সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান নিয়ে সংশয়ঃ খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে


বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কৃষককে ধান-চাল বিক্রি করতে নিরুত্সাহী করে তুলেছে। ফলে বাজারে নতুন ধান বিক্রি কমে গেছে। এর ফলে দামও বেড়েছে। এতে করে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ভেস্তে যেতে বসেছে। ধান-চালে উদ্বৃত্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া এমন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে গতকালের আমার দেশ।
গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে অনেক আশার বাণীও প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরুতেই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, যাতে হতাশ না হয়ে পারা যায় না। উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, নওগাঁ ও জয়পুরহাটের সরকারি গুদামগুলোতে ছটাক পরিমাণও ধান আসেনি। আর চালের সংগ্রহ যিকঞ্চিতই বলা যায়, লক্ষ্যমাত্রার শূন্য দশমিক ৫ ভাগেরও কম। এই তিন জেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার ৩৭৮ টন। জয়পুরহাট ছাড়া বাকি দুই জেলায় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অর্থাত্ এক মাসে চাল এসেছে মাত্র ১২০ টন। পরিস্থিতি যদি দেশের সর্বত্রই এমন হয় তবে তা সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব করে তুলবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাজারে ধান-চালের মূল্যের সঙ্গে সরকারি সংগ্রহ মূল্যের ফারাকের কারণেই কেউ ধান-চাল বিক্রিতে এগিয়ে আসছে না। প্রকারভেদে প্রতি মণ ধান বাজারে ৬৩০ থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারি সংগ্রহ মূল্য কেজিপ্রতি ১৪ টাকা অর্থাত্ মণপ্রতি ৫৬০ টাকা আর চালের সংগ্রহ মূল্য যেখানে কেজিপ্রতি ২২ টাকা সেখানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। অর্থাত্ হাটবাজারের চেয়ে ধানচালের সরকারি সংগ্রহ মূল্যের পার্থক্য ৩ থেকে ৪ টাকা। এ অবস্থায় কোনো কৃষকই সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহী হবে না, এটাই স্বাভাবিক। একই কারণে মিল মালিকরাও চাল সরবরাহে এগিয়ে আসছেন না। সাধারণত তালিকাভুক্ত মিল মালিকদের মাধ্যমেই খাদ্য বিভাগ বেশিরভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করে থাকে। এবার সেই মিলাররাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নওগাঁ জেলার ১ হাজার ২০০ মিলারের মধ্যে মাত্র ১৮০ জনের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের চুক্তি হওয়ার কথা জানা গেছে। বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। বগুড়ার দেড় হাজারের মধ্যে ১০০ এবং জয়পুরহাটের ৪১৬ জনের মধ্যে মাত্র ১৬ জন চুক্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। অবস্থার পরিবর্তন না হলে নিশ্চিতভাবেই সরকার খাদ্য সংগ্রহে মহাবিপদের মুখোমুখি হচ্ছে, তা জোর দিয়ে বলা যায়।
এর আগে খাদ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে জানা গিয়েছিল, গত বোরো মৌসুমে বাজারমূল্যের তুলনায় সরকারের সংগ্রহ মূল্য বেশি ছিল। কিন্তু তার পরও সরকার ঘোষিত মূল্য থেকে কৃষককে প্রত্যাশিত সুযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। সেজন্য ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন সরকারি মূল্যের সঙ্গে বাজারমূল্যের ব্যবধান সবকিছুই ভণ্ডুল করে দিতে বসেছে। বিগত দিনে মিলররা মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা নিয়ে লাভবান হওয়ায় সরকার থেকে রোপা আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার কথা বলা হয়েছিল। এটা কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবিও ছিল। কিন্তু বাজারের অবস্থা এখন সবকিছুকেই ব্যর্থতার মুখে ঠেলে দিয়েছে বলা যায়।
দেশের বাজার থেকে চাহিদামত ধান-চাল সংগ্রহ করা না গেলে সরকারের সামনে বিকল্প পথ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের দ্বারস্থ হওয়া। কিন্তু এবার সেখানকার অবস্থাও সুবিধার নয়। ভারত, ফিলিপাইন, ব্রাজিলসহ প্রধান প্রধান চাল রফতানিকারক দেশে ধানের উত্পাদন মার খাওয়ায় তারাই চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব না হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না। সময় থাকতেই বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারি সংগ্রহ মূল্য পুনর্নির্ধারণ এবং বাজারে ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, এটা মনে রাখা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.