চারদিক-‘এইবার বাড়িত গেলে খালি খেলমু’ by শামসুজ্জামান শামস
‘এইবার বাড়িত গেলে আর আহুম না। খালি খেলমু। বাইট্টা হইয়া গেছি আর এট্টু বড় অইলে স্কুলে যামু। এরপর এইহানে পড়তে আমু।’ বলল জুয়েল আর জনি। মে দিবসের সকাল। গরম লোহার কড়াইয়ে রুটি ভাজছে জুয়েল। পাশেই আরেকটি লোহার কড়াইয়ে ডিম ভাজছে জনি। এদের একজনের বয়স ১০, অন্যজনের ১১।
দুজনেই কিছুক্ষণ পরপরই হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিচ্ছে কপালে জমে থাকা ঘাম। কাজ শেষে তাদের সঙ্গে কথা হলে এভাবেই বলেছিল তারা দুজনে। এরা দুজনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ক্যানটিনে কাজ করে।
‘আব্বু-আম্মু, ওঠো, ব্রাশ করে নাশতা শেষে পড়ার টেবিলে পড়তে বসো। হোমওয়ার্কগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে।’ কথাগুলো চেনা চেনা লাগছে না? প্রতিদিন সকালে সচেতন পরিবারের সন্তানদের উদ্দেশে বাবা-মাকে এ কথাগুলো বলতে শোনা যায়। একই অধিকারের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও শিশুশ্রমিকদের শুনতে হয় ভিন্ন কথা। ওরা শোনে, ‘এই ওঠ! থালা-বাসন ধুইয়া তাড়াতাড়ি নাশতা বানা। কাস্টমার আইসা যেন ফিরা না যায়।’
খাবারের দোকানে কর্মরত শিশুশ্রমিকদের ঘুম ভাঙে এ ধরনের কথা শুনে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খাবারের দোকানে এ রকম অনেক শিশু রয়েছে; বিভিন্ন হলের ক্যানটিন ও দোকানে প্রায় ২৫-৩০ জন শিশুশ্রমিক কাজ করে। এদের সবার বয়সই ৯ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে অস্থায়ীভাবে চা, আইসক্রিম, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করে প্রায় ১৫-২০ শিশুশ্রমিক। তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশুই স্কুল শেষে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে। শুধু পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার লক্ষ্যে যে সময়টা ফুটবল অথবা ক্রিকেট ব্যাট হাতে থাকার কথা ছিল, সেই সময়টায় তারা চায়ের ফ্লাস্ক আর বাদামের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এদেরই একজন নয় বছরের শেখ মুজিবুর রহমান। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় সে। ‘প্রতিদিন ১০০ ট্যাকার চা বেচি। মায় ছোট বইনেরে রাখে, তাই গার্মেন্সে কাম করতে পারে না। আমি কাম কইরা আব্বারে ট্যাকা দেই। আব্বায়ও রিকশা চালায়। দুইজনের ট্যাকা দিয়া সংসার চলে। বড় হইয়া সরকারি চাকরি করুম। সবাই খেলে, আমি কাম করি; কষ্ট লাগে। তয় ছোট বইনডার কথা মনে হইলে আর খারাপ লাগে না।’ কথা শেষ না হতেই ক্রেতার ডাকে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে দৌড়ে চলে যায় শেখ মুজিবুর রহমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় একই পরিমাণ পরিশ্রম করলেও ক্যানটিন ও দোকানে কাজের অভিজ্ঞতা এবং বয়সের ওপর ভিত্তি করে শিশুশ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। হলের ভেতরের ক্যানটিন, মেস ও দোকানে কর্মরত শিশুশ্রমিককে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মাসে ৬০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। আর হলের বাইরের দোকানগুলোর ক্ষেত্রে ডেইরি ফার্ম গেটের দোকানগুলোতে একজন শিশুশ্রমিককে এক হাজার থেকে ুএক হাজার ৫০০ টাকা, বটতলার খাবারের দোকানগুলোতে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দোকানে কর্মরত সোহেল, শিমুল, আরিফের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, খাবারের দোকান হওয়ায় ভোরবেলায় উঠতে হয়। প্রায় সারা দিনই কাজ করতে হয়। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ চলে। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় মাত্র ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা। সমান কাজ করলেও একেকজনকে একেক রকম বেতন দেওয়া হয়। তবে দোকানদার জাকির, শান্ত, শহিদুল ও কাদের বলেন, পরিবারে অভাব থাকায় এরা বাধ্য হয়ে দোকানে কাজ করে। থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি দোকান-মালিকেরা সব সময় এদের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির বলেন, শিশুদের কায়িক শ্রম থেকে উদ্ধার করে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। যারা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত করে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া কোমলমতি এসব শিশুর শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দরিদ্র পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব।
এ এক অদ্ভুত অবস্থা! এই শিশুরা কাজ না করলে তাদের পরিবার খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না। আবার শিশুদের দিয়ে এ রকম কাজ করানো যায় কি না, তা নিয়েও থাকে সংশয়।
শিশুরা ফিরে পাক তাদের শৈশব। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
শামসুজ্জামান শামস
‘আব্বু-আম্মু, ওঠো, ব্রাশ করে নাশতা শেষে পড়ার টেবিলে পড়তে বসো। হোমওয়ার্কগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে।’ কথাগুলো চেনা চেনা লাগছে না? প্রতিদিন সকালে সচেতন পরিবারের সন্তানদের উদ্দেশে বাবা-মাকে এ কথাগুলো বলতে শোনা যায়। একই অধিকারের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও শিশুশ্রমিকদের শুনতে হয় ভিন্ন কথা। ওরা শোনে, ‘এই ওঠ! থালা-বাসন ধুইয়া তাড়াতাড়ি নাশতা বানা। কাস্টমার আইসা যেন ফিরা না যায়।’
খাবারের দোকানে কর্মরত শিশুশ্রমিকদের ঘুম ভাঙে এ ধরনের কথা শুনে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খাবারের দোকানে এ রকম অনেক শিশু রয়েছে; বিভিন্ন হলের ক্যানটিন ও দোকানে প্রায় ২৫-৩০ জন শিশুশ্রমিক কাজ করে। এদের সবার বয়সই ৯ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে অস্থায়ীভাবে চা, আইসক্রিম, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করে প্রায় ১৫-২০ শিশুশ্রমিক। তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশুই স্কুল শেষে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে। শুধু পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার লক্ষ্যে যে সময়টা ফুটবল অথবা ক্রিকেট ব্যাট হাতে থাকার কথা ছিল, সেই সময়টায় তারা চায়ের ফ্লাস্ক আর বাদামের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এদেরই একজন নয় বছরের শেখ মুজিবুর রহমান। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় সে। ‘প্রতিদিন ১০০ ট্যাকার চা বেচি। মায় ছোট বইনেরে রাখে, তাই গার্মেন্সে কাম করতে পারে না। আমি কাম কইরা আব্বারে ট্যাকা দেই। আব্বায়ও রিকশা চালায়। দুইজনের ট্যাকা দিয়া সংসার চলে। বড় হইয়া সরকারি চাকরি করুম। সবাই খেলে, আমি কাম করি; কষ্ট লাগে। তয় ছোট বইনডার কথা মনে হইলে আর খারাপ লাগে না।’ কথা শেষ না হতেই ক্রেতার ডাকে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে দৌড়ে চলে যায় শেখ মুজিবুর রহমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় একই পরিমাণ পরিশ্রম করলেও ক্যানটিন ও দোকানে কাজের অভিজ্ঞতা এবং বয়সের ওপর ভিত্তি করে শিশুশ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। হলের ভেতরের ক্যানটিন, মেস ও দোকানে কর্মরত শিশুশ্রমিককে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মাসে ৬০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। আর হলের বাইরের দোকানগুলোর ক্ষেত্রে ডেইরি ফার্ম গেটের দোকানগুলোতে একজন শিশুশ্রমিককে এক হাজার থেকে ুএক হাজার ৫০০ টাকা, বটতলার খাবারের দোকানগুলোতে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দোকানে কর্মরত সোহেল, শিমুল, আরিফের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, খাবারের দোকান হওয়ায় ভোরবেলায় উঠতে হয়। প্রায় সারা দিনই কাজ করতে হয়। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ চলে। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় মাত্র ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা। সমান কাজ করলেও একেকজনকে একেক রকম বেতন দেওয়া হয়। তবে দোকানদার জাকির, শান্ত, শহিদুল ও কাদের বলেন, পরিবারে অভাব থাকায় এরা বাধ্য হয়ে দোকানে কাজ করে। থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি দোকান-মালিকেরা সব সময় এদের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির বলেন, শিশুদের কায়িক শ্রম থেকে উদ্ধার করে শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। যারা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত করে, তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া কোমলমতি এসব শিশুর শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দরিদ্র পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব।
এ এক অদ্ভুত অবস্থা! এই শিশুরা কাজ না করলে তাদের পরিবার খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে না। আবার শিশুদের দিয়ে এ রকম কাজ করানো যায় কি না, তা নিয়েও থাকে সংশয়।
শিশুরা ফিরে পাক তাদের শৈশব। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
শামসুজ্জামান শামস
No comments