জন্মাষ্টমী-শুভবোধের উন্মেষ ঘটুক by সুব্রত ঘোষ
আজ ২২ আগস্ট, শুভ জন্মাষ্টমী। সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময় একটি দিন। হিন্দু শাস্ত্রমতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মানবরূপে মর্তে আবির্ভাব ঘটে। আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে এদিনে এক বৈরী সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে নিরাকার ব্রহ্ম বাসুদেব ও দেবকীর
সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে ওই সময়টাতে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিল। মথুরার রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে উৎখাত করে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেছিল।
একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিল জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপালসহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ নাকি একাই ৮৬ জন যুব রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিল। এছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দুর্যোধন-দুঃশাসন। মহাভারতে কাহিনীতে বর্ণিত দুঃশাসন কর্তৃক সভাসমক্ষে কুলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সৎ-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এভাবেই তখন পাপের রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদত। এহেন অধর্ম-অবিচার নির্মূল করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্তেই শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবানের মর্তে আগমন। তাই শ্রীকৃষ্ণ মর্তে এসে একে একে কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও কৌরবদের দর্পচূর্ণ করে, তাদের পাপসৌধ ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপন করলেন।
ওই অত্যাচারী রাজাদের মধ্যে একজন কংসরাজের বোন দেবকীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। দেবকীর অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে এ দৈববাণী জেনে কংস দেবকী ও তার স্বামী বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করে। একে একে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তার হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে ও সন্তানদের হত্যা করে। সপ্তম সন্তানের বেলায় দেবকীর গর্ভ স্থানান্তরিত হয় রোহিণীর গর্ভে। আর অষ্টম সন্তানরূপে জন্ম হয় শ্রীকৃষ্ণের। তাকে কংসের হাতে না দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর কথামতো কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাতে ঝড়বৃষ্টিতে সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে রেখে আসেন আরেক সদ্য মাতা যশোদার পাশে আর তার কন্যাকে নিয়ে ফিরে আসেন কারাগারে। কংসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান না পেলেও হাল ছাড়ে না। কংসরাজ তখন ছয় মাস পর্যন্ত বয়সের সব শিশুকে হত্যা করার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠায়। পুতনা রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখিয়ে বিষমাখা স্তন্য পান করানোর ছলে শিশুদের হত্যা করে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে পুতনা রাক্ষসী মারতে পারে না, বরং স্তন্যপানকালে ঘাতক পুতনাই মারা যায়। শৈশব থেকেই মনুষ্যশিশু শ্রীকৃষ্ণ এরকম একের পর এক অতিমানবিক ঘটনা ঘটাতে থাকেন, যা লীলা হিসেবে আখ্যাত। লীলাবলে ও লীলাচ্ছলেই শ্রীকৃষ্ণ ধ্বংস করেন কংসসহ অত্যাচারী রাজাদের। মর্তে শ্রীকৃষ্ণের ১২৫ বছরব্যাপী মনুষ্যরূপী লীলাগুলোকে সময়ানুসারে বৃন্দাবনলীলা (১ থেকে ১১ বছর), মথুরালীলা (১১ থেকে ২৩ বছর), দ্বারকালীলা (২৩ থেকে ১২৫ বছর) এ ভাগে ভাগ করেছেন শাস্ত্রকারগণ।
সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে জন্মাষ্টমী খুবই সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। জানা যায়, অতীতে জন্মাষ্টমীর মিছিল ঢাকা শহরের ঐতিহ্যেরই অংশ ছিল। পাকিস্তান আমল থেকে সুদীর্ঘকাল এই মিছিল বন্ধ ছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে ছেদ পড়েছিল, সুখের বিষয় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আবার সেই ঐতিহ্য ফিরে আসছে। নিঃসন্দেহে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। জন্মাষ্টমীতে জাতীয় ছুটি পালনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে অনুকূল রাষ্ট্রীয় বাতাবরণেরই পরিচয় দেয়। এটা সত্যি যে, সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই অসাম্প্রদায়িক স্বপ্ন সাধের সোনার বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম, অর্পিত সম্পত্তি, শত্রু সম্পত্তি আইনের মতো কালাকানুনসহ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনও বর্তমান। তাছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু শাস্ত্রীয় মতে প্রচলিত হিন্দু বিবাহ আইনে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও হিন্দু নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নব্য আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন হিন্দু আইন সংস্কারের নামে ধর্মটিকে ধ্বংস করতে একটি বিশেষ স্বাথান্বেষী মহল বর্তমানে সদাতৎপর। এগুলো দূর করতে সরকারের বিশেষ এবং আন্তরিক উদ্যোগ দরকার। আমরা আশা করব, আমাদের সব আশা-ভরসা আর নির্ভরতার প্রতীক এই রাষ্ট্র ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অধিকার সংরক্ষণে সর্বদা সজাগ ও আন্তরিক থাকবে। আমাদের একান্ত চাওয়া, আজকের এ শুভদিনে উৎসবের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ূক; সবার অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত করুক। কলুষতা-হানাহানিমুক্ত, নির্লোভ, বীর্যময় মহাজীবন গঠনের যে শুভ সংবাদ নিয়ে জন্মাষ্টমী আমাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে, সর্বজনীনভাবে তাকে মননে, চিন্তায় ধারণ করে কর্মে প্রতিফলিত করতে পারার মধ্যেই রয়েছে এ দিনটি উদ্যাপনের সার্থকতা।
ডা. সুব্রত ঘোষ : চিকিৎসক ও সংগঠক
subrato_ilika@yahoo.com
একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিল জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপালসহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ নাকি একাই ৮৬ জন যুব রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিল। এছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দুর্যোধন-দুঃশাসন। মহাভারতে কাহিনীতে বর্ণিত দুঃশাসন কর্তৃক সভাসমক্ষে কুলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সৎ-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এভাবেই তখন পাপের রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদত। এহেন অধর্ম-অবিচার নির্মূল করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্তেই শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবানের মর্তে আগমন। তাই শ্রীকৃষ্ণ মর্তে এসে একে একে কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও কৌরবদের দর্পচূর্ণ করে, তাদের পাপসৌধ ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপন করলেন।
ওই অত্যাচারী রাজাদের মধ্যে একজন কংসরাজের বোন দেবকীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। দেবকীর অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে এ দৈববাণী জেনে কংস দেবকী ও তার স্বামী বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করে। একে একে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তার হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে ও সন্তানদের হত্যা করে। সপ্তম সন্তানের বেলায় দেবকীর গর্ভ স্থানান্তরিত হয় রোহিণীর গর্ভে। আর অষ্টম সন্তানরূপে জন্ম হয় শ্রীকৃষ্ণের। তাকে কংসের হাতে না দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর কথামতো কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাতে ঝড়বৃষ্টিতে সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে রেখে আসেন আরেক সদ্য মাতা যশোদার পাশে আর তার কন্যাকে নিয়ে ফিরে আসেন কারাগারে। কংসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান না পেলেও হাল ছাড়ে না। কংসরাজ তখন ছয় মাস পর্যন্ত বয়সের সব শিশুকে হত্যা করার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠায়। পুতনা রাক্ষসী স্তনে বিষ মাখিয়ে বিষমাখা স্তন্য পান করানোর ছলে শিশুদের হত্যা করে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে পুতনা রাক্ষসী মারতে পারে না, বরং স্তন্যপানকালে ঘাতক পুতনাই মারা যায়। শৈশব থেকেই মনুষ্যশিশু শ্রীকৃষ্ণ এরকম একের পর এক অতিমানবিক ঘটনা ঘটাতে থাকেন, যা লীলা হিসেবে আখ্যাত। লীলাবলে ও লীলাচ্ছলেই শ্রীকৃষ্ণ ধ্বংস করেন কংসসহ অত্যাচারী রাজাদের। মর্তে শ্রীকৃষ্ণের ১২৫ বছরব্যাপী মনুষ্যরূপী লীলাগুলোকে সময়ানুসারে বৃন্দাবনলীলা (১ থেকে ১১ বছর), মথুরালীলা (১১ থেকে ২৩ বছর), দ্বারকালীলা (২৩ থেকে ১২৫ বছর) এ ভাগে ভাগ করেছেন শাস্ত্রকারগণ।
সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হিসেবে জন্মাষ্টমী খুবই সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। জানা যায়, অতীতে জন্মাষ্টমীর মিছিল ঢাকা শহরের ঐতিহ্যেরই অংশ ছিল। পাকিস্তান আমল থেকে সুদীর্ঘকাল এই মিছিল বন্ধ ছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে ছেদ পড়েছিল, সুখের বিষয় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আবার সেই ঐতিহ্য ফিরে আসছে। নিঃসন্দেহে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। জন্মাষ্টমীতে জাতীয় ছুটি পালনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে অনুকূল রাষ্ট্রীয় বাতাবরণেরই পরিচয় দেয়। এটা সত্যি যে, সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই অসাম্প্রদায়িক স্বপ্ন সাধের সোনার বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম, অর্পিত সম্পত্তি, শত্রু সম্পত্তি আইনের মতো কালাকানুনসহ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনও বর্তমান। তাছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু শাস্ত্রীয় মতে প্রচলিত হিন্দু বিবাহ আইনে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও হিন্দু নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নব্য আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন হিন্দু আইন সংস্কারের নামে ধর্মটিকে ধ্বংস করতে একটি বিশেষ স্বাথান্বেষী মহল বর্তমানে সদাতৎপর। এগুলো দূর করতে সরকারের বিশেষ এবং আন্তরিক উদ্যোগ দরকার। আমরা আশা করব, আমাদের সব আশা-ভরসা আর নির্ভরতার প্রতীক এই রাষ্ট্র ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অধিকার সংরক্ষণে সর্বদা সজাগ ও আন্তরিক থাকবে। আমাদের একান্ত চাওয়া, আজকের এ শুভদিনে উৎসবের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ূক; সবার অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত করুক। কলুষতা-হানাহানিমুক্ত, নির্লোভ, বীর্যময় মহাজীবন গঠনের যে শুভ সংবাদ নিয়ে জন্মাষ্টমী আমাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে, সর্বজনীনভাবে তাকে মননে, চিন্তায় ধারণ করে কর্মে প্রতিফলিত করতে পারার মধ্যেই রয়েছে এ দিনটি উদ্যাপনের সার্থকতা।
ডা. সুব্রত ঘোষ : চিকিৎসক ও সংগঠক
subrato_ilika@yahoo.com
No comments