নজরুলজয়ন্তী-কাব্যগুণ ও সুরের আবহ by মোঃ আশ্রাফুল করিম
নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা আরও বিস্ময়করভাবে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে তার রচিত বাউল, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ঝাপান, কাজরি, ছাদ পেটানো গান, গণসঙ্গীত, মেয়েলি গীত, ঘুমপাড়ানি গান, রাখালি গান, মাঝির গান, লোকগান, গ্রাম্যসঙ্গীত, স্বদেশীগান, ভক্তিসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন,
শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত প্রভৃতি নানা শ্রেণীর গানের মাধ্যমে
কাজী নজরুল ইসলামের প্রধানতম পরিচয় কবি হলেও তার বৈচিত্র্যধর্মী সৃষ্টিসম্ভারে বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক, গীতালেখ্য ও গীতিনাট্য রচয়িতা, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গায়ক, বাদক, সঙ্গীত পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক, পত্রিকা পরিচালক, অভিনেতা, বাগ্মী, আবৃত্তিকার, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যাকাশে একমাত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত বিচিত্র প্রতিভাবান সাহিত্যস্রষ্টা তৃতীয় আর কেউ নেই।
নজরুলকে এক অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেক গবেষকের মতে, তিনি প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার গানের রচয়িতা। সংখ্যা ও মানের দিক থেকে বাংলা গানের ক্ষেত্রে তো বটেই, বিশ্ব সঙ্গীতের ইতিহাসে এ এক অনন্য রেকর্ড হয়ে থাকবে।
১৯২৮ সালের প্রথম থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত নজরুলসঙ্গীত রচনা করেছেন নিরলসভাবে। ১৯৪২ সালের শুরু থেকেই তার আর সঙ্গীত রচনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কেননা এ সময়েই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ ক'বছরে চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বেতার ও রেকর্ড কোম্পানিকে কেন্দ্র করে নজরুল যে অজস্র গান রচনা করেন তা শুধু অকল্পনীয় নয়, অসাধ্যসাধন বললে অত্যুক্তি হবে না। মন্মথ রায়ের 'মহুয়া' ও 'লায়লী মজনু', শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা', মনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জাহাঙ্গীর' ও 'অন্নপূর্ণা' প্রভৃতি নাটকের প্রয়োজনে তিনি অনেক গান লিখেছেন। এছাড়া 'দিকশূল', চৌরঙ্গী', 'নন্দিনী', 'পাতালপুরী', চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি বাণীচিত্রের জন্য নজরুল অনেক গান রচনা করেছেন। প্রাচীন সঙ্গীত ও শাস্ত্রাদি বিষয়ে নজরুলের ব্যাপক আগ্রহ ও গবেষণা উপরন্তু ওস্তাদ কাদের বখ্শ, দবীর খাঁ, মঞ্জু সাহেব, পিয়ারা সাহেব, ওস্তাদ জমীরউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বদল খাঁ প্রমুখ তৎকালীন প্রখ্যাত সঙ্গীত মনীষীর কাছ থেকে তালিম এবং একান্ত সাহচর্য, সর্বোপরি গভীর অনুসন্ধিৎসু মন তাকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক টইটম্বুর ভাণ্ডারের সন্ধান দিয়েছিল। ফলে অধুনালুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগরাগিণীগুলো পুনরুদ্ধার ও চর্চার মতো কষ্টসাধ্য সাধনায় নজরুল নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন এবং অভাবনীয় সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে তার পক্ষে প্রায় ২০টি নতুন রাগ এবং প্রায় ১২টি নতুন তাল সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল। এদিক দিয়েও নজরুল এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীল সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তৎকালে কলকাতা বেতারে প্রচারিত বহুল প্রশংসিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় 'হারামণি', 'নবরাগ-মালিকা' ও গীতি-বিচিত্রা' নামে তিনটি নিয়মিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নজরুল এসব উদ্ভাসিত নব প্রবর্তিত ক্ল্যাসিক্যাল রাগরাগিণীর সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। তার উদ্ভাসিত নতুন রাগে রচিত গানের মধ্যে উলেল্গখযোগ্য_ পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বলে (ললিত), আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায় (দরবারি কানাড়া), শূন্য এ বুকে পাখী মোর (ছায়ানট), একি তন্দ্রা বিজড়িত আঁখিপাত (মালাকোষ), অনিমেষ আঁখি আমার (বাগেশ্রী), অঞ্জলি লহ মোর (তিলং), কেন করুণ সুরে হৃদয়পুরে বাজিছে বাঁশরী (দেশ-সুরট), কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া (খাম্বাজমিশ্র) প্রভৃতি।
উল্লেখ্য, নজরুল গজল দিয়ে সঙ্গীত জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন, কৃষ্ণনগরে থাকাকালে নিদারুণ অর্থকষ্টে যখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে তখনই দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। সামান্য টাকার জন্য প্রায়ই তাকে প্রকাশক ও বন্ধুদের শরণাপন্ন হতে হতো। তখনই বিদ্রোহী কবি, বীর রসের কবি নজরুল সৃষ্টি করলেন কোমল মধুর রসের গজল গান। এর ফলে বাঙালি শ্রোতৃসমাজ এক নতুন সুরের আবহে আন্দোলিত হলো। পারস্যের সাকি, সরাই, পেয়ালা, গুল, গুলবাগ, বুলবুল বাংলা গানের বাণীকে এক উচ্চতর মার্গে উপনীত করে দিয়ে বিদ্রোহী কবি যেন অন্য একরূপে প্রতিভাত হলেন উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে। তৎকালীন দেশখ্যাত গায়ক-গায়িকারা এই নবসৃষ্ট গজল গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিলেন অন্য এক শিহরণ জাগানো অনুভূতিতে। ফলে নজরুল যেন গজল গানের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতের এক নতুন রাজ্যে অবগাহন করলেন চিরঞ্জীব মহিমা নিয়ে, পাশাপাশি শ্রোতৃসমাজের হৃদয়েও চিরস্থায়ী আসন লাভ করলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমগ্র উত্তর ভারতের সর্বত্র গজল-গীত, না'ত ও কাওয়ালি, কাজরি ও হোরিবর্গের একজন জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পারসিক গজলের আদলে সুর করা তার বিখ্যাত গজল গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : করুণ কেন অরুণ আঁখি, বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল, এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনল বল কে, চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না ওই নয়ন বাণে, কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি প্রভৃতি। নজরুলের গজল গানগুলো আজও সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে।
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে নজরুল স্বাদেশিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অসহযোগ, খেলাফত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রভাবে এতই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে নজরুল স্বদেশী সুর ও ঢঙে অনেক উদ্দীপনামূলক ও দেশপ্রেমমূলক গান রচনা করেছেন। এ সময় রচিত গানের মধ্যে অন্যতম_ শিকল পরা ছল মোদের শিকল পরা ছল (বিষের বাঁশী), কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট (ভাঙার গান), ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর ক'ষে লাঙল (কৃষাণের গান), ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি (শ্রমিকের গান), দুর্গম গিরি কান্তার মরু (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার), আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্রদল (ছাত্রদলের গান), জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত (অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত), জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা (নারী জাগরণের গান), ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী তল (কুচকাওয়াজের গান), মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান (সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান) প্রভৃতি। বাংলা লোকসঙ্গীতের একটা উল্লেখ্যযোগ্য ধারা হলো ভাটিয়ালি। অর্থাৎ নদীতে ভাটির স্রোতে নৌকা প্রবাহিত হওয়ার সময় গীত হওয়ার কারণে এর নাম হয়েছে ভাটিয়ালি এবং এ গান যে সুরে গাওয়া তার নামও ভাটিয়ালি। নজরুলের ভাটিয়ালি সুরে রচিত পদ্মার ঢেউ রে, ও মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে, চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে, একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা প্রভৃতি গান রীতিমতো ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিসম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা আরও বিস্ময়করভাবে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে তার রচিত বাউল, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ঝাপান, কাজরি, ছাদ পেটানো গান, গণসঙ্গীত, মেয়েলি গীত, ঘুমপাড়ানি গান, রাখালি গান, মাঝির গান, লোকগান, গ্রাম্যসঙ্গীত, স্বদেশীগান, ভক্তিসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত প্রভৃতি নানা শ্রেণীর গানের মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ্য, আধুনিক বাংলা গানের সমকালীন সেরা কণ্ঠশিল্পী আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, কমল দাশগুপ্ত, শচীন দেববর্মণ, চিত্ত রায়, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ এসব গানকে গ্রামোফোন ডিস্কে অমর করে রেখে গেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রাকৃত মাত্রাচ্ছন্দে কিছু গান লিখলেও সংস্কৃত বৃত্তচ্ছন্দে একমাত্র নজরুল ছাড়া আর কেউ বাংলা গান লিখেননি। এদিক দিয়েও নজরুল এক অলৌকিক সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে নজরুলকে বাংলা গানের জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উৎকৃষ্ট কাব্যগুণ আর সুরের সমন্বয়ে তার গানগুলো হয়ে উঠেছে রসের এক চিরন্তন উৎস।
ড. মোঃ আশ্রাফুল করিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
কাজী নজরুল ইসলামের প্রধানতম পরিচয় কবি হলেও তার বৈচিত্র্যধর্মী সৃষ্টিসম্ভারে বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক, গীতালেখ্য ও গীতিনাট্য রচয়িতা, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গায়ক, বাদক, সঙ্গীত পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক, পত্রিকা পরিচালক, অভিনেতা, বাগ্মী, আবৃত্তিকার, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যাকাশে একমাত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত বিচিত্র প্রতিভাবান সাহিত্যস্রষ্টা তৃতীয় আর কেউ নেই।
নজরুলকে এক অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেক গবেষকের মতে, তিনি প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার গানের রচয়িতা। সংখ্যা ও মানের দিক থেকে বাংলা গানের ক্ষেত্রে তো বটেই, বিশ্ব সঙ্গীতের ইতিহাসে এ এক অনন্য রেকর্ড হয়ে থাকবে।
১৯২৮ সালের প্রথম থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত নজরুলসঙ্গীত রচনা করেছেন নিরলসভাবে। ১৯৪২ সালের শুরু থেকেই তার আর সঙ্গীত রচনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কেননা এ সময়েই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ ক'বছরে চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বেতার ও রেকর্ড কোম্পানিকে কেন্দ্র করে নজরুল যে অজস্র গান রচনা করেন তা শুধু অকল্পনীয় নয়, অসাধ্যসাধন বললে অত্যুক্তি হবে না। মন্মথ রায়ের 'মহুয়া' ও 'লায়লী মজনু', শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা', মনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জাহাঙ্গীর' ও 'অন্নপূর্ণা' প্রভৃতি নাটকের প্রয়োজনে তিনি অনেক গান লিখেছেন। এছাড়া 'দিকশূল', চৌরঙ্গী', 'নন্দিনী', 'পাতালপুরী', চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি বাণীচিত্রের জন্য নজরুল অনেক গান রচনা করেছেন। প্রাচীন সঙ্গীত ও শাস্ত্রাদি বিষয়ে নজরুলের ব্যাপক আগ্রহ ও গবেষণা উপরন্তু ওস্তাদ কাদের বখ্শ, দবীর খাঁ, মঞ্জু সাহেব, পিয়ারা সাহেব, ওস্তাদ জমীরউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বদল খাঁ প্রমুখ তৎকালীন প্রখ্যাত সঙ্গীত মনীষীর কাছ থেকে তালিম এবং একান্ত সাহচর্য, সর্বোপরি গভীর অনুসন্ধিৎসু মন তাকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক টইটম্বুর ভাণ্ডারের সন্ধান দিয়েছিল। ফলে অধুনালুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগরাগিণীগুলো পুনরুদ্ধার ও চর্চার মতো কষ্টসাধ্য সাধনায় নজরুল নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন এবং অভাবনীয় সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে তার পক্ষে প্রায় ২০টি নতুন রাগ এবং প্রায় ১২টি নতুন তাল সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল। এদিক দিয়েও নজরুল এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীল সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তৎকালে কলকাতা বেতারে প্রচারিত বহুল প্রশংসিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় 'হারামণি', 'নবরাগ-মালিকা' ও গীতি-বিচিত্রা' নামে তিনটি নিয়মিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নজরুল এসব উদ্ভাসিত নব প্রবর্তিত ক্ল্যাসিক্যাল রাগরাগিণীর সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। তার উদ্ভাসিত নতুন রাগে রচিত গানের মধ্যে উলেল্গখযোগ্য_ পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বলে (ললিত), আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায় (দরবারি কানাড়া), শূন্য এ বুকে পাখী মোর (ছায়ানট), একি তন্দ্রা বিজড়িত আঁখিপাত (মালাকোষ), অনিমেষ আঁখি আমার (বাগেশ্রী), অঞ্জলি লহ মোর (তিলং), কেন করুণ সুরে হৃদয়পুরে বাজিছে বাঁশরী (দেশ-সুরট), কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া (খাম্বাজমিশ্র) প্রভৃতি।
উল্লেখ্য, নজরুল গজল দিয়ে সঙ্গীত জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন, কৃষ্ণনগরে থাকাকালে নিদারুণ অর্থকষ্টে যখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে তখনই দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। সামান্য টাকার জন্য প্রায়ই তাকে প্রকাশক ও বন্ধুদের শরণাপন্ন হতে হতো। তখনই বিদ্রোহী কবি, বীর রসের কবি নজরুল সৃষ্টি করলেন কোমল মধুর রসের গজল গান। এর ফলে বাঙালি শ্রোতৃসমাজ এক নতুন সুরের আবহে আন্দোলিত হলো। পারস্যের সাকি, সরাই, পেয়ালা, গুল, গুলবাগ, বুলবুল বাংলা গানের বাণীকে এক উচ্চতর মার্গে উপনীত করে দিয়ে বিদ্রোহী কবি যেন অন্য একরূপে প্রতিভাত হলেন উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে। তৎকালীন দেশখ্যাত গায়ক-গায়িকারা এই নবসৃষ্ট গজল গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিলেন অন্য এক শিহরণ জাগানো অনুভূতিতে। ফলে নজরুল যেন গজল গানের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতের এক নতুন রাজ্যে অবগাহন করলেন চিরঞ্জীব মহিমা নিয়ে, পাশাপাশি শ্রোতৃসমাজের হৃদয়েও চিরস্থায়ী আসন লাভ করলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমগ্র উত্তর ভারতের সর্বত্র গজল-গীত, না'ত ও কাওয়ালি, কাজরি ও হোরিবর্গের একজন জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পারসিক গজলের আদলে সুর করা তার বিখ্যাত গজল গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : করুণ কেন অরুণ আঁখি, বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল, এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনল বল কে, চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না ওই নয়ন বাণে, কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি প্রভৃতি। নজরুলের গজল গানগুলো আজও সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে।
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে নজরুল স্বাদেশিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অসহযোগ, খেলাফত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রভাবে এতই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে নজরুল স্বদেশী সুর ও ঢঙে অনেক উদ্দীপনামূলক ও দেশপ্রেমমূলক গান রচনা করেছেন। এ সময় রচিত গানের মধ্যে অন্যতম_ শিকল পরা ছল মোদের শিকল পরা ছল (বিষের বাঁশী), কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট (ভাঙার গান), ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর ক'ষে লাঙল (কৃষাণের গান), ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি (শ্রমিকের গান), দুর্গম গিরি কান্তার মরু (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার), আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্রদল (ছাত্রদলের গান), জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত (অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত), জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা (নারী জাগরণের গান), ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী তল (কুচকাওয়াজের গান), মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান (সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান) প্রভৃতি। বাংলা লোকসঙ্গীতের একটা উল্লেখ্যযোগ্য ধারা হলো ভাটিয়ালি। অর্থাৎ নদীতে ভাটির স্রোতে নৌকা প্রবাহিত হওয়ার সময় গীত হওয়ার কারণে এর নাম হয়েছে ভাটিয়ালি এবং এ গান যে সুরে গাওয়া তার নামও ভাটিয়ালি। নজরুলের ভাটিয়ালি সুরে রচিত পদ্মার ঢেউ রে, ও মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে, চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে, একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা প্রভৃতি গান রীতিমতো ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিসম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা আরও বিস্ময়করভাবে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে তার রচিত বাউল, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ঝাপান, কাজরি, ছাদ পেটানো গান, গণসঙ্গীত, মেয়েলি গীত, ঘুমপাড়ানি গান, রাখালি গান, মাঝির গান, লোকগান, গ্রাম্যসঙ্গীত, স্বদেশীগান, ভক্তিসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত প্রভৃতি নানা শ্রেণীর গানের মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ্য, আধুনিক বাংলা গানের সমকালীন সেরা কণ্ঠশিল্পী আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, কমল দাশগুপ্ত, শচীন দেববর্মণ, চিত্ত রায়, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখ এসব গানকে গ্রামোফোন ডিস্কে অমর করে রেখে গেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রাকৃত মাত্রাচ্ছন্দে কিছু গান লিখলেও সংস্কৃত বৃত্তচ্ছন্দে একমাত্র নজরুল ছাড়া আর কেউ বাংলা গান লিখেননি। এদিক দিয়েও নজরুল এক অলৌকিক সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে নজরুলকে বাংলা গানের জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উৎকৃষ্ট কাব্যগুণ আর সুরের সমন্বয়ে তার গানগুলো হয়ে উঠেছে রসের এক চিরন্তন উৎস।
ড. মোঃ আশ্রাফুল করিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
No comments