ফিরে দেখা ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান by মাহফুজ উল্লাহ


সময়ের পরিক্রমায় চার দশক পেরিয়ে গেলেও ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনের স্মৃতি এখনও সে সময়ের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মনে চিরজাগরূক। ১৯৫৮ সালে তত্কালীন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর সারাদেশে যে দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ ও উষ্মার কমতি ছিল না।
১৯৫৯ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন তাকে ঠেকানোর জন্যই ঘটেছিল এই সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা। সেদিন সামরিক শাসন জারি না হয়ে নির্বাচন হলে দেশের অবস্থা ভিন্ন হতো।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ইতিহাসে এক অভাবিত ঘটনা। পাকিস্তানের দীর্ঘ একুশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একটি আন্দোলন উভয় প্রদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং আন্দোলনের ফলে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থিত ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটে। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ইতিহাসে জনগণের পক্ষে এতবড় সফল আন্দোলন আর কখনও হয়নি। ঊনসত্তরের আন্দোলনের বিস্তৃতি ঠেকাতে দ্বিতীয়বারের জন্য যে সামরিক শাসন জারি হয়, আটান্ন সালের সামরিক শাসনের সঙ্গে তার একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ইয়াহিয়া খান দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেন। আটান্ন সালে আইয়ুব খান একই অঙ্গীকার করেছিলেন। সে সময় জনসংখ্যার একাংশ আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানালেও ঊনসত্তরে অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আইয়ুব খানের দীর্ঘ দশ বছরের শাসন পাকিস্তানকে যা দিয়েছে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে গণঅভ্যুত্থানে। আটষট্টির শেষ দিনগুলোতে আত্মতৃপ্ত শাসকশ্রেণী যখন উন্নয়ন দশকের উত্সবে ব্যস্ত, তখনই দুষ্কৃতকারী হিসেবে অভিহিত ছাত্ররা তাদের শাসনের কবর তৈরি করে।
সেদিনের সেই আন্দোলন শুধু পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর আগেই গোটা পৃথিবীতে রাস্তায় নেমে এসেছিল তরুণরা। আটষট্টি সালের মে মাসে ফ্রান্সে এবং পরবর্তীকালে ইউরোপে তারুণ্যের বিদ্রোহের যে প্রকাশ, নিঃসন্দেহে তার প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী। অক্টোবরের শেষদিকে মনে হয়েছিল বিশ্বব্যাপী তরুণদের বিক্ষোভ প্রশমিত এবং আন্দোলন পতনমুখী। কারণগুলো ছিল মেক্সিকোর ছাত্র ও শ্রমিকদের সাময়িক পরাজয়, ইতালি এবং পশ্চিম জার্মানিতে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থতা, চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপ প্রভৃতি। 
ততদিনে অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার রঙ্গমঞ্চে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের জনগণ। সনাতনী পন্থায় আন্দোলন দমনের জন্য সরকার প্রথম থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে শুরু করলেও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আটষট্টি সালের মে মাসে ফ্রান্সে এবং নভেম্বরে পাকিস্তানে যে ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে কতগুলো সাদৃশ্য ছিল। উভয় দেশে দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছিলেন দুই সেনানায়ক—চার্লস দ্য গল ও আইয়ুব খান। উভয়ে ছিলেন চীনের বন্ধু এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘অসমর্থক’। উভয় দেশের প্রগতিশীল মহলে ছিল বিভ্রান্তি এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তির প্রতি নমনীয় মনোভাব। কিন্তু ফ্রান্সে শ্রমিক শ্রেণী যত শক্তিশালী ছিল, পাকিস্তানে ততটা ছিল না। অপরদিকে শুরুতে ফ্রান্সে ছাত্রছাত্রীদের প্রথম দাবি ছিল, ছাত্রাবাসের একই কামরায় একসঙ্গে থাকার অধিকার, পাকিস্তানে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছিল বেআইনি পণ্য আটকের কারণে।
পাকিস্তানে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সামাজিক শ্রেণী ছিল কৃষক সমাজ। তাই দীর্ঘ দশ বছর ধরে সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, পুঁজিবাদী ও সামন্ত স্বার্থের প্রত্যক্ষ সমর্থনে দেশ শাসন করেন আইয়ুব খান। এই শাসনের প্রয়োজনে ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন করা হয়। সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয় ভূলুণ্ঠিত। দলীয় ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী লাভ করে প্রশাসনিক আনুকূল্য। সরকারি প্রচারণা এত উলঙ্গ ছিল যে, প্রথম ক’বছরের আইয়ুবি চমক তাতে উবে যায়। এই প্রচারণার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল চেয়ারম্যান মাওয়ের উদ্ধৃতির অনুকরণে আইয়ুবের চিন্তা সংবলিত ‘সবুজ বই’। শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি শাসক শ্রেণীকে এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টি এনে দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণের জন্য দশ বছরের শাসন ছিল অন্ধকার, নির্যাতন এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের শাসন, বুদ্ধিবৃত্তির নৈরাজ্য এবং নেতৃত্বহীনতার শাসন।
পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ সবসময় একটি সচেতন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আচরণ করেছে। এর একটি কারণ ছিল, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলো লাগাতারভাবে মৌলিক অধিকারের জন্যও আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেনি। অবশ্য ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর একটা পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ এবং ছাত্র আন্দোলন ছিল গোটা দেশে একমাত্র সংগঠিত শক্তি। ছাত্রদের কর্মসূচিতে শিক্ষা সমস্যা গুরুত্ব লাভ করলেও দেশের রাজনৈতিক অবস্থা থেকে তা বিচ্ছিন্ন ছিল না। শিক্ষাঙ্গনে নির্যাতন যুক্ত ছিল আইয়ুবি নির্যাতনের সঙ্গে।
ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও তার প্রচলিত শাসনের অবসান ঘটেনি। কিন্তু এটা ছিল এক অভাবিত রাজনৈতিক বিজয় এবং পাকিস্তানের জনগণকে তা এক অকল্পনীয় মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক রাজনৈতিক রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে যখন প্রথম ঘটনা ঘটে, তখন সরকারি মনোভাব ছিল নির্লিপ্ত। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে মোড় নেয় তাতে সুবিধাভোগীদের সামনে একমাত্র রাস্তা ছিল দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন প্রভুকে বিসর্জন দেয়া।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যে উলঙ্গ শোষণ চলেছে, তার কারণে এখানে অভ্যুত্থানের মাত্রা ছিল ব্যাপক, প্রতিশোধের স্পৃহা ছিল তীব্র। আন্দোলনের তীব্রতা ও গতি সত্ত্বেও তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়, ঊনসত্তরে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসনের কথা তত্কালীন রাজনৈতিক নেতারা আগেই জানতেন। লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার সম্পর্কে মার্কস যে মন্তব্য করেছেন, এক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য : ‘সমাজ নিজের জন্য নতুন উপাদান বিজয়ের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র তার প্রাচীনতম কাঠামোয় ফিরে গেছে, ফিরে গেছে তলোয়ার এবং আলখেল্লার নির্লজ্জ নিয়ন্ত্রণে।’
ঊনসত্তর সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পরদিনই পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিকরা তা অমান্য করে। চট্টগ্রামে শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী কিছু কিছু ক্ষেত্রে দমননীতি চালালেও, কিছু কিছু ক্ষেতে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, কোয়েটা প্রভৃতি স্থানেও একই ঘটনা ঘটে। সামরিক শাসন জারির পরপরই প্রচারিত এক প্রচারপত্রে ছাত্রনেতা তারিক আলী মন্তব্য করেছিলেন : ‘যে শান্তি ফিরে এসেছে মনে হয় তা প্রতারণামূলক হতে বাধ্য। দশ বছর পরে এক জোয়াল থেকে মুক্ত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানিরা এক বছরের বেশি আরেকজন পশ্চিম পাকিস্তানি একনায়ককে মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। সামান্যতম ঘটনাও আরেকটি অভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে, যার পরিণতি হবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান।’ এবং বাস্তবে তা-ই ঘটেছে।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা কী? এর প্রধান মর্মকথা হচ্ছে, যে রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যাপক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, তার সাফল্য অনিবার্য। ১১ দফা আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে যেসব ধারা ছিল একবার তার পুনরাবৃত্তি করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ১১ দফা আন্দোলনের প্রচারপত্রই বলে দেয় এদেশের মানুষ তার নিজস্ব অধিকারের ব্যাপারে কতখানি সচেতন ছিল।
আন্দোলনের প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল, ‘স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘদিনের অনুসৃত জনস্বার্থবিরোধী নীতির ফলেই ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর জীবনে সঙ্কট ক্রমেই বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। শাসনে-শোষণে অতিষ্ঠ হইয়া ছাত্র-জনতা ছাত্র-গণআন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন। কিন্তু এই অবস্থায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের দিকে আগাইয়া আসিতেছে না। সম্প্রতি দুই-একটি দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করা হইলেও কর্মসূচিভিত্তিক কোনো ঐক্যফ্রন্ট গড়িয়া উঠিতেছে না। আমরা ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত দাবিসমূহের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করিয়া ব্যাপক গণআন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিবার জন্য সকল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি। 
১। (ক) সচ্ছল কলেজগুলিকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং ইতিমধ্যে যেসব কলেজ প্রাদেশিকীকরণ করা হইয়াছে সেগুলিকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া আনিতে হইবে। তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ছাত্রদের উচ্চ ক্লাসে ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করিতে হইবে। কারিগরি, প্রকৌশল, চিকিত্সা ও কৃষিছাত্রদের দাবি মানিতে হইবে, ছাত্র বেতন কমাইতে হইবে, নারী শিক্ষার প্রসার করিতে হইবে এবং শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিহার করিয়া শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে। 
(খ) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুন সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিতে হইবে।
(গ) শাসক গোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ ও ‘হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট’ বাতিল করিতে হইবে এবং ছাত্রসমাজের ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে। 
২। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে। 
৩। নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে :
(ক) দেশে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেল শাসনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা—এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোনো কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভেনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সাথে সাথে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর পরীক্ষামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিতে হইবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হার অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির মধ্যে আমদানি-রফতানি চলিবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানি করিবার অধিকার অঙ্গরাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।
৫। ব্যাংক, বীমা, ইন্স্যুরেন্স ও বৃহত্ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬। কৃষকের ওপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণপ্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে।
৭। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিত্সা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯। জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০। সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোটবহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১। দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’
এই কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলে যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে ছাত্রসমাজ দাবিনামা তৈরি করলেও খুব সঠিকভাবেই সেখানে জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে ১১ দফা আন্দোলনের মতো একটি সর্বগ্রাসী আন্দোলন কি সম্ভব? কারণ এদেশে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং একই জাতির মধ্যে সুবিধাভোগীদের সংখ্যাও বাড়ছে, যারা বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছেন। দলমত নির্বিশেষে এখানে অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্ম হয়েছে, যা যে কোনো আন্দোলনকে ব্যাপক জনভিত্তি দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। তাই ১১ দফা আন্দোলনের মতো দেশব্যাপী জনসমর্থিত আন্দোলনের সম্ভাবনা প্রায় সীমিত। অনেকে ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে ব্যাপক আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সে আন্দোলন মূলত ছিল রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক, যা প্রশাসনের অন্দর মহল অর্থাত্ সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে সরকারপ্রধান পরিবর্তনে উত্সাহী করে তোলে।
কিন্তু ১১ দফা আন্দোলনের বিস্তৃতি, কৌশল এবং সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্ন মর্যাদা দিয়েছে। এদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে তারা রাজনৈতিক প্রশ্নে যেভাবে সচেতন, অন্যান্য প্রশ্নেও তেমনি সচেতন। এদেশের মানুষকে রাজনৈতিক স্লোগানের ফুলঝুরি ও অতীতমুখিনতা নিয়ে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা সম্ভব নয়।
লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.