বহে কাল নিরবধি-ভারতে মাওবাদীদের নেপথ্য কাহিনী by এম আবদুল হাফিজ
ভারতের সর্বাধিক সমৃদ্ধ লৌহ খনিতে ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রহরারত ছিল ক্যামোফ্লাজ ফ্যার্টিগ পরিহিত আর্মি প্রদত্ত স্বয়ংক্রিয় রাইফেলে সজ্জিত ১৬ সদস্য; যখন মাওবাদীদের একটি দুর্ধর্ষ দল তাদের আক্রমণ করে এবং বাইলাদিলা মাইনিং ফসপোরেসর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পালিয়ে যায় তখন জ্যোৎস্নাবিধৌত রাত হলেও গভীর অরণ্যের আচ্ছাদনে অদৃশ্য হয়ে যেতে তাদের কোনো অসুবিধাই হয়নি।
মাওবাদী গেরিলারা প্রহরীদের ওপর তাদের অটোম্যাটিক অস্ত্র ব্যবহার করে, যা প্রহরীদের ডিফেন্সের অবস্থান নেওয়ারই সুযোগ দেয়নি। প্রহরার এই প্রত্যন্ত আউট পোস্টটি কোনো নিকটবর্তী প্রধান শহর থেকে অন্তত এক ঘণ্টার ড্রাইভ কিন্তু আত্মরক্ষার নিমিত্তে গোলাগুলি বিনিময় বড়জোর কয়েক মিনিট মাত্র স্থায়ী হতে পেরেছে। সবশেষ হিসাব মতো প্রহরী দলের মাত্র আটজন এই গেরিলা আক্রমণে বেঁচেছিল।
এই প্রহরীরা শুধু ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মজুদ খনিজসম্পদই পাহারা দিচ্ছিল না, তারা খনিতে ব্যবহার্য বিস্ফোরকেরও প্রহরার দায়িত্বে ছিল। সেখানে মজুদ বিস্ফোরকের মধ্যে প্রধান ছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, যা পর্বত পার্শ্বকে প্রয়োজনমতো চূর্ণ করতে প্রয়োজন হয়; যাতে লৌহপিণ্ড সংগ্রহের জন্য আলগা করা সম্ভব হয়। যখন গেরিলা ও প্রহরীদের সংঘর্ষ থিতিয়ে আসে এবং বেঁচে যাওয়া প্রহরীরা প্রায় ২০০০ গ্রামবাসীকে পাকড়াও করে, যারা নাকি ভ্যানগার্ডদের কষ্ট সহকারে পরিবেষ্টনী দেয়ালে আরোহণের সময় তাদের পশ্চাতে লুকিয়ে ছিল। বলাবাহুল্য, গেরিলাদের ভ্যানগার্ডরা কমপাউন্ডে প্রবেশ করেই বিস্ফোরকের ম্যাগাজিনগুলো খালি করতে থাকে। এই গ্রামবাসীরা গেরিলাদের সাহায্যে সর্বমোট ২০ টন বিস্ফোরক তাদের পিঠে করে বহন করে। এই পরিমাণ বিস্ফোরক অন্তত এক যুগের জন্য মাওবাদীদের বিদ্রোহ জিইয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট বলে ধারণা করা হয়।
ভারতের প্রত্যন্ত একটি রাজ্য ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হামলার সাড়ে চার বছর পর এমন হামলায় ব্যবহার্য বিস্ফোরক দ্রব্যেও সারা দেশ ছেয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বিস্ফোরক বোমা হিসেবে ব্যবহারের জন্য ১০ পাউন্ডের কফির কৌটোতে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো ভরে তাকে বোমায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। কয় মাস আগে এক সাধারণ গ্রামবাসী এর দ্বারাই আধাসামরিক এবং বেসামরিক লোকে ভর্তি একটি বাস বাষ্পে পরিণত করতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে এমন আরেকটি বোমা রেলওয়ের একটি অংশকে উড়িয়ে দেয়। এগুলো দিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চলতে থাকে অ্যামবুশ বা ববিফাঁদ পাতার কাজ। বাইলাদিলা খনিতে মাওবাদী আক্রমণকে ওই সংগঠনটির বিরুদ্ধে ভারতের দীর্ঘদিনের স্ট্র্যাটেজিক দ্বন্দ্বে একটি উল্লেখযোগ্য পরাজয় মনে করা হয়।
