শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর-'মধুর হাঁড়ি' ভাঙতে হবে
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে দুর্নীতি ও অনিয়মের যে সংবাদ বুধবারের সমকালে প্রকাশিত হয়েছে তাতে অনেকেই চিন্তান্বিত ও আশাহত হবেন। কিন্তু এ সংবাদ অনেককেই বিস্মিত করবে না। কেন না ভুক্তভোগী মাত্রই অবগত, কাজ উদ্ধার করতে হলে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেই মোটা অঙ্কের উৎকোচ গুনতে হয়।
ভুক্তভোগীদের মারফত সাধারণ মানুষও দুর্নীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল। কিন্তু সাধারণ্যে এসব দুর্নীতি সাধারণভাবে অপ্রতিরোধ্য ও সমাধানহীন ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ফলে ভুক্তভোগীরা প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদের কথা না ভেবে পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বেশি ঝামেলায় জড়াতে চান না। অল্প হোক কি বেশি, উৎকোচের টাকা গুণে কাজ উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। যারা উৎকোচ গুণে কাজ উদ্ধার করতে পারেন তারা করিতকর্মা আর যারা উৎকোচ গুনতে নীতি-নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের প্রশ্ন তোলেন তাদের কাজ উদ্ধার পায় না। এই বাস্তবতায় দেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করে, দুর্নীতি ও অনিয়ম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় বিস্তার করেছে। বহু যুগের ধারাবাহিকতায় কোথাও কোথাও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পর্যন্ত পেয়েছে। দুর্নীতি রোধের বাহারি স্লোগানে এ শিকড় উৎপাটন কঠিন। তার চেয়েও বড় কথা, সত্যিই কি দুর্নীতির শিকড় উৎপাটনের কোনো উদ্যোগ আমাদের সমাজে আছে? সাম্প্রতিক অতীতে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, রাজনীতিকে কলুষিত করতে এমন ঢালাও অভিযোগ আনা হয়েছে। কথাটির মধ্যে সত্য আছে। সমাজের অন্য বহু স্তর বাদ দিয়ে শুধু রাজনীতিকদের দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত করার যুক্তি নেই। দুর্নীতির কথা বললে শুধু রাজনীতিকদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে বহু ক্ষেত্র বাদ পড়ে যায়। বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ উদ্ধারে যাওয়া মানুষের সঙ্গে কথা বললেই এর প্রমাণ মিলবে। কিন্তু সে প্রমাণ জোগাড় করে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ কোথায়? তথ্য-প্রমাণ, তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যে সদাতৎপর ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন দরকার তার অবস্থা এখন কেমন? শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে দুর্নীতির যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা উদ্বেগজনক। টেন্ডারবাজি, টেন্ডারে অনিয়ম, কমিশন আদায়, নির্মাণকাজে অবহেলা ও দুর্নীতি থেকে শুরু করে লোকবল নিয়োগ, দায়িত্ব বণ্টন পর্যন্ত দুর্নীতির বহু আলামত এখানে মিলেছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচয় দাঁড়িয়েছে 'মধুর হাঁড়ি' হিসেবে। অভিযোগ শুধু ভুক্তভোগীদের নয়, স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীরও। ইতিপূর্বে মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির ব্যাপারেও সরব হয়েছেন মন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি ইতিবাচক ঘটনা। যেখানে সবার চেষ্টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সেখানে মন্ত্রী যখন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেন তখন আশান্বিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমরা মনে করি, এ রসের হাঁড়ি ভেঙে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরই নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্য দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালিত হওয়া দরকার। আর শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে গেড়ে বসা দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করতে সরকারের তরফে বড় উদ্যোগ আসা উচিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি রোধ করতে ক্ষমতাসম্পন্ন দুর্নীতি দমন কমিশনের বিকল্প নেই। সরকার যদি আন্তরিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কার্যকর সমর্থন জোগায় তবে নাগরিকরা আশ্বস্ত হবে, কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলেও ধীরে ধীরে দুর্নীতি রোধ করাও সম্ভব হবে।
No comments