বুড়িগঙ্গার বর্জ্য অপসারণঃ সার্বিক সমন্বয়ের অভাব
‘ক দেহি গরুর পো। এই গলির ময়লা নিয়ে কোন গলিতে ফালামু’? বেশ ক’বছর আগে কার্টুনিস্ট রণবীর আঁকা কার্টুন চিত্রের একটি সংলাপ। ময়লা টানা গরুর গাড়ির কোচোয়ানের জবানিতে তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির বেহাল অবস্থার চিত্র এভাবেই তুলে ধরেছিলেন।
সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর বর্জ্য অপসারণে সরকারি উদ্যোগের হালও যেন অনেকটা সে রকম। একদিকে নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের কাজ চলছে, অন্যদিকে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে দূষিত করা হচ্ছে নদীর পানি। কোনো কোনো জায়গায় তুলে আনা স্তূপিকৃত বর্জ্য আবার ছড়িয়ে পড়ছে নদীতেই। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য উত্তোলন, পরিবহন এবং ডাম্পিং পদ্ধতি পরিবেশ ও বিজ্ঞানসম্মত না হলে এই ভালো উদ্যোগটি মাটি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। তাদের আশঙ্কা, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ব্যাহত হতে পারে নদীর তলদেশ পরিচ্ছন্নতার এই অভিযান। এরই মধ্যে এ নিয়ে বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বঅভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবল না থাকায় শুরুতেই দেখা দিয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
জানা গেছে, সাত কোটি টাকার এই পাইলট প্রকল্পের কাজ চলাকালে স্থানীয়রা শুধু নদীতে ময়রা-আবর্জনাই ফেলছেন না, জবরদখলকারীরা পাকাপোক্ত করে নদী ভরাটের কাজ করেই চলছেন। এরই মধ্যে সমন্বয়হীনতার ফলে বাদামতলী ব্রিজের দু’পাশের এক কিলোমিটার অংশ থেকে পলিথিন তোলার কাজ চলছে এলোমেলোভাবে। নদীর তীর থেকে তোলা বর্জ্য নদীর পাড়ে ফেলায় তা ফের গড়িয়ে পড়ছে নদীতে। এজন্য বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে বেড়াও দেয়া হয়েছে, যেগুলো মোটেই টেকসই নয়। শুরুতে মিরপুরের আমিনবাজারে সিটি করপোরেশনের প্রায় ভরে ওঠা গার্বেজে বর্জ্য ফেলার জায়গা নির্বাচন করেছিল বিআইডব্লিউটিএ। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কেরানিগঞ্জ, সাভার ও ফতুল্লায় স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। বর্জ্য ধরে রাখার জন্য এসব জায়গা যথেষ্ট উপযোগী কিনা তা নিয়েও নানা প্রশ্ন। উল্লেখ্য, এক কি. মি. নদী থেকে তিন লাখ ঘনমিটার বর্জ্য তুলে তা ফেলতে জমির দরকার ২১ একর। নির্বাচিত জায়গায় এত জমি নেই। এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান নতুন করে জায়গা খোঁজার কথা বলেছেন। এ থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায়, গাড়ির আগেই জুড়ে দেয়া হয়েছে গাড়ী । এদিকে এক কিলোমিটার নদীর প্রতি ২৫০ মিটার করে চারভাগে ভাগ করে কাজ দেয়া হয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত কাজ শুরুই করেনি। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকলে নদীর গলদ সাফ হবে কী করে?
জানা গেছে, তিন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। সে হিসাবে প্রতিদিন ৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করা দরকার। প্রকল্প অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নদীর তলদেশ থেকে তিন ফুট ও তীর থেকে ছয় ফুট গভীর করে বর্জ্য সরাতে হবে। অথচ প্রকল্পের অপারেশন অফিসার জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনিক হাজার টন বর্জ্য তোলার ক্ষমতা থাকলেও মেশিন নষ্ট ও অন্যান্য কারণে ৫০০ টনের বেশি তুলতে পারছে না। এদিকে বর্জ্য অপসারণের জায়গায় জাহাজ ভেড়ানো, লঞ্চ ও নৌকা তৈরি এবং কাঠ ফেলে রাখায় কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। অর্থাত্ এতবড় একটি কাজে কর্তৃপক্ষ আটঘাট বেঁধে নেমেছেন বলে মনে হয় না। এক কথায়, বিআইডব্লিউটিএ এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় নেই; যা এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে জরুরি।
সমন্বয়হীনতার জন্য ভালো কাজ শেষ পর্যন্ত অকাজে পরিণত হওয়ার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। যানজট নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় নেই, নগরীর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে সমন্বয় নেই, সমন্বয় নেই গ্যাস-বিদ্যুত্ বিতরণে। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বন উজাড়, নতুন বনায়ন, নদীর মত্স্য সম্পদ সুরক্ষা, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষকদের সার-ঋণ ইত্যাদি বিতরণসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রায়ই সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ওঠে। এতসব অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নদীর বর্জ্য অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আগেভাগেই কেন সবকিছু গুছিয়ে নেয়া হলো না, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। আমাদের প্রত্যাশা, সমন্বয়হীনতার এই পুরনো খেলার অবসান ঘটিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যথাসময়ে সঠিক ও টেকসই পন্থায় বুড়িগঙ্গার বর্জ্য অপসারণের কাজ শেষ করবে।
No comments