ব্যালের নাম রবিঠাকুর by গোলাম মুরশিদ
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ব্যালে। আর ব্যালেতে কেবল নাচ থাকে না। নাচের সঙ্গে থাকে সংগীত। এই সংগীত ছিল প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের অপূর্ব মোহজাল। পৃথিবীর বহু দেশেই গত বছর পালিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী। এখনো তার জের চলছে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে দেশে, এমনকি বিদেশে, নিশ্চয় অনেক হইচই হয়ে থাকবে; কিন্তু তারপর গত ৯৮ বছরে এভাবে অথবা এতটা ঘটা করে তাঁকে আর স্মরণ করা হয়েছে কি না, সন্দেহ হয়। আসলে পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসার ফলেই হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া, কাজটা এখন বেশ সহজ হয়ে গেছে। অন্তত জন্মদিন পালন করার মতো কোনো গান ও কবিতার জন্য খোঁজাখুঁজি করতে হয় না—তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন বহু প্রাসঙ্গিক কবিতা আর গান। গঙ্গা জলে গঙ্গাপুজোর মতো তাঁর গান, কবিতা, নাটক, চিত্রের প্রতিলিপি ইত্যাদি দিয়েই তাঁকে স্মরণ করা যায়। জয়ন্তী পালনের জন্য এর ওপর আর যা প্রয়োজন, সে হলো: কয়েকজন বক্তা আর একজন সভাপতি। বাংলাভাষী সম্প্রদায়ে সেটা জোগাড় করা আদৌ কঠিন ছিল না। কারণ বাক্যপ্রিয় বাঙালিদের মধ্যে বক্তা আর সভাপতির কোনো অভাব নেই। এমনকি নানা ভাষায় অনূদিত হওয়ায় অন্যান্য দেশেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অবগত লোকের এখন তেমন আকাল হয় না। অনুষ্ঠানের আঙ্গিকও সুবিদিত। প্রথমে কয়েকজনের বক্তৃতা, তারপর নাচ-গান-আবৃত্তি। এমন অনুষ্ঠানে না গিয়ে কেবল নিমন্ত্রণপত্র দেখে অথবা না দেখেই সাংবাদিকেরা ফলাও করে অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন লিখতে পারেন।
কিন্তু সম্প্রতি নিউইয়র্কের ঘণ্টা খানেক উত্তরে নিউ জার্সিতে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উৎসব পালিত হলো একটা ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। দুদিনের এই অনুষ্ঠানের প্রথম দিন যে আয়োজন করা হয়েছিল, তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এ দিন ছিল একটা ব্যালে নৃত্য। এই ব্যালের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই ব্যালের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রবিঠাকুর’। ব্যালে সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্যই জানেন যে কেবল নাচ থাকে না। সে নাচের সঙ্গে থাকে সংগীত। সেদিনের সংগীত ছিল প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের অপূর্ব মোহজাল।
আটটি তরঙ্গে বিভক্ত এই ব্যালের প্রথমে দেখানো হয় একটি বালককে—বালক রবিকে। সে বড় হয়ে ওঠে এক বৃদ্ধের সাহচর্যে এবং তাঁর শিক্ষায়। বৃদ্ধ অর্থাৎ দেবেন্দ্রনাথ আকাশ, পৃথিবী, জীবনের তাৎপর্য তুলে ধরেন পুত্রের কাছে। বালক রবি কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত হন। প্রেম, প্রকৃতি ও জগৎ নতুন রূপে ধরা দেয় তাঁর কাছে। পাশ্চাত্য তাঁকে মুগ্ধ করে। ভালোবাসার স্বাদ পান তারপর। আপনজনের মৃত্যুর আঘাত তাঁর বক্ষকে বিদীর্ণ করে। সৃষ্টির তীব্র আনন্দ এবং হূদয়মথিত-করা প্রচণ্ড বেদনায় তিনি আলোড়িত হন। খ্যাতির উজ্জ্বল আলোকে তিনি হন উদ্ভাসিত। এই সৃষ্টি দিয়ে তিনি অতঃপর আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। পাশাপাশি আপন আদর্শে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন, সেও আন্তর্জাতিকতার আদর্শে। কিন্তু স্বার্থান্ধ জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বে সারা বিশ্বে দেখা দেয় সভ্যতার সংকট। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীকে দেখে তিনি বিচলিত বোধ করেন এবং বিশ্ববাসীকে শোনান তাঁর শান্তির ললিত বাণী। শেষ পর্যন্ত রেখে যান অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তাঁর শাশ্বত সত্যের বার্তা।
ব্যালের মান কেমন ছিল, সে সম্পর্কে রসজ্ঞদের মূল্যায়ন এক-এক রকম হতে বাধ্য। কারও কারও মতে, ভারতীয় যোগের সুপরিচিত কয়েকটি মুদ্রা এবং ব্যালের প্রচলিত কয়েকটি মুদ্রার সমন্বয় ঘটিয়ে। নৃত্যের পরিকল্পনা করা হয়, বৈচিত্র্য ছিল না তাতে। এটা হয়তো একটা সীমাবদ্ধতা কিন্তু যা বিতর্কাতীত ছিল, তা হলো এই ব্যালের পরিকল্পনা এবং তার পেছনে যে ধারণা কাজ করেছিল, তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিকতা ও বিশ্বমনস্কতা।
নাচ আর গানের মধ্যেও তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিল। নাচে অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পেশাদার ব্যালে শিল্পীরা, সঙ্গে কেবল আন্তর্জাতিক বিশ্বের সংঘাত বোঝানোর জন্য কয়েকটি অপ্রধান চরিত্রে কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অভিনেতা। যন্ত্রসংগীতে যাঁরা অংশ নেন, তাঁরাও আন্তর্জাতিক—একজন ছাড়া সবাই ছিলেন অবাঙালি। তিনজন বেহালাবাদকের মধ্যে একজন ছিলেন চীনা অথবা জাপানি। চেলো, বাঁশি এবং তবলাসহ সবগুলো বাদ্যযন্ত্রই বাজিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ শিল্পীরা। উপমহাদেশের শিল্পী ছিলেন কেবল একজন—অভিষেক মুখার্জি, তিনি বাজিয়েছিলেন সেতার। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে কোনো গানের কোনো একটি তান স্থায়ী স্বরের মতো গলায় ধরে রাখছিলেন তরুণী শিল্পী কবিতা সাহা।
রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝখানে, শুরুতে অথবা শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মূল গানের সুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ স্বাধীন কম্পোজিশন। মোট কথা, সুরের একটা জাদুময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল নিউ জার্সি পারফরম্যান্স আর্টস সেন্টারের অত্যাধুনিক অডিটরিয়ামে। সংগীত পরিচালনা করেন সমীর চ্যাটার্জি। অকুণ্ঠ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন ইতালিয়ান, ক্রিস্তিনো তিয়োৎজো।
সংগীত-নৃত্যের চেয়েও এই অডিটরিয়ামে যা এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেছিল, সে হলো এর আন্তর্জাতিক আবহ। রবীন্দ্রজয়ন্তী নিতান্তই বাঙালিদের উৎসব। সেই বাঙালির উৎসব এ রকম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসা, এর চেয়ে উত্তম প্রয়াস আর আমি কখনো দেখিনি। নিজেদের পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না রেখে রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার এর থেকে ভালো উপায়ও কোথাও দেখিনি।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে, ১৩ নভেম্বর, ছিল রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের অভিনয়। নাটকের সাফল্য নির্ভর করে তার কাহিনি, মঞ্চে ঘটনার ঘনঘটা আর সংলাপের ওপর। তা ছাড়া অভিনয় তো আছেই। রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকই ঘটনাপ্রধান নয়, কথাপ্রধান। এটা নাটকের গতিকে মন্থর করে দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিসর্জন সেদিক দিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। শেক্সপিয়ারের পঞ্চাঙ্ক ট্র্যাজেডির আদর্শে রচিত এই নাটকের মধ্যে দ্রুত ঘটতে থাকে সংঘাতময় ঘটনাবলি এবং তা পরিণতিকে এগিয়ে দেয় অবশ্যম্ভাবী ট্র্যাজেডির দিকে। বিসর্জন নাটকের মূল বিষয় হলো রাষ্ট্র ও মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ। শ্রেয়তাবোধের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার বিরোধ। বিষয়টা সর্বজনিক এবং চিরকালীন। আজও এই দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সমগ্র বিশ্ব। সুতরাং সোয়া শ বছর আগে লেখা হলেও আজও এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস পায়নি। ভাষার দূরত্বকে অতিক্রম করেও এ নাটকের মূল বাণী পৌঁছে যেতে পারে সবার কাছে, সব দেশে।
দারুণ চাহিদার কথা ভেবে তাঁর প্রকাশক ম্যাকমিলান কোম্পানি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অল্প পরেই এ নাটক অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য ফরমায়েশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাড়াহুড়ো করে রবীন্দ্রনাথও এ অনুবাদ করে দেন ১৯১৫ সালে। নাটকের ভাষা হওয়া উচিত যদ্দুর সম্ভব মুখের অর্থাৎ চলিত ভাষা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দুর্ভাগ্যক্রমে অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি সাধু ভাষায়। ফলে তিনি নিজের রচনা নিজেই অনুবাদ করলেও, সে অনুবাদ যুগের উপযোগী ছিল না। নিউ জার্সির নাটকের উদ্যোক্তারা এটা অনুভব করেছিলেন উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই। তাই এ নাটকের নতুন করে অনুবাদ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত চ্যাটার্জিকে। সুদীপ্ত দীর্ঘকাল মার্কিন মুলুকে বাস করেছেন। তা ছাড়া, তাঁর বিশেষজ্ঞতা হলো নাট্যকলায়। তাঁর অনুবাদের ভাষা তাই ছিল বেশ আধুনিক ইংরেজি। কিন্তু তার মধ্যেও প্রচুর আড়ষ্টতা এবং কেতাবি ভাষার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিল। সত্যি বলতে কী, এ অনুবাদ আরও উন্নত হতে পারত। সংলাপগুলোকে আরও ভারতীয় মনে হওয়ার কারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জোরালো ভারতীয় উচ্চারণ।
সব মিলে অভিনয়ও ছিল বেশ আড়ষ্ট। খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলেন গার্গি মুখার্জি। তিনি গুণবতীর ভূমিকায় মোটামুটি সাবলীল অভিনয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। নয়তো গোবিন্দমাণিক্য, রঘুপতি, জয়সিংহ, অপর্ণা ইত্যাদি চরিত্রে সবারই অভিনয় ছিল লক্ষযোগ্যভাবে আড়ষ্ট। অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেমানান হয়েছিলেন, যিনি জয়সিংহের অভিনয় করেন। তাঁর অভিনয়ের গুণাগুণ সম্পর্কে বলছি না, কিন্তু টাকমাথার একজন প্রৌঢ়কে জয়সিংহ কল্পনা করতে পারা একটা কঠিন ব্যাপার। তাঁর সত্যিকার বয়স কত, তা আমার জানা নেই, তবে সেটা যদি রঘুপতির চেয়েও বেশি হয়ে থাকে, তা হলেও অবাক হব না।
সবার অভিনয়ই মোটামুটি কৃত্রিম মনে হওয়ার আরেকটি কারণ: অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁদের মুখে অর্ধমুখোশ পরেছিলেন। এটা আধুনিক অভিনয়ে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় গ্রহণ করা হলেও, বিসর্জন-এর মতো ধ্রুপদি এবং সিরিয়াস থিমের জন্য উপযোগী ছিল বলে অন্তত আমার মনে হয়নি। কালীমূর্তি জোগাড় করতে পারেননি আয়োজকেরা অথবা হয়তো তার চেষ্টাও করেননি। মূর্তির বদলে তাঁরা দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন ফ্রেমে বাঁধানো নকশা। এর ফলে দেবী অপ্রসন্ন হয়ে মুখ ঘুরিয়েছেন অথবা আবার প্রসন্ন হয়ে মুখ ফেরালেন—নাটকের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুটি তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে।
এই নাটকের দর্শকদের একটা বড় অংশই ছিল বিদেশি শ্বেতাঙ্গ। রবিঠাকুর ব্যালে নৃত্যেও দর্শকেরা ছিল তাই। এটা দেখে তারিফ করতে হয়। ব্যালে ও নাটকের অভিনয় দেখতেই কেবল বিদেশিরা আসেননি, চাঁদাদাতাদেরও অনেকেই ছিলেন বিদেশি এবং অবাঙালি ভারতীয়। কেবল তা-ই নয়, অভিনয়েও অপ্রধান ভূমিকায় যোগ দিয়েছিলেন অবাঙালি ভারতীয় ও বিদেশিরা। নাটকটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক ফার্লি। মোটকথা, এই সার্ধশততম জন্মবর্ষ উৎসব পালিত হয়েছিল নিতান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। আমাদের বাঙালি কবি তাঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পরও এভাবে দেশি-বিদেশিদের আকৃষ্ট করেন, এটা দেখে সত্যি আনন্দিত হতে হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে কুক্ষিগত করে রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদেরই সম্পত্তি। এমনকি, রবীন্দ্রনাথেই তাঁরা সীমাবদ্ধ থাকতে চান। যেন, রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। অথবা রবীন্দ্রচর্চাই একটা ‘পুণ্যের’ কাজ। এই কাজে রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে তাঁরই রচিত ‘মন্ত্রে’ তাঁকেই স্মরণ করে তাঁর সময়ে ফিরে যাওয়াকেই বাঙালিরা সর্বোচ্চ আদর্শ বলে বিবেচনা করেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাকে মহাপাপের কাজ বলে গণ্য করেন। ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক মৌলবাদের মতো একে বলা যেতে পারে, একধরনের ‘রবীন্দ্রবাদ’। মার্ক্সের দেড় শ বছরের পুরোনো ‘ভবিষ্যদ্বাণী’তে সন্দেহ দেখালে সেটাকে কমিউনিস্টরা যেমন ক্ষমার অযোগ্য পাতক বলে মনে করেন, রবীন্দ্রবাদীরাও তেমনি সামান্যতম রবীন্দ্র-তরিকা থেকে সরে গেলে তাকে অমার্জনীয় পদস্খলন বলে ফতোয়া দেন। এর একটা বড় দৃষ্টান্ত হলো: রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রনৃত্যে সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই অবাঞ্ছিত বলে বিবেচিত হয়।
এই রক্ষণশীল মনোভাব রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের অথবা সাধারণজনের সম্পদে পরিণত হতে দেবে না। অথবা রবীন্দ্রচর্চায় উৎসাহ জোগাবে না। এমনকি, রবীন্দ্রনাথকে সম্যকভাবে বুঝে তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে বর্তমান জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করবে না। শেক্সপিয়ার জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথেরও তিন শতাব্দী আগে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হরহামেশাই হচ্ছে। এবং সফল কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেউ করতে পারলে লোকে তাঁর নিন্দা না করে বরং প্রশংসা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের বাণীকে কেন অপরিবর্তনীয় অলঙ্ঘনীয় দৈববাণীর মতো ধরে রাখতে হবে, সেটা আমার বোধগম্য নয়। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা প্রথমদিকে যাঁরা করেছিলেন, যেভাবে করেছিলেন, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে আজ কি একটা অনুষ্ঠানে এক হাজার শিল্পী মিলে একটা গান পরিবেশন করার কথা ভাবা যেত? অথবা সে গান কি আজও বৃদ্ধ থেকে তরুণ প্রজন্ম, সবার মুখে মুখে ফিরত? আমরা কি পারি না সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে, রবীন্দ্রসংগীতকে নিজেদের সৃষ্টিতে কাজে লাগাতে?
সে যা-ই হোক, নিউ জার্সিতে যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দেড় শ বছর পূর্তি উদ্্যাপন করা হলো, সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এই দৃষ্টান্তযোগ্য প্রয়াসের সংগঠক এবং পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন বাঙালি ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তাঁর নাম দীপন রায়। তাঁর পেশার সঙ্গে সাহিত্য-সংগীতের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল সব কর্মকাণ্ডের পেছনে প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছিল তাঁরই উৎসাহ। এই গোষ্ঠীকে যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন অগাধ আনুকূল্য দিয়ে, তিনি তাঁদেরও একজন। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অশেষ অভিনন্দন।
কিন্তু সম্প্রতি নিউইয়র্কের ঘণ্টা খানেক উত্তরে নিউ জার্সিতে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উৎসব পালিত হলো একটা ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। দুদিনের এই অনুষ্ঠানের প্রথম দিন যে আয়োজন করা হয়েছিল, তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এ দিন ছিল একটা ব্যালে নৃত্য। এই ব্যালের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই ব্যালের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রবিঠাকুর’। ব্যালে সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্যই জানেন যে কেবল নাচ থাকে না। সে নাচের সঙ্গে থাকে সংগীত। সেদিনের সংগীত ছিল প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের অপূর্ব মোহজাল।
আটটি তরঙ্গে বিভক্ত এই ব্যালের প্রথমে দেখানো হয় একটি বালককে—বালক রবিকে। সে বড় হয়ে ওঠে এক বৃদ্ধের সাহচর্যে এবং তাঁর শিক্ষায়। বৃদ্ধ অর্থাৎ দেবেন্দ্রনাথ আকাশ, পৃথিবী, জীবনের তাৎপর্য তুলে ধরেন পুত্রের কাছে। বালক রবি কৈশোর থেকে যৌবনে উপনীত হন। প্রেম, প্রকৃতি ও জগৎ নতুন রূপে ধরা দেয় তাঁর কাছে। পাশ্চাত্য তাঁকে মুগ্ধ করে। ভালোবাসার স্বাদ পান তারপর। আপনজনের মৃত্যুর আঘাত তাঁর বক্ষকে বিদীর্ণ করে। সৃষ্টির তীব্র আনন্দ এবং হূদয়মথিত-করা প্রচণ্ড বেদনায় তিনি আলোড়িত হন। খ্যাতির উজ্জ্বল আলোকে তিনি হন উদ্ভাসিত। এই সৃষ্টি দিয়ে তিনি অতঃপর আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। পাশাপাশি আপন আদর্শে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন, সেও আন্তর্জাতিকতার আদর্শে। কিন্তু স্বার্থান্ধ জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বে সারা বিশ্বে দেখা দেয় সভ্যতার সংকট। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীকে দেখে তিনি বিচলিত বোধ করেন এবং বিশ্ববাসীকে শোনান তাঁর শান্তির ললিত বাণী। শেষ পর্যন্ত রেখে যান অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তাঁর শাশ্বত সত্যের বার্তা।
ব্যালের মান কেমন ছিল, সে সম্পর্কে রসজ্ঞদের মূল্যায়ন এক-এক রকম হতে বাধ্য। কারও কারও মতে, ভারতীয় যোগের সুপরিচিত কয়েকটি মুদ্রা এবং ব্যালের প্রচলিত কয়েকটি মুদ্রার সমন্বয় ঘটিয়ে। নৃত্যের পরিকল্পনা করা হয়, বৈচিত্র্য ছিল না তাতে। এটা হয়তো একটা সীমাবদ্ধতা কিন্তু যা বিতর্কাতীত ছিল, তা হলো এই ব্যালের পরিকল্পনা এবং তার পেছনে যে ধারণা কাজ করেছিল, তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিকতা ও বিশ্বমনস্কতা।
নাচ আর গানের মধ্যেও তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিল। নাচে অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পেশাদার ব্যালে শিল্পীরা, সঙ্গে কেবল আন্তর্জাতিক বিশ্বের সংঘাত বোঝানোর জন্য কয়েকটি অপ্রধান চরিত্রে কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অভিনেতা। যন্ত্রসংগীতে যাঁরা অংশ নেন, তাঁরাও আন্তর্জাতিক—একজন ছাড়া সবাই ছিলেন অবাঙালি। তিনজন বেহালাবাদকের মধ্যে একজন ছিলেন চীনা অথবা জাপানি। চেলো, বাঁশি এবং তবলাসহ সবগুলো বাদ্যযন্ত্রই বাজিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ শিল্পীরা। উপমহাদেশের শিল্পী ছিলেন কেবল একজন—অভিষেক মুখার্জি, তিনি বাজিয়েছিলেন সেতার। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে কোনো গানের কোনো একটি তান স্থায়ী স্বরের মতো গলায় ধরে রাখছিলেন তরুণী শিল্পী কবিতা সাহা।
রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝখানে, শুরুতে অথবা শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মূল গানের সুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ স্বাধীন কম্পোজিশন। মোট কথা, সুরের একটা জাদুময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল নিউ জার্সি পারফরম্যান্স আর্টস সেন্টারের অত্যাধুনিক অডিটরিয়ামে। সংগীত পরিচালনা করেন সমীর চ্যাটার্জি। অকুণ্ঠ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন ইতালিয়ান, ক্রিস্তিনো তিয়োৎজো।
সংগীত-নৃত্যের চেয়েও এই অডিটরিয়ামে যা এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেছিল, সে হলো এর আন্তর্জাতিক আবহ। রবীন্দ্রজয়ন্তী নিতান্তই বাঙালিদের উৎসব। সেই বাঙালির উৎসব এ রকম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসা, এর চেয়ে উত্তম প্রয়াস আর আমি কখনো দেখিনি। নিজেদের পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না রেখে রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার এর থেকে ভালো উপায়ও কোথাও দেখিনি।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে, ১৩ নভেম্বর, ছিল রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের অভিনয়। নাটকের সাফল্য নির্ভর করে তার কাহিনি, মঞ্চে ঘটনার ঘনঘটা আর সংলাপের ওপর। তা ছাড়া অভিনয় তো আছেই। রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকই ঘটনাপ্রধান নয়, কথাপ্রধান। এটা নাটকের গতিকে মন্থর করে দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিসর্জন সেদিক দিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। শেক্সপিয়ারের পঞ্চাঙ্ক ট্র্যাজেডির আদর্শে রচিত এই নাটকের মধ্যে দ্রুত ঘটতে থাকে সংঘাতময় ঘটনাবলি এবং তা পরিণতিকে এগিয়ে দেয় অবশ্যম্ভাবী ট্র্যাজেডির দিকে। বিসর্জন নাটকের মূল বিষয় হলো রাষ্ট্র ও মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ। শ্রেয়তাবোধের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার বিরোধ। বিষয়টা সর্বজনিক এবং চিরকালীন। আজও এই দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সমগ্র বিশ্ব। সুতরাং সোয়া শ বছর আগে লেখা হলেও আজও এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস পায়নি। ভাষার দূরত্বকে অতিক্রম করেও এ নাটকের মূল বাণী পৌঁছে যেতে পারে সবার কাছে, সব দেশে।
দারুণ চাহিদার কথা ভেবে তাঁর প্রকাশক ম্যাকমিলান কোম্পানি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অল্প পরেই এ নাটক অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য ফরমায়েশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাড়াহুড়ো করে রবীন্দ্রনাথও এ অনুবাদ করে দেন ১৯১৫ সালে। নাটকের ভাষা হওয়া উচিত যদ্দুর সম্ভব মুখের অর্থাৎ চলিত ভাষা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দুর্ভাগ্যক্রমে অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি সাধু ভাষায়। ফলে তিনি নিজের রচনা নিজেই অনুবাদ করলেও, সে অনুবাদ যুগের উপযোগী ছিল না। নিউ জার্সির নাটকের উদ্যোক্তারা এটা অনুভব করেছিলেন উদ্যোগ গ্রহণ করার আগেই। তাই এ নাটকের নতুন করে অনুবাদ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত চ্যাটার্জিকে। সুদীপ্ত দীর্ঘকাল মার্কিন মুলুকে বাস করেছেন। তা ছাড়া, তাঁর বিশেষজ্ঞতা হলো নাট্যকলায়। তাঁর অনুবাদের ভাষা তাই ছিল বেশ আধুনিক ইংরেজি। কিন্তু তার মধ্যেও প্রচুর আড়ষ্টতা এবং কেতাবি ভাষার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিল। সত্যি বলতে কী, এ অনুবাদ আরও উন্নত হতে পারত। সংলাপগুলোকে আরও ভারতীয় মনে হওয়ার কারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জোরালো ভারতীয় উচ্চারণ।
সব মিলে অভিনয়ও ছিল বেশ আড়ষ্ট। খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলেন গার্গি মুখার্জি। তিনি গুণবতীর ভূমিকায় মোটামুটি সাবলীল অভিনয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। নয়তো গোবিন্দমাণিক্য, রঘুপতি, জয়সিংহ, অপর্ণা ইত্যাদি চরিত্রে সবারই অভিনয় ছিল লক্ষযোগ্যভাবে আড়ষ্ট। অভিনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেমানান হয়েছিলেন, যিনি জয়সিংহের অভিনয় করেন। তাঁর অভিনয়ের গুণাগুণ সম্পর্কে বলছি না, কিন্তু টাকমাথার একজন প্রৌঢ়কে জয়সিংহ কল্পনা করতে পারা একটা কঠিন ব্যাপার। তাঁর সত্যিকার বয়স কত, তা আমার জানা নেই, তবে সেটা যদি রঘুপতির চেয়েও বেশি হয়ে থাকে, তা হলেও অবাক হব না।
সবার অভিনয়ই মোটামুটি কৃত্রিম মনে হওয়ার আরেকটি কারণ: অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁদের মুখে অর্ধমুখোশ পরেছিলেন। এটা আধুনিক অভিনয়ে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় গ্রহণ করা হলেও, বিসর্জন-এর মতো ধ্রুপদি এবং সিরিয়াস থিমের জন্য উপযোগী ছিল বলে অন্তত আমার মনে হয়নি। কালীমূর্তি জোগাড় করতে পারেননি আয়োজকেরা অথবা হয়তো তার চেষ্টাও করেননি। মূর্তির বদলে তাঁরা দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন ফ্রেমে বাঁধানো নকশা। এর ফলে দেবী অপ্রসন্ন হয়ে মুখ ঘুরিয়েছেন অথবা আবার প্রসন্ন হয়ে মুখ ফেরালেন—নাটকের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুটি তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে।
এই নাটকের দর্শকদের একটা বড় অংশই ছিল বিদেশি শ্বেতাঙ্গ। রবিঠাকুর ব্যালে নৃত্যেও দর্শকেরা ছিল তাই। এটা দেখে তারিফ করতে হয়। ব্যালে ও নাটকের অভিনয় দেখতেই কেবল বিদেশিরা আসেননি, চাঁদাদাতাদেরও অনেকেই ছিলেন বিদেশি এবং অবাঙালি ভারতীয়। কেবল তা-ই নয়, অভিনয়েও অপ্রধান ভূমিকায় যোগ দিয়েছিলেন অবাঙালি ভারতীয় ও বিদেশিরা। নাটকটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক ফার্লি। মোটকথা, এই সার্ধশততম জন্মবর্ষ উৎসব পালিত হয়েছিল নিতান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। আমাদের বাঙালি কবি তাঁর মৃত্যুর ৭০ বছর পরও এভাবে দেশি-বিদেশিদের আকৃষ্ট করেন, এটা দেখে সত্যি আনন্দিত হতে হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে কুক্ষিগত করে রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদেরই সম্পত্তি। এমনকি, রবীন্দ্রনাথেই তাঁরা সীমাবদ্ধ থাকতে চান। যেন, রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। অথবা রবীন্দ্রচর্চাই একটা ‘পুণ্যের’ কাজ। এই কাজে রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে তাঁরই রচিত ‘মন্ত্রে’ তাঁকেই স্মরণ করে তাঁর সময়ে ফিরে যাওয়াকেই বাঙালিরা সর্বোচ্চ আদর্শ বলে বিবেচনা করেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাকে মহাপাপের কাজ বলে গণ্য করেন। ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক মৌলবাদের মতো একে বলা যেতে পারে, একধরনের ‘রবীন্দ্রবাদ’। মার্ক্সের দেড় শ বছরের পুরোনো ‘ভবিষ্যদ্বাণী’তে সন্দেহ দেখালে সেটাকে কমিউনিস্টরা যেমন ক্ষমার অযোগ্য পাতক বলে মনে করেন, রবীন্দ্রবাদীরাও তেমনি সামান্যতম রবীন্দ্র-তরিকা থেকে সরে গেলে তাকে অমার্জনীয় পদস্খলন বলে ফতোয়া দেন। এর একটা বড় দৃষ্টান্ত হলো: রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রনৃত্যে সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই অবাঞ্ছিত বলে বিবেচিত হয়।
এই রক্ষণশীল মনোভাব রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের অথবা সাধারণজনের সম্পদে পরিণত হতে দেবে না। অথবা রবীন্দ্রচর্চায় উৎসাহ জোগাবে না। এমনকি, রবীন্দ্রনাথকে সম্যকভাবে বুঝে তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে বর্তমান জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করবে না। শেক্সপিয়ার জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথেরও তিন শতাব্দী আগে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হরহামেশাই হচ্ছে। এবং সফল কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেউ করতে পারলে লোকে তাঁর নিন্দা না করে বরং প্রশংসা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের বাণীকে কেন অপরিবর্তনীয় অলঙ্ঘনীয় দৈববাণীর মতো ধরে রাখতে হবে, সেটা আমার বোধগম্য নয়। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা প্রথমদিকে যাঁরা করেছিলেন, যেভাবে করেছিলেন, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে আজ কি একটা অনুষ্ঠানে এক হাজার শিল্পী মিলে একটা গান পরিবেশন করার কথা ভাবা যেত? অথবা সে গান কি আজও বৃদ্ধ থেকে তরুণ প্রজন্ম, সবার মুখে মুখে ফিরত? আমরা কি পারি না সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে, রবীন্দ্রসংগীতকে নিজেদের সৃষ্টিতে কাজে লাগাতে?
সে যা-ই হোক, নিউ জার্সিতে যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দেড় শ বছর পূর্তি উদ্্যাপন করা হলো, সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এই দৃষ্টান্তযোগ্য প্রয়াসের সংগঠক এবং পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন বাঙালি ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তাঁর নাম দীপন রায়। তাঁর পেশার সঙ্গে সাহিত্য-সংগীতের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল সব কর্মকাণ্ডের পেছনে প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছিল তাঁরই উৎসাহ। এই গোষ্ঠীকে যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন অগাধ আনুকূল্য দিয়ে, তিনি তাঁদেরও একজন। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অশেষ অভিনন্দন।
No comments