মুক্তির গান by আবদুশ শাকুর
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নিরস্ত্র বাঙালির প্রধান অস্ত্র ছিল সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতির প্রধান অংশ ছিল ভাষা, যার মুখ্য অঙ্গ ছিল গান—বাঙালির মুক্তির গান। কার থেকে মুক্তি? কিসের থেকে? পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নিরস্ত্র বাঙালির প্রধান অস্ত্র ছিল সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতির প্রধান অংশ ছিল ভাষা, যার মুখ্য অঙ্গ ছিল গান—বাঙালির মুক্তির গান। কার থেকে মুক্তি? কিসের থেকে? পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ থেকে। এককথায় পাকিস্তান থেকে মুক্তি। কেন? পাকিস্তানিরা ধর্মের রাজনীতিকে বিকৃতিরও সব সীমা ছাড়িয়ে বর্বরতার কোন পাতালে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা সম্যক উপলব্ধি করার দুর্ভাগ্য আমার নিজেরই হয়েছিল একাত্তরের বীভৎস দিনগুলোতে—হানাদার বাহিনী, মিজো বাহিনী আর বর্মি বাহিনী কর্তৃক চতুর্দিক সিল করে দেওয়া বান্দরবানের আটকে পড়া মহকুমা শাসক হিসেবে।
মিলিশিয়ার দল আর কল্ড-আপ এক্স-আর্মিমেন আজানের আহ্বান শুনে তাজ্জব বনে জিজ্ঞেস করত, ‘এ হিন্দুর দেশে আজান দেয় কে?’ তাদের ব্রিফ করা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান শুধু নামে, আসলে তারা সবাই হিন্দু। সেটা তাদের লুঙ্গি তুললেই দেখতে পাওয়া যাবে। অতএব, সেভাবে দেখে দেখে তাদের মুসলমানি করাতে হবে এবং ইসলামকে সর্বাঙ্গে সিলিয়ে দিয়ে তাদের নাপাক অঙ্গ পাক করার জন্যই সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে তাদের। বুড়ো নওমুসলিমদেরও খৎনা? আলবত। তাদের অমন নাজুক স্থানে ঝুলন্ত হিন্দুত্ব রাখা যাবে না। এত বড় একটা ধর্মলাভের বিনিময়ে ওই ক্ষুদ্র বাহুল্যটুকু ত্যাগ ওদের করতেই হবে। (পরে অবশ্য ধর্মের সেই পাকিস্তানি খাদেমদের কারও কারও ওই বাহুল্যটুকুর মূলসুদ্ধ ত্যাগ করতে হয়েছিল বাঙালি বীরাঙ্গনাদের গোপন অস্ত্রের আঘাতে)।
এমনি পরিপ্রেক্ষিতেই স্বপ্ন দেখেছিলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতি তথা ধর্মব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত একটি দেশের নাগরিক হওয়ার—যে দেশের জাতীয় সম্পদ কুক্ষিগত হবে না হাতেগোনা কতিপয় দুর্বৃত্ত পরিবারের ভোগের জন্য। ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণহীনতার এই দুটি বীজই নিষ্ফলা প্রমাণিত হয়েছে আমার বাস্তবের বাংলাদেশে। এক জেনারেল এসে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজটি উপড়ে ফেলে দেয়। আরেক জেনারেল এসে দেশটির বুকে ধর্মীয় রাষ্ট্রের বীজই পুঁতে দেয়। ফলে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িই হয়ে ওঠে বাস্তবের বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন। অথচ ইসলামের পয়গম্বর বলেছেন, তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে বাড়াবাড়ির স্থান নেই—লা ইক্রাহা ফি-দ্দীন্।
বিগত তিনটি সংসদের মেয়াদকালে ক্ষমতাসীন দল করেছে দিবারাত্রি লুটপাট আর ফুর্তিবাজি। বিরোধী দল করেছে লাগাতার বয়কট আর হরতাল। আদর্শহীনতার এই নগ্ন প্রতিযোগিতার ময়দানে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনকারী একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে, বস্তুত, দুটিমাত্র যুদ্ধংদেহী প্রতিস্পর্ধী ক্যাম্পে। এমন সংকটময় অবস্থা থেকে মুক্তিকামী বাঙালি হিসেবে জাতির ভবিষ্যৎস্বরূপ নিকষ কালো একটি টানেলের মুখে বসে আছি উদীয়মান মুক্তির আলোর রেখাটি দেখার আশায়—যে আলোর প্রথম ঝলকস্বরূপ অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।
আশা ছিল, স্বাধীনতার নবোদিত সূর্যটি পূর্ণ বিকশিত হয়ে বাঙালিকে উপহার দেবে সার্বিক মুক্তি। কিন্তু বিকশিত না হয়ে সূর্যটি পড়ে রইল আলো আর আঁধারের মাঝখানে। পরিস্থিতিটিকে মূর্ত করে তোলার দৈনন্দিনের দৃষ্টান্তটি হলো ‘সুবেহ সাদিক’ বা ‘সত্য প্রভাত’ আর ‘প্রভাত’-এর মধ্যবর্তী অল্পক্ষণের ‘সুবেহ কাজিব’ বা ‘মিথ্যা প্রভাত’। প্রভাতের অপেক্ষায় আমরা যেন আজ এতটা বছর ধরে এক দীর্ঘক্ষণের ‘সুবেহ কাজিব’-এর মধ্যে আটকে পড়ে আছি।
এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গাইতে হবে চাকা ঘোরানোর গান, উত্তরণের গান। একাত্তরের মুক্তির গান গীত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের প্রণোদনের গান হিসেবে। কিন্তু ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সে গান শ্রুত হচ্ছে বিনোদনের গান হিসেবে। তা হোক না। গানগুলোর মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক।
মুক্তিযুদ্ধের গানের, তথা জালিম পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তিলাভের গানের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এবার গাইতে হবে বাংলাদেশের গান, দেশপ্রেমের গান, দেশাত্মবোধক গান, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে রেখে নিরন্তর উত্তরণের গান। বাঙালির দেশাত্মবোধক গানের দেড় শ বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দিকে একবার ফিরে তাকালেই নিদ্রিত দেশাত্মবোধ জেগে উঠবে, বারবার তাকালে জাগ্রতই থাকবে। তাহলে আসুন, ফুটন্ত অতীতচারণা করে আমাদের ঘুমন্ত দেশাত্মবোধটিকে জাগিয়ে তুলি।
বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক অর্থে স্বদেশচেতনার আবির্ভাব ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এর আগের চর্চিত স্বদেশ প্রসঙ্গ সীমাবদ্ধ ছিল নিসর্গীয় ও ধর্মীয় অর্থে। চর্যাপদ থেকে রামপ্রসাদের গান পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছরের সাহিত্যে দেশাত্মবোধক গান বা কবিতা নেই। বাংলা ভাষার উৎস সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি প্যাট্রিয়টিজম শব্দটির প্রতিশব্দ নেই বলেও আক্ষেপ শুনি বোদ্ধামহলে। অথচ আমরা কৈশোরেই প্যাট্রিয়টিজম শিরোনামের ইংরেজি কবিতা পড়েছি। তবে কি আমাদের স্বদেশচেতনা পরাধীনতা থেকে উদ্ভূত? দেশপ্রেমের চর্চা ইংরেজদের কাছ থেকে শেখা? এক অর্থে তা-ই। তাহলে ইংরেজরা ওটা পেল কীভাবে? পেল, ওরাও এককালে স্বাধীন ছিল না বলে—অধীন ছিল নর্সমেনদের, নরম্যানদের।
আসলে স্বদেশচেতনামূলক গানের পেছনে আছে জাতিরাষ্ট্রের চেতনা, জাতীয়তাবোধ। মডার্ন ন্যাশনালিজমের উদ্ভব ফরাসি বিপ্লব থেকেই বটে। তবে এর অন্যান্য উৎসও রয়েছে, যেমন শক্তিশালী রাজতন্ত্রের শক্ত কেন্দ্রীয় শাসনাধীন রাজ্য। বস্তুত স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এবং তাদের ধারাবাহিক উপস্থিতি, যে শর্তটি বঙ্গদেশে পূর্ণ হয়েছে ঊনবিংশ শতকে। তার আগে দেশটিতে ছিল কেবলই উচ্চবিত্ত আর বিত্তহীন, ভূস্বামী আর ভূমিদাস।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘ভারতকলঙ্ক’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, নতুন দুটি জিনিস আমরা ইংরেজের চিত্তভান্ডার থেকে লাভ করেছি—স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা আর জাতিপ্রতিষ্ঠা। নবলব্ধ এই দুটি জিনিসের চেতনাই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাগরিত দেশপ্রেমের দুটি প্রধান উপাদান। তাহলে বলতে হয়, বাংলায় দেশাত্মবোধক সাহিত্যের উদ্ভবের প্রধান কারণ ছিল দুটি—রাজনৈতিক ও সামাজিক। তবে অপ্রধান হলেও তৃতীয় কারণও একটা ছিল, সেটি সাহিত্যিক।
উনিশ শতকের বাঙালি ইউরোপীয় সাহিত্যের স্বদেশপ্রেমে জারিত উদ্দীপনামূলক সাহিত্য থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে। এ বিষয়ে তাঁদের সরাসরি উদ্বুদ্ধ করে থাকবে মুর, ক্যাম্বেল, স্কট, বায়রনদের কবিতা। এসব কারণের সমাহারই উনিশ শতকে বাঙালির মনে স্বদেশচেতনার সঞ্চার করেছে, যা প্রতিফলিত হয়েছে তার কাব্যে ও গানে। সারকথা, বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে দেশগান একটি নতুন সংযোজন এবং কালের বিচারে তাকে আধুনিক সৃষ্টি বলতে হয়।
সর্বদা স্মর্তব্য যে, দেশাত্মবোধক গানের প্রধান উৎস ছিল বাঙালির বিপর্যস্তবোধ। বস্তুত, সব ভাষাতেই দেশগান সৃষ্টির পেছনে প্রধান উপকরণ প্রায়ই এক রকম—যেকোনো কারণে দেশটির বিপন্নবোধ। যেমন শেকসিপয়ারের রিচার্ড দ্য সেকেন্ড নাটকে জন অব গন্টের মুখে শ্রুত ইংল্যান্ডের প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও কর্মের গৌরবগাথার পটভূমিকায় প্রচ্ছন্ন আছে দেশটির বিপর্যয়ের ব্যথা। বঙ্গেও এহেন ব্যথা অন্তরে পুঞ্জিত হয়ে যখন গণচিত্তকে ক্লিষ্ট করে তুলল, তখনই বাঙালির হূদয় থেকে উৎসারিত হয়ে স্বদেশচেতনা প্রতিফলিত হলো তার সাহিত্যে ও সংগীতে।
যেমন দীনবন্ধু মিত্রের নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০) নীলকর-নির্যাতিত গ্রামবাংলার দরিদ্র চাষিদের দুঃখ-বেদনাকে ভাষা দিয়ে সমাজচেতনার দ্বারোদ্ঘাটন করেছিল। এরই সূত্র ধরে বাঙালির স্বদেশ সম্পর্কে একাধিক নতুন উপলব্ধি রূপ পরিগ্রহ করল। মাতৃভূমির সঙ্গে ভূমিসন্তানের নাড়ির সম্পর্কবোধ এই নবচেতনার অন্যতম লক্ষণ। মাতৃভাষার চেতনা তো বহু পূর্বের নিধুবাবুর (১৭৪১-১৮৩৯) গানেও প্রকাশ পেয়েছিল, যেমন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশীয় ভাষা, মিটে কি আশা’। এই নতুন কণ্ঠস্বর ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতা পেল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের (১৮১২-১৮৫৯) ‘স্বদেশ’, ‘মাতৃভাষা’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) ‘বঙ্গভাষা’ (১৮৬১), ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ (১৮৬২) ইত্যাদি কবিতায়।
বাংলা সাহিত্যের নতুন আয়োজন থেকেই তার দেশাত্মবোধক গানের ধারাটি বেরিয়ে এসেছিল। খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল গুপ্তকবির দেশাত্মবোধক রচনা। তাঁর ‘স্বদেশ’ কবিতার নমুনা: জাননা কি জীব তুমি/ জননী জন্মভূমি/ সে তোমায় হূদয়ে রেখেছে।/ থাকিয়া মায়ের কোলে/ সন্তানে জননী ভোলে/ কে কোথায় এমন দেখেছে \/। তাঁর ‘মাতৃভাষা’ কবিতার দৃষ্টান্ত: কহিতে অন্তরের আশা/ মুখে নাহি ফুটে ভাষা/ ব্যাকুল হয়েছ কত তায়।/ মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা,/ আবো আবো আবা আবা/ সমুদয় দেববাণী প্রায় \/।
এ তো গেল কবিতার কথা। বাংলা দেশাত্মবোধক গানের ইতিহাসে প্রথমেই স্মরণ করতে হবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের শতবর্ষ পূর্বেকার ‘হিন্দুমেলা’ (১৮৬৭) নামের একটি স্বাদেশিক কর্মসূচির প্রভাবকে। অরুণকুমার বসু লিখেছেন: ‘জাতীয় নাট্যশালা স্থাপন, নীলদর্পণের অনুবাদ প্রকাশ ও অভিনয় প্রভৃতি বিচিত্র-বিবিধ ঘটনায় আমাদের স্বদেশচেতনার ইতিহাস উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে হিন্দুমেলাই সেই বৃহত্তম ঘটনা, বাংলা দেশাত্মবোধক সংগীতের ইতিহাসে যার প্রভাব সর্বাগ্রগণ্য’। [বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত, পৃ. ১৯৪-৯৫, ১৯৭৮, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা]।
প্রসঙ্গত, সুভাষ চৌধুরীর বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য: ‘মুক্তির গানের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা হিন্দুমেলা থেকেই শুরু। তার আগে তেমন কোন ধারাবাহিকতার সন্ধান মেলে না, যা দিয়ে একটি ক্রমবিন্যাস করা সম্ভব। তার প্রধান কারণ জাতীয়তাবোধের উন্মেষে সংগীতের ক্ষমতার সম্ভাব্যতার কথা তখনো তেমন করে উপলব্ধি করা যায়নি।’ [মুক্তির গান, বিনোদন সংখ্যা দেশ পত্রিকা, ১৯৮৪, কলকাতা]।
হিন্দুমেলার উদ্ভব ঘটেছিল রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-১৮৯৯) এক বক্তৃতার একটি প্রস্তাবের সূত্র ধরে। প্রস্তাবটি ছিল ‘শিক্ষিত বঙ্গবাসিগণের মধ্যে জাতীয় গৌরবেচ্ছা-সঞ্চারিণী সভা’ সংস্থাপনের। বক্তৃতায় তিনি একটি সংগীতবিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, যে সংগীতে শিক্ষার্থীদের ‘অন্তঃকরণে দেশহিতৈষিতা ও সমরানুরাগের সঞ্চার হইতে পারে’। প্রস্তাবটি বাস্তবায়নকল্পে নবগোপাল মিত্র (১৮৪০-১৮৯৪) ‘চৈত্রমেলা’ নামে একটি জাতীয় মেলার সূচনা করেন, পরে যার নাম হয় ‘হিন্দুমেলা’।
এই মেলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুড়তুতো ভাই গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯)। নতুন উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ এই হিন্দুমেলাকে উপলক্ষ করেই স্বদেশি গান রচনার সূত্রপাত ঘটে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই নবচেতনার গান রচনার যেন একটা ধুম পড়ে যায়। তার মধ্যে সম্পাদক রচিত একটি স্বদেশি গান বেশি খ্যাতি পায়, ‘লজ্জায় ভারতযশ গাইব কি করে’। তাঁর মৃত্যুর পর সম্পাদক হন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। প্রকৃতপক্ষে সহসম্পাদক নবগোপালবাবুই ছিলেন হিন্দুমেলার সংগঠনপ্রধান এবং সর্ব অর্থেই এর প্রাণপুরুষ। জাতীয়তার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশব্রতী এই নিবেদিতচিত্ত কর্মীকে লোকে ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’ নামে ডাকত, কারণ তিনি তাঁর সব সংগঠনের বিশেষণরূপে ‘ন্যাশনাল’ কথাটি ব্যবহার করতেন, ‘ন্যাশনাল পেপার’, ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’, ‘ন্যাশনাল স্কুল’ ইত্যাদি।
১৮৬৮ সালে হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে গীত হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩) রচিত: ‘মিলে সবে ভারত সন্তান/ এক তান মনপ্রাণ/ গাও ভারতের যশোগান।/... হোক ভারতের জয়/ জয় ভারতের জয়,/ গাও ভারতের জয় \/’। তবে সেকালের সর্বজনপ্রিয় স্বাধীনতার গানরূপে পরিচিতি পায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭) ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/ কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে/ কে পরিবে পায়?’।
১৮৭৫ সালে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখলেন, ‘চাহি না স্বর্গের সুখ নন্দন কানন/ মুহূর্তেক পাই যদি স্বাধীন জীবন।/। শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) লিখলেন, ‘উঠ জাগো শ্রমজীবী ভাই।/ উপস্থিত যুগান্তর,/ চলাচল নারীনর/ ঘুমাবার বেলা আর নাই/’। ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটি। ১৮৯৮ সালে বীণাবাদিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) রচিত ‘চলের চল্ সবে ভারতসন্তান/ মাতৃভূমি করে আহ্বান/...দলাদলি সব ভুলি।/ হিন্দুমুসলমান/ এক পথে এক সাথে চল্/ উড়াইয়ে একতা নিশান/’।
এভাবে ক্রমান্বয়ে দেশাত্মবোধক গানের প্রসঙ্গ ভারতবর্ষের বৃহত্তর প্রাঙ্গণ থেকে একান্ত হয়ে এসে পড়ল বঙ্গদেশের নিজস্ব অঙ্গনে—১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন উপলক্ষে। বস্তুত দেশাত্মবোধক গানের উন্মেষ হিন্দুমেলার যুগে হলেও তার সার্থক বিকাশ ঘটেছে বঙ্গভঙ্গের যুগে। প্রথম যুগে প্রকাশ পেয়েছিল জাতীয় ভাবনা আর দ্বিতীয় যুগে স্বদেশচেতনা নিছক ভাবানুভূতির সংকীর্ণ পরিমণ্ডল ছাপিয়ে রূপান্তরিত হলো দেশসেবার বাস্তবিক কর্মপ্রেরণায়। এই ধারাটির অনুসরণেই কালে কালে ‘অসহযোগ’, ‘আইন অমান্য’ প্রভৃতি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করল জাতীয় আন্দোলন।
এ পর্বের স্বদেশি গানগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনে বাঙালিকে শক্তি জুগিয়েছে। এ পর্যায়ে দেশপ্রেম হলো কর্মসাধনার অঙ্গ। সে কর্মসাধনা প্রেরণা পেল ইংরেজ-পাকিস্তানিদের মতো বিদেশি শাসকের প্রতি ক্রমবর্ধিষ্ণু বিদ্বেষ থেকে। এই পর্বটি থেকেই দেশগান হতে থাকল দখলদার বিতাড়নের হাতিয়ার, তার জন্য শোষক-শাসক নিধনেরও। স্বদেশি আন্দোলনের যুগের দেশাত্মবোধক গানের নিয়ামক চিন্তা-চৈতন্য ছিল—একতা, সক্রিয়তা, স্বনির্ভরতা, দেশমাতৃকার প্রতি গভীর ভক্তি এবং প্রত্যক্ষ আত্মীয়তাবোধ-সম্পর্কিত।
মধ্য-ঊনবিংশ শতক থেকে মধ্য-বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল হিন্দুস্থানি সংগীতচর্চার স্বর্ণপর্বটি, যার কেন্দ্র ছিল কলকাতা—যে শহরের স্বীকৃতিকে হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠতম উস্তাদও তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি জ্ঞান করতেন। হিন্দুস্থানি সংগীত-প্রভাবিত এমনি পরিবেশেই আবির্ভাব এবং তিরোভাব ঘটে বাংলা গানের ভুবনের আলোকস্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১)। স্বভাবতই, শক্তিশালী হিন্দুস্থানি সংগীতের এহেন সর্বগ্রাসী প্রভাববলয়ের ভেতর বাংলা গানের স্বাভাবিক বিকাশের বিষয়ে বিশেষ চিন্তান্বিত হয়েছিলেন বাংলা গানের ভুবনের এই পুরোধাপুরুষ। হিন্দুস্থানি সংগীত কেবল প্রশিক্ষিত জনের গাওয়ার এবং শোনার। প্রতিপক্ষে বাংলা গান সবার গান। সে জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানকে ওস্তাদিমুক্ত রেখেছেন, যাতে এ গান সবাই গাইতে পারে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে, হাটে বাটে মাঠে ঘাটে।
মহাবাগেগয়কারের এই কথাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা গান সবার মনের কথার গান, পদের গান, পদাবলীর গান। এ গানের প্রথম প্রবল প্রবাহটি ছিল কীর্তনের—ষোড়শ শতকের নামকীর্তন, লীলাকীর্তন, রসকীর্তনের। সেই সর্বপ্রথম বাংলার জনসাধারণ গানে গলা মেলাবার একটি জায়গা পেয়েছিল। তেমনি জোরদার আরেকটি প্রবাহ এসেছিল তার ৩০০ বছর পরে—বাঙালির মুক্তির গানে। এখানেও সমবেত কণ্ঠে গলা মেলাবার জায়গা পেয়েছিল বাংলার সর্বস্তরের জনগণ। এ অবকাশটির সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকের ষাটের দশকের কলকাতায়, ‘চৈত্রমেলা’র সূচনায়।
অলৌকিক আলোকে উদ্ভাসিত এবং অলোকসামান্য প্রতিভার তারকাখচিত সেই হিন্দুমেলার উৎসমুখস্বরূপ রাজনারায়ণ বসুর ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা-সঞ্চারিণী সভা’ ও ‘একটি সংগীতবিদ্যালয় স্থাপনের, যে সংগীতে শিক্ষার্থীদের অন্তঃকরণে দেশহিতৈষিতা ও সমরানুরাগের সঞ্চার হইতে পারে’—এই প্রস্তাব দুটিতে যেন বীজই বপিত হয়েছিল বাঙালির মুক্তির গানের, যে গান অদ্যাবধি চলমান; হয়তো চলতেই থাকবে সত্যিকারের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত।
বিপর্যয়বোধ ছাড়া দেশাত্মবোধক গানের আরেক অগ্নিঝরা উৎস প্রত্যক্ষ আঘাত। যেমন—১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আঘাতে বাঙালি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে উঠেছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে স্বদেশচেতনা রূপান্তরিত হলো দেশসেবার বাস্তবিক কর্মপ্রেরণায়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর দেশাত্মবোধক গানের প্রবাহে ভাটার টান পড়ে। সে স্তিমিত পর্বে দেশগানের ক্ষেত্রে প্রধান দুই ব্যক্তিত্ব ছিলেন লোককবি রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭) আর চারণকবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪)।
অবশ্য পরের দশকের প্রথমার্ধেই আবির্ভূত হন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) মুক্তির গানের উদ্দীপনাসঞ্চারী নতুন ধারা নিয়ে, স্বদেশি আন্দোলনের অংশী হয়ে। বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী শ্রেণীর জাগরণী গানের মাধ্যমে তিনি যেন বিশের দশকেই অগ্রিম সংবাদ দিচ্ছিলেন গণসংগীতে উত্তাল চল্লিশের দশকের। গণসংগীতের সেই প্রবল জোয়ারটি এসেছিল ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন ওরফে ‘আইপিটিএ’র গণমুখী সাংস্কৃতিক তৎপরতায়। ওটি ছিল ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী ভূমণ্ডলীয় আন্দোলনের ইন্ডিয়ান চ্যাপ্টার। অবিস্মরণীয় সেই সংগীতপর্বের মুখ্য কথাকার, সুরকার ও রূপকার ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১-১৯৭৭), হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭), বিনয় রায় (১৯১৮-১৯৭৫), সলিল চৌধুরী (১৯২২-১৯৯৫) প্রমুখ। দেশাত্মবোধক গণসংগীত আন্দোলনের চল্লিশের দশকটিকে যেন রবীন্দ্র-নজরুলখচিত তিরিশের দশকের চেয়েও উজ্জ্বল প্রতিভাত হয়।
বঙ্গভঙ্গের আঘাত খেয়ে বাঙালি যেমন দেশাত্মবোধক গান গেয়ে উঠেছিল ১৯০৫ সালে, তেমনি উর্দু ভাষার মার খেয়ে বাংলা ভাষার গান গেয়ে উঠল ১৯৫২ সালে। অবশেষে একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ বেধে গেলে, তাতে বাঙালির শতবর্ষের পুঞ্জীভূত মুক্তির গান কামানের সমান ভূমিকাই পালন করেছিল।
বিপর্যয় যেহেতু বাঙালির নিত্যসঙ্গী, মুক্তির গান সে গেয়েই চলেছে অদ্যাবধি। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩০ বছর পরও স্বাধীনতাকে খুঁজে না পেয়ে বাংলাদেশের পপগায়ক হায়দার হোসেন তাঁর ২০০৫ সালের একটি অ্যালবামের নাম দিয়েছেন ফাঁইস্যা গেছি। মানে গায়ক ফেঁসে গেছেন। তাই তিনি গাইছেন:
কী দেখার কথা কী দেখছি
কী শোনার কথা কী শুনছি
কী ভাবার কথা কী ভাবছি
কী বলার কথা কী বলছি
তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি \
হায়দার হোসেনের মতো ‘ফাঁইস্যা’ গেছে আজ এ দেশের আপামর জনসাধারণও। তাই এবার চাই জনগণের উত্তরণের গান।
মিলিশিয়ার দল আর কল্ড-আপ এক্স-আর্মিমেন আজানের আহ্বান শুনে তাজ্জব বনে জিজ্ঞেস করত, ‘এ হিন্দুর দেশে আজান দেয় কে?’ তাদের ব্রিফ করা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান শুধু নামে, আসলে তারা সবাই হিন্দু। সেটা তাদের লুঙ্গি তুললেই দেখতে পাওয়া যাবে। অতএব, সেভাবে দেখে দেখে তাদের মুসলমানি করাতে হবে এবং ইসলামকে সর্বাঙ্গে সিলিয়ে দিয়ে তাদের নাপাক অঙ্গ পাক করার জন্যই সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে তাদের। বুড়ো নওমুসলিমদেরও খৎনা? আলবত। তাদের অমন নাজুক স্থানে ঝুলন্ত হিন্দুত্ব রাখা যাবে না। এত বড় একটা ধর্মলাভের বিনিময়ে ওই ক্ষুদ্র বাহুল্যটুকু ত্যাগ ওদের করতেই হবে। (পরে অবশ্য ধর্মের সেই পাকিস্তানি খাদেমদের কারও কারও ওই বাহুল্যটুকুর মূলসুদ্ধ ত্যাগ করতে হয়েছিল বাঙালি বীরাঙ্গনাদের গোপন অস্ত্রের আঘাতে)।
এমনি পরিপ্রেক্ষিতেই স্বপ্ন দেখেছিলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতি তথা ধর্মব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত একটি দেশের নাগরিক হওয়ার—যে দেশের জাতীয় সম্পদ কুক্ষিগত হবে না হাতেগোনা কতিপয় দুর্বৃত্ত পরিবারের ভোগের জন্য। ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণহীনতার এই দুটি বীজই নিষ্ফলা প্রমাণিত হয়েছে আমার বাস্তবের বাংলাদেশে। এক জেনারেল এসে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজটি উপড়ে ফেলে দেয়। আরেক জেনারেল এসে দেশটির বুকে ধর্মীয় রাষ্ট্রের বীজই পুঁতে দেয়। ফলে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িই হয়ে ওঠে বাস্তবের বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন। অথচ ইসলামের পয়গম্বর বলেছেন, তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে বাড়াবাড়ির স্থান নেই—লা ইক্রাহা ফি-দ্দীন্।
বিগত তিনটি সংসদের মেয়াদকালে ক্ষমতাসীন দল করেছে দিবারাত্রি লুটপাট আর ফুর্তিবাজি। বিরোধী দল করেছে লাগাতার বয়কট আর হরতাল। আদর্শহীনতার এই নগ্ন প্রতিযোগিতার ময়দানে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনকারী একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে, বস্তুত, দুটিমাত্র যুদ্ধংদেহী প্রতিস্পর্ধী ক্যাম্পে। এমন সংকটময় অবস্থা থেকে মুক্তিকামী বাঙালি হিসেবে জাতির ভবিষ্যৎস্বরূপ নিকষ কালো একটি টানেলের মুখে বসে আছি উদীয়মান মুক্তির আলোর রেখাটি দেখার আশায়—যে আলোর প্রথম ঝলকস্বরূপ অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।
আশা ছিল, স্বাধীনতার নবোদিত সূর্যটি পূর্ণ বিকশিত হয়ে বাঙালিকে উপহার দেবে সার্বিক মুক্তি। কিন্তু বিকশিত না হয়ে সূর্যটি পড়ে রইল আলো আর আঁধারের মাঝখানে। পরিস্থিতিটিকে মূর্ত করে তোলার দৈনন্দিনের দৃষ্টান্তটি হলো ‘সুবেহ সাদিক’ বা ‘সত্য প্রভাত’ আর ‘প্রভাত’-এর মধ্যবর্তী অল্পক্ষণের ‘সুবেহ কাজিব’ বা ‘মিথ্যা প্রভাত’। প্রভাতের অপেক্ষায় আমরা যেন আজ এতটা বছর ধরে এক দীর্ঘক্ষণের ‘সুবেহ কাজিব’-এর মধ্যে আটকে পড়ে আছি।
এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গাইতে হবে চাকা ঘোরানোর গান, উত্তরণের গান। একাত্তরের মুক্তির গান গীত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের প্রণোদনের গান হিসেবে। কিন্তু ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সে গান শ্রুত হচ্ছে বিনোদনের গান হিসেবে। তা হোক না। গানগুলোর মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক।
মুক্তিযুদ্ধের গানের, তথা জালিম পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তিলাভের গানের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এবার গাইতে হবে বাংলাদেশের গান, দেশপ্রেমের গান, দেশাত্মবোধক গান, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে রেখে নিরন্তর উত্তরণের গান। বাঙালির দেশাত্মবোধক গানের দেড় শ বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দিকে একবার ফিরে তাকালেই নিদ্রিত দেশাত্মবোধ জেগে উঠবে, বারবার তাকালে জাগ্রতই থাকবে। তাহলে আসুন, ফুটন্ত অতীতচারণা করে আমাদের ঘুমন্ত দেশাত্মবোধটিকে জাগিয়ে তুলি।
বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক অর্থে স্বদেশচেতনার আবির্ভাব ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এর আগের চর্চিত স্বদেশ প্রসঙ্গ সীমাবদ্ধ ছিল নিসর্গীয় ও ধর্মীয় অর্থে। চর্যাপদ থেকে রামপ্রসাদের গান পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছরের সাহিত্যে দেশাত্মবোধক গান বা কবিতা নেই। বাংলা ভাষার উৎস সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি প্যাট্রিয়টিজম শব্দটির প্রতিশব্দ নেই বলেও আক্ষেপ শুনি বোদ্ধামহলে। অথচ আমরা কৈশোরেই প্যাট্রিয়টিজম শিরোনামের ইংরেজি কবিতা পড়েছি। তবে কি আমাদের স্বদেশচেতনা পরাধীনতা থেকে উদ্ভূত? দেশপ্রেমের চর্চা ইংরেজদের কাছ থেকে শেখা? এক অর্থে তা-ই। তাহলে ইংরেজরা ওটা পেল কীভাবে? পেল, ওরাও এককালে স্বাধীন ছিল না বলে—অধীন ছিল নর্সমেনদের, নরম্যানদের।
আসলে স্বদেশচেতনামূলক গানের পেছনে আছে জাতিরাষ্ট্রের চেতনা, জাতীয়তাবোধ। মডার্ন ন্যাশনালিজমের উদ্ভব ফরাসি বিপ্লব থেকেই বটে। তবে এর অন্যান্য উৎসও রয়েছে, যেমন শক্তিশালী রাজতন্ত্রের শক্ত কেন্দ্রীয় শাসনাধীন রাজ্য। বস্তুত স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এবং তাদের ধারাবাহিক উপস্থিতি, যে শর্তটি বঙ্গদেশে পূর্ণ হয়েছে ঊনবিংশ শতকে। তার আগে দেশটিতে ছিল কেবলই উচ্চবিত্ত আর বিত্তহীন, ভূস্বামী আর ভূমিদাস।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘ভারতকলঙ্ক’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, নতুন দুটি জিনিস আমরা ইংরেজের চিত্তভান্ডার থেকে লাভ করেছি—স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা আর জাতিপ্রতিষ্ঠা। নবলব্ধ এই দুটি জিনিসের চেতনাই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাগরিত দেশপ্রেমের দুটি প্রধান উপাদান। তাহলে বলতে হয়, বাংলায় দেশাত্মবোধক সাহিত্যের উদ্ভবের প্রধান কারণ ছিল দুটি—রাজনৈতিক ও সামাজিক। তবে অপ্রধান হলেও তৃতীয় কারণও একটা ছিল, সেটি সাহিত্যিক।
উনিশ শতকের বাঙালি ইউরোপীয় সাহিত্যের স্বদেশপ্রেমে জারিত উদ্দীপনামূলক সাহিত্য থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে। এ বিষয়ে তাঁদের সরাসরি উদ্বুদ্ধ করে থাকবে মুর, ক্যাম্বেল, স্কট, বায়রনদের কবিতা। এসব কারণের সমাহারই উনিশ শতকে বাঙালির মনে স্বদেশচেতনার সঞ্চার করেছে, যা প্রতিফলিত হয়েছে তার কাব্যে ও গানে। সারকথা, বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে দেশগান একটি নতুন সংযোজন এবং কালের বিচারে তাকে আধুনিক সৃষ্টি বলতে হয়।
সর্বদা স্মর্তব্য যে, দেশাত্মবোধক গানের প্রধান উৎস ছিল বাঙালির বিপর্যস্তবোধ। বস্তুত, সব ভাষাতেই দেশগান সৃষ্টির পেছনে প্রধান উপকরণ প্রায়ই এক রকম—যেকোনো কারণে দেশটির বিপন্নবোধ। যেমন শেকসিপয়ারের রিচার্ড দ্য সেকেন্ড নাটকে জন অব গন্টের মুখে শ্রুত ইংল্যান্ডের প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও কর্মের গৌরবগাথার পটভূমিকায় প্রচ্ছন্ন আছে দেশটির বিপর্যয়ের ব্যথা। বঙ্গেও এহেন ব্যথা অন্তরে পুঞ্জিত হয়ে যখন গণচিত্তকে ক্লিষ্ট করে তুলল, তখনই বাঙালির হূদয় থেকে উৎসারিত হয়ে স্বদেশচেতনা প্রতিফলিত হলো তার সাহিত্যে ও সংগীতে।
যেমন দীনবন্ধু মিত্রের নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০) নীলকর-নির্যাতিত গ্রামবাংলার দরিদ্র চাষিদের দুঃখ-বেদনাকে ভাষা দিয়ে সমাজচেতনার দ্বারোদ্ঘাটন করেছিল। এরই সূত্র ধরে বাঙালির স্বদেশ সম্পর্কে একাধিক নতুন উপলব্ধি রূপ পরিগ্রহ করল। মাতৃভূমির সঙ্গে ভূমিসন্তানের নাড়ির সম্পর্কবোধ এই নবচেতনার অন্যতম লক্ষণ। মাতৃভাষার চেতনা তো বহু পূর্বের নিধুবাবুর (১৭৪১-১৮৩৯) গানেও প্রকাশ পেয়েছিল, যেমন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশীয় ভাষা, মিটে কি আশা’। এই নতুন কণ্ঠস্বর ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতা পেল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের (১৮১২-১৮৫৯) ‘স্বদেশ’, ‘মাতৃভাষা’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) ‘বঙ্গভাষা’ (১৮৬১), ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ (১৮৬২) ইত্যাদি কবিতায়।
বাংলা সাহিত্যের নতুন আয়োজন থেকেই তার দেশাত্মবোধক গানের ধারাটি বেরিয়ে এসেছিল। খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল গুপ্তকবির দেশাত্মবোধক রচনা। তাঁর ‘স্বদেশ’ কবিতার নমুনা: জাননা কি জীব তুমি/ জননী জন্মভূমি/ সে তোমায় হূদয়ে রেখেছে।/ থাকিয়া মায়ের কোলে/ সন্তানে জননী ভোলে/ কে কোথায় এমন দেখেছে \/। তাঁর ‘মাতৃভাষা’ কবিতার দৃষ্টান্ত: কহিতে অন্তরের আশা/ মুখে নাহি ফুটে ভাষা/ ব্যাকুল হয়েছ কত তায়।/ মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা,/ আবো আবো আবা আবা/ সমুদয় দেববাণী প্রায় \/।
এ তো গেল কবিতার কথা। বাংলা দেশাত্মবোধক গানের ইতিহাসে প্রথমেই স্মরণ করতে হবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের শতবর্ষ পূর্বেকার ‘হিন্দুমেলা’ (১৮৬৭) নামের একটি স্বাদেশিক কর্মসূচির প্রভাবকে। অরুণকুমার বসু লিখেছেন: ‘জাতীয় নাট্যশালা স্থাপন, নীলদর্পণের অনুবাদ প্রকাশ ও অভিনয় প্রভৃতি বিচিত্র-বিবিধ ঘটনায় আমাদের স্বদেশচেতনার ইতিহাস উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে হিন্দুমেলাই সেই বৃহত্তম ঘটনা, বাংলা দেশাত্মবোধক সংগীতের ইতিহাসে যার প্রভাব সর্বাগ্রগণ্য’। [বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত, পৃ. ১৯৪-৯৫, ১৯৭৮, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা]।
