জাতীয় সংসদ-নারী সাংসদদের হাতাহাতি এবং পুরুষের চোখ by মোহীত উল আলম
প্রচারমাধ্যমগুলো সেদিন (১৮ মার্চ) সংসদে নারী সাংসদদের মধ্যে যে হাতাহাতি ও চুলোচুলি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তা খুব রসিয়ে প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর জনাকয়েক পাঠক তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় এ আশা ব্যক্ত করেছেন যে অচিরেই এই সংসদীয় নাটকটির ভিডিওচিত্র ইউটিউবে প্রদর্শিত হবে। সংসদে মারামারি করার কাহিনি নতুন কিছু নয়।
এ দেশের ইতিহাসেই সংসদে মারামারির কারণে ডেপুটি স্পিকারের প্রাণত্যাগের ঘটনা আছে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় পরস্পরবিরোধী সাংসদদের মধ্যে কুংফু, কিক বক্সিং, রেসলিং ও ঘুষোঘুষি ঘটনার চমৎকার কিছু ছবি ওয়েবসাইটের জাংক মেইলে প্রচুর পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য, দুই কোরিয়া, জাপান, চীন, ভিয়েতনামসহ ওই অঞ্চলের সব দেশে প্রচুর পরিমাণে মার্শাল আর্টের প্রচলন আছে বলে সংসদেও তার প্রতিফলন ঘটে।
কিন্তু নারী সাংসদদের চুলোচুলি বা হাতাহাতির ঘটনা সম্ভবত নজীরবিহীন। সে জন্য আমাদের নারী সাংসদদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়সহ প্রায় হাতাহাতি ও চুলোচুলির উপক্রম গরম খবরে পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু আমাদের সমাজে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া লাগলে নারীরা চুলোচুলি ও নখ আঁচড়ানিতে অভ্যস্ত সে জন্য সংসদেও নারী সাংসদেরা উস্মাবিস্ফোরিত অবস্থায় তাই করতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু যে জন্য এ আলোচনার অবতারণা সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংসদে পুরুষ সাংসদেরা এর চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করেন, কখনো কখনো সংঘর্ষমুখরও হয়ে ওঠেন। সেগুলো খবরও হয়। কিন্তু সরস আলোচনার বিষয়বস্তু হয় না। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের করা কোনো কাজকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখার রেওয়াজ নেই। তাই নারী সাংসদদের হাতাহাতি ও চুলোচুলি করার উপক্রমকে সরস সাংবাদিকতার প্রচার হিসেবে আমরা উপভোগ করলেও এ কথা গোপন থাকে না যে পুরুষেরা নারীকে যে চোখে দেখতে চায়, নারীরা সেরূপে সংসদে আবির্ভূত হয়েছেন বলেই পুরুষের চোখ তৃপ্ত হয়েছে, হয়েছে তাদের মনোতুষ্টি। পাঠক হয়তো বলবেন, নারী পাঠক এবং নারী দর্শকও তো খবরটা উপভোগ করেছেন। তাহলে সেটার উত্তর হবে, এই নারীমহল পুরুষ দ্বারা তৈরি সামাজিক মূল্যবোধের অবকাঠামোয় বসবাসরত অবরোধবাসিনী।
আবার দেখুন, যে নারী সাংসদেরা ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছিলেন তাঁরা কিন্তু নির্বাচিত নন, বাছাইকৃত। অর্থাৎ সংসদকক্ষে তাঁদের আগমন সামনের দরজা দিয়ে ঘটেনি। তাঁদের বাছাইকরণপদ্ধতি যে প্রকৃতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল, ধারণা করছি, সেখানে তাঁদের জিহ্বাশক্তি ও কেশশক্তিকে (চুল) প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য তাঁদের আস্ফাালনের সময় ওই দুই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। কিন্তু যেদিন থেকে কিছু নারী সদস্যকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, কিন্তু বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে সংসদে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল সেদিন এ দর্শন কাজ করেছিল যে নারীরও কিছু সাংসদীয় অধিকার থাকা দরকার। অর্থাৎ একটি সমতামূলক আচরণ থেকে এ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ কথাটাই স্বীকার করা হয়েছিল যে পুরুষশাসিত সমাজে নারী ও পুরুষ কখনো সমান হতে পারে না। তাই সমতার নামে কিছু অনির্বাচিত সাংসদকে প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করা হলো। এই নারী সাংসদেরা যখন পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত, কৌতুক সৃষ্টি করার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করলেন, তখন পুরুষশাসিত প্রচারমাধ্যম সোৎসাহে খবরটি প্রচার করল। কারণ কাজটি করার জন্যই নারী সাংসদদের বাছাইয়ের মাধ্যমে সংসদে পাঠানো হয়েছিল। এভাবে সুকৌশলে পুরুষ নারীর জন্য একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করে রাখে যেখানে নারীরা তাদের অবনমনের অবস্থা উপলব্ধি করতে না পেরে মহোৎসাহে পুরুষ কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে যায়।
বিদ্বজ্জন মাত্রই জানেন যে নারীকে অবরোধবাসিনী করে রাখার মূল প্রবচনটি হচ্ছে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ কথাটি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নারীবাদের জননী মেরি ওলস্ট্যানক্র্যাফট তাঁর বিখ্যাত রচনা ভিন্ডিকেইশন অব দ্য রাইটস অব উইমেন-এ এ চিন্তাকে ঝাড়ুপেটা করে বললেন, সংসারের এ মায়ার নিগড়ে আবদ্ধ করে নারীকে আসলে বি-রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। ক্ষমতা, যুক্তি, জ্ঞান, রাজনীতি ও ব্যবসা—অর্থাৎ রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব উৎসের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়, সেসব থেকে নারীকে চিরতরে বঞ্চিত করা হলো। ক্যাথেরিন বেইলসে, মেরিলিন ফ্রেঞ্চ, ইলাইন শোওয়াল্টার এবং জুলিয়া ক্রিস্টেভা প্রমুখ নারীবাদী লেখক ওলস্ট্যানক্র্যাফটের পুরুষশাসনের বৈরিতার আলোকে সোচ্চার হলেন এই বলে যে প্রকৃত প্রেম বা ভালোবাসা বলতে যা বোঝানো হয় সেটা তলে তলে নিশ্চিত হয় তখনই যখন নারী পুরুষের নিয়ন্ত্রণের কাছে নিজেকে বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্পণ করে। সংসারের সমতার আড়ালে আসলে অসমতাই প্রতিষ্ঠা পায়।
আমার মায়ের মতো স্বাধীনচেতা নারী আমি খুব কম দেখেছি, কিন্তু তিনি কখনো আমার বাবার কথার বাইরে গিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। সংসারের কাজে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল দুজনের মধ্যে—কিন্তু আমার বাবা জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন সাহিত্যিক হয়ে গেলেন আর আমার মা আমার মা-ই রয়ে গেলেন। লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ যেমন চমৎকারভাবে তাঁর ‘আ রুম উইথ আ ভিউ’ প্রবন্ধে বলেছেন, শেক্সপিয়ারের কোনো বোন যদি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করতেন তাহলে তাঁর হতাশায় আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকত না। কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে এটা বলা যায় যে আজ যদি তসলিমা নাসরিন পুরুষ লেখক হতেন তাহলে তাঁর দ্রোহী চেতনার জন্য তিনি হয়তো জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খাতা’ নামে একটি চমৎকার গল্প আছে। গল্পের নারী উমা কিশোরী চরিত্র। বাল্যবিবাহের কারণে তার শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ। ক্রমশ আঁকিবুঁকি শিখতে শিখতে সে বাক্যনির্মাণ শেখে এবং একটি ছোট খাতায় তার মনোভাব অনর্গল লিখে যেতে থাকে। কিন্তু উমার যুবক স্বামী পেয়ারীমোহন, যে কিনা নিজেও একজন উঠতি লেখক, একদিন জেনে যায় উমার এই গোপন খাতাটির কথা। সে ভেবে অবাক হয়, আরে, নারী তো থাকবে রান্নাঘরে সংসারে সুখ আনার জন্য, সে কেন লিখবে! খাতাটি সে উমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। উমার সাহিত্যজীবনের এখানেই ইতি। তখন রবীন্দ্রনাথ লেখক হিসেবে মন্তব্য করছেন (হাতের কাছে গল্পটি নেই, তাই নিজের ভাষায় লিখছি), পেয়ারীমোহন যে কঠিন কঠিন বাক্যে চিন্তাশীল প্রবন্ধের নামে প্রায় যে অখাদ্যগুলো রচনা করে চলেছে, তার সে খাতা কেড়ে নেবে জগৎসংসারে এমন কোনো শক্তি নেই। কারণ পুরুষশাসিত সমাজের একজন প্রতিনিধি পেয়ারীমোহন। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল স্বামীকে লিখছে যে সে আর ২৭ নম্বর মাখন বড়াল লেইনে স্বামীর গৃহে ফিরে যাবে না।
রবীন্দ্রনাথ নারীর মনের ভেতরের স্বাধীনতার ওপর খুব জোর দিয়েছিলেন। কনিষ্ঠতম কন্যা মীরার স্বামী নগেন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখলেন যে তার (মীরার) গোপনতম ইচ্ছাটির কথা জানার জন্য তো সে (নগেন্দ্রনাথ) জোর প্রয়োগ করতে পারে না। মীরার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের প্রথমবার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নানা মহল থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল সম্পর্কটা পুনরায় জোড়া দেওয়ার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর আগ্রহ দেখাননি। বরং নগেনকে বোঝালেন যে তিনি নিজেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হয়ে মীরার বিচার করতে পারেন না।
তবে নারী যে বিনা বাক্যব্যয়ে পুরুষের শাসন যুগ যুগ ধরে মেনে চলেছে সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তাদের বিদ্রোহটা আসে অসরাসরিভাবে, দুর্লক্ষ্যভাবে। শেক্সপিয়ারের একটি প্রিয় চরিত্র রোজালিন্ড নারীকে অবদমনের চেষ্টা বৃথা এ কথা বোঝাতে গিয়ে বলছে, তাকে কক্ষে বন্ধ করে রাখলে সে জানলা দিয়ে তার কণ্ঠস্বরের জানান দেবে। জানলা বন্ধ করলে চিমনি দিয়ে প্রকাশ করবে। চিমনি বন্ধ করলে দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে সে সবাক হবে।
এ অর্থে আমার ধারণা, নারী সাংসদদের উত্তেজনামুখর আচরণকে ঠিক ‘চুলোচুলি’, ‘হাতাহাতি’—এ রকম লঘুতার মধ্যে না রেখে তাঁদের চাপা স্বাধীনতাবোধের প্রকাশ হিসেবে দেখা উচিত। যে নারী সব সময় গৃহে থাকেন, তিনি যদি সাংসদ হন এবং নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে হল্লাচিল্লা করার অধিকারকে তাঁর স্বাধীনতাবোধের ডিসকোর্স হিসেবে দেখা উচিত।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা; গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।
কিন্তু নারী সাংসদদের চুলোচুলি বা হাতাহাতির ঘটনা সম্ভবত নজীরবিহীন। সে জন্য আমাদের নারী সাংসদদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়সহ প্রায় হাতাহাতি ও চুলোচুলির উপক্রম গরম খবরে পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু আমাদের সমাজে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া লাগলে নারীরা চুলোচুলি ও নখ আঁচড়ানিতে অভ্যস্ত সে জন্য সংসদেও নারী সাংসদেরা উস্মাবিস্ফোরিত অবস্থায় তাই করতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু যে জন্য এ আলোচনার অবতারণা সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংসদে পুরুষ সাংসদেরা এর চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করেন, কখনো কখনো সংঘর্ষমুখরও হয়ে ওঠেন। সেগুলো খবরও হয়। কিন্তু সরস আলোচনার বিষয়বস্তু হয় না। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের করা কোনো কাজকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখার রেওয়াজ নেই। তাই নারী সাংসদদের হাতাহাতি ও চুলোচুলি করার উপক্রমকে সরস সাংবাদিকতার প্রচার হিসেবে আমরা উপভোগ করলেও এ কথা গোপন থাকে না যে পুরুষেরা নারীকে যে চোখে দেখতে চায়, নারীরা সেরূপে সংসদে আবির্ভূত হয়েছেন বলেই পুরুষের চোখ তৃপ্ত হয়েছে, হয়েছে তাদের মনোতুষ্টি। পাঠক হয়তো বলবেন, নারী পাঠক এবং নারী দর্শকও তো খবরটা উপভোগ করেছেন। তাহলে সেটার উত্তর হবে, এই নারীমহল পুরুষ দ্বারা তৈরি সামাজিক মূল্যবোধের অবকাঠামোয় বসবাসরত অবরোধবাসিনী।
আবার দেখুন, যে নারী সাংসদেরা ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছিলেন তাঁরা কিন্তু নির্বাচিত নন, বাছাইকৃত। অর্থাৎ সংসদকক্ষে তাঁদের আগমন সামনের দরজা দিয়ে ঘটেনি। তাঁদের বাছাইকরণপদ্ধতি যে প্রকৃতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল, ধারণা করছি, সেখানে তাঁদের জিহ্বাশক্তি ও কেশশক্তিকে (চুল) প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য তাঁদের আস্ফাালনের সময় ওই দুই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। কিন্তু যেদিন থেকে কিছু নারী সদস্যকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, কিন্তু বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে সংসদে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল সেদিন এ দর্শন কাজ করেছিল যে নারীরও কিছু সাংসদীয় অধিকার থাকা দরকার। অর্থাৎ একটি সমতামূলক আচরণ থেকে এ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ কথাটাই স্বীকার করা হয়েছিল যে পুরুষশাসিত সমাজে নারী ও পুরুষ কখনো সমান হতে পারে না। তাই সমতার নামে কিছু অনির্বাচিত সাংসদকে প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করা হলো। এই নারী সাংসদেরা যখন পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত, কৌতুক সৃষ্টি করার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করলেন, তখন পুরুষশাসিত প্রচারমাধ্যম সোৎসাহে খবরটি প্রচার করল। কারণ কাজটি করার জন্যই নারী সাংসদদের বাছাইয়ের মাধ্যমে সংসদে পাঠানো হয়েছিল। এভাবে সুকৌশলে পুরুষ নারীর জন্য একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করে রাখে যেখানে নারীরা তাদের অবনমনের অবস্থা উপলব্ধি করতে না পেরে মহোৎসাহে পুরুষ কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে যায়।
বিদ্বজ্জন মাত্রই জানেন যে নারীকে অবরোধবাসিনী করে রাখার মূল প্রবচনটি হচ্ছে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ কথাটি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নারীবাদের জননী মেরি ওলস্ট্যানক্র্যাফট তাঁর বিখ্যাত রচনা ভিন্ডিকেইশন অব দ্য রাইটস অব উইমেন-এ এ চিন্তাকে ঝাড়ুপেটা করে বললেন, সংসারের এ মায়ার নিগড়ে আবদ্ধ করে নারীকে আসলে বি-রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। ক্ষমতা, যুক্তি, জ্ঞান, রাজনীতি ও ব্যবসা—অর্থাৎ রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব উৎসের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়, সেসব থেকে নারীকে চিরতরে বঞ্চিত করা হলো। ক্যাথেরিন বেইলসে, মেরিলিন ফ্রেঞ্চ, ইলাইন শোওয়াল্টার এবং জুলিয়া ক্রিস্টেভা প্রমুখ নারীবাদী লেখক ওলস্ট্যানক্র্যাফটের পুরুষশাসনের বৈরিতার আলোকে সোচ্চার হলেন এই বলে যে প্রকৃত প্রেম বা ভালোবাসা বলতে যা বোঝানো হয় সেটা তলে তলে নিশ্চিত হয় তখনই যখন নারী পুরুষের নিয়ন্ত্রণের কাছে নিজেকে বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্পণ করে। সংসারের সমতার আড়ালে আসলে অসমতাই প্রতিষ্ঠা পায়।
আমার মায়ের মতো স্বাধীনচেতা নারী আমি খুব কম দেখেছি, কিন্তু তিনি কখনো আমার বাবার কথার বাইরে গিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। সংসারের কাজে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল দুজনের মধ্যে—কিন্তু আমার বাবা জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন সাহিত্যিক হয়ে গেলেন আর আমার মা আমার মা-ই রয়ে গেলেন। লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ যেমন চমৎকারভাবে তাঁর ‘আ রুম উইথ আ ভিউ’ প্রবন্ধে বলেছেন, শেক্সপিয়ারের কোনো বোন যদি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করতেন তাহলে তাঁর হতাশায় আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকত না। কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে এটা বলা যায় যে আজ যদি তসলিমা নাসরিন পুরুষ লেখক হতেন তাহলে তাঁর দ্রোহী চেতনার জন্য তিনি হয়তো জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খাতা’ নামে একটি চমৎকার গল্প আছে। গল্পের নারী উমা কিশোরী চরিত্র। বাল্যবিবাহের কারণে তার শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ। ক্রমশ আঁকিবুঁকি শিখতে শিখতে সে বাক্যনির্মাণ শেখে এবং একটি ছোট খাতায় তার মনোভাব অনর্গল লিখে যেতে থাকে। কিন্তু উমার যুবক স্বামী পেয়ারীমোহন, যে কিনা নিজেও একজন উঠতি লেখক, একদিন জেনে যায় উমার এই গোপন খাতাটির কথা। সে ভেবে অবাক হয়, আরে, নারী তো থাকবে রান্নাঘরে সংসারে সুখ আনার জন্য, সে কেন লিখবে! খাতাটি সে উমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। উমার সাহিত্যজীবনের এখানেই ইতি। তখন রবীন্দ্রনাথ লেখক হিসেবে মন্তব্য করছেন (হাতের কাছে গল্পটি নেই, তাই নিজের ভাষায় লিখছি), পেয়ারীমোহন যে কঠিন কঠিন বাক্যে চিন্তাশীল প্রবন্ধের নামে প্রায় যে অখাদ্যগুলো রচনা করে চলেছে, তার সে খাতা কেড়ে নেবে জগৎসংসারে এমন কোনো শক্তি নেই। কারণ পুরুষশাসিত সমাজের একজন প্রতিনিধি পেয়ারীমোহন। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল স্বামীকে লিখছে যে সে আর ২৭ নম্বর মাখন বড়াল লেইনে স্বামীর গৃহে ফিরে যাবে না।
রবীন্দ্রনাথ নারীর মনের ভেতরের স্বাধীনতার ওপর খুব জোর দিয়েছিলেন। কনিষ্ঠতম কন্যা মীরার স্বামী নগেন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখলেন যে তার (মীরার) গোপনতম ইচ্ছাটির কথা জানার জন্য তো সে (নগেন্দ্রনাথ) জোর প্রয়োগ করতে পারে না। মীরার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের প্রথমবার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নানা মহল থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল সম্পর্কটা পুনরায় জোড়া দেওয়ার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর আগ্রহ দেখাননি। বরং নগেনকে বোঝালেন যে তিনি নিজেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ হয়ে মীরার বিচার করতে পারেন না।
তবে নারী যে বিনা বাক্যব্যয়ে পুরুষের শাসন যুগ যুগ ধরে মেনে চলেছে সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তাদের বিদ্রোহটা আসে অসরাসরিভাবে, দুর্লক্ষ্যভাবে। শেক্সপিয়ারের একটি প্রিয় চরিত্র রোজালিন্ড নারীকে অবদমনের চেষ্টা বৃথা এ কথা বোঝাতে গিয়ে বলছে, তাকে কক্ষে বন্ধ করে রাখলে সে জানলা দিয়ে তার কণ্ঠস্বরের জানান দেবে। জানলা বন্ধ করলে চিমনি দিয়ে প্রকাশ করবে। চিমনি বন্ধ করলে দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে সে সবাক হবে।
এ অর্থে আমার ধারণা, নারী সাংসদদের উত্তেজনামুখর আচরণকে ঠিক ‘চুলোচুলি’, ‘হাতাহাতি’—এ রকম লঘুতার মধ্যে না রেখে তাঁদের চাপা স্বাধীনতাবোধের প্রকাশ হিসেবে দেখা উচিত। যে নারী সব সময় গৃহে থাকেন, তিনি যদি সাংসদ হন এবং নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে হল্লাচিল্লা করার অধিকারকে তাঁর স্বাধীনতাবোধের ডিসকোর্স হিসেবে দেখা উচিত।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা; গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।
No comments