ভারতের বাম রাজনীতির শেষ সূর্য অস্তমিতঃ চলে গেলেন জ্যোতি বসু
ভারতীয় রাজনীতির কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব, বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু আর নেই। গতকাল রোববার স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে কলকাতার সল্টলেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর ৬ মাস ১০ দিন।
রাজনীতির অঙ্গনের এই অকুতোভয় যোদ্ধা শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন বার্ধক্যজনিত জটিল অসুস্থতার কাছে। তার মৃত্যুতে ভারতের বাম রাজনীতির শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছে; এক সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি ঘটেছে; একথা বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না।
ঢাকার নিকটবর্তী সোনারগাঁওয়ের অন্তর্গত ‘বারুদির ছেলে’ জ্যোতি বসুর জন্ম হয় কলকাতায় ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান জ্যোতি বসু কলকাতার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লরেটো এবং সেন্ট জেভিয়ার্সে পাঠ শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে যান। সেখানেই মার্কসবাদে তার দীক্ষা। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শ্রমিকনেতা থাকাকালে হুলিয়া মাথায় নিয়ে একাধিকবার পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন রেল কলোনিতে আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি। সেই স্মৃতি এখনও কাউকে কাউকে রোমন্থন করতে দেখা যায়। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন ভারতে রাজ্য বিধানসভার যত নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তার প্রতিটিতেই জয়লাভ করেছেন একটি ছাড়া। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচন ছিল ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। ১৯৬৪ সালে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শগত বিরোধের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন তিনি ছিলেন সিপিআইএমের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের একজন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে তিনি দু’বার অকংগ্রেসি রাজ্য সরকারের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন থেকে ২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত টানা ২৩ বছর তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার আমলে ব্যাপক কৃষি সংস্কার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল। তবে শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তার সরকারের ব্যর্থতার জন্য সমালোচনাও কম হয়নি। ১৯৯৬, ১৯৯৭ সালে অকংগ্রেসি কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাকে সর্বভারতীয় রাজনীতির অন্যতম কুশীলবে পরিণত করে। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের সঙ্গে বামমোর্চার ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির প্রভাব হ্রাসের সূচনা তারই নিরলস চেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে তিনি নিশ্চিতভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নিজের দল সিপিআইএমের সম্মতি না পাওয়ায় এ উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। জ্যোতি বসু পার্টির সিদ্ধান্ত বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলেও পরবর্তী সময়ে এটাকে এক ঐতিহাসিক ভুল বলে মন্তব্য করেছেন।
জ্যোতি বসু ছিলেন মনে-প্রাণে একজন মার্কসবাদী। তবে তার মধ্যে আভিজাত্য, আধুনিকতা ও মার্কসবাদের এক বিরল সম্মিলন ঘটেছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ভারতে বিরুদ্ধ শক্তির স্রোত প্রতিহত করে দু’দশকের বেশি একটানা একটি রাজ্য সরকার পরিচালনা করে এক অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করেন তিনি। ভারতের একাধিক প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে তার পরামর্শ নিতেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে শুরু করে তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা পর্যন্ত অনেকে যে হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তার রোগমুক্তি কামনা করেছেন—সেটা অকারণ নয়। একথা সত্য যে, জীবনের শেষের দিনগুলোতে আক্ষরিক অর্থেই তিনি অবসরে ছিলেন। কিন্তু তারপরও জ্যোতি বসু থাকা এবং না থাকার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তার আত্মার সদ্গতি কামনা করি এবং তার পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
No comments