ধর নির্ভয় গান-দিনে দিনে বড় জমিয়াছে দেনা... by আলী যাকের
আমরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটি এমন অরাজক অবস্থা অবলোকন করি, যেখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। আইন আছে, কিন্তু কেউ আইন মানে না। সমাজ ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কেউ সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে না। চোখ আছে কিন্তু চোখের কোনো চামড়া নেই। কী এক অদ্ভুত আঁধার গ্রাস করেছে আমাদের সমাজকে।
আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বড় দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, 'ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির/মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর/বেদনার করুণ কাহিনী।' এই নতশিরদের রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করেই বলতে হয়, 'এসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।' প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রায় দুঃসাধ্য কাজটি কীভাবে সম্ভব? কাজটি আপাত কঠিন মনে
হলেও অসম্ভব নয়
আজ এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ২৩ মার্চ আর দু'দিন পরেই ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আর যে মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই মাসের ২৩ মার্চ আমরা পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র দিবস পালন করতে বাধ্য ছিলাম। অতএব, আজ এই ২৩ মার্চে, আমার মন বারবার চলে যাচ্ছে সেই '৭১-এর ২৩ মার্চে, যখন আমার দেশ হয়ে উঠেছিল অগি্নগর্ভ বাংলাদেশ। আমি এই ঢাকা শহরেই ছিলাম। ২৩ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে, বোধকরি একমাত্র সেনাছাউনিগুলো ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দৃষ্টিগোচর হয়নি। সর্বত্র পতপত করে উড়ছিল বাংলাদেশের নতুন পতাকা। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত আর লাল বৃত্তের মাঝখানে আঁকা বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র। আমরা পরম গর্ব ভরে তাকিয়ে থাকতাম ওই পতাকার দিকে, বড় আশায় বুক বেঁধে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম স্বাধিকার থেকে নিশ্চিত স্বাধীনতার পথে। এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।
আজ আমাদের স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাই। দেখার চেষ্টা করি কী ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল মন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনা? এবং তার কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি এই ৪১ বছরে? সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমাকে চিন্তান্বিত করে, তা হলো একটি অত্যন্ত বৈধ প্রশ্ন! ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বুদ্ধিমুক্তির কথা সর্বাগ্রে চিন্তা করেছিলাম। সেই মুক্তি কি আমাদের হয়েছে? আমি এখনও মনে করি যে, আমাদের বুদ্ধির মুক্তি আজও সুদূরপরাহত। বস্তুতপক্ষে বুদ্ধির মুক্তি হয়নি বলেই আমরা আমাদের বিবেকের অনুশাসনকেও মেনে চলতে শিখিনি। সেই কারণে নানাবিধ সামাজিক অনাচার, ব্যভিচার যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি আমাদের বুদ্ধির আয়তনও ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই বুদ্ধির পরাধীনতার কারণেই ১৯৭১-এ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম; কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমাদের জাতিসত্তার সামগ্রিক মুক্তি, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র নিয়ামক, তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। বস্তুতপক্ষে এখন আমরা যুক্তি-বুদ্ধির অনেক দূরে এক গাঢ় অমানিশার মধ্যে প্রবেশ করেছি যেন। আমরা ভেবেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাব, পাব একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ ব্যাপারটি পরপর সেনাশাসনের মাধ্যমে এবং আমাদের সংবিধান বিকৃত করার মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বস্তুতপক্ষে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছি, ঠিক তখন থেকেই একটি ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। আর তা ছিল এই যে, যেহেতু বাংলাদেশকে আর পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু দেশের নাম যা-ই হোক না কেন এটি যেন একটি দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে ওঠে। এই কারণেই আমরা দেখতে পাই যে, '৭৫-এর পটপরিবর্তনের পরই আমাদের জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা', যা আমরা অর্জন করেছিলাম ৩০ লাখ শহীদ এবং অসংখ্য মানুষের সম্মান উৎসর্গের মাধ্যমে, তা বদলে দেওয়া হলো। স্মর্তব্য যে, 'জয় বাংলা' ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার উচ্চারিত শেষ স্লোগান, যা ওষ্ঠে ধারণ করে সে শাহাদাত বরণ করে। একই সঙ্গে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে বিতাড়িত করা হলো। ভাবটা এমন, যে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলে ধর্মচর্চা বাধাগ্রস্ত হবে। প্রচারও করা হলো সেভাবেই। যদিও আমরা সবাই জানি যে, ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র নিজ নিজ ধর্মের নিরবচ্ছিন্ন চর্চা নিশ্চিত করে এবং সেই চেতনা থেকেই আমাদের সংবিধানে একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযোজন করা হয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশের সব মানুষ মিলে। সেই যুদ্ধে বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই সমান অংশীদার ছিল। মনে পড়ে সেই অমোঘ পোস্টার, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা দেয়ালে দেয়ালে সেঁটিয়ে দিত? 'বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি?' এ দেশের মাটি তখন রঞ্জিত হয়েছে সব জাতি, গোষ্ঠী এবং ধর্মাবলম্বীর রক্তে। তাদের কাউকে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা রেহাই দেয়নি। যে-ই বলেছে আমি স্বাধীনতা চাই, তাকেই হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। যে-ই উচ্চারণ করেছে 'জয় বাংলা', তাকেই নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। অথচ '৭৫-এর পরে আমরা একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের সংবিধানকে অপবিত্র করলাম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তো এ কথা বলে না? তারপর আরেক স্বৈরশাসক এসে আমাদের আরও দূরে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধ থেকে। সে সংযোজন করল রাষ্ট্রধর্ম। অর্থাৎ একে একে একটি নীলনকশা অনুযায়ী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর যে ষড়যন্ত্র, সেটিকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। আমরা ছিলাম মুক্তমনা, আমরা ছিলাম অসাম্প্রদায়িক, আমরা ছিলাম গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, আমাদের ওপরে আরোপ করা হলো আবারও সেই ধর্মান্ধ, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকল। তারই কারণে আমরা দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল যে প্রজন্ম, তার ঠিক পরবর্তী প্রজন্মই ওই বিকৃত স্বৈরশাসকদের অনুশাসনে প্রায় প্রতিবন্ধী একটি জাতি হিসেবে বেড়ে উঠেছিল। তাদের ইতিহাসের সত্য কোনোদিন জানতে দেওয়া হয়নি। তাদের বাংলাদেশের চেতনা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। তাদের প্রতিনিয়ত অন্ধকারাচ্ছন্ন এক প্রতিক্রিয়াশীলতার বুলি আওড়াতে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে মুক্তি থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম আমরা। এ কথা বলতেও ভয় হতো যে, আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমরা এও দেখেছি যে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের এক অন্তর্কলহে লিপ্ত করা হয়েছে। তারপর তাদের একেকজনকে হত্যা করা হয়েছে এমনভাবে যে, মনে হবে মুক্তিযোদ্ধারাই বোধহয় ক্ষমতালোভী। আমরা হারিয়েছি এ রকম অনেক অমৃতের সন্তানকে। সমাজতন্ত্র আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ছিল। সেটিকেও নির্বাসিত করা হয়েছে সংবিধান থেকে। তার বদলে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যেনতেন প্রকারে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির চেষ্টাকে। সেই কারণে 'আছে' এবং 'নেই'-এর মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
আজ যাদের আছে, সেই কতিপয় মানুষের এমনই আছে যে, তারা সারাবিশ্ব ক্রয় করে ফেলতে পারে এবং এই অর্থ তারা লুটপাট করে অর্জন করেছে। কোনো জবাবদিহিতা নেই কোনো কিছুর। যে সমাজে শাসক স্বয়ং দুর্বৃত্ত হয়, সেই সমাজে শাসিতরাও অরাজকতার দিকে ধাবিত হয়। সে কারণে আমরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটি এমন অরাজক অবস্থা অবলোকন করি, যেখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। আইন আছে, কিন্তু কেউ আইন মানে না। সমাজ ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কেউ সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে না। চোখ আছে কিন্তু চোখের কোনো চামড়া নেই। কী এক অদ্ভুত আঁধার গ্রাস করেছে আমাদের সমাজকে। আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বড় দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, 'ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির/মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর/বেদনার করুণ কাহিনী।' এই নতশিরদের রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করেই বলতে হয়, 'এসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।' প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রায় দুঃসাধ্য কাজটি কীভাবে সম্ভব? কাজটি আপাত কঠিন মনে হলেও অসম্ভব নয়। এখনও জীবিত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। এখনও জাগ্রত মুক্তিযুদ্ধের দীক্ষায় দীক্ষিত আমাদের অনেক সন্তান। তারা যদি ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে সকল অপকর্ম, সকল অনাচার, সকল দুরাচার নির্বাসনে পাঠাতে পারে আমার এই সাহসী বাংলাদেশ।
অতি সম্প্রতি আজকের সেসব তরুণ, যারা এখনও শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করেনি, তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি যে, তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা বুঝতে শিখেছে যে, প্রশ্ন করতে হবে। তারা জবাব চায় সব অপকর্মের। বুকে ভরসা হয় এই ভেবে যে, আমরা কতগুলো প্রতিবন্ধী নর্দমার কীটের হাতে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে রেখে যাচ্ছি না। রেখে যাচ্ছি একদল বলিষ্ঠ, মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা, টগবগে তরুণের হাতে, যারা ঘুরে দাঁড়াবে। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলবে, 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।' বলবেই।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
হলেও অসম্ভব নয়
আজ এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ২৩ মার্চ আর দু'দিন পরেই ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আর যে মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই মাসের ২৩ মার্চ আমরা পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র দিবস পালন করতে বাধ্য ছিলাম। অতএব, আজ এই ২৩ মার্চে, আমার মন বারবার চলে যাচ্ছে সেই '৭১-এর ২৩ মার্চে, যখন আমার দেশ হয়ে উঠেছিল অগি্নগর্ভ বাংলাদেশ। আমি এই ঢাকা শহরেই ছিলাম। ২৩ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে, বোধকরি একমাত্র সেনাছাউনিগুলো ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দৃষ্টিগোচর হয়নি। সর্বত্র পতপত করে উড়ছিল বাংলাদেশের নতুন পতাকা। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত আর লাল বৃত্তের মাঝখানে আঁকা বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র। আমরা পরম গর্ব ভরে তাকিয়ে থাকতাম ওই পতাকার দিকে, বড় আশায় বুক বেঁধে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম স্বাধিকার থেকে নিশ্চিত স্বাধীনতার পথে। এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।
আজ আমাদের স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাই। দেখার চেষ্টা করি কী ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল মন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনা? এবং তার কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি এই ৪১ বছরে? সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমাকে চিন্তান্বিত করে, তা হলো একটি অত্যন্ত বৈধ প্রশ্ন! ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বুদ্ধিমুক্তির কথা সর্বাগ্রে চিন্তা করেছিলাম। সেই মুক্তি কি আমাদের হয়েছে? আমি এখনও মনে করি যে, আমাদের বুদ্ধির মুক্তি আজও সুদূরপরাহত। বস্তুতপক্ষে বুদ্ধির মুক্তি হয়নি বলেই আমরা আমাদের বিবেকের অনুশাসনকেও মেনে চলতে শিখিনি। সেই কারণে নানাবিধ সামাজিক অনাচার, ব্যভিচার যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি আমাদের বুদ্ধির আয়তনও ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই বুদ্ধির পরাধীনতার কারণেই ১৯৭১-এ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম; কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমাদের জাতিসত্তার সামগ্রিক মুক্তি, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র নিয়ামক, তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। বস্তুতপক্ষে এখন আমরা যুক্তি-বুদ্ধির অনেক দূরে এক গাঢ় অমানিশার মধ্যে প্রবেশ করেছি যেন। আমরা ভেবেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাব, পাব একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ ব্যাপারটি পরপর সেনাশাসনের মাধ্যমে এবং আমাদের সংবিধান বিকৃত করার মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বস্তুতপক্ষে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছি, ঠিক তখন থেকেই একটি ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। আর তা ছিল এই যে, যেহেতু বাংলাদেশকে আর পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু দেশের নাম যা-ই হোক না কেন এটি যেন একটি দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে ওঠে। এই কারণেই আমরা দেখতে পাই যে, '৭৫-এর পটপরিবর্তনের পরই আমাদের জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা', যা আমরা অর্জন করেছিলাম ৩০ লাখ শহীদ এবং অসংখ্য মানুষের সম্মান উৎসর্গের মাধ্যমে, তা বদলে দেওয়া হলো। স্মর্তব্য যে, 'জয় বাংলা' ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার উচ্চারিত শেষ স্লোগান, যা ওষ্ঠে ধারণ করে সে শাহাদাত বরণ করে। একই সঙ্গে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে বিতাড়িত করা হলো। ভাবটা এমন, যে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলে ধর্মচর্চা বাধাগ্রস্ত হবে। প্রচারও করা হলো সেভাবেই। যদিও আমরা সবাই জানি যে, ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র নিজ নিজ ধর্মের নিরবচ্ছিন্ন চর্চা নিশ্চিত করে এবং সেই চেতনা থেকেই আমাদের সংবিধানে একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযোজন করা হয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশের সব মানুষ মিলে। সেই যুদ্ধে বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই সমান অংশীদার ছিল। মনে পড়ে সেই অমোঘ পোস্টার, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা দেয়ালে দেয়ালে সেঁটিয়ে দিত? 'বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি?' এ দেশের মাটি তখন রঞ্জিত হয়েছে সব জাতি, গোষ্ঠী এবং ধর্মাবলম্বীর রক্তে। তাদের কাউকে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা রেহাই দেয়নি। যে-ই বলেছে আমি স্বাধীনতা চাই, তাকেই হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। যে-ই উচ্চারণ করেছে 'জয় বাংলা', তাকেই নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। অথচ '৭৫-এর পরে আমরা একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের সংবিধানকে অপবিত্র করলাম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তো এ কথা বলে না? তারপর আরেক স্বৈরশাসক এসে আমাদের আরও দূরে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধ থেকে। সে সংযোজন করল রাষ্ট্রধর্ম। অর্থাৎ একে একে একটি নীলনকশা অনুযায়ী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর যে ষড়যন্ত্র, সেটিকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। আমরা ছিলাম মুক্তমনা, আমরা ছিলাম অসাম্প্রদায়িক, আমরা ছিলাম গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, আমাদের ওপরে আরোপ করা হলো আবারও সেই ধর্মান্ধ, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকল। তারই কারণে আমরা দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল যে প্রজন্ম, তার ঠিক পরবর্তী প্রজন্মই ওই বিকৃত স্বৈরশাসকদের অনুশাসনে প্রায় প্রতিবন্ধী একটি জাতি হিসেবে বেড়ে উঠেছিল। তাদের ইতিহাসের সত্য কোনোদিন জানতে দেওয়া হয়নি। তাদের বাংলাদেশের চেতনা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। তাদের প্রতিনিয়ত অন্ধকারাচ্ছন্ন এক প্রতিক্রিয়াশীলতার বুলি আওড়াতে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে মুক্তি থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম আমরা। এ কথা বলতেও ভয় হতো যে, আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমরা এও দেখেছি যে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের এক অন্তর্কলহে লিপ্ত করা হয়েছে। তারপর তাদের একেকজনকে হত্যা করা হয়েছে এমনভাবে যে, মনে হবে মুক্তিযোদ্ধারাই বোধহয় ক্ষমতালোভী। আমরা হারিয়েছি এ রকম অনেক অমৃতের সন্তানকে। সমাজতন্ত্র আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ছিল। সেটিকেও নির্বাসিত করা হয়েছে সংবিধান থেকে। তার বদলে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যেনতেন প্রকারে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির চেষ্টাকে। সেই কারণে 'আছে' এবং 'নেই'-এর মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
আজ যাদের আছে, সেই কতিপয় মানুষের এমনই আছে যে, তারা সারাবিশ্ব ক্রয় করে ফেলতে পারে এবং এই অর্থ তারা লুটপাট করে অর্জন করেছে। কোনো জবাবদিহিতা নেই কোনো কিছুর। যে সমাজে শাসক স্বয়ং দুর্বৃত্ত হয়, সেই সমাজে শাসিতরাও অরাজকতার দিকে ধাবিত হয়। সে কারণে আমরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটি এমন অরাজক অবস্থা অবলোকন করি, যেখান থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। আইন আছে, কিন্তু কেউ আইন মানে না। সমাজ ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কেউ সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে না। চোখ আছে কিন্তু চোখের কোনো চামড়া নেই। কী এক অদ্ভুত আঁধার গ্রাস করেছে আমাদের সমাজকে। আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বড় দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, 'ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির/মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর/বেদনার করুণ কাহিনী।' এই নতশিরদের রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করেই বলতে হয়, 'এসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।' প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রায় দুঃসাধ্য কাজটি কীভাবে সম্ভব? কাজটি আপাত কঠিন মনে হলেও অসম্ভব নয়। এখনও জীবিত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। এখনও জাগ্রত মুক্তিযুদ্ধের দীক্ষায় দীক্ষিত আমাদের অনেক সন্তান। তারা যদি ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে সকল অপকর্ম, সকল অনাচার, সকল দুরাচার নির্বাসনে পাঠাতে পারে আমার এই সাহসী বাংলাদেশ।
অতি সম্প্রতি আজকের সেসব তরুণ, যারা এখনও শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করেনি, তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি যে, তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা বুঝতে শিখেছে যে, প্রশ্ন করতে হবে। তারা জবাব চায় সব অপকর্মের। বুকে ভরসা হয় এই ভেবে যে, আমরা কতগুলো প্রতিবন্ধী নর্দমার কীটের হাতে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে রেখে যাচ্ছি না। রেখে যাচ্ছি একদল বলিষ্ঠ, মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা, টগবগে তরুণের হাতে, যারা ঘুরে দাঁড়াবে। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলবে, 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।' বলবেই।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments