যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন-বাংলাদেশে বড় সমস্যা নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন

বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন। এর পরেই রয়েছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য। এ ছাড়া আদিবাসীদের রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা এবং তাদের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণও একটি বড় সমস্যা।


মার্কিন সরকারের 'মানবাধিকার চর্চাবিষয়ক দেশভিত্তিক প্রতিবেদন ২০১১'-তে এ কথা বলা হয়েছে। ২০১১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি তৈরি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক আগে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বাংলাদেশ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীকে গুম, হেফাজতে মৃত্যু, অকারণে গ্রেপ্তার ও আটকের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কারাবন্দিত্ব মাঝেমধ্যেই জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে বিচারপূর্ব দীর্ঘ কারাবাসও বাংলাদেশের বড় মানবাধিকার সমস্যা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়মুক্তির ঘটনা আরো অনেক জায়গায় মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এর মধ্য দিয়েই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যরা দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করছেন।
২০১১ সালে বাংলাদেশে গুম ও অপহরণের ঘটনা বেড়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব অপহরণের অনেক ঘটনাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর এসবের পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
পুলিশ সাধারণত অকার্যকর এবং তারা ক্ষমতাসীন দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা তদন্ত করতে চায় না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দায়মুক্তি ব্যাপক মাত্রায় রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের ঘটনা তদন্তের বিধি থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটে না।
সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর র‌্যাবের হাতে ৪৩ জন নিহত হয়েছে। তার আগের বছর নিহত হয়েছে ৬৮ জন। তবে ২০০৪ সাল থেকে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো র‌্যাব কর্মকর্তার বিচারের বিষয়টি প্রকাশ করেনি সরকার।
প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমনে আইনের প্রয়োগ না করা, বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, সাংবাদিক নির্যাতনসহ আরো কিছু বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। সরকার সমাবেশের স্বাধীনতাও খর্ব করেছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বার্ষিক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ইতিমধ্যে হতভম্ব হয়ে পড়া বিচারব্যবস্থায় বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ ক্রমশ বেড়ে চলায় সমস্যা আরো বেড়েছে। এর ফলে বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।' এতে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নষ্ট করেছে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে সরকার বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে। এর সঙ্গে চলছে সেলফ সেনসরশিপ এবং নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সাংবাদিক হয়রানি।
প্রতিবেদনে বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সংবিধানে এগুলো নিশ্চিত করা হলেও সরকার বাস্তবে এসব অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে প্রায় সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সমালোচনা করলে পত্রিকাকে চাপে পড়তে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন অনুযায়ী দাপ্তরিক দুর্নীতির জন্য ফৌজদারি দণ্ডের বিধান থাকলেও সরকার কখনো তা কার্যকর করে না। ফলে কর্মকর্তারা অবাধে দুর্নীতি করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্বে রয়েছে। এ সংস্থায় কমিশনার হিসেবে একজন সাবেক আমলা এবং এক সাবেক বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা জনগণের কাছে আওয়ামীপন্থী হিসেবে বিবেচিত।
র‌্যাবের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি : অ্যামনেস্টি
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বাংলাদেশ সরকার র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও একের পর এক তা ঘটেই চলেছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে কেবল গত বছরই বিচার ছাড়া ৫৪ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৭০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এসেছে। অথচ এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত বা ন্যায়বিচার কোনোটিই হয়নি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে লন্ডনভিত্তিক সংস্থা অ্যামনেস্টির গত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এ কথা বলা হয়েছে। গত বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
অ্যামনেস্টির ৫০তম বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নতুন নারীনীতি কার্যকর করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের ফলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কমেছে, কিন্তু তা পুরোপুরি লাঘব হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকারও সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। অ্যামনেস্টির হিসাবে, গত এক বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৪৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে অন্তত পাঁচজনের।
বিচারবহির্ভূত হত্যা : অ্যামনেস্টির হিসাবে, ২০১১ সালে র‌্যাবের হাতে ৫৪ জন নিহত হয়েছে। ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১১ সালের শেষ পর্যন্ত অন্তত ৭০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। র‌্যাবের হাতে নির্যাতন বা আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে আরো বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, র‌্যাব ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। র‌্যাব যে ক্রসফায়ারের কথা বলে, সেভাবে তাদের মৃত্যু হয়নি। আর এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।'
উদাহরণ হিসেবে ঝালকাঠিতে র‌্যাবের হাতে কলেজছাত্র লিমন হোসেনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, লিমন র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু হলেও পুলিশ উল্টো তার বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।
পুলিশি নির্যাতন : অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে কমপক্ষে তিনজন মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকার বলেছে, এই মৃত্যুতে কোনো পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বছর শেষে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
বছরজুড়ে র‌্যাব, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে 'হাজার হাজার' নির্যাতনের অভিযোগ উঠলেও সরকার কোনো ঘটনারই বিচার করেনি বলে উল্লেখ করেছে অ্যামনেস্টি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার : একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে এই বিচার-প্রক্রিয়ায় অনেক ত্রুটি ছিল। এর কিছু কিছু সংশোধন করা হলেও এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এই ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে পারছে না।
প্রতিবেদনটির বাংলাদেশ অধ্যায় নিয়ে অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হলে এ জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি যাঁদের বিচার করা হচ্ছে, তাঁদের মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে যে দেশের অন্য কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, এটি মানবাধিকারের জন্য একটি বড় সমস্যা বলে তিনি অভিহিত করেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর মার্চে প্রকাশিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য চিকিৎসাসেবা, আইনি সহায়তা এবং কাউন্সেলিং দেওয়ার কথা বলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, কর্তৃপক্ষ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
যৌন ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার অনেক নারী ও শিশু সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের হাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি দখল হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, পার্বত্য জেলাগুলোতে দুই পক্ষের সহিংস সংঘর্ষে সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বাধা না পেয়ে বাঙালিরা প্রায়ই পাহাড়িদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই এটা ঘটছে।
ইকোনমিস্টের বিষোদ্গার : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলের বার্ষিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি গতকাল বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি মন্তব্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দি ইকোনমিস্ট। গতকাল গভীর রাতে পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে এটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির উপশিরোনামে বলা হয়, 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশকে একটি বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন'।
ইকোনমিস্ট মূলত সরকারের নেতিবাচক দিকগুলো উল্লেখ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলেছে। সামনে অনেক কঠিন সময় বলে সতর্ক করে দিয়েছে। আর সব কিছুর জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীকেই দায়ী করেছে।
সূত্র : ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইট ও দি ইকোনমিস্ট অনলাইন।

No comments

Powered by Blogger.