মাত্র এক যুগ আগে এই বিদ্রোহীরা ভুলবশত প্রায়ই তাদেরকে তাদের পূর্বসূরিদের নামে অভিহিত করত। উল্লেখ্য, তারাই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নকশালবাড়ি গ্রামে ১৯৬৭ সালে এ বিদ্রোহের সূচনা করে। তবে সেই বিদ্রোহ বা আন্দোলনের ছক এখন প্রায় বিলীন। নকশালবাদীদের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ধারা এখন শুধু অকেজোই নয়, প্রাচীন ও সেকেলে। সেই বিপ্লবের কর্মীরাও আর অবশিষ্ট নেই। অতঃপর মাওবাদীদের অবয়বেই সেই বিপ্লবের উত্থান ঘটেছে_তাও কোনো অজপাড়াগাঁয়ে নয়, তারা ফিরে এসেছে ভারতের খনিজ অঞ্চলে, যার ওপর ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভরশীল! একটি নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীরা মার্কসবাদ, লেনিনবাদ এবং মাওবাদের তত্ত্ব থেকে বিপ্লবকে বের করে এনে ২১ শতকের উপযোগী করে সাজিয়েছে এবং তাদের ব্র্যান্ড নেম দিয়েছে 'কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মাওবাদী'। এই পুনর্গঠিত সংগঠনের এক মুখপাত্রের ভাষায়_তারা লিবারেলাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন এবং বিশ্বায়নের বিরোধী। যদিও এই মতবাদ ভারতের বাইরে অন্য কোথাও সামান্যই স্বীকৃতি পেয়েছে বা সাফল্য দেখেছে, কিন্তু ভারতে তা শুধু বিচ্ছিন্ন গ্রামীণ সহিংসতার প্রধান উৎসই নয়, গেরিলা যুদ্ধের এক সুসংগঠিত সংগঠন এবং কর্তৃপক্ষের জন্য রীতিমতো হুমকি। গত ১০ বছরে প্রায় ১০ হাজার লোক এদের হাতে নিহত হয়েছে এবং দেড় লক্ষাধিক লোক এদের গেরিলা তৎপরতার কারণে স্থায়ীভাবে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
সংবাদপত্র নিয়মিতভাবে গ্রিনহান্ট অপারেশনের সাফল্যগাথা অপারেশনে নিহত সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের ছবিসহ প্রকাশ করে। বাঁশের খণ্ডে লটকানো বিপ্লবীদের মৃতদেহ, তাদের কাছে প্রাপ্ত অতিরিক্ত হাতিয়ার ইত্যাদিসহ সংবাদপত্রে আসে সম্ভবত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিদ্রোহীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য। কিন্তু গ্রিনহান্ট অপারেশনে অনুসৃত নৃশংসতার নীতিরও প্রচুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। যদিও অনেকে আবার কর্তৃপক্ষের এই হার্ডলাইনের সমর্থক। আসলে মাওবাদী ইস্যু জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে।
তবে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। ২১ শতকের ভারতে, যে দেশটি ইতিমধ্যেই অন্তত ২০ বছর ধরে একটি দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। শুধু তাই নয়, দেশটি তো বিশ্বায়নের অন্যতম বিখ্যাত সাফল্য-কাহিনীর ধারক; সেই ১৯৯১ সাল থেকে, যখন ভারত প্রায় দেউলিয়াত্বের কিনারায়, আজকের মনমোহন সিংই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশটিকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় খাতের একচেটিয়া প্রাধান্যের সমাপ্তি টেনেছিলেন। রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন বিশাল ফার্মগুলোকে তিনি বাণিজ্যিক সংস্থারূপে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করেন।
আশ্চর্য নয় যে সেই ১৯৯১ সালের উদ্যোগের পরিণতিতে ভারতের জিডিপি আজ ওই সময়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের প্রধান শহরগুলো এখন সচ্ছল পেশাদার শ্রেণীতে পরিপূর্ণ। ঝকঝকে নতুন চার লেন বিশিষ্ট মহাসড়কে ততোধিক ঝকঝকে নতুন মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে তারা তাদের কাজে যায়_যে কাজগুলোর সংস্থান কিছু দিন আগেও ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা পশ্চাৎপদতার কারণে বিশ্বায়নের গতিবেগের সঙ্গে কদম মেলাতে না পেরে দেশের অগ্রগতির এই ধারা থেকে ছিটকে পড়েছে।
অর্থনীতির লিবারেলাইজেশনের ছোঁয়াই লাগেনি ভারতের সর্বনিম্ন স্তরের ২০০ মিলিয়ন মানুষের জীবনে। মনে রাখতে হবে যে ভারত সামাজিক স্তর বিন্যাসে এতটাই স্তরীভূত যে সমাজের অর্থনীতিই হোক বা অন্য কিছু, একটি সর্বজনীন চিত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন।
দিলি্ল, মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালুরুতে এখন চোখে ধাঁধা লাগানো কাচ ও ইস্পাতের সমন্বয়ে তৈরি তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্র। কিন্তু ভারতের বিশাল পশ্চাৎভূমি হতদরিদ্র। কিন্তু তা সর্বাধিক প্রকট ভারতের খনিজ অঞ্চলে, বিশেষ করে দেশের পূর্বাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ এলাকায়। এখানকার খনি থেকে আসে ইস্পাত; যা দিয়ে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন ভবন এবং চকচকে মোটরগাড়ি।
কেউ যদি আজকের মাও বিদ্রোহের নকশা মেলে ধরে এবং খনিজ কার্যক্রম, যা ভারতের সমৃদ্ধিতে গতিবেগ সঞ্চার করে, উভয়কেই একে অপরের সমান্তরাল দেখা যাবে। বিদ্রোহের এখনকার গ্রাউন্ড জিরো ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ড একে অপরের প্রতিবেশী দুটি পশ্চাৎপদ রাজ্য, যা দিলি্লর ৭৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বদিকে। রাজ্য দুটি আকার ও আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসের সমান। কিন্তু এখানে ৪৬ মিলিয়ন মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাস করে। ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড়ের খনিজ থেকে কর্তৃপক্ষের কোষাগারে ২০০৮ সালে এসেছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। এখনো উত্তোলিত হয়নি এমন খনিজের মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু এই ভূগর্ভস্থিত সম্পদের ব্যবস্থাপনা এত দায়িত্বহীনভাবে হয়েছে যে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়েছে স্থানীয়রা। গৃহচ্যুত এ মানুষগুলো আজ বেকার এবং খনিজ উত্তোলনে বিষাক্ত পরিবেশের শিকার। কেউ কি এদের ভালো-মন্দের কোনো খোঁজ কস্মিনকালে রাখে? ফলে যা অবশ্যম্ভাবী, সেটাই হয়েছে। এরা এদের ভাগ্য সঁপে দিয়েছে মাওবাদী বিদ্রোহীদের হাতে। মাওবাদীদের মতো এরাও এখন 'গ্রিন হান্টের' শিকার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
এই প্রহরীরা শুধু ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মজুদ খনিজসম্পদই পাহারা দিচ্ছিল না, তারা খনিতে ব্যবহার্য বিস্ফোরকেরও প্রহরার দায়িত্বে ছিল। সেখানে মজুদ বিস্ফোরকের মধ্যে প্রধান ছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, যা পর্বত পার্শ্বকে প্রয়োজনমতো চূর্ণ করতে প্রয়োজন হয়; যাতে লৌহপিণ্ড সংগ্রহের জন্য আলগা করা সম্ভব হয়। যখন গেরিলা ও প্রহরীদের সংঘর্ষ থিতিয়ে আসে এবং বেঁচে যাওয়া প্রহরীরা প্রায় ২০০০ গ্রামবাসীকে পাকড়াও করে, যারা নাকি ভ্যানগার্ডদের কষ্ট সহকারে পরিবেষ্টনী দেয়ালে আরোহণের সময় তাদের পশ্চাতে লুকিয়ে ছিল। বলাবাহুল্য, গেরিলাদের ভ্যানগার্ডরা কমপাউন্ডে প্রবেশ করেই বিস্ফোরকের ম্যাগাজিনগুলো খালি করতে থাকে। এই গ্রামবাসীরা গেরিলাদের সাহায্যে সর্বমোট ২০ টন বিস্ফোরক তাদের পিঠে করে বহন করে। এই পরিমাণ বিস্ফোরক অন্তত এক যুগের জন্য মাওবাদীদের বিদ্রোহ জিইয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট বলে ধারণা করা হয়।
ভারতের প্রত্যন্ত একটি রাজ্য ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হামলার সাড়ে চার বছর পর এমন হামলায় ব্যবহার্য বিস্ফোরক দ্রব্যেও সারা দেশ ছেয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বিস্ফোরক বোমা হিসেবে ব্যবহারের জন্য ১০ পাউন্ডের কফির কৌটোতে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো ভরে তাকে বোমায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। কয় মাস আগে এক সাধারণ গ্রামবাসী এর দ্বারাই আধাসামরিক এবং বেসামরিক লোকে ভর্তি একটি বাস বাষ্পে পরিণত করতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে এমন আরেকটি বোমা রেলওয়ের একটি অংশকে উড়িয়ে দেয়। এগুলো দিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চলতে থাকে অ্যামবুশ বা ববিফাঁদ পাতার কাজ। বাইলাদিলা খনিতে মাওবাদী আক্রমণকে ওই সংগঠনটির বিরুদ্ধে ভারতের দীর্ঘদিনের স্ট্র্যাটেজিক দ্বন্দ্বে একটি উল্লেখযোগ্য পরাজয় মনে করা হয়।
মাত্র এক যুগ আগে এই বিদ্রোহীরা ভুলবশত প্রায়ই তাদেরকে তাদের পূর্বসূরিদের নামে অভিহিত করত। উল্লেখ্য, তারাই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নকশালবাড়ি গ্রামে ১৯৬৭ সালে এ বিদ্রোহের সূচনা করে। তবে সেই বিদ্রোহ বা আন্দোলনের ছক এখন প্রায় বিলীন। নকশালবাদীদের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ধারা এখন শুধু অকেজোই নয়, প্রাচীন ও সেকেলে। সেই বিপ্লবের কর্মীরাও আর অবশিষ্ট নেই। অতঃপর মাওবাদীদের অবয়বেই সেই বিপ্লবের উত্থান ঘটেছে_তাও কোনো অজপাড়াগাঁয়ে নয়, তারা ফিরে এসেছে ভারতের খনিজ অঞ্চলে, যার ওপর ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভরশীল! একটি নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীরা মার্কসবাদ, লেনিনবাদ এবং মাওবাদের তত্ত্ব থেকে বিপ্লবকে বের করে এনে ২১ শতকের উপযোগী করে সাজিয়েছে এবং তাদের ব্র্যান্ড নেম দিয়েছে 'কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মাওবাদী'। এই পুনর্গঠিত সংগঠনের এক মুখপাত্রের ভাষায়_তারা লিবারেলাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন এবং বিশ্বায়নের বিরোধী। যদিও এই মতবাদ ভারতের বাইরে অন্য কোথাও সামান্যই স্বীকৃতি পেয়েছে বা সাফল্য দেখেছে, কিন্তু ভারতে তা শুধু বিচ্ছিন্ন গ্রামীণ সহিংসতার প্রধান উৎসই নয়, গেরিলা যুদ্ধের এক সুসংগঠিত সংগঠন এবং কর্তৃপক্ষের জন্য রীতিমতো হুমকি। গত ১০ বছরে প্রায় ১০ হাজার লোক এদের হাতে নিহত হয়েছে এবং দেড় লক্ষাধিক লোক এদের গেরিলা তৎপরতার কারণে স্থায়ীভাবে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
সংবাদপত্র নিয়মিতভাবে গ্রিনহান্ট অপারেশনের সাফল্যগাথা অপারেশনে নিহত সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের ছবিসহ প্রকাশ করে। বাঁশের খণ্ডে লটকানো বিপ্লবীদের মৃতদেহ, তাদের কাছে প্রাপ্ত অতিরিক্ত হাতিয়ার ইত্যাদিসহ সংবাদপত্রে আসে সম্ভবত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিদ্রোহীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য। কিন্তু গ্রিনহান্ট অপারেশনে অনুসৃত নৃশংসতার নীতিরও প্রচুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। যদিও অনেকে আবার কর্তৃপক্ষের এই হার্ডলাইনের সমর্থক। আসলে মাওবাদী ইস্যু জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে।
তবে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। ২১ শতকের ভারতে, যে দেশটি ইতিমধ্যেই অন্তত ২০ বছর ধরে একটি দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। শুধু তাই নয়, দেশটি তো বিশ্বায়নের অন্যতম বিখ্যাত সাফল্য-কাহিনীর ধারক; সেই ১৯৯১ সাল থেকে, যখন ভারত প্রায় দেউলিয়াত্বের কিনারায়, আজকের মনমোহন সিংই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশটিকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় খাতের একচেটিয়া প্রাধান্যের সমাপ্তি টেনেছিলেন। রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন বিশাল ফার্মগুলোকে তিনি বাণিজ্যিক সংস্থারূপে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করেন।
আশ্চর্য নয় যে সেই ১৯৯১ সালের উদ্যোগের পরিণতিতে ভারতের জিডিপি আজ ওই সময়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের প্রধান শহরগুলো এখন সচ্ছল পেশাদার শ্রেণীতে পরিপূর্ণ। ঝকঝকে নতুন চার লেন বিশিষ্ট মহাসড়কে ততোধিক ঝকঝকে নতুন মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে তারা তাদের কাজে যায়_যে কাজগুলোর সংস্থান কিছু দিন আগেও ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা পশ্চাৎপদতার কারণে বিশ্বায়নের গতিবেগের সঙ্গে কদম মেলাতে না পেরে দেশের অগ্রগতির এই ধারা থেকে ছিটকে পড়েছে।
অর্থনীতির লিবারেলাইজেশনের ছোঁয়াই লাগেনি ভারতের সর্বনিম্ন স্তরের ২০০ মিলিয়ন মানুষের জীবনে। মনে রাখতে হবে যে ভারত সামাজিক স্তর বিন্যাসে এতটাই স্তরীভূত যে সমাজের অর্থনীতিই হোক বা অন্য কিছু, একটি সর্বজনীন চিত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন।
দিলি্ল, মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালুরুতে এখন চোখে ধাঁধা লাগানো কাচ ও ইস্পাতের সমন্বয়ে তৈরি তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্র। কিন্তু ভারতের বিশাল পশ্চাৎভূমি হতদরিদ্র। কিন্তু তা সর্বাধিক প্রকট ভারতের খনিজ অঞ্চলে, বিশেষ করে দেশের পূর্বাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ এলাকায়। এখানকার খনি থেকে আসে ইস্পাত; যা দিয়ে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন ভবন এবং চকচকে মোটরগাড়ি।
কেউ যদি আজকের মাও বিদ্রোহের নকশা মেলে ধরে এবং খনিজ কার্যক্রম, যা ভারতের সমৃদ্ধিতে গতিবেগ সঞ্চার করে, উভয়কেই একে অপরের সমান্তরাল দেখা যাবে। বিদ্রোহের এখনকার গ্রাউন্ড জিরো ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ড একে অপরের প্রতিবেশী দুটি পশ্চাৎপদ রাজ্য, যা দিলি্লর ৭৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বদিকে। রাজ্য দুটি আকার ও আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসের সমান। কিন্তু এখানে ৪৬ মিলিয়ন মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাস করে। ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড়ের খনিজ থেকে কর্তৃপক্ষের কোষাগারে ২০০৮ সালে এসেছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। এখনো উত্তোলিত হয়নি এমন খনিজের মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু এই ভূগর্ভস্থিত সম্পদের ব্যবস্থাপনা এত দায়িত্বহীনভাবে হয়েছে যে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়েছে স্থানীয়রা। গৃহচ্যুত এ মানুষগুলো আজ বেকার এবং খনিজ উত্তোলনে বিষাক্ত পরিবেশের শিকার। কেউ কি এদের ভালো-মন্দের কোনো খোঁজ কস্মিনকালে রাখে? ফলে যা অবশ্যম্ভাবী, সেটাই হয়েছে। এরা এদের ভাগ্য সঁপে দিয়েছে মাওবাদী বিদ্রোহীদের হাতে। মাওবাদীদের মতো এরাও এখন 'গ্রিন হান্টের' শিকার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments