বিস্মৃত নাম গোলাম রহমান by ফখরুজ্জামান চৌধুরী


একটি বিস্মৃত নাম গোলাম রহমান। শিশুসাহিত্যে তার যে অবদান তাও বিস্মৃতির হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারেনি। লেখক হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। নিয়মিত লিখেছেন ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস, জীবনী। ছোটদের জন্য তার লেখা এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তাকে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই বেশি জানেন পাঠকরা।

দেশ বিভাগের পরপরই উদ্বাস্তু অন্যান্য পরিবারের সঙ্গে গোলাম রহমানরা আসেননি তত্কালীন পূর্ববাংলায়। ভিটেমাটি ছেড়ে কে আসতে চায় অজানা পরিবেশে! কলকাতায় মাটি কামড়ে পড়েছিলেন গোলাম রহমানের পিতামাতা। ১৯৪৭ সালে তত্কালীন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাস করা হলো না তার। হলো না জন্মভূমিতে থাকা। ১৯৫০ সালে কলকাতায় যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তাতে জন্মভূমিতে থাকার স্বপ্ন তার ভেঙে গেল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার আগেই ঢাকায় পাড়ি জমালেন গোলাম রহমান। ঢাকায় এসে ভর্তিও হয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে। কিন্তু জীবিকা অর্জনের তাগিদে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই তাকে কাজ শুরু করতে হলো। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি দৈনিক ইত্তেহাদে ছোটদের পাতা ও সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেন। ঢাকায় এসে তিনি কাজ শুরু করেন দৈনিক ইনসাফে।
১৯৬০ সালে ঢাকা থেকে তার সম্পাদনায় ছোটদের জন্য ‘মধুমালা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকদের সংগঠন তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে—ইস্ট পাকিস্তান ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট) সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম রহমান।
সাংবাদিকতা ছাড়া তিনি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাও করেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সফল ছিলেন এমনটা বলা যাবে না। তার মতো দিলদরিয়া, খোলামেলা মনের অধিকারী মানুষের ব্যবসার অন্ধিসন্ধি বোঝার কথাও নয়। তিনি পুস্তক প্রকাশনায়ও নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন। তার প্রকাশিত দুটি বইয়ের শুরুতে ছিল যথাক্রমে ‘পীত’ ও ‘শীত’ দুটি শব্দ। বই দুটির পুরো নাম ইচ্ছা করেই লিখলাম না। দুটি বই ব্যবসায়িক দিক থেকে অসফল ছিল, এর মধ্যে একটি ছিল অনুবাদ উপন্যাস এবং অন্যটি মৌলিক গল্প সঙ্কলন। গোলাম রহমান রসিকতা করে বলতেন, ‘পীত আর শীত আমাকে ডুবিয়েছে’। বলতেন বটে, কিন্তু কখনও এজন্য হাহুতাশ করতে দেখিনি আমরা।
গোলাম রহমানের একটি বইয়ের দোকান ছিল আজিমপুর নিউ মার্কেটে। ‘প্রিমিয়ার বুকস’ নামক তার এ বইয়ের দোকানটিতে বই কেনাবেচা যতটা হতো তার চেয়ে বেশি হতো কবি-সাহিত্যিকদের সান্ধ্যকালীন আড্ডা। সপ্তাহের দু’দিন সন্ধ্যায় এখানে নিয়মিত হাজির হতেন তখনকার দিনের তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা। মাঝে মাঝে প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকরাও যোগ দিতেন সেই তুমুল আড্ডায়।
গোলাম রহমান খুশি হতেন এই জমায়েতে। তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল না বলে সাধারণভাবে যে ধারণা করি, এ আড্ডা সেই ধারণাকে আরও দৃঢ়ভিত্তিক করে।
প্রতি সন্ধ্যায় তিনি চলে আসতেন সূত্রাপুরের কাঠের পুল থেকে। অধিকাংশ দিন আসতেন বাইসাইকেলে করে, কোনো কোনো দিন টাউন সার্ভিস বাসে। এ রুটিনের ব্যতিক্রম হতো বৃহিস্পতিবারে, নিউ মার্কেটের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। শারীরিক অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কোনো দিন যদি তিনি আসতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে পরবর্তী দিনে তাকে আমরা রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করাতাম। আড্ডার আমরা যারা নিয়মিত সদস্য ছিলাম তাদের কেউ না কেউ তো হাজির থাকতামই। এমনও দিন গেছে, আড্ডা তুমুল জমে উঠেছে, দোকানে কোনো ক্রেতা এসেছেন বই কিনতে। তার দোকানে বইটিও আছে। কেনাবেচার কারণে আড্ডায় যতি পড়বে, অতএব সহজ হলো বলে দেয়া বইটি নেই।
অসহায় গোলাম রহমান আমাদের এহেন অবিমৃষ্যকারী এবং হটকারী কাজকে প্রশ্রয় দিতেন সহাস্য মুখে। শুধু বলতেন, ‘তোমাদের জন্য তো দেখছি আমার কারবার লাটে উঠবে।’
সেই আড্ডায় যারা নিয়মিত হাজির হতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, চিত্রশিল্পী কাজী আবদুল বাসিত, জিয়া হায়দর, বেতারের সেলিম উদ্দীন আহমদ, আহমেদুজ্জামান, ড. আবদুন নূর প্রমুখ। এদের মধ্যে প্রথম চারজন আমাদের ছেড়ে গেছেন অনেক আগে। মাঝে মাঝে আসতেন কবি আবদুল কাদির, কবি বন্দে আলী মিয়া। অনেক নাম আজ স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
গোলাম রহমানের নিজের স্বাক্ষরে উপহার দেয়া তার ‘কাফে দ্য খোরাসানী’ বইটি এখনও আমার সংগ্রহে তার স্মারক হয়ে রয়ে গেছে। তার অন্যান্য বই রকমফের বহুল পঠিত পানুর পাঠশালা, বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি, জ্যান্ত ছবির ভোজবাজি, আজব দেশে এলিস, রুশ দেশের রূপকথা কিংবা ঈশপের গল্প সংগ্রহ থেকে হারিয়ে গেছে উত্সাহী পাঠকের সৌজন্যে!
মানুষটাই তো হারিয়ে গেছেন রহস্যময় পরিবেশে। যে স্বাধীনতার সূর্য দেখার জন্য দুঃস্বপ্নের রাতের স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বাধীনতা অর্জনের কিছু পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি একদল তরুণের প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে খুন হলেন গোলাম রহমান। তাকে খুন করেছে তরুণ বাঙালি। অপরাধ, তাদের দাবি অনুযায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি।
গোলাম রহমান নেই, নেই তার প্রিমিয়ার বুকস। বইয়ের বদলে সেখানে কিছুকাল আগেও দেখিছি চুল কাটার সেলুন।
এখন কি, জানি না, জানতে চাইও না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.