একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-একদল কিশোরের বিমান ছিনতাই প্রচেষ্টা by শামীম আমিনুর রহমান
বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলছে, এ সময় করাচিতে পাঁচ বাঙালি কিশোর অস্ত্র জোগাড় করে পরিকল্পনা নিল পিআইএর বিমান ছিনতাইয়ের। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল... আলতাফুরের খোঁজ পাই আমার পরিচিত এক মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিকের কাছে।
আলতাফুর ছিলেন পাঁচ কিশোর দলের একজন যাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানের করাচিতে বসে পরিকল্পনা নিয়েছিল পিআইএর একটি বিমান ছিনতাইয়ের। আলতাফুর ছিলেন মূলত ওই কিশোর দলটির নেতা। প্রথমে এই ঘটনাটা জেনে অবাক হয়েছি ভীষণরকম, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি।
তারপরও আলতাফুরকে খুঁজতে তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। সম্ভবত সেটি ছিল কোনো ছুটির দিন। পুরো অফিস ফাঁকা। সাক্ষাত হলো মাঝবয়সী সুদর্শন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনিই আলতাফুর। তাঁর ঘরে বসে আলাপ শুরু হলো। আলতাফুর ফিরে গেলেন তাঁর ফেলে আসা কৈশোরের সেই স্বর্ণালি অধ্যায়ে। আমি ক্রমশ তাঁর স্মৃতির পাতায় নিমজ্জিত হতে থাকলাম।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পিআইএর একটি বিমান ছিনতাই করার কথা মাথায় আসে আলতাফুরের। আলতাফুর তখন পাকিস্তানের করাচিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। করাচির বাংলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। গোপনে স্কুলের আরো কয়েকজন বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করলেন যে, যাত্রীবেশে টিকিট কেটে পিআইএর একটি বিমানে চড়ে বসবেন তাঁরা। তারপর বিমান আকাশে উড়ার পর অস্ত্রের মুখে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন, যেমনটা তাঁরা সিনেমায় দেখেছেন।
ওই পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আলতাফুর বলেন, ‘পরিকল্পনা নিলাম ঠিকই। কিন্তু সমস্য অনেক। টিকিটের জন্য দরকার টাকার, অস্ত্রও যোগাড় করতে হবে, সেটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এছাড়া মেটাল ডিটেক্টরকে ফাকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠতে হবে। আমরা প্লেনবিষয়ক নানা ধরনের বুলেটিন ও ডায়াগ্রাম পড়তে শুরু করলাম। সুযোগ করে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থাও পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।’
একাত্তরের নভেম্বরে একদিন আলতাফুর ও তাঁর বন্ধুরা করাচির জাহাঙ্গীর পার্কে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ওই পার্কে বেলুচিস্তানের কোয়েটা শহরের অধিবাসী জনৈক দুররানির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে। দুররানি কোয়েটা থেকে কী এক কাজে করাচিতে এসেছিলেন এবং তখন ওই পার্কে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে দুররানি জানান, কোয়েটায় অনায়াসে পিস্তল কেনা যায়। তিনি নিজেকে সংগ্রামী বেলুচিস্তানের লাল কোর্তা সংগঠনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।
গোপন কিশোর দলে আলতাফুরসহ মোট সদস্য পাঁচজন: দশম শ্রেণীর ছাত্র আখতার হোসেন, আলী আনসার, জিয়াউল হক মন্টু এবং নবম শ্রেণীর ছাত্র কায়সার হালিম ডাবলু। স্কুলের টিফিনের পয়সা, বাসার পুরোনো বইপত্র, ইলেকট্রিক ও খেলার সরঞ্জাম বিক্রির টাকা এবং স্কুল সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা একত্র করে যোগাড় হলো অস্ত্র ও প্লেনের টিকিট কেনার টাকা । আলী আনসার অবশ্য নিজেই দুটি পিস্তল কেনার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর কায়সার হালিম, যাঁকে সবাই ডাবলু বলে ডাকত, আখতার হোসেন এবং জিয়াউল হক মন্টু করাচি থেকে হাজার মাইল দূরে আফগান সীমান্তের কাছে কোয়েটা শহরে তিনবার গিয়ে দুররানির সাহায্যে পাঁচটি পিস্তল সংগ্রহ করেন। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ফলে তখন ঠিক হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের মুক্তির দাবিতে বিমান ছিনতাই করা হবে। এবং এটা করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই ২৫ মার্চের করাচি থেকে লাহোরগামী প্লেনের পাঁচটি টিকিট কেনা হলো। শেডিউল অনুযায়ী প্লেনটির সকাল সাতটায় করাচি বিমানবন্দর ছেড়ে যাবার কথা।
২৪ মার্চ বিকেলে আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন ও জিয়াউল হক মন্টু যাঁর যাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। আগেই ঠিক করা ছিল, রাতে তাঁরা আনসারের বাসায় থাকবেন। কিন্তু আনসারের বাসায় গেস্ট থাকায় ওখানে থাকা হলো না। আনসারও বাসায় অতিথি রেখে বেরুতে পারলেন না। অগত্যা বাকি চারজন অর্থাৎ আলতাফ, আখতার, জিয়াউল হক মন্টু ও ডাবলু এয়ারপোর্টের কাছে এক রাতের জন্য টুরিস্ট ইন নামের একটি হোটেলে রাত কাটান।
২৫ মার্চ ভোর ছটায় তাঁরা চারজন একটি ট্যাক্সি করে হাজির হন করাচী এয়ারপোর্টে। সময়ের চেয়ে বেশি আগে চলে আসায় তাঁরা দেখলেন বোর্ডিং লাউঞ্জে একেবারেই ফাঁকা। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক তখনই আখতারের বাবা ও মামা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ পর আলতাফুরের ছোট চাচাও চলে এলেন। পরিবারের কাছে তাঁদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে। আলতাফের বাবা তাঁদের এয়ারপোর্ট বাড়িতে নিয়ে এলেন ঠিকই কিন্তু ওখান থেকে বাসার লোকজনকে পিস্তল দেখিয়ে আবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দিলেন আলতাফুর ও অন্যরা। এবার প্রথমে এয়ারপোর্টের কাছে একটি রেলওয়ের স্টক ইয়ার্ডে তাঁরা জড়ো হলেন এবং ওখান থেকে এয়ারপোর্টের দক্ষিণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর কাছে চলে এলেন লুকিয়ে। কারণ তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন তাঁদের অভিভাবকেরা এয়ারপোর্টের প্রবেশপথে অপেক্ষা করবেন তাঁদের ধরার জন্য। তাঁদের ফাকি দেওয়া জন্যই এই বিকল্প পথে, কাঁটাতারের বেষ্টনী পেরিয়ে লাহোরগামী প্লেনে উঠার সিদ্ধান্ত। কিন্তু মুশকিল হলো তার কেটে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢোকার মতো কোনো কিছু তাঁদের হাতে নেই। খানিক নানা উপায় নিয়ে ভেবে শেষে বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা স্থগিত করে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা।
তবে সোজা বাসায় না গিয়ে একটি ট্রাকে লিফট নিয়ে শহরের দিকে চলে আসেন তাঁরা। তারপর জাহাঙ্গীর পার্কে ঢুকে ওখানেই বসে থাকেন। বাসায় ফেরেন আরো পরে।
এপ্রিল মাসের কোনো এক দিন মধ্যরাতে আলতাফুর ও তাঁর সঙ্গীদের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার হয় আলতাফুর, আখতার, কায়সার, আনসার ও জিয়াউল হক। রাতেই তাঁদের থানায় নিয়ে তখনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একত্র করা হয়। কথা আদায়ের জন্য শুরু হয় নির্যাতন। জানতে চাওয়া হয়, অস্ত্র কোত্থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হলো। প্লেন ছিনতাই করার পরিকল্পনা কবে, কখন থেকে এবং কী উদ্দেশ্যে করার চিন্তা করা হয়েছিল? কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। প্রায় তিন দিন ধরে চলে নির্যাতন। আলতাফুরের ভাষায়, ‘দুজন লম্বা-চওড়া পুলিশ বেত দিয়ে আমাদের সজোরে পেটাতে লাগল। মারতে লাগল চড় ও ঘুষি। একপর্যায়ে তারা আমাকে বেমক্কা আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমাদের পা দুটো উঁচু করে টেবিলে রাখা কাঠের একটা রোলার এবং বেত দিয়ে সজোরে পায়ের পাতায় আঘাত করা হতে থাকে। আঘাতে চোখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করি।’
তিন দিন পর (১৩ এপ্রিল ১৯৭২) দুপুরে আলতাফুর ও তাঁর দলকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য হাজির করা হয়। সেখান থেকে তাঁদের সবাইকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিছুদিন পর ওঁদের বাবাদেরও গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সন্তানদের পরিকল্পনা জানার পরও পুলিশকে খবর দেননি তাঁরা। ১৯ এপ্রিল তাঁদের মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। অভিভাবকদের চেয়ারে বসতে দিয়ে আলতাফুরদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জগুলো পড়ে শোনানো হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে যে ধারায় কোর্টে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাতে মার্শাল লর ১০ ধারা ও পেনাল কোডের ৩৯৯ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা কোর্ট রাখে। আলতাফুরের পক্ষের আইনজীবী কোর্টে যুক্তি তুলে ধরলেন, তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ তখন অনেক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থন দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত এবং এর জন্য তাঁদের সময় দরকার। আসলে আলতাফুরের আইনজীবী চাচ্ছিলেন, যাতে কোর্টের প্রসিডিং কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। কারণ, তখন শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানে মার্শাল ল উঠিয়ে নেওয়া হবে। ফলে মামলা কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। এর কয়েক দিন পর মার্শাল ল তুলে নেওয়া হয়। আর আলতাফুরদের মামলা চলে যায় বেসামরিক আদালতে বা সাধারণ কোর্টে। এরপর বিচার চলাকালীন আলতাফুরদের দল এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত জেলে ছিলেন এবং তাঁদের অভিভাবকদেরও জুন পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়েছিল। জুনে অভিভাবকেরা এবং আগস্টে আলতাফুরের দল জামিন লাভ করে। পাকিস্তানে তখন বাঙালিদের বাংলাদেশে সরকারিভাবে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন, কায়সার হালিম, আলী আনসার, জিয়াউল হক তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এত দিন পর মধ্যবয়সী আইনজীবী আলতাফুর সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন: ‘বাস্তবে তখন সম্ভব ছিল কি না; সে কথা না ভেবেই কত বড় বড় পরিকল্পনাই না করেছিলাম। আমার এবং আমাদের বন্ধুদের সেদিনের এ রকম প্রচেষ্টাকে অনেকেই হাস্যকর বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমরা যা কিছু করেছিলাম, মাতৃভূমির সঙ্গে আমাদের অকৃত্রিম নাড়ির টান থেকে, গভীর দেশপ্রেমের বোধ থেকেই।’
বিমান ছিনতাই স্কোয়াডের সেদিনের সেই কিশোর সদস্যরা এখন কোথায়। আলতাফুরের কাছে জানা গেল, আখতার হোসেন একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনসের পাইলট, আর আলী আনসার চট্টগ্রামে একটি ফটো স্টুডিওর মালিক এবং কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন। জিয়াউল হক মন্টু আছেন কানাডায়। তাঁর খুব কাছের বন্ধু কায়সার হালিম, যাকে তিনি ডাবলু বলে ডাকতেন তিনি বেঁচে নেই। অসমসাহসী এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ডাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুয়োলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের দিকে এক মেয়ের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
তারপরও আলতাফুরকে খুঁজতে তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। সম্ভবত সেটি ছিল কোনো ছুটির দিন। পুরো অফিস ফাঁকা। সাক্ষাত হলো মাঝবয়সী সুদর্শন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনিই আলতাফুর। তাঁর ঘরে বসে আলাপ শুরু হলো। আলতাফুর ফিরে গেলেন তাঁর ফেলে আসা কৈশোরের সেই স্বর্ণালি অধ্যায়ে। আমি ক্রমশ তাঁর স্মৃতির পাতায় নিমজ্জিত হতে থাকলাম।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পিআইএর একটি বিমান ছিনতাই করার কথা মাথায় আসে আলতাফুরের। আলতাফুর তখন পাকিস্তানের করাচিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। করাচির বাংলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। গোপনে স্কুলের আরো কয়েকজন বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করলেন যে, যাত্রীবেশে টিকিট কেটে পিআইএর একটি বিমানে চড়ে বসবেন তাঁরা। তারপর বিমান আকাশে উড়ার পর অস্ত্রের মুখে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন, যেমনটা তাঁরা সিনেমায় দেখেছেন।
ওই পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আলতাফুর বলেন, ‘পরিকল্পনা নিলাম ঠিকই। কিন্তু সমস্য অনেক। টিকিটের জন্য দরকার টাকার, অস্ত্রও যোগাড় করতে হবে, সেটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এছাড়া মেটাল ডিটেক্টরকে ফাকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠতে হবে। আমরা প্লেনবিষয়ক নানা ধরনের বুলেটিন ও ডায়াগ্রাম পড়তে শুরু করলাম। সুযোগ করে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থাও পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।’
একাত্তরের নভেম্বরে একদিন আলতাফুর ও তাঁর বন্ধুরা করাচির জাহাঙ্গীর পার্কে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ওই পার্কে বেলুচিস্তানের কোয়েটা শহরের অধিবাসী জনৈক দুররানির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে। দুররানি কোয়েটা থেকে কী এক কাজে করাচিতে এসেছিলেন এবং তখন ওই পার্কে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে দুররানি জানান, কোয়েটায় অনায়াসে পিস্তল কেনা যায়। তিনি নিজেকে সংগ্রামী বেলুচিস্তানের লাল কোর্তা সংগঠনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।
গোপন কিশোর দলে আলতাফুরসহ মোট সদস্য পাঁচজন: দশম শ্রেণীর ছাত্র আখতার হোসেন, আলী আনসার, জিয়াউল হক মন্টু এবং নবম শ্রেণীর ছাত্র কায়সার হালিম ডাবলু। স্কুলের টিফিনের পয়সা, বাসার পুরোনো বইপত্র, ইলেকট্রিক ও খেলার সরঞ্জাম বিক্রির টাকা এবং স্কুল সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা একত্র করে যোগাড় হলো অস্ত্র ও প্লেনের টিকিট কেনার টাকা । আলী আনসার অবশ্য নিজেই দুটি পিস্তল কেনার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর কায়সার হালিম, যাঁকে সবাই ডাবলু বলে ডাকত, আখতার হোসেন এবং জিয়াউল হক মন্টু করাচি থেকে হাজার মাইল দূরে আফগান সীমান্তের কাছে কোয়েটা শহরে তিনবার গিয়ে দুররানির সাহায্যে পাঁচটি পিস্তল সংগ্রহ করেন। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ফলে তখন ঠিক হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের মুক্তির দাবিতে বিমান ছিনতাই করা হবে। এবং এটা করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই ২৫ মার্চের করাচি থেকে লাহোরগামী প্লেনের পাঁচটি টিকিট কেনা হলো। শেডিউল অনুযায়ী প্লেনটির সকাল সাতটায় করাচি বিমানবন্দর ছেড়ে যাবার কথা।
২৪ মার্চ বিকেলে আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন ও জিয়াউল হক মন্টু যাঁর যাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। আগেই ঠিক করা ছিল, রাতে তাঁরা আনসারের বাসায় থাকবেন। কিন্তু আনসারের বাসায় গেস্ট থাকায় ওখানে থাকা হলো না। আনসারও বাসায় অতিথি রেখে বেরুতে পারলেন না। অগত্যা বাকি চারজন অর্থাৎ আলতাফ, আখতার, জিয়াউল হক মন্টু ও ডাবলু এয়ারপোর্টের কাছে এক রাতের জন্য টুরিস্ট ইন নামের একটি হোটেলে রাত কাটান।
২৫ মার্চ ভোর ছটায় তাঁরা চারজন একটি ট্যাক্সি করে হাজির হন করাচী এয়ারপোর্টে। সময়ের চেয়ে বেশি আগে চলে আসায় তাঁরা দেখলেন বোর্ডিং লাউঞ্জে একেবারেই ফাঁকা। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক তখনই আখতারের বাবা ও মামা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ পর আলতাফুরের ছোট চাচাও চলে এলেন। পরিবারের কাছে তাঁদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে। আলতাফের বাবা তাঁদের এয়ারপোর্ট বাড়িতে নিয়ে এলেন ঠিকই কিন্তু ওখান থেকে বাসার লোকজনকে পিস্তল দেখিয়ে আবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দিলেন আলতাফুর ও অন্যরা। এবার প্রথমে এয়ারপোর্টের কাছে একটি রেলওয়ের স্টক ইয়ার্ডে তাঁরা জড়ো হলেন এবং ওখান থেকে এয়ারপোর্টের দক্ষিণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর কাছে চলে এলেন লুকিয়ে। কারণ তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন তাঁদের অভিভাবকেরা এয়ারপোর্টের প্রবেশপথে অপেক্ষা করবেন তাঁদের ধরার জন্য। তাঁদের ফাকি দেওয়া জন্যই এই বিকল্প পথে, কাঁটাতারের বেষ্টনী পেরিয়ে লাহোরগামী প্লেনে উঠার সিদ্ধান্ত। কিন্তু মুশকিল হলো তার কেটে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢোকার মতো কোনো কিছু তাঁদের হাতে নেই। খানিক নানা উপায় নিয়ে ভেবে শেষে বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা স্থগিত করে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা।
তবে সোজা বাসায় না গিয়ে একটি ট্রাকে লিফট নিয়ে শহরের দিকে চলে আসেন তাঁরা। তারপর জাহাঙ্গীর পার্কে ঢুকে ওখানেই বসে থাকেন। বাসায় ফেরেন আরো পরে।
এপ্রিল মাসের কোনো এক দিন মধ্যরাতে আলতাফুর ও তাঁর সঙ্গীদের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার হয় আলতাফুর, আখতার, কায়সার, আনসার ও জিয়াউল হক। রাতেই তাঁদের থানায় নিয়ে তখনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একত্র করা হয়। কথা আদায়ের জন্য শুরু হয় নির্যাতন। জানতে চাওয়া হয়, অস্ত্র কোত্থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হলো। প্লেন ছিনতাই করার পরিকল্পনা কবে, কখন থেকে এবং কী উদ্দেশ্যে করার চিন্তা করা হয়েছিল? কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। প্রায় তিন দিন ধরে চলে নির্যাতন। আলতাফুরের ভাষায়, ‘দুজন লম্বা-চওড়া পুলিশ বেত দিয়ে আমাদের সজোরে পেটাতে লাগল। মারতে লাগল চড় ও ঘুষি। একপর্যায়ে তারা আমাকে বেমক্কা আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমাদের পা দুটো উঁচু করে টেবিলে রাখা কাঠের একটা রোলার এবং বেত দিয়ে সজোরে পায়ের পাতায় আঘাত করা হতে থাকে। আঘাতে চোখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করি।’
তিন দিন পর (১৩ এপ্রিল ১৯৭২) দুপুরে আলতাফুর ও তাঁর দলকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য হাজির করা হয়। সেখান থেকে তাঁদের সবাইকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিছুদিন পর ওঁদের বাবাদেরও গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সন্তানদের পরিকল্পনা জানার পরও পুলিশকে খবর দেননি তাঁরা। ১৯ এপ্রিল তাঁদের মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। অভিভাবকদের চেয়ারে বসতে দিয়ে আলতাফুরদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জগুলো পড়ে শোনানো হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে যে ধারায় কোর্টে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাতে মার্শাল লর ১০ ধারা ও পেনাল কোডের ৩৯৯ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা কোর্ট রাখে। আলতাফুরের পক্ষের আইনজীবী কোর্টে যুক্তি তুলে ধরলেন, তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ তখন অনেক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থন দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত এবং এর জন্য তাঁদের সময় দরকার। আসলে আলতাফুরের আইনজীবী চাচ্ছিলেন, যাতে কোর্টের প্রসিডিং কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। কারণ, তখন শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানে মার্শাল ল উঠিয়ে নেওয়া হবে। ফলে মামলা কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। এর কয়েক দিন পর মার্শাল ল তুলে নেওয়া হয়। আর আলতাফুরদের মামলা চলে যায় বেসামরিক আদালতে বা সাধারণ কোর্টে। এরপর বিচার চলাকালীন আলতাফুরদের দল এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত জেলে ছিলেন এবং তাঁদের অভিভাবকদেরও জুন পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়েছিল। জুনে অভিভাবকেরা এবং আগস্টে আলতাফুরের দল জামিন লাভ করে। পাকিস্তানে তখন বাঙালিদের বাংলাদেশে সরকারিভাবে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন, কায়সার হালিম, আলী আনসার, জিয়াউল হক তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এত দিন পর মধ্যবয়সী আইনজীবী আলতাফুর সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন: ‘বাস্তবে তখন সম্ভব ছিল কি না; সে কথা না ভেবেই কত বড় বড় পরিকল্পনাই না করেছিলাম। আমার এবং আমাদের বন্ধুদের সেদিনের এ রকম প্রচেষ্টাকে অনেকেই হাস্যকর বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমরা যা কিছু করেছিলাম, মাতৃভূমির সঙ্গে আমাদের অকৃত্রিম নাড়ির টান থেকে, গভীর দেশপ্রেমের বোধ থেকেই।’
বিমান ছিনতাই স্কোয়াডের সেদিনের সেই কিশোর সদস্যরা এখন কোথায়। আলতাফুরের কাছে জানা গেল, আখতার হোসেন একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনসের পাইলট, আর আলী আনসার চট্টগ্রামে একটি ফটো স্টুডিওর মালিক এবং কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন। জিয়াউল হক মন্টু আছেন কানাডায়। তাঁর খুব কাছের বন্ধু কায়সার হালিম, যাকে তিনি ডাবলু বলে ডাকতেন তিনি বেঁচে নেই। অসমসাহসী এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ডাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুয়োলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের দিকে এক মেয়ের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
No comments