আলুচাষীরা বিপাকেঃ কৃষি বিভাগ সজাগ না হলে বিপদ
গত কয়েকদিন ধরে সূর্যের লাগাতার লুকোচুরি খেলা, হিমেল হাওয়া ও কুয়াশায় কেবল উত্তরাঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই ব্যাহত হচ্ছে না, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে বিভিন্ন ফসলের মাঠে। এখন সবচেয়ে ক্ষতির মূখে পড়েছে আলুর আবাদ। বিস্তীর্ণ এলাকায় আলু গাছে দেখা দিয়েছে গোড়াপচন রোগ।
এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন আলুচাষীরা। আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে এবার আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, শুধু আবহাওয়াজনিত কারণেই আলু গাছে রোগবালাইয়ের সংক্রমণ ঘটে না। উন্নতমানের আলুবীজ ব্যবহার না করলেও রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। চাষীরা অনেক সময় হিমাগারে সংরক্ষিত বীজ উত্পাদনের জন্য ভালো না হওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানির বীজ কিনে রোপণ করেন। এভাবে বীজ সংগ্রহ করে এবারও অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, নিম্নমানের বীজে ফলন যেমন কম, তেমন তা থেকে উত্পাদিত গাছের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম। আলুর গোড়াপচন রোগের প্রকোপ বাড়ার এও একটি কারণ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি শীত মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৯৮৩ হেক্টর জমিতে। উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন। উল্লিখিত পরিমাণ জমিতে রোপণের জন্য দরকার সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন আলু বীজ। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) বরাদ্দ মাত্র ৩ হাজার টন। প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দের পরিমাণ এত কম হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ স্বভাবতই ঝুঁকির মুখোমুখি পড়ে। উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আলু চাষ হয় বগুড়া ও রংপুর জেলায়। সেখানেও বিএডিসির বীজ বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ বছর সারের সংকট তেমন ছিল না, কিন্তু উন্নতমানের বীজ সংকট আগের চেয়ে বেড়েছে। যদিও আলুর দাম বাড়ার ফলে কৃষকরা বেশি করে আলুচাষ করার দিকে ঝুঁকছেন। আবাদি জমির পরিমাণও বেড়েছে আগের চেয়ে। কিন্তু উন্নতমানের আলুবীজ সংগ্রহ করার সুযোগ না থাকলে স্বভাবতই কৃষকরা আবাদের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। তার ওপর যদি আবহাওয়াজনিত রোগবালাইয়ের সংক্রমণ ঘটে, প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক সময়মত না পাওয়া যায় তাহলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ কেবল খাতাপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কৃষকরা এবার উচ্চফলনশীল কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, গেনোনা, অ্যালভিরার পাশাপাশি স্থানীয় জাতের পাকরি ও হাগরি আলু রোপণ করেছেন। এসব উন্নতজাতের আলু থেকে বীজ সংরক্ষণ করে যথাসময় কৃষকদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে আলু আবাদ আরও বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএডিসি লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী আলুবীজ দেয়া নিশ্চিত করতে না পারলে নিম্নমানের বীজ রোপণের সম্ভাবনা থেকেই যাবে এবং এতে করে কমে যাবে আলুর উত্পাদন, কৃষক পড়বেন বিপদে।
আলুকে বলা হয় ভাতের বিকল্প খাদ্য। এর আগে বিভিন্ন সরকারের আমলে ‘বেশি করে আলু খান’ স্লোগান দেয়া হয়েছে। আলু দিয়ে বানানো খাবার নিয়েও কম নাটক করা হয়নি। বিগত জরুরি সরকারের আমলে আলুর মহাভোজের আয়োজন হয়েছিল হোটেল র্যাডিসনে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে আলুর উত্পাদন, আলুচাষীদের সমস্যা নিয়ে যা করা দরকার সরকার পক্ষ থেকে তা যে যথেষ্ট নয় তা বিএডিসির আলুবীজ বরাদ্দের পরিমাণ থেকেই আঁচ করা যায়। আবহাওয়াজনিত রোগবালাইয়ের কথা বাদ দিলেও প্রতিবছর আলুচাষীরা উন্নতমানের বীজ, প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও সারের অভাব মোকাবিলা করেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আলুচাষ করে লাভের বদলে খরচ উঠানোও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বিএডিসিকে আরও সজাগ থাকা প্রয়োজন। আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আগেভাগেই বীজ সংরক্ষণ, পর্যাপ্ত সার, কীটনাশকের সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করাও একান্ত আবশ্যক। আলু গাছের গোড়াপচন একটি মারাত্মক রোগ। এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অন্যতম শর্ত উন্নতমানের বীজ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারের সংস্থাগুলোর নিবিড় যত্নবান হওয়ার মধ্যেই নিহিত অধিক আলু উত্পাদনের ভবিষ্যত্।
No comments