন্য সকাল থেকে শুরু করে মাঝ রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছিল ঢাকার অদূরে পূবাইলের একটি গ্রামে। তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল। এক ফোঁটা হাওয়া ছিল না। কৃত্রিম আলোর মধ্যে সামান্যক্ষণ অভিনয় করতে করতেই ঘেমে নেয়ে উঠেছিলাম। নাটকের পরিচালক সদয় হয়ে অনুমতি দিচ্ছিলেন বাইরের অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে বসে ক্ষণিক সময় কাটিয়ে নিজেকে শীতল করার। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে, যেমন বাল্যকালেও ঘেমে ওঠার পর ভেজা গেঞ্জির শীতলতার আবরণে বড্ড আরাম লাগত, তেমনি এখনও ওই একই প্রক্রিয়ায় গরমকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখানো যায়। ভেবেই মনটা খুশি হয়ে উঠল। আমি আবার পূর্ণোদ্যমে শুটিংয়ের কাজ শুরু করলাম। এইভাবে আলো-আঁধারি এবং গ্রীষ্মের তীব্রতায় শুটিং শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন মনে হলো, আসলে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। ঠিক একই নিরীক্ষা আমি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে করেছি আমার দেশের বাড়িতে। এই ঋতুতে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না আমাদের গ্রামে। গরমে প্রাণ আঁইঢাঁই করে। তখন নিজের মনের ওপরে সংযমের আবরণটি জড়িয়ে নিই। শরীর শীতল হয়ে যায়।
তবে এটা সত্য যে, এখন বিদ্যুৎ সংকটের অবস্থা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দূরে যেতে হয় না। সেদিন আমার অফিসের ছাতের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম চারপাশ থেকে উঁচু উঁচু দালান আমাদের দালানটিকে গিলে খেতে আসছে। হঠাৎ মনে হলো, এসব দালানের প্রতিটিতে নূ্যনপক্ষে একটি লিফট লাগানো হয়েছে। ঢাকা শহরে এখন বস্তুতপক্ষে ছয় কিংবা তারও অধিক তলার বাড়ি দেখা যায় প্রধানত। এক, দুই বা তিনতলার বাড়ি প্রায় সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। এসব বাড়ির প্রতিটিতে যদি একটি লিফট থাকে, তাহলে গত দুই-তিন বছর ধরে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ তারা টানছে_ তার হিসাব কি আমাদের জানা আছে? তাছাড়া সেই বাড়িগুলোর লাইট এবং ফ্যান? তার হিসাব না হয় বাদই দেওয়া গেল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা ৬-৭ হাজার মেগাওয়াটের কথা বলছি বটে, কিন্তু প্রয়োজন আমাদের ১০, ১১ কিংবা ১২ হাজার মেগাওয়াট। এই যে ক্রমবর্ধমান চাহিদা, এর খেসারত তো আমাদের দিতে হবেই। অতএব, মনকে শক্ত করাই ভালো। দেহের ক্লেশ ঘুচে যাবে।
এই যে অপরিকল্পিতভাবে উঁচু সব দালান তৈরি হচ্ছে, এর কারণে শহরের তাপও বন্দি হয়ে থাকছে একেকটি এলাকায়। আমাদের বাল্যকালে দেখেছি, এই ঢাকা শহরেই, দিনের বেলা গরম যত বেশিই হোক না কেন, সন্ধ্যার পর আস্তে আস্তে চারপাশ ঠাণ্ডা হতে থাকে। আমার তো স্পষ্টই মনে আছে, আমাদের পরিবারের সবাই আমাদের পড়াশোনা এবং সবার খাওয়া-দাওয়ার পর ছাতে আশ্রয় নিতাম। সেখানে ঠাণ্ডা হয়ে তারপর যার যার শোবার ঘরে চলে আসতাম। কিন্তু এখন দিনে যে তাপ সঞ্চারিত হয়, সেটি উঁচু উঁচু ভবনের মাঝখানে আটকে থাকে। ফলে রাতেও উষ্ণতা লাঘব হয় না একটুও এবং উঁচু ভবন ভেদ করে বাতাসের পক্ষে চলাচল করা সম্ভব হয় না কখনও।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা এবং আমাদের মানসিক গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হলো আজ। এবারে গ্রীষ্মের ওপরেই রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন দিয়ে এই কলামের ইতি টানছি। 'হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে/মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্্ সে ভাবের বশে।'
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments