চালের বাজারে পাক-ভারতের দাপটঃ আমরা অসহায় by নোমান চৌধুরী


খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যখন আমাদের সর্বক্ষণ তাড়া করে, এই নিরাপত্তার বিষয়টি যখন অনেক সময় আমাদের নীতি-নির্ধারকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন নিকটতম দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চালের বাজারে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। আয় করছে কাড়ি কাড়ি ডলার। যা আমাদের দেশের কাছে অকল্পনীয়।

ভারত গত ৪ জানুয়ারি ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দি হিন্দু জানিয়েছে, চলতি অর্থ বছরের ৯ মাসে ডিসেম্বর পর্যন্ত (ভারতের অর্থবছর এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী মার্চে শেষ হয়) বাসমতি চাল রফতানির পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৪৩.৭৫ ভাগ বেড়েছে। পূর্ববর্তী বছর রফতানির পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ টন। ইতোমধ্যে বছরের প্রথম ৯ মাসেই ২৩ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। পোসা-১১২১ চাল ২০০৮ সালে বাসমতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পোসার দর কম ও বর্ধিত চাহিদার কারণে রফতানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। বছরের জানুয়ারি, ফ্রেবুয়ারি ও মার্চ এই ৩ মাসে রফতানির পরিমাণ বেড়ে ৩০ লাখ টনে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি টন পোসা দেড় হাজার ডলার বিক্রির জন্য চুক্তি হচ্ছে বলে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই’র বরাত দিয়ে দি হিন্দু খবরটি জানিয়েছে। তবে যদ্দুর জানা গেছে, পোসা-১১২১ মূলত বাসমতি নয়। ভারতীয় কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইরান ভারতীয় চালের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক। ইরানের স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়েল রিসার্চ ল্যাবরেটরি পোসা-১১২১ চাল পরীক্ষা করে তাতে টক্সিক ক্যামিকেলস (বিষাক্ত কেমিক্যাল)-এর সন্ধান পেয়েছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
পাকিস্তান
রয়টার্স জানিয়েছে, চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে পাকিস্তান বাসমতি ও নন বাসমতি চাল রফতানির মাধ্যমে ১.০৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৭ হাজার ২৮০ কোটি টাকা) আয় করেছে। পাকিস্তানের চাল রফতানিকারক সমিতি রয়টার্সকে জানিয়েছে, করাচি, লাহোর ও কোয়েটার রফতানিকারকরা নন বাসমতি চাল ১.৪৬০৯২৩ মিলিয়ন টন রফতানি করে ৬৬.২৪৬ কোটি টাকার (প্রায় ৪ হাজার ৬৩৭ কোটি ২২ লাখ টাকা) আয় করে। একই সময়ে ০.৪৪ টন বাসমতি চাল রফতানি করে আয় করেছে ৩৮.০৪৬ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ৬৬৩ কোটি ২২ লাখ টাকা)। পাকিস্তানের রফতানিকারকরা ক্রেতার সন্ধানে এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ পেয়েছেন। চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উত্পাদন হ্রাসের আশঙ্কা থাকলেও পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে চাল রফতানি করছেন। পাকিস্তান সরকার তাদের বছরে ৪০ লাখ টন পর্যন্ত রফতানির সুযোগ দিয়েছে। পাকিস্তানি বাসমতি চালের মান উন্নত হওয়ায় বিদেশের বাজারে ভারতীয় চাল অপেক্ষা প্রতিটন ৫০ ডলার অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।
পাক-ভারতের অবস্থার নেপথ্যে
পাকিস্তান কিংবা ভারত দুটি দেশই অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে জর্জরিত। মাওবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, স্বাধীনতাকামী কিংবা ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়ে প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে, মানুষ মরছে। এরপরও খাদ্য উত্পাদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রার পেছনে সরকারসমূহের একাগ্রতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। ১২০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ সরাসরি কৃষিনির্ভর। এদের মধ্যে ৭৫ ভাগই প্রকৃতিনির্ভর। প্রকৃতি নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো একের পর এক প্রকল্প নিয়ে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২৫ বছরে হয়তো ভারতের খাদ্যশস্য উত্পাদনের ধারা পাল্টে যাবে। তখন বিশ্বের অনেক দেশই ভারতের খাদ্যশস্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আজকের ধনী দেশগুলোও যদি ভারতের উপর খাদ্যনির্ভর হয়ে পড়ে তখন আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। বর্তমান মুহূর্তেই ভারত গম উত্পাদনের দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া ফেডারেশন, চীন ও আমেরিকা রয়েছে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে। পাকিস্তানের স্থান হচ্ছে নবম। পক্ষান্তরে ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাকিস্তানে কৃষি উত্পাদনের পেছনে রয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। প্রকৃতি নির্ভরতা নেই বললেই চলে। প্রায় সমুদয় কৃষি জমি সেচ সুবিধার আওতায়। আর সরকারই এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সরকারি প্রচেষ্টার ফলে মরু আরবের খেজুর এখন পাকিস্তানেও ফলছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি খেজুর উত্পাদনকারী দেশের তালিকায় পাকিস্তান পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ
খাদ্যশস্য উত্পাদনে পাক ভারতের তুলনায় আমরা আছি অসহায় অবস্থায়। যদিও বাংলাদেশের কৃষি জমি উর্বরতার দিক থেকে বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় উত্তম। অথচ খাদ্য সঙ্কট লেগেই আছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশকে খাদ্যশস্যসহ কৃষি পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে কৃষি জমি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২৫ বছর পর নতুন বাড়ি-ঘর, সড়ক, সরকারি, বেসরকারি স্থাপনার কারণে যদি কৃষি উত্পাদনযোগ্য ভূমি অবশিষ্ট না থাকে তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। তখন দেশের লোকসংখ্যা ৩০ কোটি অতিক্রম না করলেও ছুঁই ছুঁই করবে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে কি কোনো সরকারের পক্ষে আমদানি করা সম্ভব? কি পরিণতি হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। কৃষি জমিই যদি না থাকে তখন সার ডিজেলে ভতুর্কি নয়, বিনামূল্যে দেয়া হলেও কি উত্পাদন বাড়বে? কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা না হলে ভর্তুকি নয়, সার ডিজেল বিনামূল্যে দিলেও উত্পাদন বাড়বে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ১ ফসলী বা ২ ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যেখানে বাঁধ, বেড়ি বাঁধের প্রয়োজন সেখানে তা করতে হবে। সেচ সুবিধা সরকারি উদ্যোগে সম্প্রসারণ ও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, জনসংখ্যা ও কৃষি ক্ষেত্রের প্রতি আমাদের নীতিনির্ধারকদের কার্যকর দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। দেশ কৃষিনির্ভর হলেও কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর জন্য একক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) হঠকারী সরকারি সিদ্ধান্তের শিকার। বিএডিসিকে অনেক আগেই পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। যদিও বিএডিসিই ধুন-শেওতির স্থলে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে। অত্যন্ত সক্রিয় ও প্রকৌশলী বেষ্টিত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরকে (এলজিইডি) কৃষি উত্পাদনের ক্ষেত্রে ১ হাজার হেক্টরের হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও এলজিইডি যে কোনো ধরনের কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। তাদের যথেষ্ট দক্ষ জনবলও রয়েছে। কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের বাড়তি জনবলেরও প্রয়োজন পড়বে না। কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে ১ হাজার হেক্টরের সিলিং রাখা হতো না। দেশের সার্বিক কৃষি উত্পাদনের স্বার্থে এই সিলিং কি রদ করা যায় না? কার স্বার্থে এই সিলিং? কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সম্পর্কে কিছু না বলাই শ্রেয়, কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য তাদের কোনো বাস্তব পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। মাঝে মধ্যে কেবল কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা শোনা যায়। কৃষি ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে সেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে চলছে স্থবিরতা। জমিতে অধিক ফলনের পেছনে রয়েছে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাতের ধান। কৃষিতে দেশকে ভারত ও পাকিস্তানের সমকক্ষে করা না গেলেও এলজিইডির ১ হাজার হেক্টরের সিলিং প্রত্যাহার ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা চাঙ্গা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বাঞ্ছিত ফল লাভ করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
E-mail : dailyprobhakar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.