বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতকে এনে দিয়েছে শান্তি by আতাউস সামাদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারিভাবে ভারত সফর করলেন। তিনি নয়াদিল্লি যাওয়ার আগে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আবার ফেরত আসার পরও কথা হচ্ছে। তার দলের অনেকে বলেন, সফরের আগে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন তা দারুণ ভালো হয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী নিজে গত পরশু (শনিবার) তার ভারত সফর উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। শেখ হাসিনা তাতে বলেছেন, সেখানে তিনি জয় পেয়েছেন। গতকাল বিকালে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ফলাফলের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তবে আমার এই লেখা কাল সকালেই শেষ করতে হয়েছিল বলে তার মন্তব্য শুনে নেয়ার সুযোগ হয়নি।
কাজেই তাদের দু’জনের কথার তুলনামূলক পর্যালোচনা বা তেমন কিছুর ভিত্তিতে কোনো ভাষ্য লেখার চেষ্টা করাও সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আমার নিজের মনে যেসব কথা আনাগোনা করছে, তার দু’চারটা বলব ভাবছিলাম; কিন্তু তাও ভালো করে গুছিয়ে উঠতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। এজন্য আগাম মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
ভারতকে নিয়ে কোনো বাংলাদেশী কোনোরকম আলোচনা বা মন্তব্য করতে গেলে তাকে প্রথমেই তিনটা মানসিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তানের হাত থেকে আমাদের মুক্তি পেতে একাত্তরে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তাতে ভারত আমাদের আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছে আর এ লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মিত্রশক্তি হিসেবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। এ যুদ্ধে, অর্থাত্ বাংলাদেশ রণাঙ্গনে ভারতের ১৩ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অমূল্য সহায়তাদানের জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছি। কিন্তু তবু এ প্রশ্নে একটা ঘোঁট পাকিয়ে রয়েছে। সেটা হলো—ভারত সরকার, তা যে দলই হোক না কেন এবং বেশকিছু ভারতীয় মনে করেন যে, বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। কী করলে তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবেন তা সহজে পরিষ্কার করতে চান না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তখন আমরা যদি প্রশ্ন করি, এক্ষেত্রে আমরা আর কী করতে পারি। তাহলে তারা বলেন, প্রথমত আমরা যেভাবে বলি সেভাবে সহযোগিতা করতে পার। দ্বিতীয়ত তোমরা আমাদের সন্দেহ করো এবং সমালোচনা করো, সেটা না করলেই তো ভালো হতো! এখন ভারত যদি এমন কিছু করে যাতে বাংলাদেশের ও এদেশের মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, আর সে কথাটা যদি আমরা উল্লেখ করি, তাহলে ভারত নাখোশ হয়। ওরকম ক্ষেত্রে ভারত সরকার প্রায়ই বলে, ‘না, বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না’ এবং তারা মনে করেন যে তাদের ওই কথাটাই, তা অসত্য হলেও আমাদের চুপচাপ মেনে নেয়া উচিত। তবেই আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কর্মটি সঠিকভাবে পালন করা হবে। নথিপত্র ঘাঁটলে এরও সাক্ষ্য পাওয়া যাবে যে, বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও এরকম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে কোনো কোনো সময়। এ একই বিষয়ে আরেকটা ব্যাপার হলো যে আমাদের দেশে যারা ভারতকে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যে এমন লোকজন আছেন যারা কারও মুখে ভারতের সমালোচনা শুনলেই তাকে পাকিস্তানপ্রেমী বা একাত্তরের রাজাকারসম কেউ বলে ধরে নেন। এ প্রসঙ্গে নতুন কথা চালু হয়েছে ‘আইএসআই এজেন্ট’। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে খোলামনে আলোচনা করার এই হলো এক বিরাট বাধা। আবার এই মুদ্রারও অপর পিঠ রয়েছে। বহু পাকিস্তানি আছে যারা মনে করে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ভুল করেছে এবং একদিন এ ভুল বুঝতে পারবে। কিছু বাংলাদেশীও আছেন যারা ইশারা-ইঙ্গিতে বা দীর্ঘশ্বাসে একই অনুভূতি প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বাংলাদেশ ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ থাকল না বলে আফসোস করেন। এসবের ফলে যে কোনো বাংলাদেশীর জন্য ভারত নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাকে ‘ইন্ডিয়া-পসন্দ’ বা ‘পাকিস্তান-পসন্দ’ এই দুই অভিধার একটিতে ভূষিত হতে হয়।
কিন্তু তাই বলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলোচনা করা যাবে না, তা তো হতে পারে না। ব্যক্ত হওয়ার জন্য আমার মনে যে কথাটা উঁকিঝুঁকি মারছে, সেটা বলার আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে ভারত রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে কম হলেও অন্তত যে তিনটি জিনিস পেয়েছে, তার উল্লেখ করে নিই। এর প্রথমটা হলো, ভারত দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ করার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। ব্রিটিশরা তাদের শাসিত ভারতকে ১৯৪৭ সালে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে চলে যাওয়ার পরবর্তী ২৪ বছরে ভারতকে অন্তত তিনবার ১৯৪৮ (কাশ্মীরে), ১৯৬৫ (পশ্চিম রণাঙ্গন ও কাশ্মীরে) এবং ১৯৭১ সালে (পশ্চিম রণাঙ্গন ও পূর্ব রণাঙ্গনে) পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর এবং স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই ঊনচল্লিশ বছরে পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে সাহস পায়নি এর মাঝে (কারগিলে যে যুদ্ধ হয়, তা ছিল সীমিত আকারের)। ১৯৭২ সালে ভারতের সিমলায় ইন্দিরা-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠকে যে পাক-ভারত চুক্তি হয়, তাতে কাশ্মীরের সাবেক যুদ্ধবিরতি রেখা ১৯৭১-এর যুদ্ধের ফলে যেভাবে বদলে যায়, সেটিকে ওইভাবেই রেখে দেয়া হয়। এর নাম দেয়া হয় অপঃঁধষ ষরহব ড়ভ পড়হঃত্ড়ষ (বা বাস্তুবিক নিয়ন্ত্রণ রেখা)। এতে সুবিধা হয়েছে ভারতের। সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় লাভ হয়েছে যে, যদি কোনো সময় পাকিস্তান আবারও ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায়, তখন ভারতকে পূর্বদিকে অর্থাত্ তার পেছন দিকে তাকাতে হবে না; কারণ এদিকে এখন আর পাকিস্তানের কোনো অংশ নেই, বরঞ্চ রয়েছে বাংলাদেশ, যে দেশটি তার বন্ধু এবং আক্রান্ত না হলে কোনোমতেই ভারতের সঙ্গে লড়াই বাধাবে না। এক্ষেত্রে ভারত একটা চিরস্থায়ী কৌশলগত সুবিধা পেয়ে আসছে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল থেকে। একাত্তরের যুদ্ধের ফলাফল থেকে ভারত তৃতীয় যে পুরস্কারটি পেয়েছে, তা হলো একটি যুদ্ধ জয়ের গৌরব। পাকিস্তানের সঙ্গে এর আগের যুদ্ধগুলো ছিল অমীমাংসিত আর চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল। এমনকি শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে শান্তিরক্ষা করতে গিয়েও বহু ক্ষতি স্বীকার করে ভারতীয় সৈন্যদের সে দেশ থেকে চলে আসতে হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারত এ পর্যন্ত একটা যুদ্ধেই পরিষ্কারভাবে জয়ী হয়েছে, সেটা হলো ১৯৭১ সালে এবং তা বাংলাদেশের মাটিতে। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছে। আর ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তান অকস্মাত্ ভারতের ভূখণ্ডে বিমান হামলা করলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস ধরে লড়াই করে বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের খুবই দুর্বল করে ফেলেছিল। মানসিকভাবে ওই হানাদাররা তখন একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। তখনকার ভারতীয় সেনাপতিরাও স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর লড়াই ও জনগণের সহায়তায় তারা তুলনামূলকভাবে সহজে এবং খুবই অল্প সময়ে জয়লাভ করা সহজ হয়েছিল।
আমি সবিনয়ের সঙ্গে যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ভারত বিশাল সহায়তা দেয়ার মতো বাংলাদেশও তার দিক থেকে ভারতকে সামরিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির নিরিখে যা দিয়েছে, তার মূল্য আদৌ কম নয়। অতএব, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদেশকে সব সময়ই কৃতজ্ঞতাবশে বিনাবাক্যে বেশি দিতে হবে আর কম পেতে হবে—এমন ভাবাটা ঠিক নয়, সুস্থ চিন্তাও নয়। আর ভারতের কোনো কাজের জন্য যদি আমাদের ক্ষতি হয়ে থাকে, তা আমাদের বলতেই হবে এবং ভারতের উচিত হবে তা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও প্রতিবেশীর যাতে আর ক্ষতি না হয়, সে ব্যবস্থা করা। সেরকম আচরণই হবে সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি। যেমন—ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে ভারত গঙ্গার যে পরিমাণ পানি হুগলি নদীতে নিয়ে যাচ্ছে, কলকাতা বন্দরের নাব্য রক্ষা করার জন্য তাতে সেই ১৯৭৫ সাল থেকে বছরের পর বছর বাংলাদেশের ক্ষতিই হচ্ছে। ওই বাঁধ চালু হওয়ার আগে বাংলাদেশ তার যেসব ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল, সেগুলোর কথা ভারতকে জানিয়েছিল। প্রত্যুত্তরে ভারত বলেছে, তেমন কিছু হবে না। কিন্তু এখন বাস্তবে সেসব ক্ষতি চোখে দেখা যাচ্ছে। তারপরও যদি ভারত সেই ক্ষতি হওয়ার কথা মেনে না নেয় এবং তা কাটিয়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এগিয়ে না আসে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি? তখন সেই প্রতিবাদকে অকৃতজ্ঞতা বলা যাবে কি? যাবে না। এসব ভেবে আশা করেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলাপ করা হবে। কিন্তু তার দিল্লি সফর শেষে যে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, ভারতের ফারাক্কা বাঁধপ্রসূত বাংলাদেশের বহুমুখী সমস্যার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়নি। এতে হতাশ হয়েছি। বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিসেবে না দেখে প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধানে আর কথা খরচ না করে কাজে নেমে পড়ার ঘোষণা থাকলে বাংলাদেশের মানুষ অবশ্যই স্বস্তি পেত।
অদূর ভবিষ্যতে নয়াদিল্লিকে বর্তমান সরকারকে এবং তারপরও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বা নতুন কোনো সরকারকে বোঝাতে হবে যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সামগ্রিকভাবে দেখার প্রয়োজন আছে। সোজা কথায়, ভারত যখন বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু নেবে বা নিতে চাইবে, তখন নয়াদিল্লির শাসকদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে পরিবর্তে ভালো কিছু দিতে। ছঁরফ ঢ়ত্ড় ছঁড়, অর্থাত্ একটা নিলে আরেকটা দেয়া যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি, তা তো ভারত জানে। কাজেই অসুবিধা কোথায়? আর ন্যূনতম হলো, এমন যদি হয় যে ভারত কিছু নেবে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারবে না, সেক্ষেত্রেও নিশ্চিত করতে হবে যে, ভারত যা নিল তাতে যেন বাংলাদেশের ক্ষতি না হয়। নদীর পানির বেলায় কিন্তু উল্টোটাই ঘটছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বেশকিছু অসমতা আছে, এমনকি অযৌক্তিকভাবে। এখন সেগুলো খোলাখুলি আলোচনা করার সময় এসেছে।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments