খোলা হাওয়া-ভরসার স্থান একটাই by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
মার্চের ২০ তারিখের দুটি খণ্ড চিত্র। প্রথম চিত্র: আমাদের মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। বিরোধীদলীয় নেতা দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। তারপর চলে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। তাঁদের ভাষণ শুনে মনে হলো: ১. গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে নিরন্তর বিবাদ-বিসংবাদ, ২. দেশ থেকে দল বড় এবং দল থেকে ব্যক্তি বড় এবং ৩. দেশের উন্নতির চেয়ে দলীয়
কর্মসূচি ও দেশের স্বার্থে আলাপ-আলোচনার চেয়ে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় চিত্র: মিরপুর স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছে। বাংলাদেশ দল খেলছে শ্রীলঙ্কা দলের বিরুদ্ধে। বৃষ্টি-আইনের যুক্তিহীনতায় সহজ একটি লক্ষ্য মোটামুটি কঠিন হয়ে যাওয়ার পরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছে বাংলাদেশ। ১৩৫ রানে পাঁচটি উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে খেলছে দুটি ছেলে। জয়ের যে সম্ভাবনাটা তাদের দুই সহযোদ্ধা তৈরি করে দিয়েছিল, সেটি অর্জনে তারা তাদের দক্ষতা আর সক্ষমতার সবটাই যেন ঢেলে দিল। বাংলাদেশের সেদিনের খেলা দেখে মনে হলো: ১. খেলার অর্থ যেন হচ্ছে, নিরন্তর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া, ২. খেলার মাঠের একটা জয় যেন সারা দেশের সব মানুষের জয় এবং ৩. সবাই মিলে, সবার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে একটা দল হয়ে খেলতে পারলে কোনো প্রতিপক্ষই শক্তিশালী নয়।
প্রথম চিত্রটি যাঁরা টেলিভিশনে দেখেছেন, তাঁরা শুধু হতাশ হয়ে ভেবেছেন, স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আমাদের এসব দেখতে হবে? তাঁরা আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন, আমাদের গণতন্ত্রের জিম্মাদারদের চিন্তা-চেতনায় দেশটা কোথায়? কবে তাঁরা আত্মাদরের আর আত্মগরিমার আবরণ সরিয়ে বাস্তবে নেমে আসবেন, মানুষের কথা ভাববেন, দেশের কথা ভাববেন? পাশাপাশি দ্বিতীয় চিত্রটি যাঁরা দেখেছেন এবং তাঁদের সংখ্যা অগুনতি—তাঁরা শুধু উচ্ছ্বসিত হয়েছেন ছেলেগুলোর আত্মবিশ্বাস দেখে, দেশের জন্য তাদের সব সামর্থ্যের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা দেখে। প্রথম চিত্রটি দেখে কিছু মানষ নিশ্চয় পুলকিত হয়েছে—কিন্তু তারা অন্ধ দলীয় সমর্থক, মতলবি দলবাজ। দ্বিতীয় চিত্রটি দেখে পুলকিত হয়েছে সারা বাংলাদেশ। আমি খেলা দেখছিলাম আর শুনছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়া কাঁপানো ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ গর্জন। দ্বিতীয় চিত্রের সমাপ্তিতে একটা জোয়ারের মতো তরুণেরা ছুটল টিএসসির মোড়ে, বাংলাদেশের পতাকা মাথায় জড়িয়ে। জয়টা তাদের মধ্যে সব বিভেদ ঘুচিয়ে দিল। প্রথম চিত্র শেষ হলে মানুষ তা দ্রুত ভুলে যেতে চাইল, শুধু সারা দেশে কিছু যুবক হয়তো ছুরিতে শাণ দিয়ে রাখল, দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। প্রথম চিত্রের সামান্য পেছনে গিয়ে সেই সাংসদের কথা স্মরণ করা