চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-পুলিশের সদাচরণ : মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় by যতীন সরকার
দুপুর রাতে আমার বাসায় একদঙ্গল পুলিশের উপস্থিতিতে সারাটা পাড়া সচকিত হয়ে উঠেছিল। আমার বাইরের ঘরের দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা এবং সম্মিলিত কণ্ঠের কথা- 'স্যার, দরজা খোলেন, দরজা খোলেন।' আমি তখনো ঘুমোইনি। বাইরের ঘরের দরজা খুলতে যাব, ঠিক সে সময়ই আমার শয়নকক্ষের দরজায়ও ধাক্কা। বুঝলাম, বাসার দেয়াল টপকে বেশ
কয়েকজন পুলিশ মহোদয়ের সেখানে প্রবেশ ঘটেছে। পুলিশদের কেউই আমার সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করেননি। তাঁরা বরং বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, 'স্যার, আমাদের সঙ্গে আপনাকে থানায় যেতে হবে। রাত দুপুরে এভাবে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত।'
কিন্তু পুলিশের সঙ্গে যে দুটি 'ফেউ' এসেছিল, তাদের ব্যবহার ছিল অন্য রকম। তারা আমার বিরুদ্ধে এটা-সেটা বলে পুলিশদের উত্তেজিত করে তুলতে চাইছিল। যদিও 'ফেউ' দুটির মুখ ছিল রুমালে ঢাকা, তবুও এদের একটিকে আমার ও আমার স্ত্রীর একান্ত চেনা বলে মনে হয়েছিল। কারণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বাসার যে আসবাবপত্র লুট হয়ে যায়, সেসবের অনেকই আমরা খুঁজে পাই ওই লোকটির ঘরে। ওরই মতো অন্য লুটেরাও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বছর তিনেক একান্তই কোণঠাসা হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে ওদের প্রবল পরাক্রমে আমরাই পর্যুদস্ত। বলতে গেলে ওরাই যেন এ দেশের ক্ষমতার ধারক-বাহক। ওদের ভয়েই আমরা জবুথবু হয়ে থাকি।
ওই 'ফেউ' দুটিই আমার বিছানার পাশে বড় টেবিলটিতে রাখা বইয়ের স্তূপটির প্রতি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। পুলিশের বক্তব্য ছিল, 'এত এত বই দেখার সময় নেই, এখনই চলে যেতে হবে আমাদের।'
সঙ্গে সঙ্গেই 'ফেউ'টি স্তূপের ভেতর থেকে একটা বই নিয়ে এক পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বলল, 'এই দেখুন স্যার।' বইটির শিরোনাম দেখেই পুলিশের প্রচণ্ড ধমক, 'শালা, ওটা তো ব্যাকরণ।'
এরপর পাওয়া গেল 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস', 'ভাষার ইতিবৃত্ত', 'উপন্যাসের ধারা' ইত্যাদি। কিন্তু কিছু 'আপত্তিকর' বই তো পাওয়া দরকার। তা না হলে পুলিশের 'প্রেস্টিজ' থাকে কী করে! সেই প্রেস্টিজ রক্ষার জন্যই বোধ হয় 'আপত্তিকর' বই হয়ে গেল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঙালির ইতিহাস' এবং 'সোভিয়েত লিটারেচার'-এর কয়েকটি সংখ্যা! এগুলোই পুলিশ ঝোলায় পুরে নিল।
দুজন পুলিশ কনস্টেবল আমাকে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। পথে যেতে যেতে তারা আমার সঙ্গে খুবই সৌজন্যসূচক কথাবার্তা বলল। থানায়ও পুলিশদের সৌজন্যশীল আচরণেরই পরিচয় পেলাম- দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহ শহরে কলেজে মাস্টারি করি বলেই হয়তো।
সেই রাতেই (৩ মার্চ, ১৯৭৬) শহর থেকে পুলিশ আরো তিনজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল। ধৃত তিনজনই আমার একান্ত অন্তরঙ্গ সুহৃদ। একজন আমার সহকর্মী অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম। অন্য দুজনের একজন অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ও অন্যজন অ্যাডভোকেট আবদুল কুদ্দুস।
