ইয়াহিয়া খানরা নিজেদের ছাঁচে ইতিহাস গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন by জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
মার্চের শেষ সপ্তাহে শনিবারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা), ওয়ালী আশরাফ, মঞ্জু, এনামুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলাদেশি ছাত্র, শ্রমিক ও কতক চিকিৎসক জয় বাংলা ও শেখ মুজিবের মুক্তি চাই স্লোগান দিতে দিতে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে ৩০-৪০ বাঙালি ছাত্র আহত হয়।
ওই দিনই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন আসেন। তিনি পরিষ্কারভাবে সবাইকে জানিয়ে দেন, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তারা উঠতে না পারলে তিনি তাদের সঙ্গে নেই। তার দৃঢ় মনোভাবে সবার চৈতন্য জাগে
মার্চ ১৯৭১ সালে আমি বিলেতে। পাকিস্তানের প্রথম ভাসকুলার সার্জন হওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটেনের বিভিন্ন হাসপাতালে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। ইতিপূর্বে অর্থোপেডিক এবং থোরাসিক ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে ট্রেনিং নিয়েছি। ফেব্রুয়ারি '৭১ থেকে ইয়র্কশায়ারের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় শহর ইয়র্কের দুটি বড় হাসপাতালের জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির আমি রেজিস্ট্রার।
মে মাসে এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সত্তরের নির্বাচনে ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বিলেতের সব বাঙালির মনে আনন্দ। ফেব্রুয়ারি '৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উলেল্গখ করায় বাঙালির স্বপ্ন ভালোভাবে দানা বাঁধে।
তখনকার দিনে প্রায় দেড় লাখ পূর্ব পাকিস্তানি ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে) কাজ ও শিক্ষার জন্য বসবাস করতেন। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে মার্কসবাদের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা তো ছিল আর ছিল ছাত্রলীগ, এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি।
আওয়ামী লীগ সমর্থকরা যখন আনন্দে বিভোর, তখনও মওলানা ভাসানীর ন্যাপ সমর্থক ও মার্কসবাদীরা মনে করতেন, পাকিস্তান টিকবে না, 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' সময়ের ব্যাপার মাত্র। সামরিক সরকার এত সহজে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেখ মুজিবের হাতে দেবে না।
আমাদের উদ্বেগ সত্য প্রমাণিত হলো যেদিন ১ মার্চ '৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। ৩ মার্চ '৭১ থেকে ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। সম্ভবত ৪ মার্চ মার্কসবাদী এক অংশের নেতা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি ডা. আলতাফুর রহমান ফোনে জানান, ২ মার্চ ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছেন, ৩ মার্চ থেকে শেখ সাহেবের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে একই পতাকা উড়ছে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন।
বিলেতে পূর্ব পাকিস্তানি মার্কসবাদীদের তাত্তি্বক নেতা ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমদ। তাকে বললাম, মওলানা ভাসানীর 'লাকুম দ্বীনকুম ওয়ালিয়া দ্বীন তো বাস্তবায়নের পথে; দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিন।' জিয়া উদ্দিন আরও বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের বামরা শেখ মুজিবকে চিনলেন না, মওলানাকেও চিনতে পারল না। ডাক্তার এত উল্লসিত হইও না। সামন্ত শ্রেণীর পুঁজিবাদী নেতা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে ভালো চাল খেলেছেন, ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) শেখ মুজিবুর রহমানের ১৭-১৮ মিনিটের বক্তৃতা অত্যন্ত কুশলী রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে সামরিক আইন প্রশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, 'এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ' (মেজর সিদ্দিক সালিকের 'নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল')।
শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ মূল শর্ত ছিল_ সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলার মানুষ হত্যার কারণ অনুসন্ধানে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
দু'বার বলেছেন বক্তৃতার মাঝখানে এবং শেষে 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সিরাজুল আলম খানের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মিটিংয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা উত্তোলন করেননি, পতাকা সরিয়ে দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করলেন জয় বাংলা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে।
১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ দি ডেভিড ফ্রস্ট টিভি শোতে ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, রেসকোর্সের সভায় আমি ঘোষণা করি 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, শৃঙ্খল মোচনের এবং স্বাধীনতার। আমি সামরিক জান্তাকে সুযোগ দিতে চাইনি যে তারা বলুক মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে তাই তারা পাল্টা আঘাত হেনেছে।'
সবাই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। 'সবাই মিলে কিছু করতে হবে নতুবা দেশ শেষ হয়ে যাবে। কী করছ জানিও।' অধিক খবরের প্রত্যাশায় এক সন্ধ্যায় এসে হাজির হলাম তাসাদ্দুক আহমদের 'দি গেনজেস' রেস্তোরাঁয়। তাসাদ্দুক ভাই পুরনো কমিউনিস্ট, কিন্তু 'বিশ্বাসী' নয় বলে মণি সিংহরা তাকে পার্টি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেই দুঃখে তাসাদ্দুক ভাই বিলেত চলে এসেছিলেন। সব প্রগতিশীল লোকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ। কোনো অজুহাত ছাড়াই পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালি নিধনে নেমেছে।
'পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতের খপ্পরে পড়লে তো আমাদের লাভ হবে না, মিজোদের অবস্থা হবে আমাদের। মিজো নেতা লালডেঙ্গার কথা মনে রেখ। আমরা নিশ্চয়ই সিকিম হতে চাই না।' ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তির পথ কী? আমি প্রশ্ন করলাম তাসাদ্দক ভাইকে।
'নিজেদের টাকায় অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করা, বিদেশে আমাদের স্বপক্ষে মত সৃষ্টি। ব্রিটেনে প্রায় দেড় লাখ বাঙালি আছে। প্রত্যেকে প্রতিমাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দিলে, হিসাব কর মাসে কত স্টার্লিং পাউন্ড চাঁদা উঠবে? আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালাব স্বাধীনভাবে, আমাদের স্বাধীনতার জন্য।'
খোঁজ পেলাম, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জেনেভায় আছেন। লন্ডন হয়ে দেশে ফিরবেন।
৪ মার্চ '৭১ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি দেখা করতে গেলাম। তাকে বললাম, আপনার দেশে ফিরে যাওয়া চলবে না। লন্ডনে আপনাকে আমাদের দরকার। আপনি ছাড়া অন্য কেউ বহু বিভক্ত বাঙালিদের একত্র করতে পারবে না।
তাসাদ্দক ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপের কথাও তাকে জানালাম। তাসাদ্দুক ভাইয়ের অতীতও বললাম।
আমি বিদায় নিয়ে ইয়র্ক ফিরে গেলাম। তিনি পরের দিন জেনেভায় পেঁৗছে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। লন্ডন ও তার আশপাশের শহর ও শহরতলিতে এক হাজারের অধিক ডাক্তার কাজ করতেন, অধিকাংশই ছোট হাসপাতালে, কনভালেসেন্ট হোমে এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে। কিছুসংখ্যক ডাক্তার কাজ করতেন জেনারেল প্রাকটিশনার্স হিসেবে। তাদের হাতে যথেষ্ট পয়সা ছিল।
ব্রিটেনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় মার্চের শেষে এবং মিডল্যান্ড ব্যাংকে (বর্তমানে এইচএসবিসি) সংস্থার অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সব ডাক্তারকে প্রতিমাসে বাংলাদেশের জন্য দশ পাউন্ড করে চাঁদা দেওয়ার জন্য ব্যাংকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
দশ পাউন্ডের কথা থাকলেও ডা. মাজমাদার, ডা. কাজী ফজলুল হক, আবদুর রহিম দোভাষ ও আরও কয়েকজন বিশ পাউন্ড করে প্রতি মাসে চাঁদা দিতেন। সব ব্যাপারে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন নিউইয়র্কের মার্কসবাদী ডা. খন্দকার এম আলমগীর ও তার স্ত্রী ডা. রোকেয়া আলমগীর।
ডা. নজরুল স্বাধীনতার পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন হারলে স্ট্রিটে ১৯৭২ সালে দি লন্ডন ক্লিনিকে বঙ্গবন্ধুর পিত্তথলির পাথর ও প্রদাহযুক্ত এপেনডিসেকটমি অপারেশনে রানী এলিজাবেথের শৈল্যচিকিৎসক স্যার অ্যাডওয়ার্ড মুরের সহকারীরূপে কাজ করে। তবে প্রশ্ন উঠেছিল, এই অপারেশন ঢাকায় হয়নি কেন? কোলিসিসটেকটমি ও এপেনডিসেকটমি অপারেশন করার যোগ্যতাসম্পন্ন সার্জন কি বাংলাদেশে ছিল না? বহু যোগ্যতাসম্পন্ন সার্জন ছিল। অপারেশন থিয়েটার ও সেবিকা ছিল। কিন্তু অপারেশনের কারণে সার্জনরা বঙ্গবন্ধুর নৈকট্য পাবেন, এটা জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
বাংলাদেশের দাবির সমর্থনে ব্রিটেনের কতক যুবক-যুবতী গঠন করেন 'অ্যাকশন বাংলাদেশ'। নেতৃত্বে ছিলেন স্কুলশিক্ষক পল কনেট ও তার স্ত্রী ইলিন কনেট এবং প্রাক্তন এক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কন্যা ম্যারিয়েটা প্রকোপে। ম্যারিয়েটা তার নর্থ ওয়েস্টে লন্ডনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলার ফ্ল্যাটটি অ্যাকশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগার কার্যক্রমের জন্য বিনা ভাড়ায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। সারাদিন জীবিকার জন্য কাজ করে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় অ্যাকশন বাংলাদেশের অফিসে কয়েক ঘণ্টা কাজ করতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়ে রেবা ফনসেকা সম্পূর্ণ বিনা বেতনে। তাদের সাহায্য করতে যেতেন সাদেক খানের স্ত্রী রুনী খান।
স্বাধীনতার পরপর ম্যারিয়েটা বাংলাদেশে এসে জনগণের দুর্দশা দেখে খুব ব্যথিত হয়ে ব্রিটেনে ফিরে আত্মহত্যা করেন। তিনি উইল করে গিয়েছিলেন তার প্রাপ্য সম্পত্তি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে দেওয়ার জন্য; কিন্তু তার ছোট ভাই ড. জন প্রকোপ মানসিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে ম্যারিয়েটার দান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ম্যারিয়েটার আইনজ্ঞরা আমাদের জানান যে, ড. প্রকোপের এই মামলা কোনোক্রমে টিকবে না। মৃত্যুর পর ম্যারিয়েটার প্রতি কোনো অসম্মান হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। আমি ক্যামব্রিজে ৪৫ ল্যান্সফিল্ড রোডে ড. জন এফ প্রকোপের সঙ্গে দেখা করে বললাম, তোমার বোন বাংলাদেশকে এত দিয়েছে, আমাদের আর নতুন দানের দরকার নেই। তার সম্পত্তি আমি তোমাকে দিচ্ছি, ম্যারিয়েটাকে তুমি শান্তিতে ঘুমাতে দাও।
মার্চের শেষ সপ্তাহে শনিবারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা), ওয়ালী আশরাফ, মঞ্জু, এনামুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলাদেশি ছাত্র, শ্রমিক ও কতক চিকিৎসক জয় বাংলা ও শেখ মুজিবের মুক্তি চাই স্লোগান দিতে দিতে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে ৩০-৪০ বাঙালি ছাত্র আহত হয়। ওই দিনই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন আসেন। তিনি পরিষ্কারভাবে সবাইকে জানিয়ে দেন, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তারা উঠতে না পারলে তিনি তাদের সঙ্গে নেই। তার দৃঢ় মনোভাবে সবার চৈতন্য জাগে।
লিংকনস ইনের পাস করা ব্যারিস্টার, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ায় এবং জেনেভাস্থ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে তার ভূমিকার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ সহজে হয়েছিল। তার কাজে সহায়তা করেছে অ্যাকশন বাংলাদেশ, তাসাদ্দুক আহমদ ও আরও অনেকে। লন্ডনে এসে তিনি প্রথম দেখা করলেন ব্রিটেন সরকারের দক্ষিণ এশিয়া প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হিউম ও বৈদেশিক সাহায্য মন্ত্রী রিচার্ড উডের সঙ্গে। সমর্থন জোগালেন পিটার শোর, ব্রুস ডগলাসম্যান ও মাইকেল বার্নসের। কালবিলম্ব না করে দেখা করলেন কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল আরনল্ড স্মিথ ও পরিচালক উইলিয়াম পিটার্সের সঙ্গে। তিনি কয়েকবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ এবং সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। ইতিমধ্যে এপ্রিলের শুরুতে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি তরুণ মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের আন্দোলনে যোগ দেন। বলাবাহুল্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বাংলাদেশি বহু ডিপেল্গাম্যাটদের মহিউদ্দিনই প্রথম সাহস ও দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
মহিউদ্দিনের যোগদানে আন্দোলন বেগবান হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছুটে বেড়াতে থাকেন বিলেতের এক শহর থেকে অপর শহরে। ব্রিটেনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন রাজধানীতে। চারদিকের চাপে পাকিস্তান সরকার বিচলিত হয়, বারবার সামরিক আদালত কার্যক্রম শুরুর তারিখ পরিবর্তন হতে থাকে। অতি ধীরে ধীরে মেঘ সরতে থাকে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মহিউদ্দিন ও অ্যাকশন বাংলাদেশের সহায়তায় নোবেল বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোন ম্যাকরাইডকে পাকিস্তান পাঠান সামরিক কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। সাক্ষাৎ না হলেও সংবাদপত্রকে শোন ম্যাকরাইড জানিয়ে দেন, শেখ মুজিবুরের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহমর্মিতা ও বিশ্ববাসীর সমর্থন এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার সংবাদ।
বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শক্রমে কভেন্ট্রিতে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। অনেক মহিলাও আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন, উলেল্গখযোগ্য হলেন জেবুন্নেছা বকস্, লুলু বিলকিস বানু, মিসেস জগলুল পাশা প্রমুখ।
লন্ডনের একটি দৈনিকে সম্ভবত গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছিল 'বাঙালিরা শান্তিপ্রিয়, প্রায় সবাই কবিতা লিখে, গান গায়। দুই বাঙালি এক জায়গায় থাকলে তিনটি রাজনৈতিক দল করে_ দু'জনে আলাদা দুটি এবং দু'জনে মিলে তৃতীয়টি। ঢাকায় গণহত্যা বাঙালিদের ক্ষিপ্ত করেছে, এবার তারা পাকিস্তানিদের মারবে এবং সম্ভবত সত্বর একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে।' বাস্তবে তাই হয়েছিল। পরের ইতিহাস সবার জানা।
শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে গেলেন ইতিহাসের সন্তান। জজ সাহেবদের কালিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না। ইয়াহিয়া খানরা নিজেদের ছাঁচে ফেলে ইতিহাস গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। ইতিহাস দর্জিছাঁটা পোশাক নয়। ইতিহাসবিদরা ইতিহাস সৃষ্টি করেন না, তারা কেবল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন।
স ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী :পরিচালক
গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল
মার্চ ১৯৭১ সালে আমি বিলেতে। পাকিস্তানের প্রথম ভাসকুলার সার্জন হওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটেনের বিভিন্ন হাসপাতালে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। ইতিপূর্বে অর্থোপেডিক এবং থোরাসিক ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে ট্রেনিং নিয়েছি। ফেব্রুয়ারি '৭১ থেকে ইয়র্কশায়ারের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় শহর ইয়র্কের দুটি বড় হাসপাতালের জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির আমি রেজিস্ট্রার।
মে মাসে এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সত্তরের নির্বাচনে ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বিলেতের সব বাঙালির মনে আনন্দ। ফেব্রুয়ারি '৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উলেল্গখ করায় বাঙালির স্বপ্ন ভালোভাবে দানা বাঁধে।
তখনকার দিনে প্রায় দেড় লাখ পূর্ব পাকিস্তানি ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে) কাজ ও শিক্ষার জন্য বসবাস করতেন। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে মার্কসবাদের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা তো ছিল আর ছিল ছাত্রলীগ, এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি।
আওয়ামী লীগ সমর্থকরা যখন আনন্দে বিভোর, তখনও মওলানা ভাসানীর ন্যাপ সমর্থক ও মার্কসবাদীরা মনে করতেন, পাকিস্তান টিকবে না, 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' সময়ের ব্যাপার মাত্র। সামরিক সরকার এত সহজে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেখ মুজিবের হাতে দেবে না।