প্রসঙ্গত, সুভাষ চৌধুরীর বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য: ‘মুক্তির গানের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা হিন্দুমেলা থেকেই শুরু। তার আগে তেমন কোন ধারাবাহিকতার সন্ধান মেলে না, যা দিয়ে একটি ক্রমবিন্যাস করা সম্ভব। তার প্রধান কারণ জাতীয়তাবোধের উন্মেষে সংগীতের ক্ষমতার সম্ভাব্যতার কথা তখনো তেমন করে উপলব্ধি করা যায়নি।’ [মুক্তির গান, বিনোদন সংখ্যা দেশ পত্রিকা, ১৯৮৪, কলকাতা]।
হিন্দুমেলার উদ্ভব ঘটেছিল রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-১৮৯৯) এক বক্তৃতার একটি প্রস্তাবের সূত্র ধরে। প্রস্তাবটি ছিল ‘শিক্ষিত বঙ্গবাসিগণের মধ্যে জাতীয় গৌরবেচ্ছা-সঞ্চারিণী সভা’ সংস্থাপনের। বক্তৃতায় তিনি একটি সংগীতবিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, যে সংগীতে শিক্ষার্থীদের ‘অন্তঃকরণে দেশহিতৈষিতা ও সমরানুরাগের সঞ্চার হইতে পারে’। প্রস্তাবটি বাস্তবায়নকল্পে নবগোপাল মিত্র (১৮৪০-১৮৯৪) ‘চৈত্রমেলা’ নামে একটি জাতীয় মেলার সূচনা করেন, পরে যার নাম হয় ‘হিন্দুমেলা’।
এই মেলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুড়তুতো ভাই গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯)। নতুন উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ এই হিন্দুমেলাকে উপলক্ষ করেই স্বদেশি গান রচনার সূত্রপাত ঘটে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই নবচেতনার গান রচনার যেন একটা ধুম পড়ে যায়। তার মধ্যে সম্পাদক রচিত একটি স্বদেশি গান বেশি খ্যাতি পায়, ‘লজ্জায় ভারতযশ গাইব কি করে’। তাঁর মৃত্যুর পর সম্পাদক হন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। প্রকৃতপক্ষে সহসম্পাদক নবগোপালবাবুই ছিলেন হিন্দুমেলার সংগঠনপ্রধান এবং সর্ব অর্থেই এর প্রাণপুরুষ। জাতীয়তার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশব্রতী এই নিবেদিতচিত্ত কর্মীকে লোকে ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’ নামে ডাকত, কারণ তিনি তাঁর সব সংগঠনের বিশেষণরূপে ‘ন্যাশনাল’ কথাটি ব্যবহার করতেন, ‘ন্যাশনাল পেপার’, ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’, ‘ন্যাশনাল স্কুল’ ইত্যাদি।
১৮৬৮ সালে হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে গীত হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩) রচিত: ‘মিলে সবে ভারত সন্তান/ এক তান মনপ্রাণ/ গাও ভারতের যশোগান।/... হোক ভারতের জয়/ জয় ভারতের জয়,/ গাও ভারতের জয় \/’। তবে সেকালের সর্বজনপ্রিয় স্বাধীনতার গানরূপে পরিচিতি পায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭) ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/ কে বাঁচিতে চায়?/ দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে/ কে পরিবে পায়?’।
১৮৭৫ সালে নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখলেন, ‘চাহি না স্বর্গের সুখ নন্দন কানন/ মুহূর্তেক পাই যদি স্বাধীন জীবন।/। শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) লিখলেন, ‘উঠ জাগো শ্রমজীবী ভাই।/ উপস্থিত যুগান্তর,/ চলাচল নারীনর/ ঘুমাবার বেলা আর নাই/’। ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটি। ১৮৯৮ সালে বীণাবাদিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) রচিত ‘চলের চল্ সবে ভারতসন্তান/ মাতৃভূমি করে আহ্বান/...দলাদলি সব ভুলি।/ হিন্দুমুসলমান/ এক পথে এক সাথে চল্/ উড়াইয়ে একতা নিশান/’।
এভাবে ক্রমান্বয়ে দেশাত্মবোধক গানের প্রসঙ্গ ভারতবর্ষের বৃহত্তর প্রাঙ্গণ থেকে একান্ত হয়ে এসে পড়ল বঙ্গদেশের নিজস্ব অঙ্গনে—১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন উপলক্ষে। বস্তুত দেশাত্মবোধক গানের উন্মেষ হিন্দুমেলার যুগে হলেও তার সার্থক বিকাশ ঘটেছে বঙ্গভঙ্গের যুগে। প্রথম যুগে প্রকাশ পেয়েছিল জাতীয় ভাবনা আর দ্বিতীয় যুগে স্বদেশচেতনা নিছক ভাবানুভূতির সংকীর্ণ পরিমণ্ডল ছাপিয়ে রূপান্তরিত হলো দেশসেবার বাস্তবিক কর্মপ্রেরণায়। এই ধারাটির অনুসরণেই কালে কালে ‘অসহযোগ’, ‘আইন অমান্য’ প্রভৃতি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করল জাতীয় আন্দোলন।
এ পর্বের স্বদেশি গানগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনে বাঙালিকে শক্তি জুগিয়েছে। এ পর্যায়ে দেশপ্রেম হলো কর্মসাধনার অঙ্গ। সে কর্মসাধনা প্রেরণা পেল ইংরেজ-পাকিস্তানিদের মতো বিদেশি শাসকের প্রতি ক্রমবর্ধিষ্ণু বিদ্বেষ থেকে। এই পর্বটি থেকেই দেশগান হতে থাকল দখলদার বিতাড়নের হাতিয়ার, তার জন্য শোষক-শাসক নিধনেরও। স্বদেশি আন্দোলনের যুগের দেশাত্মবোধক গানের নিয়ামক চিন্তা-চৈতন্য ছিল—একতা, সক্রিয়তা, স্বনির্ভরতা, দেশমাতৃকার প্রতি গভীর ভক্তি এবং প্রত্যক্ষ আত্মীয়তাবোধ-সম্পর্কিত।
মধ্য-ঊনবিংশ শতক থেকে মধ্য-বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল হিন্দুস্থানি সংগীতচর্চার স্বর্ণপর্বটি, যার কেন্দ্র ছিল কলকাতা—যে শহরের স্বীকৃতিকে হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠতম উস্তাদও তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি জ্ঞান করতেন। হিন্দুস্থানি সংগীত-প্রভাবিত এমনি পরিবেশেই আবির্ভাব এবং তিরোভাব ঘটে বাংলা গানের ভুবনের আলোকস্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১)। স্বভাবতই, শক্তিশালী হিন্দুস্থানি সংগীতের এহেন সর্বগ্রাসী প্রভাববলয়ের ভেতর বাংলা গানের স্বাভাবিক বিকাশের বিষয়ে বিশেষ চিন্তান্বিত হয়েছিলেন বাংলা গানের ভুবনের এই পুরোধাপুরুষ। হিন্দুস্থানি সংগীত কেবল প্রশিক্ষিত জনের গাওয়ার এবং শোনার। প্রতিপক্ষে বাংলা গান সবার গান। সে জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানকে ওস্তাদিমুক্ত রেখেছেন, যাতে এ গান সবাই গাইতে পারে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে, হাটে বাটে মাঠে ঘাটে।
মহাবাগেগয়কারের এই কথাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা গান সবার মনের কথার গান, পদের গান, পদাবলীর গান। এ গানের প্রথম প্রবল প্রবাহটি ছিল কীর্তনের—ষোড়শ শতকের নামকীর্তন, লীলাকীর্তন, রসকীর্তনের। সেই সর্বপ্রথম বাংলার জনসাধারণ গানে গলা মেলাবার একটি জায়গা পেয়েছিল। তেমনি জোরদার আরেকটি প্রবাহ এসেছিল তার ৩০০ বছর পরে—বাঙালির মুক্তির গানে। এখানেও সমবেত কণ্ঠে গলা মেলাবার জায়গা পেয়েছিল বাংলার সর্বস্তরের জনগণ। এ অবকাশটির সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকের ষাটের দশকের কলকাতায়, ‘চৈত্রমেলা’র সূচনায়।
অলৌকিক আলোকে উদ্ভাসিত এবং অলোকসামান্য প্রতিভার তারকাখচিত সেই হিন্দুমেলার উৎসমুখস্বরূপ রাজনারায়ণ বসুর ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা-সঞ্চারিণী সভা’ ও ‘একটি সংগীতবিদ্যালয় স্থাপনের, যে সংগীতে শিক্ষার্থীদের অন্তঃকরণে দেশহিতৈষিতা ও সমরানুরাগের সঞ্চার হইতে পারে’—এই প্রস্তাব দুটিতে যেন বীজই বপিত হয়েছিল বাঙালির মুক্তির গানের, যে গান অদ্যাবধি চলমান; হয়তো চলতেই থাকবে সত্যিকারের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত।
বিপর্যয়বোধ ছাড়া দেশাত্মবোধক গানের আরেক অগ্নিঝরা উৎস প্রত্যক্ষ আঘাত। যেমন—১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আঘাতে বাঙালি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে উঠেছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে স্বদেশচেতনা রূপান্তরিত হলো দেশসেবার বাস্তবিক কর্মপ্রেরণায়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর দেশাত্মবোধক গানের প্রবাহে ভাটার টান পড়ে। সে স্তিমিত পর্বে দেশগানের ক্ষেত্রে প্রধান দুই ব্যক্তিত্ব ছিলেন লোককবি রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭) আর চারণকবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪)।
অবশ্য পরের দশকের প্রথমার্ধেই আবির্ভূত হন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) মুক্তির গানের উদ্দীপনাসঞ্চারী নতুন ধারা নিয়ে, স্বদেশি আন্দোলনের অংশী হয়ে। বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী শ্রেণীর জাগরণী গানের মাধ্যমে তিনি যেন বিশের দশকেই অগ্রিম সংবাদ দিচ্ছিলেন গণসংগীতে উত্তাল চল্লিশের দশকের। গণসংগীতের সেই প্রবল জোয়ারটি এসেছিল ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন ওরফে ‘আইপিটিএ’র গণমুখী সাংস্কৃতিক তৎপরতায়। ওটি ছিল ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী ভূমণ্ডলীয় আন্দোলনের ইন্ডিয়ান চ্যাপ্টার। অবিস্মরণীয় সেই সংগীতপর্বের মুখ্য কথাকার, সুরকার ও রূপকার ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৯১১-১৯৭৭), হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭), বিনয় রায় (১৯১৮-১৯৭৫), সলিল চৌধুরী (১৯২২-১৯৯৫) প্রমুখ। দেশাত্মবোধক গণসংগীত আন্দোলনের চল্লিশের দশকটিকে যেন রবীন্দ্র-নজরুলখচিত তিরিশের দশকের চেয়েও উজ্জ্বল প্রতিভাত হয়।
বঙ্গভঙ্গের আঘাত খেয়ে বাঙালি যেমন দেশাত্মবোধক গান গেয়ে উঠেছিল ১৯০৫ সালে, তেমনি উর্দু ভাষার মার খেয়ে বাংলা ভাষার গান গেয়ে উঠল ১৯৫২ সালে। অবশেষে একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ বেধে গেলে, তাতে বাঙালির শতবর্ষের পুঞ্জীভূত মুক্তির গান কামানের সমান ভূমিকাই পালন করেছিল।
বিপর্যয় যেহেতু বাঙালির নিত্যসঙ্গী, মুক্তির গান সে গেয়েই চলেছে অদ্যাবধি। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩০ বছর পরও স্বাধীনতাকে খুঁজে না পেয়ে বাংলাদেশের পপগায়ক হায়দার হোসেন তাঁর ২০০৫ সালের একটি অ্যালবামের নাম দিয়েছেন ফাঁইস্যা গেছি। মানে গায়ক ফেঁসে গেছেন। তাই তিনি গাইছেন:
কী দেখার কথা কী দেখছি
কী শোনার কথা কী শুনছি
কী ভাবার কথা কী ভাবছি
কী বলার কথা কী বলছি
তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি \
হায়দার হোসেনের মতো ‘ফাঁইস্যা’ গেছে আজ এ দেশের আপামর জনসাধারণও। তাই এবার চাই জনগণের উত্তরণের গান।
No comments