বিদায় কার্লোস ফুয়েন্তেস by রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

নিউনদিয়া সিন এস্ক্রিবির। লেখালেখি ছাড়া এক দিনও নয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে চিলির ইংরেজ গ্রাঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মাতৃভাষা এসপানিওলের ভুবনে প্রবেশের পাশাপাশি থ্রি মাস্কেটিয়ার্স-এর আদলে একটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখা দিয়ে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত, সুদীর্ঘ ৬৬ বছর শুধুই লিখে গেছেন।


কেউই ভাবেননি, মাত্র ৮৩ বছর বয়সে হঠাৎ করে তিনি এভাবে চলে যাবেন। আরও অনেক কিছু লেখার বাকি ছিল। কিন্তু মৃত্যু তো এমনই, বলে-কয়ে আসে না!
জাতীয়তাবাদী পিতা আর ধর্মভীরু ক্যাথলিক মেহিকান পিতা-মাতার সন্তান কার্লোস ফুয়েন্তেস জন্মেছিলেন পানামা সিটিতে ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর। কূটনীতিক বাবার চাকরিসূত্রে জীবনের প্রথম ১০টি বছর কেটেছিল ওয়াশিংটনে। স্কুলে যাওয়া শুরুও ওখানটাতেই। ইংরেজির বদলে মাতৃভাষা এসপানিওলকেই বেছে নিয়েছিলেন লেখালেখির ভাষা হিসেবে। ইংরেজি ও ফরাসিতে ওস্তাদ ছিলেন। কূটনীতিক পিতার সন্তান ফুয়েন্তেস নিজেও কূটনীতিক ছিলেন পেশাজীবনে। ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের নিরলস আর অনুসন্ধানী পাঠক। বোর্হেসের পর্ব থেকে দেখেছিলেন এসপানিওল ভাষার অযুত সম্ভাবনার দিকটি। বোর্হেসও ইংরেজিতে ওস্তাদ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা দুজনই বেছে নিলেন এসপানিওল—আর সমৃদ্ধ করলেন বিশ্বসাহিত্য। সেরভান্তেসের দোন কিহোতের লা মাঞ্চার ভাষিক রাজ্যে সবাইকে হাজির করে চালিয়েছেন একের পর এক দুর্দান্ত সব অভিযান।
ফুয়েন্তেস এত এত লিখেছেন যে কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। এক আঙুল টিপে টিপে লিখতে লিখতে বৃশ্চিক রাশির জাতক এই লেখকের আঙুলটি বৃশ্চিকের কাঁটার মতোই বেঁকে গিয়েছিল। অল্প কথায়, ফুয়েন্তেসের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়াটা সাগর সেচে জল তোলার মতো। তাঁর সাহিত্যজগৎ বিশাল আর জটপাকানো, আরব্য রজনী আর বোর্হেসের গল্পের গোলকধাঁধা ও বৃত্তাকার জটের শামিল। তাঁর রচনা পাঠ স্পেন আর হিস্পানোআমেরিকার এসপানিওল ভাষার রাজ্যে এক চমকপ্রদ অভিযান।
আজতেকদের পুরাণ অনুসারে দেবতা উইতিজলোপোচ্তিল দেখেন, এক স্থানে একটি ক্যাকটাসের ওপর বসে আছে এক ইগল, আর তার মুখে পুরে আছে একটি সাপ। ওই স্থানে, তেশেকাকো হ্রদের ওপর, দেবতার ইশারা অনুযায়ী আজতেকরা পত্তন করল তাদের রাজধানী তেনোচিতত্লাল। সেটা ১৩২৫ বা ১৩৪৫ সালের কথা। কলম্বাসের দেখানো পথ ধরে স্প্যানিয়ার্ডরা এল ১৫১৯ সালে। আজতেক দেবতা মোকেতজুমা আর তার সঙ্গী-সাথিদের পরাস্ত করে তেনোচিতত্লান ধ্বংস করে দখল নিল স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল এর্নাল কোর্তেস। ১৫২১ সালে আজতেকদের তেনোচিতত্লানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হলো সিউদাদ দে মেহিকো বা মেহিকো সিটি।
‘আমাকে খুঁজে পাবে এই শহরের ধুলোবালিতে।’ ২০০৮ সালে ফুয়েন্তেসের ৮০তম জন্মজয়ন্তী আর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস লা রেজিওন ম্যাপস এসপারেন্তো-এর
(নির্মল আর শুদ্ধতম হাওয়ার ভূখণ্ড) ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত একটি বিশেষ ভিডিওচিত্রের শিরোনাম ছিল এ রকম। আসলেই তাই। ফুয়েন্তেসকে পড়তে-বুঝতে হলে পড়তে-বুঝতে হবে মেহিকো সিটি। দেবতাদের পবিত্র ভূমি মেহিকো। তার রাজধানী সিউদাদ দে মেহিকো হলো আগুয়া কেমাদা বা তপ্ত জল। বহুবার বিদেশিদের আক্রমণে ধ্বংসযজ্ঞে সিউদাদ দে মেহিকো তপ্ত হয়েছে, পুড়েছে। মেহিকোর ইতিহাস এক চূর্ণ-বিধ্বস্ত পরাজয়ের ইতিহাস, এক নিষ্ঠুর ফ্যান্টাসি। ঔপনিবেসিক শাসকদের বিজয় ও দখল, ঔপনিবেশিক কাল, স্বাধীনতা, সংস্কারপর্ব, বিপ্লব, আধুনিক কাল মেহিকোর ইতিহাসের একেকটি কালপর্ব পেরিয়েছে দেশটি। কিন্তু অন্যায়-অত্যাচার-হতাশা-দুর্দশার শেষ হয়নি আজও। মুক্তি আসেনি মানুষের। ফুয়েন্তেসের কথাসাহিত্যের পটভূমি তাঁর স্বদেশ মেহিকো, মহাদেশ লাতিন আমেরিকা আর হিস্পানি জাত। তাঁর রচনায় ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে বৃত্তাকার সময় হয়ে। মেহিকো তাঁর জন্মগত অধিকার, আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মেহিকোর ইতিহাস, তাঁর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি তিনি আমাদের শোনান নানা বর্ণের নানা গন্ধের চরিত্রদের হাজির করে উপন্যাসের গোলকধাঁধাময় জগতে। বাস্তব আর কল্পনা, ইতিহাস আর পুরাণ, মুখে মুখে গল্প বাঁধার ঐতিহ্য আর কুশলী ও সাহসী উদ্ভাবন মিলেমিশে ফুয়েন্তেসের উপন্যাসের আখ্যান নির্মিত হয়। লা রেজিওন ম্যাপস এসপারেন্তো উপন্যাসে শহর মেহিকোই মূল আখ্যানকারী।
গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের মেহিকোর পটভূমিকায় লেখা বড় ক্যানভাসের এ উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু মেহিকান বিপ্লবের (১৯১০-১৯১৭ সালে সংঘটিত) ব্যর্থতা। নানা রঙের চরিত্র আর বহু স্বরের সমাবেশে জীবন্ত এ উপন্যাসে গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, রিপোর্ট, গদ্যকবিতা, জীবনী, নাটক, মৃত আর জীবিতের সংলাপ, সিনেমার চিত্রনাট্য—সব মিলেমিশে একাকার এক অন্য বাস্তবতা। কল্পনার এক বিশ্ব, কল্পনার এক মেহিকো সিটি, বাস্তবতা ছাড়িয়ে আরেক বাস্তবতা। ফুয়েন্তেসের সৃজনশীল রচনাকর্মের সমৃদ্ধি আর বৈচিত্র্যকে ঠিক শ্রেণীভুক্ত করা যাবে না। তাঁকে পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়েই আমরা তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব। একদিনের কাহিনি সেটাই হবে প্রথাবিহিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত লা মুয়ের্তে দে আর্তোমিয়ো ক্রুস (আর্তোমিয়ো ক্রুসের মৃত্যু) কিংবা ৬২ পৃষ্ঠার ভয়ংকর সুন্দর নিখুঁত আউরা—এ দুটি উপন্যাসসহ মোট ২২টি উপন্যাসে ফুয়েন্তেস মেহিকো যে কালপর্বের উপাখ্যান সৃষ্টি করেছেন, তা অনন্য। এগুলো আমাদের কালের ক্ল্যাসিকস। স্বদেশ মেহিকো তাঁর উদ্দীপনা আর প্রেরণার উৎস, তাঁর আয়না। রুচিশীল, শিক্ষিত, মার্জিত, বিশ্বনাগরিক, বিরামহীন যাত্রী, উদার বন্ধুদের বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেস মেহিকোকে তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক উদ্বেগ-শঙ্কার কেন্দ্রে রেখে স্বদেশকে হাজির করেছেন বিশ্বের দরবারে। ৫০ বছর ধরে তিনি ছিলেন মেহিকোর সাংস্কৃতিক জগতের সেরা এক স্তম্ভ, যেমনটি ছিলেন তাঁর গুরু আলফোনসো রেইয়েস, আর কবি ওক্তাবিয়ো পাস। লন্ডন, প্যারিস বা বার্সেলোনা নয়, বরং স্বীয় মেহিকো সিটিতেই মারা গেলেন ফুয়েন্তেস—এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে!
১৯৯৮ সালে মাদ্রিদের বইমেলায় কথা বলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। আগ্রহভরে বাংলাদেশ নিয়ে দু-একটি প্রশ্নও করেছিলেন। সেই স্মৃতি কয়েক দিন ধরে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। হিসপানি আমেরিকান সাহিত্যজগতের অসামান্য এই স্রষ্টার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.