আমাদের উদ্বেগ সত্য প্রমাণিত হলো যেদিন ১ মার্চ '৭১ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। ৩ মার্চ '৭১ থেকে ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। সম্ভবত ৪ মার্চ মার্কসবাদী এক অংশের নেতা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি ডা. আলতাফুর রহমান ফোনে জানান, ২ মার্চ ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছেন, ৩ মার্চ থেকে শেখ সাহেবের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে একই পতাকা উড়ছে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন।
বিলেতে পূর্ব পাকিস্তানি মার্কসবাদীদের তাত্তি্বক নেতা ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমদ। তাকে বললাম, মওলানা ভাসানীর 'লাকুম দ্বীনকুম ওয়ালিয়া দ্বীন তো বাস্তবায়নের পথে; দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিন।' জিয়া উদ্দিন আরও বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের বামরা শেখ মুজিবকে চিনলেন না, মওলানাকেও চিনতে পারল না। ডাক্তার এত উল্লসিত হইও না। সামন্ত শ্রেণীর পুঁজিবাদী নেতা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে ভালো চাল খেলেছেন, ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) শেখ মুজিবুর রহমানের ১৭-১৮ মিনিটের বক্তৃতা অত্যন্ত কুশলী রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে সামরিক আইন প্রশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, 'এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ' (মেজর সিদ্দিক সালিকের 'নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল')।
শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ মূল শর্ত ছিল_ সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলার মানুষ হত্যার কারণ অনুসন্ধানে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
দু'বার বলেছেন বক্তৃতার মাঝখানে এবং শেষে 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সিরাজুল আলম খানের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মিটিংয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা উত্তোলন করেননি, পতাকা সরিয়ে দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করলেন জয় বাংলা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে।
১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ দি ডেভিড ফ্রস্ট টিভি শোতে ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, রেসকোর্সের সভায় আমি ঘোষণা করি 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, শৃঙ্খল মোচনের এবং স্বাধীনতার। আমি সামরিক জান্তাকে সুযোগ দিতে চাইনি যে তারা বলুক মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে তাই তারা পাল্টা আঘাত হেনেছে।'
সবাই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। 'সবাই মিলে কিছু করতে হবে নতুবা দেশ শেষ হয়ে যাবে। কী করছ জানিও।' অধিক খবরের প্রত্যাশায় এক সন্ধ্যায় এসে হাজির হলাম তাসাদ্দুক আহমদের 'দি গেনজেস' রেস্তোরাঁয়। তাসাদ্দুক ভাই পুরনো কমিউনিস্ট, কিন্তু 'বিশ্বাসী' নয় বলে মণি সিংহরা তাকে পার্টি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেই দুঃখে তাসাদ্দুক ভাই বিলেত চলে এসেছিলেন। সব প্রগতিশীল লোকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ। কোনো অজুহাত ছাড়াই পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালি নিধনে নেমেছে।
'পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতের খপ্পরে পড়লে তো আমাদের লাভ হবে না, মিজোদের অবস্থা হবে আমাদের। মিজো নেতা লালডেঙ্গার কথা মনে রেখ। আমরা নিশ্চয়ই সিকিম হতে চাই না।' ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তির পথ কী? আমি প্রশ্ন করলাম তাসাদ্দক ভাইকে।
'নিজেদের টাকায় অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করা, বিদেশে আমাদের স্বপক্ষে মত সৃষ্টি। ব্রিটেনে প্রায় দেড় লাখ বাঙালি আছে। প্রত্যেকে প্রতিমাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দিলে, হিসাব কর মাসে কত স্টার্লিং পাউন্ড চাঁদা উঠবে? আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালাব স্বাধীনভাবে, আমাদের স্বাধীনতার জন্য।'
