দূরদেশ-‘সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো’ by আলী রীয়াজ
রামজি ইউসুফের কথা কি কারও স্মরণে আছে? কিংবা মির আইমাল কাঁসির কথা? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যাঁরা পঠন-পাঠন করেন, তাঁদের কাছে এই নামগুলো পরিচিত হলেও সাধারণ কিংবা তরুণ পাঠকদের কাছে এ দুটি নাম কোনো তাৎপর্য বহন নাও করতে পারে। রামজি ইউসুফ ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার অন্যতম
রূপকার। পাকিস্তানি নাগরিক ইউসুফ কেবল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের হামলার সঙ্গেই যুক্ত নন, ১৯৯৩ সালে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ব্যাংককে ইসরায়েলি দূতাবাসে বোমা হামলার চেষ্টার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, ১৯৯৪ সালে ইরানে ইমাম রাজার মাজারে বোমা হামলা এবং ফিলিপাইন-টোকিও রুটে ফিলিপাইন এয়ারলাইনসের হামলা তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাঁর গ্রেপ্তারের জন্য কুড়ি লাখ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৯৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি সার্ভিস ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা যৌথ অভিযান চালিয়ে ইউসুফকে ইসলামাবাদের একটি গেস্টহাউস থেকে আটক করে।
মির আইমাল কাঁসি ১৯৯৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর দুজন কর্মচারীকে কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন। ২৫ জানুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই আইমাল কাঁসি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। চার বছরেরও বেশি সময় পর, ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন ভোরে আইমাল কাঁসিকে সিআইএ ও আইএসআইয়ের একটি দল ডেরা গাজি খানের সালিমার হোটেল থেকে আটক করে।
ইউসুফ ও কাঁসি উভয়কেই যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ইউসুফকে ২৪০ বছর এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে ইউসুফ শাস্তি ভোগ করছেন। কাঁসিকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন, যা ২০০২ সালে কার্যকর করা হয়েছে।
রামজি ইউসুফ ও আইমাল কাঁসির আটকের ঘটনাগুলো ঘটেছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার আগে। অনেকের সে কারণেই হয়তো মনে নাও থাকতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী আটকের ঘটনা নতুন নয়, এগুলো তার প্রমাণ। ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অন্তত চারজনকে পাকিস্তান থেকে আটক করা হয়েছে গত নয় বছরে। আবু জোবায়দা ও রামজি বিন আল-সিব আটক হন ২০০২ সালে, পরের বছর আটক হন খালেদ শেখ মোহাম্মদ। ২০০৫ সালে আটক হন লিবীয় নাগরিক আবু ফারাজ আল-লিবি। আল-কায়েদার অন্যতম শীর্ষ নেতা শেখ আল-মাসরি মার্কিন ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিহত হন ২০১০ সালে।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন অভিযানে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর রামজি ইউসুফ থেকে আল-লিবির আটকের ঘটনাগুলো আলোচনায় আসছে। একদিকে বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা এসব ঘটনার উল্লেখ করে বলছেন, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ রকম অভিযোগ যে নতুন, তা নয়; কিন্তু এখন ওসামা বিন লাদেনের উপস্থিতি এবং প্রায় ছয় বছর চোখের সামনে একই বাড়িতে থাকার কারণে প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানি প্রশাসন, বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা অযোগ্য, না তারাও এর সহযোগী? অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের উত্তর হলো, ১৯৯৫ সাল থেকেই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসীদের আটকে সাহায্য করে আসছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ সঠিক নয়। বাস্তব ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তাদের বক্তব্য দুই-ই সঠিক, যা থেকে এ ধরনের উপসংহারে পৌঁছানো অসংগত হবে না যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যেও এ দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছে; বলছে, তারা এই অভিযানের কিছুই জানত না। অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ওসামা যে বাড়িতে নিহত হয়েছেন, ওই বিষয়ে পাকিস্তান ২০০৯ সালে তথ্য সরবরাহ করেছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতারা সব সময় এ দুই অবস্থানের ভেতরে দোদুল্যমান থেকেছেন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পাকিস্তান যে একেবারে কিছুই করেনি, তা নয়। গত এক দশকে, সরকারি হিসাবমতে, ৩০ হাজার পাকিস্তানি প্রাণ হারিয়েছে, পাঁচ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। আটক ও নিহত হয়েছে অনেক সন্ত্রাসী। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, লন্ডন, মাদ্রিদ ও মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তান বা পাকিস্তানিদের যোগাযোগ আবিষ্কৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে ১৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই গেছে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। তার পরও পাকিস্তান কেন সন্ত্রাস মোকাবিলায় সফল নয়, এখন সেটাই প্রশ্ন।
পাকিস্তান সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ, না তাদের কেউ কেউ ওসামার (এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর) সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। এই প্রশ্ন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নয়, পাকিস্তানের নাগরিকেরাও একই প্রশ্ন করছে। পাকিস্তানি নাগরিকেরা এত দিন আইএসআই ও সেনাবাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জাতীয় নিরাপত্তার জুজু দেখিয়ে নিশ্চুপ করা হতো। এখন তাদের প্রশ্ন, এমন অভিযান তাদের তথাকথিত চিরশত্রু ভারত চালাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায় এবং সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যে ব্যর্থ হবে, তা তো প্রমাণিতই। তদুপরি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কি আসলেই নিরাপদ?
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মহল পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা সে পথে যাবেন না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সব সময়ই টানাপোড়েন ছিল, এখন তা বাড়বে। কিন্তু পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা যাবে না। এ জন্য এই দুই দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে পাকিস্তানকে দেয় মার্কিন সাহায্য আরও বেশি নিরীক্ষার মুখোমুখি হবে। অনুমান করা যায়, ওসামা বিন লাদেনের এই ঘটনার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় কিছু পরিবর্তন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হোসেন হাক্কানি ইতিমধ্যেই এর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
পাকিস্তানের জন্য যেটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তা হলো, পাকিস্তানি সমাজের ভেতরে ওসামা বিন লাদেন, আল-কায়েদা ও পাকিস্তানভিত্তিক অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি যে সমর্থন রয়েছে, তাকে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। গত এক দশকে পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক নেতারা যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাঁরা নতুন করে ভাবতে রাজি আছেন কি না, তা-ই দেখার বিষয়।
পাকিস্তানি সমাজে যে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন রয়েছে, তার দুটো উদাহরণ খুবই প্রাসঙ্গিক। পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে ওসামা ও আল-কায়েদার প্রতি সমর্থন বিষয়ে জনমত জরিপ চালিয়ে আসছে। ২০১০ সালে পাকিস্তানে ১৮ শতাংশ মানুষ ওসামা ও আল-কায়েদার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। যদিও এই সমর্থন ২০০৫ সালের ৫২ শতাংশ থেকে অনেক কম, কিন্তু তাকে একেবারে অবহেলা করা সম্ভব নয়। কেননা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের ভেতর ভেতরে এই সমর্থকদের প্রভাব অনেক বেশি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি দুই-ই এই সমর্থকদের দ্বারা প্রভাবিত।
দ্বিতীয় উদাহরণটির জন্য ফিরব আইমাল আল কাঁসির ঘটনায়। কাঁসিকে আটক করার এক দিন পর লাহোর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয় যে তাঁকে এফবিআই অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এই রিট আবেদনটি দাখিল করেছিলেন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদ গুল। কাঁসির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পর তাঁর লাশ পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। কোয়েটা বিমানবন্দর থেকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এক বিশাল শোভাযাত্রা করে। তাতে যোগ দিয়েছিল কমপক্ষে ৭০০ গাড়ি। পাকিস্তানের বন্দরনগর ওরমারাতে আইমাল কাঁসির স্মরণে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে, তাতে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘শহীদ আইমাল কাঁসি’ বলে।
এসব উদাহরণ সমাজের ভেতরে জঙ্গিবাদ, জঙ্গি সংগঠন ও তাদের নেতাদের সম্পর্কে মনোভাব প্রকাশ করে। এর কারণ অনুসন্ধান, প্রতিকারের উপায় চিহ্নিত করা এবং রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলো পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পাকিস্তান তার সন্ত্রাসবাদের সংকট থেকে মুক্তি পাবে না। পাকিস্তানে এসব বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, আলোচনাও শুরু হয়েছে—ফল কী হবে, সেটার জন্যই এখন অপেক্ষা।
ইলিনয়, ৮ মে ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
মির আইমাল কাঁসি ১৯৯৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর দুজন কর্মচারীকে কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন। ২৫ জানুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই আইমাল কাঁসি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। চার বছরেরও বেশি সময় পর, ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন ভোরে আইমাল কাঁসিকে সিআইএ ও আইএসআইয়ের একটি দল ডেরা গাজি খানের সালিমার হোটেল থেকে আটক করে।
ইউসুফ ও কাঁসি উভয়কেই যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ইউসুফকে ২৪০ বছর এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে ইউসুফ শাস্তি ভোগ করছেন। কাঁসিকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন, যা ২০০২ সালে কার্যকর করা হয়েছে।
রামজি ইউসুফ ও আইমাল কাঁসির আটকের ঘটনাগুলো ঘটেছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার আগে। অনেকের সে কারণেই হয়তো মনে নাও থাকতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী আটকের ঘটনা নতুন নয়, এগুলো তার প্রমাণ। ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অন্তত চারজনকে পাকিস্তান থেকে আটক করা হয়েছে গত নয় বছরে। আবু জোবায়দা ও রামজি বিন আল-সিব আটক হন ২০০২ সালে, পরের বছর আটক হন খালেদ শেখ মোহাম্মদ। ২০০৫ সালে আটক হন লিবীয় নাগরিক আবু ফারাজ আল-লিবি। আল-কায়েদার অন্যতম শীর্ষ নেতা শেখ আল-মাসরি মার্কিন ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিহত হন ২০১০ সালে।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন অভিযানে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর রামজি ইউসুফ থেকে আল-লিবির আটকের ঘটনাগুলো আলোচনায় আসছে। একদিকে বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা এসব ঘটনার উল্লেখ করে বলছেন, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ রকম অভিযোগ যে নতুন, তা নয়; কিন্তু এখন ওসামা বিন লাদেনের উপস্থিতি এবং প্রায় ছয় বছর চোখের সামনে একই বাড়িতে থাকার কারণে প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানি প্রশাসন, বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা অযোগ্য, না তারাও এর সহযোগী? অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের উত্তর হলো, ১৯৯৫ সাল থেকেই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসীদের আটকে সাহায্য করে আসছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ সঠিক নয়। বাস্তব ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তাদের বক্তব্য দুই-ই সঠিক, যা থেকে এ ধরনের উপসংহারে পৌঁছানো অসংগত হবে না যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যেও এ দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছে; বলছে, তারা এই অভিযানের কিছুই জানত না। অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ওসামা যে বাড়িতে নিহত হয়েছেন, ওই বিষয়ে পাকিস্তান ২০০৯ সালে তথ্য সরবরাহ করেছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতারা সব সময় এ দুই অবস্থানের ভেতরে দোদুল্যমান থেকেছেন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পাকিস্তান যে একেবারে কিছুই করেনি, তা নয়। গত এক দশকে, সরকারি হিসাবমতে, ৩০ হাজার পাকিস্তানি প্রাণ হারিয়েছে, পাঁচ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। আটক ও নিহত হয়েছে অনেক সন্ত্রাসী। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, লন্ডন, মাদ্রিদ ও মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তান বা পাকিস্তানিদের যোগাযোগ আবিষ্কৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে ১৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই গেছে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। তার পরও পাকিস্তান কেন সন্ত্রাস মোকাবিলায় সফল নয়, এখন সেটাই প্রশ্ন।
পাকিস্তান সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ, না তাদের কেউ কেউ ওসামার (এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর) সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। এই প্রশ্ন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নয়, পাকিস্তানের নাগরিকেরাও একই প্রশ্ন করছে। পাকিস্তানি নাগরিকেরা এত দিন আইএসআই ও সেনাবাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে জাতীয় নিরাপত্তার জুজু দেখিয়ে নিশ্চুপ করা হতো। এখন তাদের প্রশ্ন, এমন অভিযান তাদের তথাকথিত চিরশত্রু ভারত চালাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায় এবং সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যে ব্যর্থ হবে, তা তো প্রমাণিতই। তদুপরি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কি আসলেই নিরাপদ?
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মহল পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা সে পথে যাবেন না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সব সময়ই টানাপোড়েন ছিল, এখন তা বাড়বে। কিন্তু পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা যাবে না। এ জন্য এই দুই দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে পাকিস্তানকে দেয় মার্কিন সাহায্য আরও বেশি নিরীক্ষার মুখোমুখি হবে। অনুমান করা যায়, ওসামা বিন লাদেনের এই ঘটনার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় কিছু পরিবর্তন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হোসেন হাক্কানি ইতিমধ্যেই এর ইঙ্গিত দিয়েছেন।
পাকিস্তানের জন্য যেটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তা হলো, পাকিস্তানি সমাজের ভেতরে ওসামা বিন লাদেন, আল-কায়েদা ও পাকিস্তানভিত্তিক অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি যে সমর্থন রয়েছে, তাকে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। গত এক দশকে পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক নেতারা যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাঁরা নতুন করে ভাবতে রাজি আছেন কি না, তা-ই দেখার বিষয়।
পাকিস্তানি সমাজে যে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন রয়েছে, তার দুটো উদাহরণ খুবই প্রাসঙ্গিক। পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে ওসামা ও আল-কায়েদার প্রতি সমর্থন বিষয়ে জনমত জরিপ চালিয়ে আসছে। ২০১০ সালে পাকিস্তানে ১৮ শতাংশ মানুষ ওসামা ও আল-কায়েদার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। যদিও এই সমর্থন ২০০৫ সালের ৫২ শতাংশ থেকে অনেক কম, কিন্তু তাকে একেবারে অবহেলা করা সম্ভব নয়। কেননা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের ভেতর ভেতরে এই সমর্থকদের প্রভাব অনেক বেশি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি দুই-ই এই সমর্থকদের দ্বারা প্রভাবিত।
দ্বিতীয় উদাহরণটির জন্য ফিরব আইমাল আল কাঁসির ঘটনায়। কাঁসিকে আটক করার এক দিন পর লাহোর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয় যে তাঁকে এফবিআই অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এই রিট আবেদনটি দাখিল করেছিলেন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদ গুল। কাঁসির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পর তাঁর লাশ পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। কোয়েটা বিমানবন্দর থেকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এক বিশাল শোভাযাত্রা করে। তাতে যোগ দিয়েছিল কমপক্ষে ৭০০ গাড়ি। পাকিস্তানের বন্দরনগর ওরমারাতে আইমাল কাঁসির স্মরণে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে, তাতে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘শহীদ আইমাল কাঁসি’ বলে।
এসব উদাহরণ সমাজের ভেতরে জঙ্গিবাদ, জঙ্গি সংগঠন ও তাদের নেতাদের সম্পর্কে মনোভাব প্রকাশ করে। এর কারণ অনুসন্ধান, প্রতিকারের উপায় চিহ্নিত করা এবং রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলো পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পাকিস্তান তার সন্ত্রাসবাদের সংকট থেকে মুক্তি পাবে না। পাকিস্তানে এসব বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, আলোচনাও শুরু হয়েছে—ফল কী হবে, সেটার জন্যই এখন অপেক্ষা।
ইলিনয়, ৮ মে ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments