রাজনীতি-আবার টানেলে ঢুকে পড়ছি না তো? by সুভাষ সাহা
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য অবস্থানে চলে যায় এবং উভয় পক্ষই যদি এ থেকে লাভবান হবে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাহলেই বিপদ। সুতরাং আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের উচিত নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ গ্রহণ কর
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোর ডাকা ৩৬ ঘণ্টার হরতাল নিরুত্তাপভাবে পালিত হয়েছে। একই দাবিতে বিরোধী দল আবারও হরতালের ডাক দেবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। ওই হরতাল ৩ দিন থেকে কালক্রমে ৭ দিনে গড়াতে পারে। তারা রোডমার্চের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করার সম্ভাব্য সব আয়োজনই করা হচ্ছে। আর রাজনৈতিক উত্তেজনাকে কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিচ্ছেন সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তারা নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ের ওপর ভর করে এমন সব বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, যা রীতিমতো শিশুসুলভ ও হাস্যকর। এভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে হতে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে মীমাংসা বা আপসের অতীত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয় কি-না সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় থাকেন, সাধারণত তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ দেখা যায়। অন্যদিকে, যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা এই ব্যবস্থার কৌলীন্য রক্ষার দাবিতে সোচ্চার থাকেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারের সুযোগ খোঁজে সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই। আর ২০০৬ সালে তো বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে তখনকার বিরোধী দলের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও যার পূর্বে দলীয় রাজনীতি করার ইতিহাস রয়েছে সেই বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি ভুয়া ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছিল। তখন সংঘর্ষের রাজনীতির পরিণতিতে গোটা দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব হাতে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নজিরবিহীন। এভাবেই দেশের সরকার ও বিরোধী দলগুলো এক মীমাংসার অযোগ্য হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছিল। এমনি একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটেছিল ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। এরপর কী হয়েছিল তা সবার জানা। ৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর দেশ শাসন করে গেল। অথচ তত্ত্বাবধায়কের কর্মপরিধি অনুযায়ী এ সরকার দৈনন্দিন কার্য সম্পাদন ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। কিন্তু তারা সেসব রীতিনীতি মানেননি। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে, ওই সরকারের কাছ থেকে আমরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার আইডি কার্ড এবং তালিকা থেকে ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে নতুন ভোটার তালিকা পেয়েছিলাম। নির্বাচন কমিশনকেও আমরা বিগত নির্বাচনে মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নির্বাচনের জন্য দলীয় ব্যবস্থার চাইতে সাধারণ মানুষও গ্রহণযোগ্য মনে করে। তবে যেহেতু ইয়াজউদ্দিন এবং পরবর্তীকালে ফখরুদ্দীন সরকারের অভিজ্ঞতা মানুষের সামনে রয়েছে, তাই এ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার একটা জাতীয় তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব কিনা_ সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে।
সরকার পক্ষ যেমন বারবার বলছে যে, সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিয়েছে, তাই এ ব্যবস্থা বাতিলযোগ্য। হ্যাঁ, এটা ঠিক। কিন্তু রায়ের দ্বিতীয় অংশে সুপ্রিম কোর্ট এটাও বলেছেন যে, বাস্তব পরিস্থিতির স্বার্থে এই ব্যবস্থা আগামী আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বহাল রাখা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সংসদকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিষয়টি সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন আদালত। অর্থাৎ তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারে যুক্ত থাকার সুবাদে বিচার বিভাগ যাতে বিতর্কিত না হয়ে পড়ে, আদালত সেটা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন। তাই সংসদ তত্ত্ব্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে বাস্তব প্রয়োজনের ভিত্তিতে আরও একাধিক নির্বাচনের জন্য রেখে দিতে পারে। কয়টা মেয়াদের জন্য এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে_ সেটা নিশ্চয়ই আদালতের নয়, সংসদের এখতিয়ার। কারণ সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং এর সংযুক্ত কোনো ধারা মূল সাংবিধানিক কাঠামো ও স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা বিরুদ্ধ কি-না সে সম্পর্কে বলতে পারেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার সংবিধানই আদালতকে দেয়নি। আর সংবিধানে বর্ণিত স্পষ্ট সীমারেখাটি রাষ্ট্রের সব ক'টি শাখাকেই মেনে চলতে হয়। অন্যথায় সাংবিধানিক সংকটের উদ্ভব ঘটতে পারে। তবে আইন প্রণয়ন, এমনকি সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত সংসদের। সংবিধান এ ক্ষমতা আর কারও ওপর অর্পণ করেনি। সংসদ আদালতের রায় পর্যন্ত রহিত করতে পারে। শাহবানু খোরপোশ মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং জনস্বার্থে রাজীব গান্ধী সরকারের আমলে ওই রায় সংসদ কর্তৃক রহিত করার ঘটনা বিচার বিভাগ ও সংসদের এখতিয়ারকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের সরকারি দল বারবার এ ব্যাপারে বিচার বিভাগকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কেন?
এটা ঠিক যে, বিরোধী দল সংসদে এ ব্যাপারে সংশোধনী এনে বিতর্ককে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারত। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটেনি। বরং নির্বাচনের পর থেকে নানা বাহানায় তারা সংসদ থেকে বাইরে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের লাগাতার সংসদ বর্জনের রাজনীতি কি গ্রহণযোগ্য? এভাবে কি গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করা যায়? আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি কতটা দুর্বল তার প্রমাণ তো আমরা অসাংবিধানিক একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তেতো গেলার মতো হজম করতে বাধ্য হচ্ছি। আসলে এ দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রাথমিক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। বরং এ ব্যবস্থা তাদের পালাক্রমে দেশ শাসনের মৌরসি পাট্টা লাভের হাতিয়ার। আর এখানটাই যত গোলমাল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার দুই দলের কাছে কীভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে তা রীতিবিরুদ্ধ হলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন। প্রশ্ন আসে, ছোট রাজনৈতিক দলগুলো যদি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারত তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিকাশের পথ ধরতে সক্ষম হতো? কেউ কেউ বলতে পারেন যে, ভারত বা ফ্রান্সের মতো সরকার গঠনের জন্য অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বাঁধার বাধ্যবাধকতা থাকলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যা খুশি তা করার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হবে। তবে এ কারণে শরিকদের তুষ্ট করার নীতি নিতে হওয়ায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, দুর্নীতির খবর বেশি করে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এই জোট রাজনীতির কারণেই। তাছাড়া ফ্রান্সে তো এ ব্যবস্থা অনেক দিন ধরেই চলছে। তাদের ভালোই হয়েছে এতে। সে কারণে ফ্রান্সে আলোচনা-সমালোচনার দ্বার যতটা উন্মুক্ত ততটা অন্যত্র দেখা যায় না। কিন্তু আমাদের এখানে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল এতটাই শক্তিশালী যে, একমাত্র আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করা ছাড়া তাদের ক্ষমতার রাজনীতির জন্য অন্য দলের সাহায্য-সমর্থন প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। একমাত্র সামাজিক ও নতুন রাজনৈতিক চাহিদা সৃষ্টি করা গেলেই ছোট রাজনৈতিক দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করে ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। আর সে অবস্থা কি ফখরুদ্দীন সরকারের মতো আরেকটি অনির্বাচিত সরকার এসে করবে? এখানেই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের যত ভয় এখন।
কিন্তু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য অবস্থানে চলে যায় এবং উভয় পক্ষই যদি এ থেকে লাভবান হবে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাহলেই বিপদ। সুতরাং আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের উচিত নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ গ্রহণ করা। আর বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের পুরনো রাজনৈতিক কৌশল থেকে বিএনপির সরে আসা উচিত দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের স্বার্থেই। তাদের উভয়েরই সংসদের মধ্যে তাদের দলসহ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎকে চিন্তা করতে পারা উচিত। তা না হলে উভয় শক্তির অনমনীয় অবস্থানের কারণে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের উদ্ভব ঘটলে দেশে পুনরায় অসাংবিধানিক ব্যবস্থা এসে পড়াটা বিচিত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি যেমন বলেছেন, সেনাবাহিনী বুঝেছে যে রাজনৈতিক নেতাদের সরকার চালাতে দেওয়া উচিত. সেটা বাস্তব পরিস্থিতিতে উল্টেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অতীতের মতো টেকনোক্রেটদের সামনে না দিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেতে পারে। এভাবেই আমরা পুনরায় কোনো টানেলের ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। ইয়াজউদ্দিনের আমলের উপদেষ্টা অগ্রজ সাংবাদিক মাহবুবুল আলম টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে বলে জাতিকে সংকট উত্তরণে আশার বাণী শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করতেন সত্য; কিন্তু তাতে করে সংকট ঠেকানো যায়নি। সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে কি?
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় থাকেন, সাধারণত তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ দেখা যায়। অন্যদিকে, যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা এই ব্যবস্থার কৌলীন্য রক্ষার দাবিতে সোচ্চার থাকেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারের সুযোগ খোঁজে সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই। আর ২০০৬ সালে তো বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে তখনকার বিরোধী দলের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও যার পূর্বে দলীয় রাজনীতি করার ইতিহাস রয়েছে সেই বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি ভুয়া ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছিল। তখন সংঘর্ষের রাজনীতির পরিণতিতে গোটা দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব হাতে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যেটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নজিরবিহীন। এভাবেই দেশের সরকার ও বিরোধী দলগুলো এক মীমাংসার অযোগ্য হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছিল। এমনি একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটেছিল ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। এরপর কী হয়েছিল তা সবার জানা। ৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর দেশ শাসন করে গেল। অথচ তত্ত্বাবধায়কের কর্মপরিধি অনুযায়ী এ সরকার দৈনন্দিন কার্য সম্পাদন ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। কিন্তু তারা সেসব রীতিনীতি মানেননি। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে, ওই সরকারের কাছ থেকে আমরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার আইডি কার্ড এবং তালিকা থেকে ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে নতুন ভোটার তালিকা পেয়েছিলাম। নির্বাচন কমিশনকেও আমরা বিগত নির্বাচনে মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নির্বাচনের জন্য দলীয় ব্যবস্থার চাইতে সাধারণ মানুষও গ্রহণযোগ্য মনে করে। তবে যেহেতু ইয়াজউদ্দিন এবং পরবর্তীকালে ফখরুদ্দীন সরকারের অভিজ্ঞতা মানুষের সামনে রয়েছে, তাই এ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার একটা জাতীয় তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব কিনা_ সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে।
সরকার পক্ষ যেমন বারবার বলছে যে, সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিয়েছে, তাই এ ব্যবস্থা বাতিলযোগ্য। হ্যাঁ, এটা ঠিক। কিন্তু রায়ের দ্বিতীয় অংশে সুপ্রিম কোর্ট এটাও বলেছেন যে, বাস্তব পরিস্থিতির স্বার্থে এই ব্যবস্থা আগামী আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত বহাল রাখা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সংসদকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিষয়টি সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন আদালত। অর্থাৎ তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারে যুক্ত থাকার সুবাদে বিচার বিভাগ যাতে বিতর্কিত না হয়ে পড়ে, আদালত সেটা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন। তাই সংসদ তত্ত্ব্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে বাস্তব প্রয়োজনের ভিত্তিতে আরও একাধিক নির্বাচনের জন্য রেখে দিতে পারে। কয়টা মেয়াদের জন্য এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে_ সেটা নিশ্চয়ই আদালতের নয়, সংসদের এখতিয়ার। কারণ সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং এর সংযুক্ত কোনো ধারা মূল সাংবিধানিক কাঠামো ও স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা বিরুদ্ধ কি-না সে সম্পর্কে বলতে পারেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার সংবিধানই আদালতকে দেয়নি। আর সংবিধানে বর্ণিত স্পষ্ট সীমারেখাটি রাষ্ট্রের সব ক'টি শাখাকেই মেনে চলতে হয়। অন্যথায় সাংবিধানিক সংকটের উদ্ভব ঘটতে পারে। তবে আইন প্রণয়ন, এমনকি সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত সংসদের। সংবিধান এ ক্ষমতা আর কারও ওপর অর্পণ করেনি। সংসদ আদালতের রায় পর্যন্ত রহিত করতে পারে। শাহবানু খোরপোশ মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং জনস্বার্থে রাজীব গান্ধী সরকারের আমলে ওই রায় সংসদ কর্তৃক রহিত করার ঘটনা বিচার বিভাগ ও সংসদের এখতিয়ারকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের সরকারি দল বারবার এ ব্যাপারে বিচার বিভাগকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কেন?
এটা ঠিক যে, বিরোধী দল সংসদে এ ব্যাপারে সংশোধনী এনে বিতর্ককে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারত। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটেনি। বরং নির্বাচনের পর থেকে নানা বাহানায় তারা সংসদ থেকে বাইরে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের লাগাতার সংসদ বর্জনের রাজনীতি কি গ্রহণযোগ্য? এভাবে কি গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করা যায়? আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি কতটা দুর্বল তার প্রমাণ তো আমরা অসাংবিধানিক একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তেতো গেলার মতো হজম করতে বাধ্য হচ্ছি। আসলে এ দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রাথমিক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। বরং এ ব্যবস্থা তাদের পালাক্রমে দেশ শাসনের মৌরসি পাট্টা লাভের হাতিয়ার। আর এখানটাই যত গোলমাল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার দুই দলের কাছে কীভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে তা রীতিবিরুদ্ধ হলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন। প্রশ্ন আসে, ছোট রাজনৈতিক দলগুলো যদি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারত তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিকাশের পথ ধরতে সক্ষম হতো? কেউ কেউ বলতে পারেন যে, ভারত বা ফ্রান্সের মতো সরকার গঠনের জন্য অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বাঁধার বাধ্যবাধকতা থাকলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যা খুশি তা করার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হবে। তবে এ কারণে শরিকদের তুষ্ট করার নীতি নিতে হওয়ায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, দুর্নীতির খবর বেশি করে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এই জোট রাজনীতির কারণেই। তাছাড়া ফ্রান্সে তো এ ব্যবস্থা অনেক দিন ধরেই চলছে। তাদের ভালোই হয়েছে এতে। সে কারণে ফ্রান্সে আলোচনা-সমালোচনার দ্বার যতটা উন্মুক্ত ততটা অন্যত্র দেখা যায় না। কিন্তু আমাদের এখানে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল এতটাই শক্তিশালী যে, একমাত্র আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করা ছাড়া তাদের ক্ষমতার রাজনীতির জন্য অন্য দলের সাহায্য-সমর্থন প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। একমাত্র সামাজিক ও নতুন রাজনৈতিক চাহিদা সৃষ্টি করা গেলেই ছোট রাজনৈতিক দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করে ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। আর সে অবস্থা কি ফখরুদ্দীন সরকারের মতো আরেকটি অনির্বাচিত সরকার এসে করবে? এখানেই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের যত ভয় এখন।
কিন্তু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য অবস্থানে চলে যায় এবং উভয় পক্ষই যদি এ থেকে লাভবান হবে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাহলেই বিপদ। সুতরাং আমাদের সরকার ও বিরোধী দলের উচিত নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ গ্রহণ করা। আর বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের পুরনো রাজনৈতিক কৌশল থেকে বিএনপির সরে আসা উচিত দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের স্বার্থেই। তাদের উভয়েরই সংসদের মধ্যে তাদের দলসহ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎকে চিন্তা করতে পারা উচিত। তা না হলে উভয় শক্তির অনমনীয় অবস্থানের কারণে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের উদ্ভব ঘটলে দেশে পুনরায় অসাংবিধানিক ব্যবস্থা এসে পড়াটা বিচিত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি যেমন বলেছেন, সেনাবাহিনী বুঝেছে যে রাজনৈতিক নেতাদের সরকার চালাতে দেওয়া উচিত. সেটা বাস্তব পরিস্থিতিতে উল্টেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অতীতের মতো টেকনোক্রেটদের সামনে না দিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেতে পারে। এভাবেই আমরা পুনরায় কোনো টানেলের ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। ইয়াজউদ্দিনের আমলের উপদেষ্টা অগ্রজ সাংবাদিক মাহবুবুল আলম টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে বলে জাতিকে সংকট উত্তরণে আশার বাণী শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করতেন সত্য; কিন্তু তাতে করে সংকট ঠেকানো যায়নি। সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে কি?
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments