আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৭)-এক আদর্শের ছায়াতলে by আলী যাকের

জীবন থেমে থাকে না। থাকেনি আমার জন্যও। যখন বুঝতে পারলাম যে শেষ পর্যন্ত আমি সত্যিকারার্থেই একজন শব্দসৈনিক হয়ে উঠেছি, আমার পক্ষে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে যাওয়া আর সম্ভব নয়, তখন সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করলাম নিজের কাজে।


প্রতিদিন আমার মতো এই অধমের কলম দিয়েও বেরিয়ে আসতে লাগল অগি্নঝরা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক ভাষ্য। ছুটে বেড়াতে লাগলাম সংবাদ কিংবা সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত প্রতিটি সেক্টরে। রাতের ঘুম, দিনের খাওয়া অনেক সময় উপেক্ষিতই থেকে যেত। তা নিয়ে কোনো চিন্তা হয়নি কখনো। মুক্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং মুক্তির লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে দ্বিধাহীনভাবে। এই হয়ে গিয়েছিল মূলমন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঢাকা থেকে একটি ইংরেজি দৈনিক বের হতো, যার নাম ছিল দ্য পিপল। এই দৈনিকটির সম্পাদক আবেদুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। ২৫শে মার্চ রাতে শাহবাগ অঞ্চলে অবস্থিত দ্য পিপলের অফিসে গোলাবর্ষণ করে আগুন ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানি আর্মি। ঠিক একই দুষ্কর্ম করেছিল তারা ইত্তেফাক ও সংবাদ পত্রিকায়ও। দ্য পিপলের সম্পাদক আবেদুর রহমান সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় এসে ঠাঁই নেন। কলকাতার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের একটি প্রেস থেকে সাপ্তাহিক পিপল নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যদিও কলকাতায় ছাপা, সম্পাদকীয় অফিস কলকাতায়, তবু এটি বাংলাদেশি পত্রিকা হিসেবেই পরিচিত হয়ে যায়। আবেদুর রহমানের আহ্বানে আমি সাপ্তাহিক পিপলেও উপসম্পাদকীয় লিখতে শুরু করি। এ ছাড়া বিদেশি অভ্যাগতরা যখন কলকাতা সফরে আসতেন, বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে খবরাখবর নিতেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে আমি ছাপিয়েছি এই পত্রিকায়।
এ সময় আমার দুটি বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। তার প্রথমটি হলো, মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে নিয়ে কলকাতার অদূরে সল্টলেকের শরণার্থীশিবিরে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির সংসদ সদস্য জন স্টোনহাউসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ। এসব কাজে বলাই বাহুল্য প্রচণ্ড আনন্দ পেয়েছি আমি। এ ছাড়া আরো একটি কাজ আমাকে করতে হতো। তখন প্রায় প্রতি মাসে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের একটি ভাষণ জাতির উদ্দেশে সম্প্রচার করা হতো আমাদের বেতার থেকে। আমার দায়িত্ব ছিল ভাষণটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁর হয়ে বেতারে পাঠ করা। আমি এই একই কাজ আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্যও করেছি। এই কাজগুলো ছিল আমার জন্যই বরাদ্দ। অসাধারণ বক্তৃতা লিখতেন দুজনই এবং তাঁদের প্রতিটি বাক্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরের প্রায় বন্দিদশায় থাকা সব মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। এ সময় আমার সুযোগ হয়েছিল মাঝেমধ্যে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার। তাঁর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সততা ও মেধা আমাকে চমৎকৃত করত। কোনো একটি বিষয় তাঁর চোখ এড়িয়ে যেতে দেখিনি। শেকসপিয়ার সরণিতে বাংলাদেশ সরকারকে একটি ভবন দেওয়া হয়। ওই ভবনের একটি কামরায় ছিল তাজউদ্দীন আহমদের অফিস। তিনি ওই ছোট্ট কামরায়ই রাত যাপন করতেন। আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে তাঁকে দেখা গেছে খাকি পোশাক পরা, মাথায় গিয়াপ ক্যাপ, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করছেন। বস্তুত একটি বিষয়, যা আমাদের সামগ্রিক সাফল্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছিল, তা হচ্ছে আমাদের তখনকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শ। তাঁর যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের সময় নির্দেশ ছিল- যাঁকে যে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, তিনি সেই কাজটিই যথাসাধ্য আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পাদন করবেন। এই জন্য গ্রামের কৃষক ভাই অস্ত্রহাতে মাটি কামড়ে ধরে শত্রুকে মোকাবিলা করেছেন এবং আমি হেন নগণ্য ব্যক্তিও একটি বিদেশি ভাষায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটি বিভাগ পরিচালনা করেছি। আমরা সবাই নিজ নিজ কাজে ও উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ নিবেদিত ছিলাম। ডানে-বাঁয়ে কখনো তাকাইনি। আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে একটি বদভ্যাস আমি লক্ষ করেছি। তারা নিজেদের কার্যকারণ সম্পর্কে কখনোই কোনো ধারণা রাখে না। ফলে নিজের করণীয় কাজকে অনেক সময় উপেক্ষা করে। যা নিয়ে চিন্তা করার তার কোনো কারণ নেই, সেই অপকর্মেই বেশি আগ্রহ দেখায়। ওই শ্রেণীর অনেক বাঙালি তখন প্রাণভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাঁদের কাজই ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অথবা সরকারের বাইরের বিভিন্ন রাজনীতিবিদের ছিদ্র অন্বেষণ করা। আমাকে এ রকম অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন- 'শুনলাম, অমুক নেতাকে নাকি কাল মাঝরাতে কলকাতার কোনো পানশালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে?' যেহেতু আমি আমার কাজ নিয়ে দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা কাটাতাম, আমার সময় ছিল না ওই সব খবর রাখার। প্রবৃত্তিও ছিল না। আমি তাঁদের হতাশ করে দিয়ে বলতাম, 'আমি জানি না।'
প্রসঙ্গত যে কথাটি বলছিলাম, আমাদের প্রবাসজীবনে, এমনকি দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি বাঙালি, অতি ক্ষুদ্র সংখ্যার দালাল ছাড়া, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁদের নিজের কাজ করে গেছেন একাগ্রভাবে। একটি জাতি যখন এ ধরনের আদর্শের ছায়াতলে সমবেত হয় একটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, তখন তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। এবং সে কারণেই আমাদের যুদ্ধজয় এত সহজ হয়েছে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.