আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৮)-শরণার্থী জীবন by আলী যাকের

ধর্মনগর পৌঁছে দেখলাম স্টেশনটি ছোট্ট, সুন্দর। প্লাটফর্মটি বেশ লম্বা; কিন্তু এর চারপাশে যেখানেই যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে সব জায়গায় ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ কেউ গামছা পেতে বসেছে, কেউ চাদর। দু-একটা শীতলপাটি, হোগলাপাতার মাদুরও চোখে পড়ল। দেশ ছাড়ার সময় শেষ সম্বল হিসেবে নিয়ে এসেছে বোধ হয়।

আবার মনটা নিজের অজান্তেই চলে যায় ঢাকায়। ছেড়ে আসা বাড়ির পেছনের বারান্দায়। শীতলপাটির ওপরে আসন করে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মহা আমেজে এই সেদিনই তো লিওন ইউরিসের এঙ্ােডাস উপন্যাসটা পড়ছিলাম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে দেশছাড়া, সমাজচ্যুত গৃহহারা ইহুদিদের করুণ কাহিনী। তখন চোখ ভিজে এসেছিল আমার। ভেবেছিলাম, এমনও কি ঘটে কোনো জাতির জীবনে? কী জঘন্য দুর্বৃত্ত ছিল অ্যাডলফ হিটলার? ভালো হয়েছে নির্বংশ হয়েছে ওই বদমাশ। ঘৃণিত হয়েছে তার নাৎসি স্যাঙাতরা। মুক্তবুদ্ধির জয় হয়েছে। মুক্তিকামী মানুষ হাল ধরেছে মানবতার। এঙ্ােডাস পড়ার পর দুই মাসের মধ্যেই যে আমার জন্যও অপেক্ষা করছিল, ঠিক একই ধরনের জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার অঘটন সে কথা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম আমি?
যা হোক, আমরাও একদিকে একটি কোনায় একটু জায়গা করে নিয়ে চাদর পাতলাম। মাথার ওপরে খোলা আকাশ। এখানেই আমাদের রাত যাপন করতে হবে। দুই রাত। কেননা পরশু দিনের আগে কোনো ট্রেন নেই। তখন পাহাড় লাইনে ত্রিপুরার ধর্মনগর থেকে লামডিং পর্যন্ত দুদিনে একটি ট্রেন চলাচল করত। সকালে ছেড়ে সারা দিন, সারা রাত ট্রেনে কাটত_তারপর পরদিন সকালে লামডিং। রাজি হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। ভাবতে ভাবতে রাত হয়ে এসেছে। শরণার্থীদের জন্য চালে-ডালে একধরনের খিচুড়ি রান্না হচ্ছে স্থানীয় সরকার এবং এলাকাবাসীর আনুকূল্যে। তাই কোনোমতে গলাধঃকরণ করে ক্ষুনি্নবৃত্তি করলাম সবাই। তারপর খোলা আকাশের নিচে শয্যা গ্রহণ। ততক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের কিছু লোক আমাদের কয়েকটা চাটাই দিয়ে গেছে। যার ওপরে চাদর পেতে তৈরি হয়েছে আমাদের শোবার জায়গা। রাতে খোলা আকাশের নিচে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছি আর ভাবছি, এখন যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কবে যেতে পারব সেই যুদ্ধে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছি জানি না। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। আমি ছাড়া কেউ তখনো ওঠেনি। হঠাৎ দেখি, ভারতীয় আর্মির ইউনিফর্ম পরিহিত চার-পাঁচজন আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ পদস্থ অফিসার বলে মনে হলো, দুলাভাইকে 'স্যার' সম্বোধন করে ডাকছেন। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। দুলাভাইও উঠে বসলেন। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন ওই অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে। নামটা ভুলে গেছি; কিন্তু তিনি একজন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। দুলাভাইকে তিনি স্যালুট করে বললেন, 'আপনার খবর আমরা আগরতলা থেকে পেয়েছি। আপনি তো সংসদ সদস্য, তাই নয় কি?' দুলাভাই মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলায় তিনি আরেকবার স্যালুট করলেন এবং বললেন, 'আপনারা সবাই আজকে আমার তাঁবুতে, আমার মেহমান। আজকে দুপুরে দয়া করে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন।' বলেই তিনি যেমন এসেছিলেন, একটা স্যালুট দিয়ে তেমনি চলে গেলেন। তাঁর তাঁবুতে আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা একটা কী দেড়টা। ভদ্রলোক নিরামিষাশী। অতএব অতিসাধারণ খাবার। একটা নিরামিষ, বুটের ডাল আর গরম গরম চাপাতি। চাপাতিতে অবশ্য ঘিয়ের প্রলেপ ছিল। আমাদের তখনকার অবস্থায় ওই খাবারই মনে হচ্ছিল অমৃত। আমরা সবাই সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর্মি বলতেই পাকিস্তান আর্মিকে জানতাম। কিন্তু আর্মির যে এই চেহারাও হয় তা আগে কখনো কল্পনা করতে পারিনি। ওই রাতেও আমরা ব্রিগেডিয়ারের আতিথ্য গ্রহণ করলাম এবং একই ধরনের খাবার খেলাম। আরো একটি দিন ও রাত কাটাতে হবে ধর্মনগরে। পরদিন সকালবেলা আমরা ক্যাম্পের নাশতা খেয়ে যে যার মতো ঘোরাফেরা করছি। আমি স্টেশনের বাইরে এলাম জায়গাটা ঘুরেফিরে দেখতে। স্টেশনসংলগ্ন একটি রাস্তা ছিল। সে রাস্তাটি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এসে রাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ শালবন। বনের পথে হাঁটার রাস্তা। আমি সেই রাস্তায় নেমে পড়লাম। হাঁটছি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। হঠাৎ মনে হলো আরে! যেদিকে পথ হাঁটছি_সেদিকেই তো আমার বাংলাদেশ। একটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতো হেঁটে চললাম সামনে। আমার সারা মন আচ্ছন্ন করেছে তখন বাংলাদেশের স্মৃতি, আমার গ্রাম, আমার ঢাকা শহর। কত দূর যে হেঁটেছি তা লক্ষ করিনি। ভাবছি, এই তো এসে গেলাম বাংলাদেশে। এখনই দেখা পাব বাংলাদেশের মাটির। ঘাসে ঘাসে পা ফেলব। হঠাৎ পেছন থেকে একটু রুক্ষ স্বরেই কে যেন বলে উঠল, 'রোকো'। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ কোম্পানীগঞ্জের কাছে সিঅ্যান্ডবি রোডের স্মৃতি জেগে উঠল মনে। মনে পড়ল পাকিস্তানি সেনা সদস্যের হুংকার, 'ভাগো'। আমি পেছনে ঘুরে দাঁড়ালাম, দেখি দুজন ভারতীয় আর্মির পোশাক পরা মানুষ। তাঁদের কাঁধে ঝুলছে অস্ত্র। তাঁরা দুজন আমার কাছে এলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মনে হলো অফিসার, আমায় চোস্ত ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি। আমি ততক্ষণে বাস্তবে ফিরে এসেছি। বললাম, 'জানি না।' তিনি আমায় বললেন, 'তুমি কি জানো আর কিছু দূরেই বাংলাদেশের বর্ডার?' হঠাৎ মনে হলো, আরে! তাহলে তো প্রায় এসেই পড়েছিলাম আমার জন্মভূমিতে! অফিসার বললেন, 'এবং বর্ডারের অদূরেই পাকিস্তানি আর্মি আর্টিলারি নিয়ে ওত পেতে বসে আছে। একটু নড়াচড়া দেখলেই তারা গুলি করে উড়িয়ে দিত তোমাকে। চল ফিরে চল।' সম্মোহিত আমি ধীর পায়ে ফিরে চললাম অবশ্যম্ভাবী শরণার্থী জীবনের দিকে।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.