খোঁজ পেলাম, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জেনেভায় আছেন। লন্ডন হয়ে দেশে ফিরবেন।
৪ মার্চ '৭১ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি দেখা করতে গেলাম। তাকে বললাম, আপনার দেশে ফিরে যাওয়া চলবে না। লন্ডনে আপনাকে আমাদের দরকার। আপনি ছাড়া অন্য কেউ বহু বিভক্ত বাঙালিদের একত্র করতে পারবে না।
তাসাদ্দক ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপের কথাও তাকে জানালাম। তাসাদ্দুক ভাইয়ের অতীতও বললাম।
আমি বিদায় নিয়ে ইয়র্ক ফিরে গেলাম। তিনি পরের দিন জেনেভায় পেঁৗছে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। লন্ডন ও তার আশপাশের শহর ও শহরতলিতে এক হাজারের অধিক ডাক্তার কাজ করতেন, অধিকাংশই ছোট হাসপাতালে, কনভালেসেন্ট হোমে এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে। কিছুসংখ্যক ডাক্তার কাজ করতেন জেনারেল প্রাকটিশনার্স হিসেবে। তাদের হাতে যথেষ্ট পয়সা ছিল।
ব্রিটেনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় মার্চের শেষে এবং মিডল্যান্ড ব্যাংকে (বর্তমানে এইচএসবিসি) সংস্থার অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সব ডাক্তারকে প্রতিমাসে বাংলাদেশের জন্য দশ পাউন্ড করে চাঁদা দেওয়ার জন্য ব্যাংকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
দশ পাউন্ডের কথা থাকলেও ডা. মাজমাদার, ডা. কাজী ফজলুল হক, আবদুর রহিম দোভাষ ও আরও কয়েকজন বিশ পাউন্ড করে প্রতি মাসে চাঁদা দিতেন। সব ব্যাপারে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন নিউইয়র্কের মার্কসবাদী ডা. খন্দকার এম আলমগীর ও তার স্ত্রী ডা. রোকেয়া আলমগীর।
ডা. নজরুল স্বাধীনতার পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন হারলে স্ট্রিটে ১৯৭২ সালে দি লন্ডন ক্লিনিকে বঙ্গবন্ধুর পিত্তথলির পাথর ও প্রদাহযুক্ত এপেনডিসেকটমি অপারেশনে রানী এলিজাবেথের শৈল্যচিকিৎসক স্যার অ্যাডওয়ার্ড মুরের সহকারীরূপে কাজ করে। তবে প্রশ্ন উঠেছিল, এই অপারেশন ঢাকায় হয়নি কেন? কোলিসিসটেকটমি ও এপেনডিসেকটমি অপারেশন করার যোগ্যতাসম্পন্ন সার্জন কি বাংলাদেশে ছিল না? বহু যোগ্যতাসম্পন্ন সার্জন ছিল। অপারেশন থিয়েটার ও সেবিকা ছিল। কিন্তু অপারেশনের কারণে সার্জনরা বঙ্গবন্ধুর নৈকট্য পাবেন, এটা জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
বাংলাদেশের দাবির সমর্থনে ব্রিটেনের কতক যুবক-যুবতী গঠন করেন 'অ্যাকশন বাংলাদেশ'। নেতৃত্বে ছিলেন স্কুলশিক্ষক পল কনেট ও তার স্ত্রী ইলিন কনেট এবং প্রাক্তন এক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কন্যা ম্যারিয়েটা প্রকোপে। ম্যারিয়েটা তার নর্থ ওয়েস্টে লন্ডনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলার ফ্ল্যাটটি অ্যাকশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগার কার্যক্রমের জন্য বিনা ভাড়ায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। সারাদিন জীবিকার জন্য কাজ করে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় অ্যাকশন বাংলাদেশের অফিসে কয়েক ঘণ্টা কাজ করতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়ে রেবা ফনসেকা সম্পূর্ণ বিনা বেতনে। তাদের সাহায্য করতে যেতেন সাদেক খানের স্ত্রী রুনী খান।
স্বাধীনতার পরপর ম্যারিয়েটা বাংলাদেশে এসে জনগণের দুর্দশা দেখে খুব ব্যথিত হয়ে ব্রিটেনে ফিরে আত্মহত্যা করেন। তিনি উইল করে গিয়েছিলেন তার প্রাপ্য সম্পত্তি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে দেওয়ার জন্য; কিন্তু তার ছোট ভাই ড. জন প্রকোপ মানসিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে ম্যারিয়েটার দান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ম্যারিয়েটার আইনজ্ঞরা আমাদের জানান যে, ড. প্রকোপের এই মামলা কোনোক্রমে টিকবে না। মৃত্যুর পর ম্যারিয়েটার প্রতি কোনো অসম্মান হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। আমি ক্যামব্রিজে ৪৫ ল্যান্সফিল্ড রোডে ড. জন এফ প্রকোপের সঙ্গে দেখা করে বললাম, তোমার বোন বাংলাদেশকে এত দিয়েছে, আমাদের আর নতুন দানের দরকার নেই। তার সম্পত্তি আমি তোমাকে দিচ্ছি, ম্যারিয়েটাকে তুমি শান্তিতে ঘুমাতে দাও।
মার্চের শেষ সপ্তাহে শনিবারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা), ওয়ালী আশরাফ, মঞ্জু, এনামুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলাদেশি ছাত্র, শ্রমিক ও কতক চিকিৎসক জয় বাংলা ও শেখ মুজিবের মুক্তি চাই স্লোগান দিতে দিতে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে ৩০-৪০ বাঙালি ছাত্র আহত হয়। ওই দিনই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন আসেন। তিনি পরিষ্কারভাবে সবাইকে জানিয়ে দেন, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তারা উঠতে না পারলে তিনি তাদের সঙ্গে নেই। তার দৃঢ় মনোভাবে সবার চৈতন্য জাগে।
লিংকনস ইনের পাস করা ব্যারিস্টার, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ায় এবং জেনেভাস্থ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে তার ভূমিকার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ সহজে হয়েছিল। তার কাজে সহায়তা করেছে অ্যাকশন বাংলাদেশ, তাসাদ্দুক আহমদ ও আরও অনেকে। লন্ডনে এসে তিনি প্রথম দেখা করলেন ব্রিটেন সরকারের দক্ষিণ এশিয়া প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হিউম ও বৈদেশিক সাহায্য মন্ত্রী রিচার্ড উডের সঙ্গে। সমর্থন জোগালেন পিটার শোর, ব্রুস ডগলাসম্যান ও মাইকেল বার্নসের। কালবিলম্ব না করে দেখা করলেন কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল আরনল্ড স্মিথ ও পরিচালক উইলিয়াম পিটার্সের সঙ্গে। তিনি কয়েকবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ এবং সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। ইতিমধ্যে এপ্রিলের শুরুতে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি তরুণ মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের আন্দোলনে যোগ দেন। বলাবাহুল্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বাংলাদেশি বহু ডিপেল্গাম্যাটদের মহিউদ্দিনই প্রথম সাহস ও দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
মহিউদ্দিনের যোগদানে আন্দোলন বেগবান হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছুটে বেড়াতে থাকেন বিলেতের এক শহর থেকে অপর শহরে। ব্রিটেনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন রাজধানীতে। চারদিকের চাপে পাকিস্তান সরকার বিচলিত হয়, বারবার সামরিক আদালত কার্যক্রম শুরুর তারিখ পরিবর্তন হতে থাকে। অতি ধীরে ধীরে মেঘ সরতে থাকে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মহিউদ্দিন ও অ্যাকশন বাংলাদেশের সহায়তায় নোবেল বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোন ম্যাকরাইডকে পাকিস্তান পাঠান সামরিক কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। সাক্ষাৎ না হলেও সংবাদপত্রকে শোন ম্যাকরাইড জানিয়ে দেন, শেখ মুজিবুরের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহমর্মিতা ও বিশ্ববাসীর সমর্থন এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার সংবাদ।
বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শক্রমে কভেন্ট্রিতে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। অনেক মহিলাও আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন, উলেল্গখযোগ্য হলেন জেবুন্নেছা বকস্, লুলু বিলকিস বানু, মিসেস জগলুল পাশা প্রমুখ।
লন্ডনের একটি দৈনিকে সম্ভবত গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছিল 'বাঙালিরা শান্তিপ্রিয়, প্রায় সবাই কবিতা লিখে, গান গায়। দুই বাঙালি এক জায়গায় থাকলে তিনটি রাজনৈতিক দল করে_ দু'জনে আলাদা দুটি এবং দু'জনে মিলে তৃতীয়টি। ঢাকায় গণহত্যা বাঙালিদের ক্ষিপ্ত করেছে, এবার তারা পাকিস্তানিদের মারবে এবং সম্ভবত সত্বর একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে।' বাস্তবে তাই হয়েছিল। পরের ইতিহাস সবার জানা।
শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে গেলেন ইতিহাসের সন্তান। জজ সাহেবদের কালিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না। ইয়াহিয়া খানরা নিজেদের ছাঁচে ফেলে ইতিহাস গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। ইতিহাস দর্জিছাঁটা পোশাক নয়। ইতিহাসবিদরা ইতিহাস সৃষ্টি করেন না, তারা কেবল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন।
স ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী :পরিচালক
গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল
No comments