আবদুর রশিদ পরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হয়েছিলেন, বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। আবদুল কুদ্দুস এখনো হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত।
প্রথম থানাহাজতে রাখা হলেও রাতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি বা বড় দারোগা) আমাদের হাজত থেকে বের করে নিয়ে এলেন এবং অন্য পুলিশরা যেখানে বসেন, সেখানেই চারজনকে চেয়ারে উপবিষ্ট থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
পরদিন সকালেই গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে আমাদের সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা দলে দলে থানায় এসে ভিড় করলেন। সারা দিন ধরেই একের পর এক তাঁরা আসতে লাগলেন। সেই ভিড় সামলানো যদিও পুলিশদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তবু দর্শনার্থীদের সঙ্গে তাঁরা কেউই বিরূপ আচরণ করেননি। বিশেষ করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বড় দারোগার সদাচরণে সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। কারণ ডাণ্ডাধারী দারোগা-পুলিশদের মুখ থেকে যে সর্বদা অভিধানবহির্ভূত অশিষ্ট শব্দবন্ধনই নির্গত হয়- এমনটিই এত দিন ধরে তাঁদের জানা ছিল। অথচ আজকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতিই প্রত্যক্ষ করলেন। কাজেই তাঁদের বিস্ময় তো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
গ্রেপ্তার হওয়ার পরবর্তী রাতটিও আমরা থানায়ই কাটালাম। থানাহাজতে না নিয়ে থানার মূল কক্ষে পুলিশদের পাশেই আমাদের বিছানা পেতে দেওয়া হলো। 'কোনো অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জানাবেন'- পাশে উপবিষ্ট কয়েকজন পুলিশের মুখে বেশ কয়েকবারই এ কথাটি উচ্চারিত হলো এবং প্রতিবারের উচ্চারণই বিনয়ের স্পর্শমণ্ডিত।
শুয়ে শুয়ে অনেক কথাই ভাবছিলাম। পুলিশদের সম্পর্কে লোকে যে বলে 'বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে একশ ঘা'- সে কথার সভ্যতার প্রমাণ তো আমি ছেলেবেলা থেকেই পেয়ে আসছি। পুলিশের ঘা যাদের ওপর পড়ে, তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা আমি বহুবারই প্রত্যক্ষ করেছি। পুলিশের অঘটন-ঘটন-পটীয়সী বুদ্ধির পরিচয়-জ্ঞাপক অনেক গল্পও শুনেছি। সে রকমই একটি গল্প :
এক এলাকায় জোড়া খুন হয়েছে এবং নিহত দুজনের কারো লাশই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে থানার বড় দারোগাকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। দারোগা জানালেন, 'আমি তদন্ত করিয়া জানিতে পারিয়াছি যে ওই লোক দুইটি দীর্ঘকাল যাবৎ শত্রুতাসূত্রে আবদ্ধ ছিল। তাই তাহারা পরস্পরকে খুন করিয়া পরস্পরের লাশ গুম করিয়াছে।'
এটি হয়তো নিতান্তই কাল্পনিক ও হাস্যরসাত্মক একটি গল্প। তবে বাস্তবেও পুলিশের হাতে যে অনেক অঘটন ঘটে, সে কথাও মোটেই মিথ্যা নয়। পুলিশের দারোগার অসীম ক্ষমতার পরিচয় পেয়েই গাঁয়ের এক কিষানি নাকি জজ সাহেবকে 'দারোগা হওয়ার' জন্য আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। উপযুক্ত অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে পুলিশ যে অনায়াসে 'রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙে'- তেমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।
কিন্তু সব দেখেশুনে-বুঝেও পুলিশের আচরণ সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলার হিম্মত নেই জনসাধারণের। তাই অন্তরে সঞ্চিত সব ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশের জন্য ধরে তারা নানা বাঁকা পথ- বানায় নানা গল্প, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন। আবার যখনই সুযোগ পায়, তখনই জনগণ মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত করে সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে- 'পুলিশ জুলুম বন্ধ করো।'
শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় 'রাষ্ট্র' নামক যে সংগঠনটির উদ্ভব ঘটেছে, সেই রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গই হলো পুলিশ। ইংরেজ রাজত্বকালে যাদের 'পুলিশ' নাম দেওয়া হয়েছে, 'কোতোয়াল'রা তাদেরই পূর্বসূরি। পুলিশদের মতো কোতোয়ালদেরও জনগণ বন্ধু বলে ভাবতে পারেনি। কোতোয়ালদের গণনির্যাতনের অনেক সংবাদই বিধৃত আছে প্রাক-আধুনিক যুগের বাংলার লিখিত সাহিত্যে ও মৌখিক লোকসাহিত্যে। আর ইংরেজ রাজত্বে, বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, 'পুলিশ শুধু করছে পরখ কার কতটা চামড়া পুরু'। একই কথা প্রযোজ্য পাকিস্তান জমানার পুলিশ সম্পর্কেও।
তবে পাকিস্তানের শাসনপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতা লাভের প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তখনই এখানকার পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্কের ঘটে অভূতপূর্ব রূপান্তর। পুলিশ স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, আর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির ওপর। বলতে গেলে পুলিশদের শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। সারা দেশেই পুলিশ আর জনতা কাঁধে কাঁধ মিলায় শত্রুর উৎসাদনের লক্ষ্যে, 'পুলিশ-জনতা ভাই ভাই- এই উল্লাসধ্বনিই পরিণতি পায় মুক্তির রণধ্বনিতে।
স্বাধীন বাংলাদেশও পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে বলেই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম- পুলিশ কেবল দুষ্টেরই দমন করবে, শিষ্টজনের হবে পরম বন্ধু; 'পুলিশ জুলুম বন্ধ করো'র মতো কোনো ধ্বনি কোনো দিনই উচ্চারণ করতে হবে না আমাদের।
কিন্তু হায়! পাকিস্তানের ভূতের আছড়ে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমাদের প্রত্যাশা মারাত্মকভাবে আহত হলো। সেই ভূত বাংলাদেশের পুলিশকেও পাকিস্তানের পুলিশের মতোই গণবিরোধী করে তুলতে চাইল। কিন্তু পুরোপুরি তা পারল কি?
পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশকে একটি নয়া পাকিস্তানে পরিণত করতে চাইলেও তার চাওয়াটা যে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে- এমন ভাবাটা একেবারেই অসংগত। কারণ ইতিহাসের পথচলা তো ভূতের মতো পেছন দিকে চলা নয়। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলে বলেই কখনো কখনো পশ্চাৎমুখী মনে হলেও আসলে ইতিহাস সর্বদা পচা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকেই এগিয়ে চলে। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটতে পারে না, ঘটেওনি। পাকিস্তানের ভূতের আছড়গ্রস্ত বাংলাদেশের অনেক পুলিশই হয়তো কদাচারে লিপ্ত, কিন্তু এরই পাশাপাশি কিছুসংখ্যক সদাচারী পুলিশও অবশ্যই বিদ্যমান। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যাঁরা ব্রতী তাঁদের প্রতি অনেক পুলিশই শ্রদ্ধাবান, সে রকম শ্রদ্ধারই প্রকাশ দেখলাম ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার পুলিশদের আচরণে।
কিন্তু এ রকম সদাচরণকারী পুলিশের সংখ্যা কত? প্রচলিত ব্যবস্থায় কার্যরত পুলিশদের কতজনের পক্ষে সদাচরণকারী থাকা সম্ভব?
ব্রিটিশ শাসকরা এই উপমহাদেশে যে ধরনের পুলিশি ব্যবস্থার পত্তন ঘটিয়েছিল, সে ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। না ঘটাই তো স্বাভাবিক। কারণ জনগণের সংগ্রামের ফলে নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রটির মূল কর্তৃত্ব নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশ নাগরিকের করায়ত্ত হয়নি। বিচিত্রবিধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিতে মালিকানা লাভের বদৌলতে শক্তিমদমত্ত হয়ে উঠেছে যারা সংখ্যায় নিতান্ত লঘু হলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশীল তো তারাই। এদের বিপরীতে যাদের অবস্থান সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষ যেদিন কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠবে, দেশে কোনো শোষকগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকবে না যেদিন, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রকৃত প্রতিষ্ঠার ফলে পাকিস্তানপন্থী কুলাঙ্গারদের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে যেদিন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রভাববলয় থেকে দেশটির মুক্তি ঘটবে যেদিন- সেদিনই স্বাধীনতার অমৃতফল পেঁৗছে যাবে সবার ঘরে ঘরে। সেদিন থেকে প্রতিষ্ঠিত হবে পুলিশ আর জনগণের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। কেবল গণবিরোধীরাই সারাক্ষণ কম্পমান থাকবে পুলিশের ভয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ধারক কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে না কোনো পুলিশ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে পুলিশের যে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই সম্পর্কেরই দৃঢ়তর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটবে সেদিন। যথাযথ সদাচরণে অভ্যস্ত হবে সব পুলিশই।
এ রকম সব কথা ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম রাত কেটে গেল; থানার জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
কিন্তু পুলিশের সঙ্গে যে দুটি 'ফেউ' এসেছিল, তাদের ব্যবহার ছিল অন্য রকম। তারা আমার বিরুদ্ধে এটা-সেটা বলে পুলিশদের উত্তেজিত করে তুলতে চাইছিল। যদিও 'ফেউ' দুটির মুখ ছিল রুমালে ঢাকা, তবুও এদের একটিকে আমার ও আমার স্ত্রীর একান্ত চেনা বলে মনে হয়েছিল। কারণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বাসার যে আসবাবপত্র লুট হয়ে যায়, সেসবের অনেকই আমরা খুঁজে পাই ওই লোকটির ঘরে। ওরই মতো অন্য লুটেরাও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বছর তিনেক একান্তই কোণঠাসা হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে ওদের প্রবল পরাক্রমে আমরাই পর্যুদস্ত। বলতে গেলে ওরাই যেন এ দেশের ক্ষমতার ধারক-বাহক। ওদের ভয়েই আমরা জবুথবু হয়ে থাকি।
ওই 'ফেউ' দুটিই আমার বিছানার পাশে বড় টেবিলটিতে রাখা বইয়ের স্তূপটির প্রতি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। পুলিশের বক্তব্য ছিল, 'এত এত বই দেখার সময় নেই, এখনই চলে যেতে হবে আমাদের।'
সঙ্গে সঙ্গেই 'ফেউ'টি স্তূপের ভেতর থেকে একটা বই নিয়ে এক পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বলল, 'এই দেখুন স্যার।' বইটির শিরোনাম দেখেই পুলিশের প্রচণ্ড ধমক, 'শালা, ওটা তো ব্যাকরণ।'
এরপর পাওয়া গেল 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস', 'ভাষার ইতিবৃত্ত', 'উপন্যাসের ধারা' ইত্যাদি। কিন্তু কিছু 'আপত্তিকর' বই তো পাওয়া দরকার। তা না হলে পুলিশের 'প্রেস্টিজ' থাকে কী করে! সেই প্রেস্টিজ রক্ষার জন্যই বোধ হয় 'আপত্তিকর' বই হয়ে গেল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঙালির ইতিহাস' এবং 'সোভিয়েত লিটারেচার'-এর কয়েকটি সংখ্যা! এগুলোই পুলিশ ঝোলায় পুরে নিল।
দুজন পুলিশ কনস্টেবল আমাকে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেল। পথে যেতে যেতে তারা আমার সঙ্গে খুবই সৌজন্যসূচক কথাবার্তা বলল। থানায়ও পুলিশদের সৌজন্যশীল আচরণেরই পরিচয় পেলাম- দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহ শহরে কলেজে মাস্টারি করি বলেই হয়তো।
সেই রাতেই (৩ মার্চ, ১৯৭৬) শহর থেকে পুলিশ আরো তিনজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল। ধৃত তিনজনই আমার একান্ত অন্তরঙ্গ সুহৃদ। একজন আমার সহকর্মী অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম। অন্য দুজনের একজন অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ও অন্যজন অ্যাডভোকেট আবদুল কুদ্দুস।
আবদুর রশিদ পরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হয়েছিলেন, বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। আবদুল কুদ্দুস এখনো হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত।
প্রথম থানাহাজতে রাখা হলেও রাতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি বা বড় দারোগা) আমাদের হাজত থেকে বের করে নিয়ে এলেন এবং অন্য পুলিশরা যেখানে বসেন, সেখানেই চারজনকে চেয়ারে উপবিষ্ট থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
পরদিন সকালেই গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে আমাদের সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা দলে দলে থানায় এসে ভিড় করলেন। সারা দিন ধরেই একের পর এক তাঁরা আসতে লাগলেন। সেই ভিড় সামলানো যদিও পুলিশদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তবু দর্শনার্থীদের সঙ্গে তাঁরা কেউই বিরূপ আচরণ করেননি। বিশেষ করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বড় দারোগার সদাচরণে সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। কারণ ডাণ্ডাধারী দারোগা-পুলিশদের মুখ থেকে যে সর্বদা অভিধানবহির্ভূত অশিষ্ট শব্দবন্ধনই নির্গত হয়- এমনটিই এত দিন ধরে তাঁদের জানা ছিল। অথচ আজকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতিই প্রত্যক্ষ করলেন। কাজেই তাঁদের বিস্ময় তো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
গ্রেপ্তার হওয়ার পরবর্তী রাতটিও আমরা থানায়ই কাটালাম। থানাহাজতে না নিয়ে থানার মূল কক্ষে পুলিশদের পাশেই আমাদের বিছানা পেতে দেওয়া হলো। 'কোনো অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জানাবেন'- পাশে উপবিষ্ট কয়েকজন পুলিশের মুখে বেশ কয়েকবারই এ কথাটি উচ্চারিত হলো এবং প্রতিবারের উচ্চারণই বিনয়ের স্পর্শমণ্ডিত।
শুয়ে শুয়ে অনেক কথাই ভাবছিলাম। পুলিশদের সম্পর্কে লোকে যে বলে 'বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে একশ ঘা'- সে কথার সভ্যতার প্রমাণ তো আমি ছেলেবেলা থেকেই পেয়ে আসছি। পুলিশের ঘা যাদের ওপর পড়ে, তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা আমি বহুবারই প্রত্যক্ষ করেছি। পুলিশের অঘটন-ঘটন-পটীয়সী বুদ্ধির পরিচয়-জ্ঞাপক অনেক গল্পও শুনেছি। সে রকমই একটি গল্প :
এক এলাকায় জোড়া খুন হয়েছে এবং নিহত দুজনের কারো লাশই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে থানার বড় দারোগাকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। দারোগা জানালেন, 'আমি তদন্ত করিয়া জানিতে পারিয়াছি যে ওই লোক দুইটি দীর্ঘকাল যাবৎ শত্রুতাসূত্রে আবদ্ধ ছিল। তাই তাহারা পরস্পরকে খুন করিয়া পরস্পরের লাশ গুম করিয়াছে।'
এটি হয়তো নিতান্তই কাল্পনিক ও হাস্যরসাত্মক একটি গল্প। তবে বাস্তবেও পুলিশের হাতে যে অনেক অঘটন ঘটে, সে কথাও মোটেই মিথ্যা নয়। পুলিশের দারোগার অসীম ক্ষমতার পরিচয় পেয়েই গাঁয়ের এক কিষানি নাকি জজ সাহেবকে 'দারোগা হওয়ার' জন্য আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। উপযুক্ত অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে পুলিশ যে অনায়াসে 'রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙে'- তেমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।
কিন্তু সব দেখেশুনে-বুঝেও পুলিশের আচরণ সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলার হিম্মত নেই জনসাধারণের। তাই অন্তরে সঞ্চিত সব ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশের জন্য ধরে তারা নানা বাঁকা পথ- বানায় নানা গল্প, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন। আবার যখনই সুযোগ পায়, তখনই জনগণ মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত করে সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে- 'পুলিশ জুলুম বন্ধ করো।'
শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় 'রাষ্ট্র' নামক যে সংগঠনটির উদ্ভব ঘটেছে, সেই রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গই হলো পুলিশ। ইংরেজ রাজত্বকালে যাদের 'পুলিশ' নাম দেওয়া হয়েছে, 'কোতোয়াল'রা তাদেরই পূর্বসূরি। পুলিশদের মতো কোতোয়ালদেরও জনগণ বন্ধু বলে ভাবতে পারেনি। কোতোয়ালদের গণনির্যাতনের অনেক সংবাদই বিধৃত আছে প্রাক-আধুনিক যুগের বাংলার লিখিত সাহিত্যে ও মৌখিক লোকসাহিত্যে। আর ইংরেজ রাজত্বে, বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, 'পুলিশ শুধু করছে পরখ কার কতটা চামড়া পুরু'। একই কথা প্রযোজ্য পাকিস্তান জমানার পুলিশ সম্পর্কেও।
তবে পাকিস্তানের শাসনপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতা লাভের প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তখনই এখানকার পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্কের ঘটে অভূতপূর্ব রূপান্তর। পুলিশ স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, আর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির ওপর। বলতে গেলে পুলিশদের শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। সারা দেশেই পুলিশ আর জনতা কাঁধে কাঁধ মিলায় শত্রুর উৎসাদনের লক্ষ্যে, 'পুলিশ-জনতা ভাই ভাই- এই উল্লাসধ্বনিই পরিণতি পায় মুক্তির রণধ্বনিতে।
স্বাধীন বাংলাদেশও পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে বলেই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম- পুলিশ কেবল দুষ্টেরই দমন করবে, শিষ্টজনের হবে পরম বন্ধু; 'পুলিশ জুলুম বন্ধ করো'র মতো কোনো ধ্বনি কোনো দিনই উচ্চারণ করতে হবে না আমাদের।
কিন্তু হায়! পাকিস্তানের ভূতের আছড়ে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও আমাদের প্রত্যাশা মারাত্মকভাবে আহত হলো। সেই ভূত বাংলাদেশের পুলিশকেও পাকিস্তানের পুলিশের মতোই গণবিরোধী করে তুলতে চাইল। কিন্তু পুরোপুরি তা পারল কি?
পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশকে একটি নয়া পাকিস্তানে পরিণত করতে চাইলেও তার চাওয়াটা যে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে- এমন ভাবাটা একেবারেই অসংগত। কারণ ইতিহাসের পথচলা তো ভূতের মতো পেছন দিকে চলা নয়। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলে বলেই কখনো কখনো পশ্চাৎমুখী মনে হলেও আসলে ইতিহাস সর্বদা পচা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকেই এগিয়ে চলে। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটতে পারে না, ঘটেওনি। পাকিস্তানের ভূতের আছড়গ্রস্ত বাংলাদেশের অনেক পুলিশই হয়তো কদাচারে লিপ্ত, কিন্তু এরই পাশাপাশি কিছুসংখ্যক সদাচারী পুলিশও অবশ্যই বিদ্যমান। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যাঁরা ব্রতী তাঁদের প্রতি অনেক পুলিশই শ্রদ্ধাবান, সে রকম শ্রদ্ধারই প্রকাশ দেখলাম ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার পুলিশদের আচরণে।
কিন্তু এ রকম সদাচরণকারী পুলিশের সংখ্যা কত? প্রচলিত ব্যবস্থায় কার্যরত পুলিশদের কতজনের পক্ষে সদাচরণকারী থাকা সম্ভব?
ব্রিটিশ শাসকরা এই উপমহাদেশে যে ধরনের পুলিশি ব্যবস্থার পত্তন ঘটিয়েছিল, সে ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। না ঘটাই তো স্বাভাবিক। কারণ জনগণের সংগ্রামের ফলে নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রটির মূল কর্তৃত্ব নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশ নাগরিকের করায়ত্ত হয়নি। বিচিত্রবিধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিতে মালিকানা লাভের বদৌলতে শক্তিমদমত্ত হয়ে উঠেছে যারা সংখ্যায় নিতান্ত লঘু হলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশীল তো তারাই। এদের বিপরীতে যাদের অবস্থান সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষ যেদিন কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠবে, দেশে কোনো শোষকগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকবে না যেদিন, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রকৃত প্রতিষ্ঠার ফলে পাকিস্তানপন্থী কুলাঙ্গারদের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে যেদিন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রভাববলয় থেকে দেশটির মুক্তি ঘটবে যেদিন- সেদিনই স্বাধীনতার অমৃতফল পেঁৗছে যাবে সবার ঘরে ঘরে। সেদিন থেকে প্রতিষ্ঠিত হবে পুলিশ আর জনগণের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। কেবল গণবিরোধীরাই সারাক্ষণ কম্পমান থাকবে পুলিশের ভয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ধারক কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে না কোনো পুলিশ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে পুলিশের যে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই সম্পর্কেরই দৃঢ়তর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটবে সেদিন। যথাযথ সদাচরণে অভ্যস্ত হবে সব পুলিশই।
এ রকম সব কথা ভাবতে ভাবতে নির্ঘুম রাত কেটে গেল; থানার জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments