চারদিক-আমি শহীদ পরিবারের সন্তান
‘গাঢ় অন্ধকার যেন রাতের গভীরতাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা সবে নয়টার ঘর ছুঁয়েছে। তার পরও রাতকে অনেক বেশি ঘনকালো ঠেকছিল সেদিন। আর সেই ভয়াল রাতেই ঘটে সেই অমানবিক ঘটনা। সন্ধ্যার পর থেকেই শ্রীশ্রী আনন্দমনি আশ্রম ও রমনা কালীবাড়ি মন্দির অনেক বেশি সুনসান হয়ে যায়।
আর সেই সময়টা নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার জ্যাঠা থাকতেন মন্দিরের ঠিক পাশেই। সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন আমার বড় দুই বোন। ভয়াল সেই একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন বড় জ্যাঠা। গুলি করেই ক্ষান্ত থাকেনি, মন্দিরের চারপাশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মন্দিরের চারপাশের বসতির মানুষ যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলি থেকে রেহাই পেলেও পুড়ে মারা যান আগুনে। জ্যাঠা গনেশ মুচি আর বড় দুই বোনসহ তিনজন শহীদ হন সেই ভয়াল রাতে। মেরে ফেলার জন্য সেদিন বাবাকেও লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে গুলিটা বাবার বুক ভেদ না করে পায়ে লাগে। প্রাণে বেঁচে যান বাবা।’ কথাগুলো বলার সময় দিলীপ মুচির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঠোঁটটা তিরতির করে কাঁপছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এবং বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী আবাসিক হলের মূল ফটকে বসে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মুচির কাজ করেন তিনি।
প্রখর রোদ। রোদের তীব্রতা এত বেশি যে ছোট নিচু একচালার নিচে বসেও রেহাই পাচ্ছেন না রোদ থেকে। এরই মাঝে সবে জুতায় আঠা মাখিয়ে রেখেছেন। অন্য জুতায় মাখছেন কালো কালি। কালি মাখা হাতেই কপালের ঘাম মুছে নেন তিনি। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন শহীদ পরিবারের এই সন্তান। ‘বয়স তখন খুব বেশি নয়, দুই-তিন বছর হবে। তাই স্মৃতিতে কিছুই নেই। পুরো ঘটনা বাবার মুখেই শোনা। নিজের চোখের সামনে ভাই আর মেয়েদের মৃত্যুতে বাবা শোকাহত হন। তবে শোক প্রকাশের ফুরসত পাননি। ক্ষত পা নিয়ে বাবা আর মা ছোট্ট আমাকে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বাবার পায়ের ক্ষত রয়ে গেছে আজও। তবে মনের ক্ষত সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তাঁঁকে। শত কষ্টের মাঝেও পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছি। এরপর ড. শহীদুল্লাহ কলেজে আইএ ভর্তি হই। কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পাসটা আর কপালে জোটেনি। শেষতক সংসারের হাল ধরতেই এই পেশায় নামা।’ প্রশ্ন করি অন্য সব পেশা বাদ দিয়ে কেন এই পেশায় এলেন? ‘আসলে সংসারে আমার পরের ছোট ভাইবোন, অন্যদিকে পঙ্গু বাবার দায়িত্ব নিতেই এই পেশায় আসা। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বড় চাকরি করব। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হলো না।’ কথা বলার ফাঁকে হাতের কাজের কোনো রকম হেরফের হচ্ছে না। ঠিকই নিপুণ হাতে জুতা সেলাই করছেন। জুতার ধরন বুঝে কোনোটায় রং করছেন। আবার ব্যাগ সেলাই থেকে শুরু করে ছাতা ঠিক করার কাজটা করে যাচ্ছেন। বলা যেতে পারে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন তিনি। গনেশ মুচি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ম্যাট্রিক পাস করেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারিনি। এখন মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিয়েই কত মানুষ চাকরি পাচ্ছে। অথচ একই পরিবারের তিনজন মানুষ শহীদ হয়েও কোনো চাকরি পাচ্ছি না। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে কী পেলাম আমরা?’
‘সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাবা নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি অন্য দেশে। বলেছেন, “একদিন স্বাধীনতা আসবে, আসবে সুখ।”
অথচ আজ আস্তাকুঁড়ে বেঁচে আছি। কোনো দিন ২০০, কোনো দিন ৩০০ টাকা উপার্জন করছি। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বাবা-মাকে নিয়ে ছোট ভাড়াবাড়িতে থাকছি কামরাঙ্গীর চরে। সংসার চলতেই চায় না। তার পরও দিন যায়, রাত আসে। শুধু স্বপ্ন বুনি সন্তানেরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। হয়তো স্বগর্বেই একদিন বলবে, “আমরা শহীদ পরিবারের কৃতী সন্তান।”’
শারমিন নাহার
প্রখর রোদ। রোদের তীব্রতা এত বেশি যে ছোট নিচু একচালার নিচে বসেও রেহাই পাচ্ছেন না রোদ থেকে। এরই মাঝে সবে জুতায় আঠা মাখিয়ে রেখেছেন। অন্য জুতায় মাখছেন কালো কালি। কালি মাখা হাতেই কপালের ঘাম মুছে নেন তিনি। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন শহীদ পরিবারের এই সন্তান। ‘বয়স তখন খুব বেশি নয়, দুই-তিন বছর হবে। তাই স্মৃতিতে কিছুই নেই। পুরো ঘটনা বাবার মুখেই শোনা। নিজের চোখের সামনে ভাই আর মেয়েদের মৃত্যুতে বাবা শোকাহত হন। তবে শোক প্রকাশের ফুরসত পাননি। ক্ষত পা নিয়ে বাবা আর মা ছোট্ট আমাকে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বাবার পায়ের ক্ষত রয়ে গেছে আজও। তবে মনের ক্ষত সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তাঁঁকে। শত কষ্টের মাঝেও পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছি। এরপর ড. শহীদুল্লাহ কলেজে আইএ ভর্তি হই। কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পাসটা আর কপালে জোটেনি। শেষতক সংসারের হাল ধরতেই এই পেশায় নামা।’ প্রশ্ন করি অন্য সব পেশা বাদ দিয়ে কেন এই পেশায় এলেন? ‘আসলে সংসারে আমার পরের ছোট ভাইবোন, অন্যদিকে পঙ্গু বাবার দায়িত্ব নিতেই এই পেশায় আসা। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বড় চাকরি করব। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হলো না।’ কথা বলার ফাঁকে হাতের কাজের কোনো রকম হেরফের হচ্ছে না। ঠিকই নিপুণ হাতে জুতা সেলাই করছেন। জুতার ধরন বুঝে কোনোটায় রং করছেন। আবার ব্যাগ সেলাই থেকে শুরু করে ছাতা ঠিক করার কাজটা করে যাচ্ছেন। বলা যেতে পারে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন তিনি। গনেশ মুচি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ম্যাট্রিক পাস করেও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারিনি। এখন মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিয়েই কত মানুষ চাকরি পাচ্ছে। অথচ একই পরিবারের তিনজন মানুষ শহীদ হয়েও কোনো চাকরি পাচ্ছি না। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে কী পেলাম আমরা?’
‘সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাবা নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি অন্য দেশে। বলেছেন, “একদিন স্বাধীনতা আসবে, আসবে সুখ।”
অথচ আজ আস্তাকুঁড়ে বেঁচে আছি। কোনো দিন ২০০, কোনো দিন ৩০০ টাকা উপার্জন করছি। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বাবা-মাকে নিয়ে ছোট ভাড়াবাড়িতে থাকছি কামরাঙ্গীর চরে। সংসার চলতেই চায় না। তার পরও দিন যায়, রাত আসে। শুধু স্বপ্ন বুনি সন্তানেরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। হয়তো স্বগর্বেই একদিন বলবে, “আমরা শহীদ পরিবারের কৃতী সন্তান।”’
শারমিন নাহার
No comments