শহীদুল জহির-জীবন, বাস্তব ও ঘোরের কারবারি by মাহবুব টিপু
২৩ মার্চ ২০০৮-এ বলা-কওয়া ছাড়া দুম করে মারা গেলেন শহীদুল জহির। যারা তাঁর পাঠক ছিল, খোঁজ রাখত অল্পবিস্তর, তারা আপনজন হারানোর কষ্ট পেল। মৃত্যু সত্য, আর অমন মৃত্যু তাঁকেই মানায়—বলে মেনে নিল সবাই। একাকিত্বকে সঙ্গী করেছিলেন, ভিড়-মিডিয়া-ব্যস্ততাকে সযত্নে এড়িয়ে চলতেন।
আবার মা-ভাইবোনের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। খুব গম্ভীর দেখালেও ভেতরে ছিলেন সংবেদনশীল। আর ছিলেন বন্ধুবৎসল ও আড্ডাপ্রিয়। যোগাযোগে সাড়া দিতেন, খোঁজও নিতেন কারও কারও। কিন্তু সবই করতেন একটা অদৃশ্য দেয়ালের ওপার থেকে। একদিন জানা গেল, দেয়ালের ওপার থেকে আর কখনো খোঁজ নিতে, দিতে আসবেন না তিনি।
শহীদুল জহিরের লেখায় মেলে অন্তহীন ঘোরের বেসাতি। এতে একবার ডুব দিলে ক্রমশ ঘোরের ঘূর্ণিস্রোতে তলিয়ে যেতে হয়, রক্ষা শুধু, জীবনের জটিল বাস্তবতা পাঠককে ঠিক ভাসিয়ে রাখে, জাগিয়ে তোলে।
জীবনের সরল মাকু দিয়ে সাহিত্যে নিপাট ও নিস্তারহীন ঘোর বুনেছিলেন তিনি। শেষে নিঃসঙ্গতা ও অবহেলার সুতায় জড়িয়ে মারা পড়লেন বেঘোরে; বাঁচার, বাঁচানোর দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে।
ভলিউম বিবেচনায় তাঁর লেখা পত্র কম। চারটি উপন্যাস—জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (’৮৬), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (’৯৫), মুখের দিকে দেখি (২০০৬) ও আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু (২০০৯)। গল্পগ্রন্থের মধ্যে পারাপার (’৮৫), ডুমুরখেকো মানুষ (’৯৯) ও ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪)। এর বাইরে কয়েকটি অগ্রন্থিত গল্প ও অনুবাদ। কিন্তু লেখালেখির পেছনে দীর্ঘদিন লেগে ছিলেন। সাহিত্য রচনাকে ব্রত করেছিলেন, আর সামান্য যা করতেন, তা ছিল বেঁচে থাকার তাগিদে।
পারাপার-এর গল্পগুলো (’৭৪-’৭৬-এ রচিত) তরুণ বয়সে লেখা। কিন্তু সেই গল্পে আভাস-ইঙ্গিতে তেজি, একরোখা আর পরিণত লেখকের সন্ধান মেলে। রিকশাওয়ালা, ঠেলাচালক, কুলি, মেথর আর কৃষকদের মতো নিম্নবর্গের মানুষের জীবন তুলে ধরেছিলেন গল্পের ছোট ক্যানভাসে। মার্ক্সীয় দর্শন তাঁর চিন্তায় ক্রিয়াশীল তখন। কিন্তু ‘যা’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ‘যেমন’ করে বলতে উন্মুখ ছিলেন, সেই কাঙ্ক্ষিত অধরাকে ধরতে পেরেছিলেন জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায়। মাত্র ৪০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ক্যানভাস করেছিলেন গোটা দেশ আর দেশের পোড় খাওয়া মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, প্রেম আর নিরন্তর সংগ্রামের গোয়ের্নিকা হয়ে উঠেছিল আখ্যানটি। সাদার চেয়েও সাদামাটা প্রচ্ছদ আর প্রবন্ধ-গন্ধময় নামের উপন্যাসটির খোঁজ দু-চারজন ছাড়া কেউ পায়নি। তার ঠাঁই হয়েছিল লেখকের চৌকির তলায় ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। কেউ আগ্রহ নিয়ে পীড়াপীড়ি করে পড়তে চাইলে ধুলা-ময়লা ঝেড়ে বলতেন, ‘পইড়া দেখতে পারো।’
পরের দুটি উপন্যাস সে রাত্রে পূর্ণিমা ছিল ও মুখের দিকে দেখি একটিকে আরেকটি ছাড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাস। প্রথমটিতে রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা ও বিস্তার, দ্বিতীয়টিতে আছে মাস্টারপিস হওয়ার উপাদান ও যোগ্যতা। তুলনায় আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু কিছুটা দুর্বল, ১৯৮৯ সালের সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হলেও জীবদ্দশায় লেখক বই প্রকাশ করেননি, অবহেলায় রেখে দিয়েছিলেন আলমারির নিচ তাকিয়ায়। মৃত্যুর পর ২০০৯-এ প্রকাশিত হলে উপন্যাসটির বৈভব ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরই উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পায়।
ডুমুরখেকো মানুষ ও ডলু নদীর হাওয়া বই দুটিতে মোট ১৫টি গল্প আছে। আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস উভয় গ্রন্থে আছে, লেখকের ভাষায় ‘শুধুমাত্র শুদ্ধ পাঠ’ নিশ্চিত করতে। বই দুটির সব গল্পই একটির চেয়ে অন্যটি আলাদা, অনন্য। চতুর্থ মাত্রা, আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, কোথায় পাব তারে। কোনো ঘটনা বা কাহিনি ছাড়াই অসামান্য গল্প। আবার ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ ঘটনার ঘনঘটায় পূর্ণ। ‘কাঁটা’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত অতুলনীয় এক শিল্পকর্ম। ‘চতুর্থ মাত্রা’ তো আগাপাছতলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। ডলু নদীর হাওয়া প্রেম ও জীবনের জটিল ধাঁধার বিস্তার। তাঁর সব গল্প নিয়ে আগবাড়িয়ে এমন কথা চলে।
বাস্তব ও অলীকের ভেদরেখায় দাঁড়িয়ে শহীদুল জহির আখ্যান নির্মাণ করেন, যেখানে একমাত্রিক ফ্যান্টাসি আর বহুমাত্রিক বাস্তবতা কুহেলিকাময় বাস্তবতা তৈরি করে। তাঁর শিল্পের জমি ও শিল্পের আকাশ পরস্পর জুড়ে থাকে। আর তাতে জড়িয়ে-ছড়িয়ে থাকে শ্লেষ, বিদ্রূপ, হাস্যরস আর ব্যঙ্গের এক অনন্যরসায়ন, যা বিরামহীন ঘোর ও মুগ্ধতা তৈরি করে। বিষয় হিসেবে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, প্রেম, সমাজবাস্তবতা কিংবা রাজনীতিকে বেছে নেওয়া হয়। আর এসবের ফাঁকফোকরে কিংবা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। কখনো চরিত্র ও ঘটনার কেন্দ্রে, কখনো জোরালো হয়ে বহুদূর পরিধির কাছাকাছি। কিন্তু সব ছাপিয়ে মানুষের জীবন আর তার বাস্তবতাই প্রতিষ্ঠা পায়। তার হাহাকার ও নগদ পাওনার কাল্পনিক মিশেলে তৈরি হয় এক নয়া বাস্তবতা। নয়া দুনিয়ায় ভিন্ন বাস্তবতার বাঁকে ও চোরাবালিতে থাকে প্রেম-যৌনতা আর ক্ষমতার নির্মম কামড়। এরা মানুষকে নাড়ায়। তাকে নিয়ে খেলা করে, কিন্তু কখনো ছেড়ে যায় না। যদিও তাঁর আখ্যানের প্রেম ও যৌনতা, গতানুগতিক, ক্লান্তিকর ও আবেগসর্বস্ব নয়। এ প্রবৃত্তি চরিত্রকে ভোগায়, তাকে শান্তি ও স্বস্তি দেয় না। বরং হলাহল ও বিতৃষ্ণা উগরে দেয়।’ সম্পর্কের টানাপোড়েনে নির্ভরতা ও নির্ভারতার পরিবর্তে সেখানে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচল তৈরি হয়। জহিরের সৃষ্টি মানুষেরা তাই নিম্নবর্গের ন্যুব্জ, ভেঙে পড়া, পিছলে পিছিয়ে পড়া, দোমড়ানো-মোচড়ানো। এরা উন্মূল, বিচ্ছিন্ন, বাস্তু ও সম্পর্কহীন। শঠ জীবনের পাতা চোরাগোপ্তা ফাঁদে তারা সহজেই ধরা পড়ে আর পস্তায়। কিন্তু আত্মসমর্পণ করে না, লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যায় না।
শৈলী ও ভাষায় নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন জহির। সৌন্দর্য সৃষ্টির নন্দনতত্ত্বকে যত্ন করে এড়িয়ে চলেছেন। ফুল-পাখি, আমি-তুমি-ভালোবাসাময় প্রপঞ্চ বাদ দিয়ে পাল্টা নন্দনতত্ত্ব হাজির করেছিলেন। শব্দ-বাক্য ব্যবহারে ছিলেন খুঁতখুঁতে ও পারফেক্টশনিস্ট। বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ককে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার সবার আছে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে, ফ্রেমে বন্দী করে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং ভাষা হচ্ছে সচল নদীর মতো নিরন্তর প্রবহমান।
নিরীক্ষাকে ব্যক্তিজীবনেও যেন প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন জহির। মুখের দিকে দেখিতে এক সত্তার দুই ব্যক্তি মামুন ও খরকোশ পুরান ঢাকা ও সাতকানিয়ায় বেড়ে ওঠে, যুক্তির বিচারে যা অবিশ্বাস্য প্রকল্প। কিন্তু জহির নিজে এই জটিল কাহিনির মতো দ্বৈত জীবন যাপন করেছেন। শহীদুল হক নামে সৎ ও চৌকস আমলা (সচিব) ছিলেন। কিন্তু খুব কাছের সহকর্মীদের কাছেও তাঁর লেখকসত্তার পরিচয় ছিল অজানা। আবার পাঠক-লেখক-কবিদের খুব অল্পসংখ্যক তাঁর আমলা পরিচয়ের খবর জানতেন। তাঁর দপ্তরে শহীদুল জহিরের খোঁজে কেউ ফোন করলে তিনি জানাতেন, ‘ওই নামে এখানে কেউ নেই।’ এই দ্বৈত সত্তার ধাঁধা মৃত্যুর পরও মীমাংসা হয়নি। তাঁর কবরে শহীদুল জহির ও শহীদুল হক নামে দুটি সাইনবোর্ড এখনো বহাল আছে।
শহীদুল জহির আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু উপন্যাসের শুরুর পূর্বে ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অবশ্যই হয়, কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য ভিন্ন।’ প্রাচীন চীনে সিমা ছিয়েন নামের একজন সাহিত্যিক বলেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।’ শহীদুল জহির বেলেহাঁসের পালকের মতো মৃত্যু নিয়ে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন আর অনেকের ওপর চাপিয়ে গেছেন থাই পাহাড়ের অযুত ভার।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।শহীদুল জহিরের লেখায় মেলে অন্তহীন ঘোরের বেসাতি। এতে একবার ডুব দিলে ক্রমশ ঘোরের ঘূর্ণিস্রোতে তলিয়ে যেতে হয়, রক্ষা শুধু, জীবনের জটিল বাস্তবতা পাঠককে ঠিক ভাসিয়ে রাখে, জাগিয়ে তোলে।
জীবনের সরল মাকু দিয়ে সাহিত্যে নিপাট ও নিস্তারহীন ঘোর বুনেছিলেন তিনি। শেষে নিঃসঙ্গতা ও অবহেলার সুতায় জড়িয়ে মারা পড়লেন বেঘোরে; বাঁচার, বাঁচানোর দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে।
ভলিউম বিবেচনায় তাঁর লেখা পত্র কম। চারটি উপন্যাস—জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (’৮৬), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (’৯৫), মুখের দিকে দেখি (২০০৬) ও আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু (২০০৯)। গল্পগ্রন্থের মধ্যে পারাপার (’৮৫), ডুমুরখেকো মানুষ (’৯৯) ও ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪)। এর বাইরে কয়েকটি অগ্রন্থিত গল্প ও অনুবাদ। কিন্তু লেখালেখির পেছনে দীর্ঘদিন লেগে ছিলেন। সাহিত্য রচনাকে ব্রত করেছিলেন, আর সামান্য যা করতেন, তা ছিল বেঁচে থাকার তাগিদে।
পারাপার-এর গল্পগুলো (’৭৪-’৭৬-এ রচিত) তরুণ বয়সে লেখা। কিন্তু সেই গল্পে আভাস-ইঙ্গিতে তেজি, একরোখা আর পরিণত লেখকের সন্ধান মেলে। রিকশাওয়ালা, ঠেলাচালক, কুলি, মেথর আর কৃষকদের মতো নিম্নবর্গের মানুষের জীবন তুলে ধরেছিলেন গল্পের ছোট ক্যানভাসে। মার্ক্সীয় দর্শন তাঁর চিন্তায় ক্রিয়াশীল তখন। কিন্তু ‘যা’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ‘যেমন’ করে বলতে উন্মুখ ছিলেন, সেই কাঙ্ক্ষিত অধরাকে ধরতে পেরেছিলেন জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায়। মাত্র ৪০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ক্যানভাস করেছিলেন গোটা দেশ আর দেশের পোড় খাওয়া মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, প্রেম আর নিরন্তর সংগ্রামের গোয়ের্নিকা হয়ে উঠেছিল আখ্যানটি। সাদার চেয়েও সাদামাটা প্রচ্ছদ আর প্রবন্ধ-গন্ধময় নামের উপন্যাসটির খোঁজ দু-চারজন ছাড়া কেউ পায়নি। তার ঠাঁই হয়েছিল লেখকের চৌকির তলায় ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। কেউ আগ্রহ নিয়ে পীড়াপীড়ি করে পড়তে চাইলে ধুলা-ময়লা ঝেড়ে বলতেন, ‘পইড়া দেখতে পারো।’
পরের দুটি উপন্যাস সে রাত্রে পূর্ণিমা ছিল ও মুখের দিকে দেখি একটিকে আরেকটি ছাড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাস। প্রথমটিতে রয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা ও বিস্তার, দ্বিতীয়টিতে আছে মাস্টারপিস হওয়ার উপাদান ও যোগ্যতা। তুলনায় আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু কিছুটা দুর্বল, ১৯৮৯ সালের সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হলেও জীবদ্দশায় লেখক বই প্রকাশ করেননি, অবহেলায় রেখে দিয়েছিলেন আলমারির নিচ তাকিয়ায়। মৃত্যুর পর ২০০৯-এ প্রকাশিত হলে উপন্যাসটির বৈভব ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরই উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পায়।
ডুমুরখেকো মানুষ ও ডলু নদীর হাওয়া বই দুটিতে মোট ১৫টি গল্প আছে। আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস উভয় গ্রন্থে আছে, লেখকের ভাষায় ‘শুধুমাত্র শুদ্ধ পাঠ’ নিশ্চিত করতে। বই দুটির সব গল্পই একটির চেয়ে অন্যটি আলাদা, অনন্য। চতুর্থ মাত্রা, আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, কোথায় পাব তারে। কোনো ঘটনা বা কাহিনি ছাড়াই অসামান্য গল্প। আবার ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ ঘটনার ঘনঘটায় পূর্ণ। ‘কাঁটা’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত অতুলনীয় এক শিল্পকর্ম। ‘চতুর্থ মাত্রা’ তো আগাপাছতলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। ডলু নদীর হাওয়া প্রেম ও জীবনের জটিল ধাঁধার বিস্তার। তাঁর সব গল্প নিয়ে আগবাড়িয়ে এমন কথা চলে।
বাস্তব ও অলীকের ভেদরেখায় দাঁড়িয়ে শহীদুল জহির আখ্যান নির্মাণ করেন, যেখানে একমাত্রিক ফ্যান্টাসি আর বহুমাত্রিক বাস্তবতা কুহেলিকাময় বাস্তবতা তৈরি করে। তাঁর শিল্পের জমি ও শিল্পের আকাশ পরস্পর জুড়ে থাকে। আর তাতে জড়িয়ে-ছড়িয়ে থাকে শ্লেষ, বিদ্রূপ, হাস্যরস আর ব্যঙ্গের এক অনন্যরসায়ন, যা বিরামহীন ঘোর ও মুগ্ধতা তৈরি করে। বিষয় হিসেবে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, প্রেম, সমাজবাস্তবতা কিংবা রাজনীতিকে বেছে নেওয়া হয়। আর এসবের ফাঁকফোকরে কিংবা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। কখনো চরিত্র ও ঘটনার কেন্দ্রে, কখনো জোরালো হয়ে বহুদূর পরিধির কাছাকাছি। কিন্তু সব ছাপিয়ে মানুষের জীবন আর তার বাস্তবতাই প্রতিষ্ঠা পায়। তার হাহাকার ও নগদ পাওনার কাল্পনিক মিশেলে তৈরি হয় এক নয়া বাস্তবতা। নয়া দুনিয়ায় ভিন্ন বাস্তবতার বাঁকে ও চোরাবালিতে থাকে প্রেম-যৌনতা আর ক্ষমতার নির্মম কামড়। এরা মানুষকে নাড়ায়। তাকে নিয়ে খেলা করে, কিন্তু কখনো ছেড়ে যায় না। যদিও তাঁর আখ্যানের প্রেম ও যৌনতা, গতানুগতিক, ক্লান্তিকর ও আবেগসর্বস্ব নয়। এ প্রবৃত্তি চরিত্রকে ভোগায়, তাকে শান্তি ও স্বস্তি দেয় না। বরং হলাহল ও বিতৃষ্ণা উগরে দেয়।’ সম্পর্কের টানাপোড়েনে নির্ভরতা ও নির্ভারতার পরিবর্তে সেখানে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচল তৈরি হয়। জহিরের সৃষ্টি মানুষেরা তাই নিম্নবর্গের ন্যুব্জ, ভেঙে পড়া, পিছলে পিছিয়ে পড়া, দোমড়ানো-মোচড়ানো। এরা উন্মূল, বিচ্ছিন্ন, বাস্তু ও সম্পর্কহীন। শঠ জীবনের পাতা চোরাগোপ্তা ফাঁদে তারা সহজেই ধরা পড়ে আর পস্তায়। কিন্তু আত্মসমর্পণ করে না, লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যায় না।
শৈলী ও ভাষায় নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন জহির। সৌন্দর্য সৃষ্টির নন্দনতত্ত্বকে যত্ন করে এড়িয়ে চলেছেন। ফুল-পাখি, আমি-তুমি-ভালোবাসাময় প্রপঞ্চ বাদ দিয়ে পাল্টা নন্দনতত্ত্ব হাজির করেছিলেন। শব্দ-বাক্য ব্যবহারে ছিলেন খুঁতখুঁতে ও পারফেক্টশনিস্ট। বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ককে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার সবার আছে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে, ফ্রেমে বন্দী করে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং ভাষা হচ্ছে সচল নদীর মতো নিরন্তর প্রবহমান।
নিরীক্ষাকে ব্যক্তিজীবনেও যেন প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন জহির। মুখের দিকে দেখিতে এক সত্তার দুই ব্যক্তি মামুন ও খরকোশ পুরান ঢাকা ও সাতকানিয়ায় বেড়ে ওঠে, যুক্তির বিচারে যা অবিশ্বাস্য প্রকল্প। কিন্তু জহির নিজে এই জটিল কাহিনির মতো দ্বৈত জীবন যাপন করেছেন। শহীদুল হক নামে সৎ ও চৌকস আমলা (সচিব) ছিলেন। কিন্তু খুব কাছের সহকর্মীদের কাছেও তাঁর লেখকসত্তার পরিচয় ছিল অজানা। আবার পাঠক-লেখক-কবিদের খুব অল্পসংখ্যক তাঁর আমলা পরিচয়ের খবর জানতেন। তাঁর দপ্তরে শহীদুল জহিরের খোঁজে কেউ ফোন করলে তিনি জানাতেন, ‘ওই নামে এখানে কেউ নেই।’ এই দ্বৈত সত্তার ধাঁধা মৃত্যুর পরও মীমাংসা হয়নি। তাঁর কবরে শহীদুল জহির ও শহীদুল হক নামে দুটি সাইনবোর্ড এখনো বহাল আছে।
শহীদুল জহির আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু উপন্যাসের শুরুর পূর্বে ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অবশ্যই হয়, কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য ভিন্ন।’ প্রাচীন চীনে সিমা ছিয়েন নামের একজন সাহিত্যিক বলেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।’ শহীদুল জহির বেলেহাঁসের পালকের মতো মৃত্যু নিয়ে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন আর অনেকের ওপর চাপিয়ে গেছেন থাই পাহাড়ের অযুত ভার।
No comments