রাজনীতি-সংঘাতের প্রতিকারে তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই? by মো. জাকির হোসেন
কয়েক দিন আগে রিকশা করে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। রিকশায় ওঠার পরই চালক আলাপ শুরু করে দেয়। আমার জেলার নাম জানতে চায়। আমি কোন পেশায় আছি, সেটার প্রতিও তার খুব আগ্রহ। আমিও তার পরিবার, পড়াশোনা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ দেখাই।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে তার কাছে জানতে চাই আমাদের রাজনীতির অবস্থা কী? রিকশাচালক জবাব দেয়, ‘রাজনীতি তো স্যার শ্যাষ।’ আমি বলি শ্যাষ মানে কী? আমার প্রশ্নের উত্তরে রসিক রিকশাচালক একটি মজার গল্প বলে। আমাদের বড় দুই দলের মধ্যে এক দলের জনৈক নেতা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ সেই নেতা নাকি তাঁর স্ত্রীকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, আমি তো মরেই যাচ্ছি, আমার মরার পর তুমি অমুক দলের কাউকে বিয়ে করো। স্ত্রী অবাক হয়ে বলে, তোমার প্রতিপক্ষ যে দলের কারণে আজ তোমার এই অবস্থা, সেই দলের কাউকে বিয়ে করার জন্য বলছ, তুমি কী পাগল হয়ে গিয়েছ? স্বামী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেন, জীবিত অবস্থায় তো ওদের মনের মতো টাইট দিতে পারলাম না, তাই মরার পর ভালো করে টাইট দিতে চাই। আমি এতক্ষণে অনুধাবন করি রিকশাচালক আমাদের সংঘর্ষের রাজনীতির ইঙ্গিত করে বলেছে রাজনীতি তো শ্যাষ।
প্রিয় পাঠক, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও তপ্ত হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আসন্ন সংঘাতের বিষয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ প্রকাশ শুরু হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতপার্থক্য দূর করতে সরকার ও বিরোধী দলকে সংযত আচরণ করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদে ও সংসদের বাইরে সংলাপে বসার জন্য নিয়মিতভাবে দেশি-বিদেশি পরামর্শ শোনা যাচ্ছে। বিএনপি সংলাপে যাওয়ার শর্তযুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। সংলাপে বসার আগেই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের লিখিত ঘোষণা দিতে হবে বলে বিরোধীদলীয় নেত্রী শর্তারোপ করেছেন। ১২ মার্চের মহাসমাবেশ থেকে ঘোষিত আল্টিমেটাম অনুযায়ী ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল না হলে দেশে ভয়াবহ সংঘাতের পরিণতি সৃষ্টি হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার হুঁশিয়ার উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ডেড ইস্যু, এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতের রাজনীতির ফলে আমাদের নাবালক গণতন্ত্র বারবার হুমকির মুখে পড়ছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভয়াবহ নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অন্যান্য ইতিবাচক কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার যে দুর্লভ সুযোগ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে, তা হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের প্রধান দুই দলের বিরামহীন সংঘাতের রাজনীতির ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বারবার অযাচিত হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে।
দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের বড় দুই দলকে সংলাপের যে তাগিদ দিয়েছেন, তার লক্ষ্য মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিরসন করে আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আমাদের রাজনীতির অসুখকে ‘মতপার্থক্য’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই দিয়ে তা সারানোর চেষ্টা ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। কেননা, আমাদের রাজনীতির অসুখ কেবল মতপার্থক্যের মতো সর্দি-কাশির অসুখ নয়, আমাদের রাজনীতি প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘর্ষের ভয়ানক রোগে আক্রান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এই রোগ সারানোর প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পর পর চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিহিংসা ও সংঘর্ষ রোগের কোনো উপশম এর দ্বারা হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয় না।
দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলিক কিছু প্রশ্নে গুরুতর মতবিরোধ রয়েছে, যা অহর্নিশ ভয়াবহ রাজনৈতিক বিভক্তি সৃষ্টি করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আওয়ামী লীগ মনে করে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে জড়িত ছিল। আর এই দলের কয়েকজন নেতা প্রত্যক্ষভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন বা এরূপ অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বিএনপি তা মনে করে না। উপরন্তু বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করেছে ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মনে করে, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে তাদের অন্তত চারজনকে মন্ত্রী বানিয়েছে। আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তারেক রহমানসহ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতারা জড়িত। কিন্তু বিএনপি মনে করে, তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি ভাবধারা ও তাহজীব-তমদ্দুন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করেছেন। আর এ প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্যে ফাটল ধরানোসহ ভয়ানক ক্ষতি করেছেন। কিন্তু বিএনপি এর বিন্দুবিসর্গও মানতে নারাজ। অধিকন্তু বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ ভারতীয় রাজনীতির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত এবং বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। এসব মতবিরোধ প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্রমাগতভাবে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘাতের বীজ বপন করে চলেছে। মৌলিক মতবিরোধের বিষয়ে আলোচনা এবং এ ক্ষেত্রে দূরত্ব কমিয়ে আনা ব্যতিরেকে কেবল তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন ফর্মুলার মাধ্যমে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘর্ষের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের আশা সুদূর পরাহত। এ বিষয়ে আমার এক বন্ধু সহকর্মী একটি মজার কথা বলেছেন। ধরা যাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করল। আর আওয়ামী লীগকে বিএনপি সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলো। এবার বিএনপি আওয়ামী লীগ আমলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় করা মামলার বদলা নিতে দ্রুত বিচার আইনকে ‘অতি দ্রুত বিচার আইন’-এ পরিবর্তন করবে। আর জামিন অযোগ্য ধারাকে ‘খালাস অযোগ্য’ ধারায় পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবে। এভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী (!) প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও একধাপ এগিয়ে যাবে অনুমান করা যায়।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির কারণে আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের সময় ও মেধার একটি বড় অংশ জনকল্যাণের পরিবর্তে জনদুর্ভোগে ব্যয় হচ্ছে। আশঙ্কার কথা হলো সংঘাত, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি এখন আর কেবল রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি দলের গণ্ডি পেরিয়ে সংসদ, শিক্ষাঙ্গন, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনসহ সুশাসন ও আইনের শাসনের হূৎপিণ্ডসম প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আর গোটা জাতিকে এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বেসামরিক প্রশাসনের কথাই ধরা যাক। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিদায়ী সরকারের প্রীতিভাজন সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো বা ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ওএসডি কর্মকর্তারা চাকরিতে বহাল থেকেও অসহায় ও অলস জীবন যাপন করতে থাকেন, আর সরকারের সুনজরে থাকা কর্মকর্তারা রাতারাতি ক্ষমতার প্রতিভূতে পরিণত হয়ে যান। অনেকেই আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এভাবেই আমাদের সংঘর্ষের রাজনীতি সুশাসনের চালিকাশক্তি আমলাতন্ত্রকেও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।
সংঘাত, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণশক্তিকে অবিরাম নিঃশেষ করে চলেছে। দেশকে ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে এ থেকে আমাদের মুক্ত হতেই হবে। কেবল তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই দিয়ে সংঘর্ষের রাজনীতির অসুখ নিরাময়ের সুযোগ নেই। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভক্তির উভয় পাশে থাকা মৌলিক মতবিরোধের বিষয়েও সংলাপ জরুরি।
মো. জাকির হোসেন: আইন অনুষদের ডিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
zhossain@justice.com
প্রিয় পাঠক, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও তপ্ত হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আসন্ন সংঘাতের বিষয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ প্রকাশ শুরু হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতপার্থক্য দূর করতে সরকার ও বিরোধী দলকে সংযত আচরণ করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদে ও সংসদের বাইরে সংলাপে বসার জন্য নিয়মিতভাবে দেশি-বিদেশি পরামর্শ শোনা যাচ্ছে। বিএনপি সংলাপে যাওয়ার শর্তযুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। সংলাপে বসার আগেই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের লিখিত ঘোষণা দিতে হবে বলে বিরোধীদলীয় নেত্রী শর্তারোপ করেছেন। ১২ মার্চের মহাসমাবেশ থেকে ঘোষিত আল্টিমেটাম অনুযায়ী ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল না হলে দেশে ভয়াবহ সংঘাতের পরিণতি সৃষ্টি হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার হুঁশিয়ার উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ডেড ইস্যু, এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতের রাজনীতির ফলে আমাদের নাবালক গণতন্ত্র বারবার হুমকির মুখে পড়ছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভয়াবহ নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অন্যান্য ইতিবাচক কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার যে দুর্লভ সুযোগ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে, তা হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের প্রধান দুই দলের বিরামহীন সংঘাতের রাজনীতির ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বারবার অযাচিত হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে।
দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের বড় দুই দলকে সংলাপের যে তাগিদ দিয়েছেন, তার লক্ষ্য মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত মতপার্থক্য নিরসন করে আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আমাদের রাজনীতির অসুখকে ‘মতপার্থক্য’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই দিয়ে তা সারানোর চেষ্টা ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। কেননা, আমাদের রাজনীতির অসুখ কেবল মতপার্থক্যের মতো সর্দি-কাশির অসুখ নয়, আমাদের রাজনীতি প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘর্ষের ভয়ানক রোগে আক্রান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এই রোগ সারানোর প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পর পর চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিহিংসা ও সংঘর্ষ রোগের কোনো উপশম এর দ্বারা হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয় না।
দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলিক কিছু প্রশ্নে গুরুতর মতবিরোধ রয়েছে, যা অহর্নিশ ভয়াবহ রাজনৈতিক বিভক্তি সৃষ্টি করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আওয়ামী লীগ মনে করে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে জড়িত ছিল। আর এই দলের কয়েকজন নেতা প্রত্যক্ষভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন বা এরূপ অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বিএনপি তা মনে করে না। উপরন্তু বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করেছে ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মনে করে, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে তাদের অন্তত চারজনকে মন্ত্রী বানিয়েছে। আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তারেক রহমানসহ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতারা জড়িত। কিন্তু বিএনপি মনে করে, তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি ভাবধারা ও তাহজীব-তমদ্দুন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করেছেন। আর এ প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্যে ফাটল ধরানোসহ ভয়ানক ক্ষতি করেছেন। কিন্তু বিএনপি এর বিন্দুবিসর্গও মানতে নারাজ। অধিকন্তু বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ ভারতীয় রাজনীতির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত এবং বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। এসব মতবিরোধ প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্রমাগতভাবে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘাতের বীজ বপন করে চলেছে। মৌলিক মতবিরোধের বিষয়ে আলোচনা এবং এ ক্ষেত্রে দূরত্ব কমিয়ে আনা ব্যতিরেকে কেবল তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন ফর্মুলার মাধ্যমে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও সংঘর্ষের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের আশা সুদূর পরাহত। এ বিষয়ে আমার এক বন্ধু সহকর্মী একটি মজার কথা বলেছেন। ধরা যাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করল। আর আওয়ামী লীগকে বিএনপি সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলো। এবার বিএনপি আওয়ামী লীগ আমলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় করা মামলার বদলা নিতে দ্রুত বিচার আইনকে ‘অতি দ্রুত বিচার আইন’-এ পরিবর্তন করবে। আর জামিন অযোগ্য ধারাকে ‘খালাস অযোগ্য’ ধারায় পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবে। এভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী (!) প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও একধাপ এগিয়ে যাবে অনুমান করা যায়।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির কারণে আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের সময় ও মেধার একটি বড় অংশ জনকল্যাণের পরিবর্তে জনদুর্ভোগে ব্যয় হচ্ছে। আশঙ্কার কথা হলো সংঘাত, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি এখন আর কেবল রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি দলের গণ্ডি পেরিয়ে সংসদ, শিক্ষাঙ্গন, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনসহ সুশাসন ও আইনের শাসনের হূৎপিণ্ডসম প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আর গোটা জাতিকে এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বেসামরিক প্রশাসনের কথাই ধরা যাক। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিদায়ী সরকারের প্রীতিভাজন সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো বা ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ওএসডি কর্মকর্তারা চাকরিতে বহাল থেকেও অসহায় ও অলস জীবন যাপন করতে থাকেন, আর সরকারের সুনজরে থাকা কর্মকর্তারা রাতারাতি ক্ষমতার প্রতিভূতে পরিণত হয়ে যান। অনেকেই আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এভাবেই আমাদের সংঘর্ষের রাজনীতি সুশাসনের চালিকাশক্তি আমলাতন্ত্রকেও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।
সংঘাত, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণশক্তিকে অবিরাম নিঃশেষ করে চলেছে। দেশকে ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে এ থেকে আমাদের মুক্ত হতেই হবে। কেবল তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই দিয়ে সংঘর্ষের রাজনীতির অসুখ নিরাময়ের সুযোগ নেই। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভক্তির উভয় পাশে থাকা মৌলিক মতবিরোধের বিষয়েও সংলাপ জরুরি।
মো. জাকির হোসেন: আইন অনুষদের ডিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
zhossain@justice.com
No comments