যায়, যিনি অত্যন্ত অমার্জিত ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করছিলেন এবং কুৎসা রটাচ্ছিলেন। দু-একজন সাংসদ তাঁর দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল একটা হাতাহাতি হয়েই যাবে। তাঁর ভাষা শুনে টেলিভিশনের শ্রোতারা নিশ্চয় কানে আঙুল দিয়েছিলেন। তাঁর একটা প্রমোশন, আমি আন্দাজ করি, সেদিনই হয়ে গেছে। তাঁর দল আগামীতে সরকার গঠন করলে তিনি নিশ্চয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হবেন এবং একুশের কোনো অনুষ্ঠানে ‘ভাষাচর্চায় শালীনতা’ বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য দেবেন। প্রথম চিত্রেরও একটু পেছনে যাওয়া যেতে পারে এবং একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ যেদিন ভারতকে হারাল, লক্ষৌর একটি হোটেলে বসে তিন বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে আমিও খেলাটা দেখেছিলাম। খেলা শেষে আমাদের প্রত্যেকের মনে হয়েছিল, যেন আমরা ঘাড়ে মাথায় অনেক উঁচু হয়ে গেছি। হোটেলে সেদিন আরও বাংলাদেশি ছিলেন। আমরা সবাই হইচই করে জয়টি উদ্যাপন করেছিলাম। আমাদের এ রকম ধারণা হয়েছিল যেন ভারতীয়রা আমাদের সমীহের চোখে দেখছে।
রাজনীতি এবং ক্রিকেট দুই জিনিস। তাদের এক করে ফেলা উচিত নয়। কিন্তু আমার বিবেচনা এ মুহূর্তে খেলা বা রাজনীতি নয়, বিবেচনা হচ্ছে দেশ। কেমন হতো, জাতীয় সংসদের অধিবেশন টেলিভিশনে দেখে দলবাজ যুবক বাংলাদেশের পতাকা হাতে ছুটত টিএসসির দিকে? টিএসসির দিকে না হলেও নিজ দলের কার্যালয়ের দিকে? এবং গিয়ে বলত, এখন বাংলাদেশকে ঠেকাবে কে? কেমন হতো যদি সাংসদের ভাষা শুনে কোনো অভিভাবক সন্তানদের ডেকে বলতেন, ‘শোনো, কীভাবে কথা বলতে হয়’ অথবা ‘একটু বসে শোনো, কত সুন্দরভাবে বিতর্ক করা যায়।’ কেমন হতো, জাতীয় সংসদের প্রতিটি অধিবেশন দেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনত? কেমন হতো, আমাদের রাজনীতির খেলোয়াড়দের দেখে যদি আমাদের এ রকম প্রত্যয় জন্মাত, রাজনীতি হচ্ছে দেশের জন্য নিরন্তর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া এবং আরও মনে হতো, সবাই মিলে তাঁরা সব সামর্থ্য এক করে বাংলাদেশের মানুষের বড় বড় প্রতিপক্ষকে যেমন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কর্মহীনতাকে জয় করার জন্য মাঠে নেমেছেন?
ক্রিকেট আর রাজনীতি অবশ্যই দুটি জিনিস। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরে ক্রিকেট আমাদের জন্য উদ্যাপনের যে কটা সুযোগ করে দিয়েছে, রাজনীতি কেন তা পারেনি? অথচ রাজনীতিই তো পাকিস্তানের ২৪ বছর আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে এবং একাত্তরে অস্ত্র হাতে দেশমুক্তির জন্য যুদ্ধে যেতে। যে রাজনীতি করেছেন ভাসানী-বঙ্গবন্ধু, মণিসিংহ, সেই রাজনীতি তাহলে কোথায় গেল? সে রাজনীতির পুনরুত্থান কি সম্ভব নয়? আমার প্রজন্মের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে যে একাত্তরের মার্চ—সেই মার্চের রাজনীতি আমরা একটি জাতি হিসেবে একত্রে চর্চা করেছি এবং একটি স্বাধীন দেশ আদায় করেছি। এত শক্তি আর শুদ্ধতা ছিল যে রাজনীতির, সেটি কোথায় হারিয়ে গেল? যদি থাকত সেই রাজনীতি, বাংলাদেশ আজ কোথায় যেতে পারে!
স্বাধীনতার ৪১ বছর পর সেই রাজনীতি হারিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করা যায়। আর কিছু না হলেও কারণগুলো আমাদের সামনে এগোনোর একটা পথ বাতলে দিতে পারে। প্রধান কারণ বোধ করি আমাদের কিছু মানুষের পাকিস্তানের ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার অক্ষমতা অথবা তার প্রতি আনুগত্য পুষে রাখা সেই একাত্তরেই বঙ্গবন্ধুর এক সহযোগী পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে তাঁর মুজিব কোটের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, পঁচাত্তরের পর মুজিব কোটের বদলে তা গায়ে চাপাতে শুরু করলেন। তিনি অবশ্য একা ছিলেন না, তাঁর ছিল আরও অনেক অনুসারী, সহযোগী। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে, তা ওই ভাবাদর্শের অনুসারীদের দ্বারাই। তারা সামরিক বাহিনীতে ছিল, সরকারে ছিল। তারা সুশীল সমাজে ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল। এখনো আছে, অথবা বলা যায়, তারা সব সময়ই থেকে গেছে। এদের সঙ্গে ছিল এবং আছে, একাত্তরে যারা নিজেদের মানুষদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। পঁচাত্তরের পর এই এতগুলো বছর তারা সমর্থন পেয়েছে, প্রশ্রয় পেয়েছে দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল থেকে। এটিই আশ্চর্য। কেমন হতো যদি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপি নতুন করে যাত্রা শুরু করত। মুক্তিযুদ্ধকে আদর্শ মেনে, বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিত প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে এবং একটি প্রাগ্রসর, উদারমনা, শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজে নেমে পড়ত? আওয়ামী লীগ তখন জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলত না এবং বিএনপিকে সহায়তা দিতে পিছিয়ে থাকতে পারত না। জনগণ সেটি হতে দিত না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা স্থাপনকারী দুটি দলের মধ্যে তখন রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকত, দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিছুটা অবশ্য থাকত, কিন্তু তা দুটি দলকে দুই মেরুতে ঠেলে দেওয়ার মতো তীব্র হতো না। হারানো রাজনীতি তাহলে হয়তো ফিরে আসত।
কেমন হতো যদি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিত এবং অতীতে যা হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার একটা নতুন অধ্যায় শুরু করার আহ্বান জানাত। তখনো একটা সুযোগ ছিল। সুযোগটা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করলে হারানো রাজনীতিটা হয়তো আবার ফিরে আসত। তা হয়নি। তার পরও শেষ একটা সুযোগ ছিল ১/১১-এর পটপরিবর্তনের পর। দুটি দলেরই প্রতিপক্ষ ছিল অভিন্ন, দুটি দলকেই দিতে হয়েছে অনেক মাশুল। কিন্তু অভিন্ন একটি লড়াইয়ে—গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে—দল দুটি কাছাকাছি আসার পরিবর্তে আরও দূরে সরে গেল। এখন তাদের মধ্যে মতাদর্শগত দূরত্বটা বিস্তর, মিল শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকার তাদের প্রবল আকাঙ্ক্ষায়।
দুটি দল এখন যুদ্ধক্ষেত্রের দুদিকে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে। তবে, আমাদের দুর্ভাগ্য, গেরিলা যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধের কোনো আলাদা মাঠ নেই, এই যুদ্ধ চলছে এবং চলবে বাংলাদেশের সব লোকালয়ে। তাতে কলাটেরাল ড্যামেজ হবে জনগণ। অথচ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজসহ সর্বত্র যে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন, যেখানে দলমত-নির্বিশেষে সব সক্ষম নাগরিকের সানন্দ অংশগ্রহণ একটি আবশ্যকতা, সেখানে আমরা তাকিয়ে আছি আগামী জুন থেকে নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য এক চরম অরাজকতা, ধ্বংস আর সন্ত্রাসের সম্ভাবনার দিকে। মানুষের পিঠ এখন প্রায় দেয়ালে ঠেকেছে, কিন্তু এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার পরিবর্তে দেয়ালে তার মাথাটা ঠুকে তাকে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে।
দুটি দলের মধ্যে সদ্ভাবের সম্ভাবনাটা উবে গেছে। দিনে দিনে বরং বৈরিতা বাড়ছে। এখন দল দুটির নেতা-নেত্রী মুখ খুললেই একে অপরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। অথচ মানুষ একেবারেই ভিন্ন কিছু চায়। মানুষ চায় উন্নতি, অগ্রগতি একের পর এক ঈর্ষণীয় অর্জন। মানুষ চায় দল দুটি একটু আত্মশুদ্ধির পথে যাক। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও কেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, মিত্রপক্ষ নিয়ে এমন বিভ্রান্তি থাকবে? আত্মশুদ্ধির ভিত্তি কি হতে পারে না মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনাময় দিনগুলো? লাখো শহীদের স্বপ্ন? তাঁদের রক্তের শপথ?
মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সঙ্গে আমরা প্রতারণা করেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা বঞ্চিত করেছি, একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে আমরা শঠতা করেছি, এখনো করছি। সে জন্য আমাদের আরও হয়তো অনেক মূল্য দিতে হবে। এত মূল্য দেওয়ার পর যদি আমাদের আত্মোপলব্ধি জাগে, যদি সবাই মিলে দেশের জন্য একযোগে কিছু করার একটা উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে হয়তো হারানো রাজনীতিটি ফিরে আসবে।
২.
তবে আমার ভরসার স্থান একটাই। এবং এই ভরসার কথায় ক্রিকেটের প্রসঙ্গটা এসে পড়ে। ক্রিকেটের মাঠে যখন বাংলাদেশ খেলে এবং প্রতিপক্ষ হয় প্রবল, একটু ভালো করলেই উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকে সমর্থকেরা, যাদের সিংহভাগ তরুণ।
এই তরুণেরা এখন পক্ষ চেনে, প্রতিপক্ষ চেনে। এরা বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে অনেক অনেক বছর বেশি পৃথিবীতে থাকবে। তারা এক দিন নিশ্চিত করবে বাংলাদেশের মাটিতেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মূর্ত হবে, এর সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হবে। বাংলাদেশের সামান্য অর্জনেই যারা ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ গর্জনে আকাশ কাঁপায়, তারা নিশ্চয় বাংলাদেশের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তারা যখন বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নতি কামনা করতে থাকবে, খেলার মাঠে যেমন কামনা করে একটি উইকেট অথবা একটি চার অথবা ছয়ের, তখন ভালো না খেলে বাংলাদেশের কি উপায় থাকবে?
যারা খারাপ খেলে, তাদের তারা বদলাতে বাধ্য করবে। আর যারা নিজের দেশকে ঠকাবে অন্য কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে, তাদের রেহাই দেবে না।
আমার আয়ুষ্কালে এ চিত্রটি দেখে যেতে না পারলেও আক্ষেপ থাকবে না। এই মার্চে আমার আবার মনে হয়েছে বাংলার তরুণেরা একটা নতুন বাংলাদেশ চাইছে, যে বাংলাদেশ দয়া চায় না, সমীহ চায়; যে বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী এবং অপ্রতিরোধ্য। এই বাংলাদেশ গড়তে যে দল মাঠে নামবে, সে দল তাদের সমর্থন পাবে। তবে এটিও আমার মনে হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে তরুণেরা। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিদায় এই তরুণেরাই নিশ্চিত করবে।
হয়তো একদিন হারানো রাজনীতি এই তরুণদের হাত ধরেই ফিরে আসবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দ্বিতীয় চিত্র: মিরপুর স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছে। বাংলাদেশ দল খেলছে শ্রীলঙ্কা দলের বিরুদ্ধে। বৃষ্টি-আইনের যুক্তিহীনতায় সহজ একটি লক্ষ্য মোটামুটি কঠিন হয়ে যাওয়ার পরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছে বাংলাদেশ। ১৩৫ রানে পাঁচটি উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে খেলছে দুটি ছেলে। জয়ের যে সম্ভাবনাটা তাদের দুই সহযোদ্ধা তৈরি করে দিয়েছিল, সেটি অর্জনে তারা তাদের দক্ষতা আর সক্ষমতার সবটাই যেন ঢেলে দিল। বাংলাদেশের সেদিনের খেলা দেখে মনে হলো: ১. খেলার অর্থ যেন হচ্ছে, নিরন্তর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া, ২. খেলার মাঠের একটা জয় যেন সারা দেশের সব মানুষের জয় এবং ৩. সবাই মিলে, সবার সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে একটা দল হয়ে খেলতে পারলে কোনো প্রতিপক্ষই শক্তিশালী নয়।
প্রথম চিত্রটি যাঁরা টেলিভিশনে দেখেছেন, তাঁরা শুধু হতাশ হয়ে ভেবেছেন, স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আমাদের এসব দেখতে হবে? তাঁরা আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন, আমাদের গণতন্ত্রের জিম্মাদারদের চিন্তা-চেতনায় দেশটা কোথায়? কবে তাঁরা আত্মাদরের আর আত্মগরিমার আবরণ সরিয়ে বাস্তবে নেমে আসবেন, মানুষের কথা ভাববেন, দেশের কথা ভাববেন? পাশাপাশি দ্বিতীয় চিত্রটি যাঁরা দেখেছেন এবং তাঁদের সংখ্যা অগুনতি—তাঁরা শুধু উচ্ছ্বসিত হয়েছেন ছেলেগুলোর আত্মবিশ্বাস দেখে, দেশের জন্য তাদের সব সামর্থ্যের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা দেখে। প্রথম চিত্রটি দেখে কিছু মানষ নিশ্চয় পুলকিত হয়েছে—কিন্তু তারা অন্ধ দলীয় সমর্থক, মতলবি দলবাজ। দ্বিতীয় চিত্রটি দেখে পুলকিত হয়েছে সারা বাংলাদেশ। আমি খেলা দেখছিলাম আর শুনছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়-পাড়া কাঁপানো ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ গর্জন। দ্বিতীয় চিত্রের সমাপ্তিতে একটা জোয়ারের মতো তরুণেরা ছুটল টিএসসির মোড়ে, বাংলাদেশের পতাকা মাথায় জড়িয়ে। জয়টা তাদের মধ্যে সব বিভেদ ঘুচিয়ে দিল। প্রথম চিত্র শেষ হলে মানুষ তা দ্রুত ভুলে যেতে চাইল, শুধু সারা দেশে কিছু যুবক হয়তো ছুরিতে শাণ দিয়ে রাখল, দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। প্রথম চিত্রের সামান্য পেছনে গিয়ে সেই সাংসদের কথা স্মরণ করা যায়, যিনি অত্যন্ত অমার্জিত ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করছিলেন এবং কুৎসা রটাচ্ছিলেন। দু-একজন সাংসদ তাঁর দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল একটা হাতাহাতি হয়েই যাবে। তাঁর ভাষা শুনে টেলিভিশনের শ্রোতারা নিশ্চয় কানে আঙুল দিয়েছিলেন। তাঁর একটা প্রমোশন, আমি আন্দাজ করি, সেদিনই হয়ে গেছে। তাঁর দল আগামীতে সরকার গঠন করলে তিনি নিশ্চয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হবেন এবং একুশের কোনো অনুষ্ঠানে ‘ভাষাচর্চায় শালীনতা’ বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য দেবেন। প্রথম চিত্রেরও একটু পেছনে যাওয়া যেতে পারে এবং একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ যেদিন ভারতকে হারাল, লক্ষৌর একটি হোটেলে বসে তিন বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে আমিও খেলাটা দেখেছিলাম। খেলা শেষে আমাদের প্রত্যেকের মনে হয়েছিল, যেন আমরা ঘাড়ে মাথায় অনেক উঁচু হয়ে গেছি। হোটেলে সেদিন আরও বাংলাদেশি ছিলেন। আমরা সবাই হইচই করে জয়টি উদ্যাপন করেছিলাম। আমাদের এ রকম ধারণা হয়েছিল যেন ভারতীয়রা আমাদের সমীহের চোখে দেখছে।
রাজনীতি এবং ক্রিকেট দুই জিনিস। তাদের এক করে ফেলা উচিত নয়। কিন্তু আমার বিবেচনা এ মুহূর্তে খেলা বা রাজনীতি নয়, বিবেচনা হচ্ছে দেশ। কেমন হতো, জাতীয় সংসদের অধিবেশন টেলিভিশনে দেখে দলবাজ যুবক বাংলাদেশের পতাকা হাতে ছুটত টিএসসির দিকে? টিএসসির দিকে না হলেও নিজ দলের কার্যালয়ের দিকে? এবং গিয়ে বলত, এখন বাংলাদেশকে ঠেকাবে কে? কেমন হতো যদি সাংসদের ভাষা শুনে কোনো অভিভাবক সন্তানদের ডেকে বলতেন, ‘শোনো, কীভাবে কথা বলতে হয়’ অথবা ‘একটু বসে শোনো, কত সুন্দরভাবে বিতর্ক করা যায়।’ কেমন হতো, জাতীয় সংসদের প্রতিটি অধিবেশন দেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনত? কেমন হতো, আমাদের রাজনীতির খেলোয়াড়দের দেখে যদি আমাদের এ রকম প্রত্যয় জন্মাত, রাজনীতি হচ্ছে দেশের জন্য নিরন্তর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া এবং আরও মনে হতো, সবাই মিলে তাঁরা সব সামর্থ্য এক করে বাংলাদেশের মানুষের বড় বড় প্রতিপক্ষকে যেমন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কর্মহীনতাকে জয় করার জন্য মাঠে নেমেছেন?
ক্রিকেট আর রাজনীতি অবশ্যই দুটি জিনিস। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরে ক্রিকেট আমাদের জন্য উদ্যাপনের যে কটা সুযোগ করে দিয়েছে, রাজনীতি কেন তা পারেনি? অথচ রাজনীতিই তো পাকিস্তানের ২৪ বছর আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে এবং একাত্তরে অস্ত্র হাতে দেশমুক্তির জন্য যুদ্ধে যেতে। যে রাজনীতি করেছেন ভাসানী-বঙ্গবন্ধু, মণিসিংহ, সেই রাজনীতি তাহলে কোথায় গেল? সে রাজনীতির পুনরুত্থান কি সম্ভব নয়? আমার প্রজন্মের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে যে একাত্তরের মার্চ—সেই মার্চের রাজনীতি আমরা একটি জাতি হিসেবে একত্রে চর্চা করেছি এবং একটি স্বাধীন দেশ আদায় করেছি। এত শক্তি আর শুদ্ধতা ছিল যে রাজনীতির, সেটি কোথায় হারিয়ে গেল? যদি থাকত সেই রাজনীতি, বাংলাদেশ আজ কোথায় যেতে পারে!
স্বাধীনতার ৪১ বছর পর সেই রাজনীতি হারিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করা যায়। আর কিছু না হলেও কারণগুলো আমাদের সামনে এগোনোর একটা পথ বাতলে দিতে পারে। প্রধান কারণ বোধ করি আমাদের কিছু মানুষের পাকিস্তানের ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার অক্ষমতা অথবা তার প্রতি আনুগত্য পুষে রাখা সেই একাত্তরেই বঙ্গবন্ধুর এক সহযোগী পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে তাঁর মুজিব কোটের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, পঁচাত্তরের পর মুজিব কোটের বদলে তা গায়ে চাপাতে শুরু করলেন। তিনি অবশ্য একা ছিলেন না, তাঁর ছিল আরও অনেক অনুসারী, সহযোগী। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে, তা ওই ভাবাদর্শের অনুসারীদের দ্বারাই। তারা সামরিক বাহিনীতে ছিল, সরকারে ছিল। তারা সুশীল সমাজে ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল। এখনো আছে, অথবা বলা যায়, তারা সব সময়ই থেকে গেছে। এদের সঙ্গে ছিল এবং আছে, একাত্তরে যারা নিজেদের মানুষদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। পঁচাত্তরের পর এই এতগুলো বছর তারা সমর্থন পেয়েছে, প্রশ্রয় পেয়েছে দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল থেকে। এটিই আশ্চর্য। কেমন হতো যদি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপি নতুন করে যাত্রা শুরু করত। মুক্তিযুদ্ধকে আদর্শ মেনে, বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিত প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে এবং একটি প্রাগ্রসর, উদারমনা, শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজে নেমে পড়ত? আওয়ামী লীগ তখন জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলত না এবং বিএনপিকে সহায়তা দিতে পিছিয়ে থাকতে পারত না। জনগণ সেটি হতে দিত না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা স্থাপনকারী দুটি দলের মধ্যে তখন রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকত, দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিছুটা অবশ্য থাকত, কিন্তু তা দুটি দলকে দুই মেরুতে ঠেলে দেওয়ার মতো তীব্র হতো না। হারানো রাজনীতি তাহলে হয়তো ফিরে আসত।
কেমন হতো যদি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিত এবং অতীতে যা হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার একটা নতুন অধ্যায় শুরু করার আহ্বান জানাত। তখনো একটা সুযোগ ছিল। সুযোগটা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করলে হারানো রাজনীতিটা হয়তো আবার ফিরে আসত। তা হয়নি। তার পরও শেষ একটা সুযোগ ছিল ১/১১-এর পটপরিবর্তনের পর। দুটি দলেরই প্রতিপক্ষ ছিল অভিন্ন, দুটি দলকেই দিতে হয়েছে অনেক মাশুল। কিন্তু অভিন্ন একটি লড়াইয়ে—গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে—দল দুটি কাছাকাছি আসার পরিবর্তে আরও দূরে সরে গেল। এখন তাদের মধ্যে মতাদর্শগত দূরত্বটা বিস্তর, মিল শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকার তাদের প্রবল আকাঙ্ক্ষায়।
দুটি দল এখন যুদ্ধক্ষেত্রের দুদিকে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে। তবে, আমাদের দুর্ভাগ্য, গেরিলা যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধের কোনো আলাদা মাঠ নেই, এই যুদ্ধ চলছে এবং চলবে বাংলাদেশের সব লোকালয়ে। তাতে কলাটেরাল ড্যামেজ হবে জনগণ। অথচ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজসহ সর্বত্র যে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন, যেখানে দলমত-নির্বিশেষে সব সক্ষম নাগরিকের সানন্দ অংশগ্রহণ একটি আবশ্যকতা, সেখানে আমরা তাকিয়ে আছি আগামী জুন থেকে নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য এক চরম অরাজকতা, ধ্বংস আর সন্ত্রাসের সম্ভাবনার দিকে। মানুষের পিঠ এখন প্রায় দেয়ালে ঠেকেছে, কিন্তু এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার পরিবর্তে দেয়ালে তার মাথাটা ঠুকে তাকে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে।
দুটি দলের মধ্যে সদ্ভাবের সম্ভাবনাটা উবে গেছে। দিনে দিনে বরং বৈরিতা বাড়ছে। এখন দল দুটির নেতা-নেত্রী মুখ খুললেই একে অপরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। অথচ মানুষ একেবারেই ভিন্ন কিছু চায়। মানুষ চায় উন্নতি, অগ্রগতি একের পর এক ঈর্ষণীয় অর্জন। মানুষ চায় দল দুটি একটু আত্মশুদ্ধির পথে যাক। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও কেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, মিত্রপক্ষ নিয়ে এমন বিভ্রান্তি থাকবে? আত্মশুদ্ধির ভিত্তি কি হতে পারে না মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনাময় দিনগুলো? লাখো শহীদের স্বপ্ন? তাঁদের রক্তের শপথ?
মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সঙ্গে আমরা প্রতারণা করেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা বঞ্চিত করেছি, একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে আমরা শঠতা করেছি, এখনো করছি। সে জন্য আমাদের আরও হয়তো অনেক মূল্য দিতে হবে। এত মূল্য দেওয়ার পর যদি আমাদের আত্মোপলব্ধি জাগে, যদি সবাই মিলে দেশের জন্য একযোগে কিছু করার একটা উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে হয়তো হারানো রাজনীতিটি ফিরে আসবে।
২.
তবে আমার ভরসার স্থান একটাই। এবং এই ভরসার কথায় ক্রিকেটের প্রসঙ্গটা এসে পড়ে। ক্রিকেটের মাঠে যখন বাংলাদেশ খেলে এবং প্রতিপক্ষ হয় প্রবল, একটু ভালো করলেই উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকে সমর্থকেরা, যাদের সিংহভাগ তরুণ।
এই তরুণেরা এখন পক্ষ চেনে, প্রতিপক্ষ চেনে। এরা বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়ে অনেক অনেক বছর বেশি পৃথিবীতে থাকবে। তারা এক দিন নিশ্চিত করবে বাংলাদেশের মাটিতেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মূর্ত হবে, এর সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হবে। বাংলাদেশের সামান্য অর্জনেই যারা ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ গর্জনে আকাশ কাঁপায়, তারা নিশ্চয় বাংলাদেশের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তারা যখন বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নতি কামনা করতে থাকবে, খেলার মাঠে যেমন কামনা করে একটি উইকেট অথবা একটি চার অথবা ছয়ের, তখন ভালো না খেলে বাংলাদেশের কি উপায় থাকবে?
যারা খারাপ খেলে, তাদের তারা বদলাতে বাধ্য করবে। আর যারা নিজের দেশকে ঠকাবে অন্য কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে, তাদের রেহাই দেবে না।
আমার আয়ুষ্কালে এ চিত্রটি দেখে যেতে না পারলেও আক্ষেপ থাকবে না। এই মার্চে আমার আবার মনে হয়েছে বাংলার তরুণেরা একটা নতুন বাংলাদেশ চাইছে, যে বাংলাদেশ দয়া চায় না, সমীহ চায়; যে বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী এবং অপ্রতিরোধ্য। এই বাংলাদেশ গড়তে যে দল মাঠে নামবে, সে দল তাদের সমর্থন পাবে। তবে এটিও আমার মনে হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে তরুণেরা। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিদায় এই তরুণেরাই নিশ্চিত করবে।
হয়তো একদিন হারানো রাজনীতি এই তরুণদের হাত ধরেই ফিরে আসবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments