তাদের হাসি বাসি পোলাওয়ের মতো by আল মাহমুদ


মানুষ নিজের জন্য নানা সম্ভাবনার কথা ভাবে। ভাবে বটে। কিন্তু কোনো সম্ভাবনা সহজে সত্য হয় না। বরং দুর্ঘটনা মানব জীবনকে বিশেষ করে চিন্তাশীল মানুষকে ঘিরে রাখে। দুর্ভাবনাটা আছে বলেই মানুষ দুর্ভাগ্যের পীড়ন সহ্য করতে পারে। তবে যদি এমন হতো মানুষের কোনো দুর্ভাবনাই নেই তাহলে কেমন হতো তা আমার আন্দাজের মধ্যে নেই।
আমি ভাবি আমার দুর্ভাবনা, দুর্ভাগ্য ও দুর্ঘটনা এসব নিয়েই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।

আমার তো একটা সুবিধা আছে। সেটা হলো মনের কথা লিখে জানাতে পারি। বেশিরভাগ মানুষের তা নেই। তারা লিখতে পারে না অথচ তাদের বুক গুড়গুড় করে দুঃখের শব্দে। দুর্ভাগ্যের আওয়াজে।
একদা আমিও কান পেতে রাখতাম কোনো সর্বনাশের শব্দ কোথাও উত্থিত হচ্ছে কিনা। আজকাল আর এসবের তোয়াক্কা করি না। কারণ, আমার লেখা আমাকে একটা অন্যরকম সাহস যুগিয়ে চলেছে। বেঁচে থাকার সাহস। আমি বাঁচি এটাই আমার সার্থকতা। তা বলে মৃত্যুর কথা যে ভাবি না এমন নয়। ভাবি। কিন্তু পরোয়া করি না। কারণ, মৃত্যুর অনেক ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমি মৃত্যু সম্পর্কে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি না হলেও আমাকে মৃত্যু মাঝে-মধ্যে যে শূন্যতা এনে দিয়েছে তা আমি এখনও হজম করে চলেছি।
আমি ভাবছি সবাই যেমন মৃত্যুকে এড়িয়ে চলে, আমিও বাধ্য না হলে তেমনি পাশ কাটিয়ে চলতে থাকব। যদি অমোঘ নিয়মের মতো মৃত্যু এসে আমার উপর আপতিত হয় তখন মরণের স্বাদ গ্রহণ করা যাবে। এখন আগ বাড়িয়ে যাকে দেখিনি তার চেহারা কেন দেখতে চাইব?
শিশুকাল থেকেই আমার একটা বদঅভ্যেস ছিল। সেটা হলো চেনা পথে না গিয়ে ভুল পথে বহুদূর পর্যন্ত চলে যাওয়া। তারপর হারিয়ে যাওয়া মানুষের মতো মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে করতে নিজ গৃহে ফিরে আসা। খুবই আনন্দ পেতাম হারিয়ে যেতে। বহুদিন হলো আমি আর হারাই না। বরং হারিয়ে যাওয়া মানুষকে বাড়ি খুঁজে বের করতে সাহায্য করি। এতে একটা আনন্দ আছে। তবে হারিয়ে যাওয়ার যে উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা এবং উত্তেজনা মনের ভেতর তোলপাড় করে সেটা আর অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না।
মানুষের একটা সময় আসে যখন সে আর হারায় না। এই সময়টা আমি কখনও নিজের জন্য প্রত্যাশা করিনি। আমি হারিয়ে যেতে চাই। হারাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে চাই। জিজ্ঞাসা করতে চাই আমি কোনদিকে যাব।
আমার কাছে আমার পরিপার্শ্ব এতটাই চেনা—এখানে হারাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আর যেখানে হারানোর কোনো ব্যবস্থাই নেই সেখানে দাঁড়াবারও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি হাঁটি। কেবল হাঁটি। কারণ, আমার পায়ের নিচের মাটি ফুরোয় না। এই মাটিই জানান দেয় যে আমার হাঁটার প্রয়োজন আছে। কারণ হাঁটার চেয়ে বেঁচে থাকার আর কোনো উপাদান মানুষকে অস্থির করে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবি এবং ভাবতে ভাবতে হাঁটি। এভাবেই আমার কাছে পৃথিবীটা মস্তবড় ঠেকে। তা না হলে পৃথিবীটা যদি ফুরিয়ে যায় তাহলে আমি দাঁড়াব কোথায়? আমি মানুষকে বহুভাবে দেখতে অভ্যস্ত। মানুষের কোনো শেষ নেই। অথচ মানুষ ছাড়া আর সবকিছুই গুনে শেষ করা যায়। মানুষকে গণনা করা যায় না। কারণ, মানুষের ভেতর অসংখ্য মানুষ।
মাঝে মাঝে ভাবি আমার খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই নাকি? আমি মানববিদ্যা নিয়ে অযথাই একা ভেবে মরতে বসেছি। তার চেয়ে যদি তুচ্ছজ্ঞান করি সবকিছুকেই তাহলে কেমন হয়? আমার সমস্ত অন্তরাত্মা একসঙ্গে বলে ওঠে, আরে সেটাই করো না কেন?
আমি চাই কিন্তু করতে পারি না। নানা কার্যকারণ এসে আমাকে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক এসবের মধ্যে ঘোল খাইয়ে দেয়। আমি হারি না। কিন্তু পারিও না। অন্যদিকে বলতে গেলে ছাড়িও না। এই তো আমার জীবনব্যাপী অভ্যেস ও আচরণের চৌহদ্দি। আমি লিখতে শিখেছি। কারণ, আমার শেখার আর কিছু ছিল না। আমি তো আর লেখা ছাড়া অন্যকিছু করার যোগ্য নই।
আমি লিখি বলেই আমাকে লোক একটু আড় চোখে দেখে। আমি লিখি বলেই সবচেয়ে কষ্টকর কাজ যে মানুষের মর্মযাতনা সেটা বুঝতে পারি। সবকিছুই কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু মানুষের দুঃখ অপার। একটা গান আছে না, দরিয়ার কুল নাই কিনারা নাইরে।
মানুষের নিয়তি হলো সে মানুষ ছাড়া আর কারও সঙ্গে ঘর বসাতে পারে না। মানুষ বলতে এখানে আমি নারীদের বুঝিয়েছি। তারা কথা বলে না। কিন্তু ধরে রাখে। সবকিছুই ধরে রাখে। আর হাসে। তাদের হাসি বাসি পোলাওয়ের মতো।
লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.