বইমেলা, মেধাস্বত্ব ও লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক by মুহম্মদ নূরুল হুদা


অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবার চতুর্থ পর্যায়ে প্রবেশ করছে। বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক ছিল সূচনা পর্যায়, আশির দশক বিধিবদ্ধ নীতিমালার পর্যায়, নব্বই দশক তুলকালাম ভেতর-বাহির আসা-যাওয়ার পর্যায়, আর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষপ্রান্তে এসে মেলা পদার্পণ করছে স্থায়ী সম্প্রসারণের পর্যায়ে।
জানা গেছে, এবারের মেলা আয়োজিত হবে একাডেমীর ভেতরে, রাস্তায় আর সন্নিহিত উদ্যানে। এর ফলে মেলার কোনো অঙ্গহানি হবে বলে মনে করি না। আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে স্বেচ্ছাশৃঙ্খলাও বেড়েছে বহুগুণ। কাজেই এবারের মেলার সাংগঠনিক সাফল্য সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। দুশ্চিন্তা কেবল সত্ সৃষ্টি, সত্ প্রকাশনা, সত্ পরিবেশনা, সত্ বিক্রি ও সততার সঙ্গে মেধাস্বত্বের প্রয়োগ নিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে আমরা বহু কথা বলেছি। কোনো লাভ হয়নি। কাজেই পুনরুক্তির মতো শোনালেও কিছু কথা আবার বলতে হচ্ছে। প্রথম কথা বই প্রকাশনা। গত কয়েক বছরে এই মেলায় গড়ে প্রায় তিন হাজারের মতো বই প্রকাশ হচ্ছে। এর অধিকাংশ যথার্থ অর্থে বই নয়। টাকা থাকলেই একজন ব্যক্তি গদ্যে বা পদ্যে তিন ফর্মার একটি বই ছেপে গ্রন্থকার হয়ে যাচ্ছেন। কেউ অন্যের রচনা সঙ্কলন করে নিজের নাম গ্রন্থকার হিসেবে ছেপে দিচ্ছেন। তারপর গ্রন্থমেলায় একজন প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকের দ্বারস্থ হয়ে মোড়ক উন্মোচন করে সাহিত্যিক অভিধা গ্রহণ করছেন। এই প্রবণতাকেও ন্যূনতম নিয়মের মধ্যে আনা জরুরি। মোড়ক উন্মোচনের সম্মতি ও ঘোষণা দেয়ার আগে কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বইটির গুণাগুণ প্রাথমিকভাবে বিচার করে দেখতে পারে। আর এজন্য বইটি কমপক্ষে তিন দিন আগে জমা দেয়ার বিধান রাখা যেতে পারে। যতই অপ্রিয় হোক, এর মাধ্যমে মেলায় প্রকাশিত প্রমিত গ্রন্থসমূহের একটি তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। আসলে মেলায় প্রকাশিত ও বিক্রয়যোগ্য প্রতিটি নতুন গ্রন্থ একাডেমী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার বিধান মেলার নীতিমালায় রাখা ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যুক্তিযুক্ত। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও বইটির মৌলিকতা নির্ণয়েও এটি জরুরি। এটি করা সম্ভব হলে মেলায় অবৈধ ও বিদেশি বইয়ের অননুমোদিত বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। তারপরের চিন্তা লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক। বাংলাদেশের জনপ্রিয় অধিকাংশ লেখকের সঙ্গে প্রকাশকদের সম্পর্ক ভালো। সেক্ষেত্রে প্রকাশকরাই অগ্রণী হয়ে লেখকদের বাড়িতে ধরনা দিয়ে থাকেন। পদাসীন, ক্ষমতাবান ও আমলা লেখকদের সঙ্গেও প্রকাশকরা মেয়াদি সম্পর্ক ভালোভাবে বজায় রাখেন। যারা নিজের পয়সা খাটিয়ে প্রকাশকদের দিয়ে বই প্রকাশ করেন তাদের সঙ্গে প্রকাশকদের সম্পর্ক মিশ্র। অধিকাংশ প্রকাশক বই ছেপে কথামত লেখককেই বই সরবরাহ করেন। বাকি সামান্য সংখ্যক বই নিজ প্রকাশনার তালিকা দীর্ঘ করার ক্ষেত্রে কাজে লাগান। কেউ কেউ লেখককে যত্সামান্য বই সরবরাহ করে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বিদেশবাসী লেখকদের ক্ষেত্রে এমনটি বেশি হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তবে সবচেয়ে অবমাননাকর অবস্থার সম্মুখীন বৃহত্ সংখ্যক নিরীক্ষাপ্রিয় ও মৌলিক লেখক, যারা পাঠকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার ধার ধারেন না। প্রকাশকরা অনুগ্রহ করে তাদের পুস্তক প্রকাশ করে নিজেদের ইমেজ বাড়ালেও তাদের সঙ্গে সম্মানজনক চুক্তি সম্পাদন ও রয়্যালটি প্রদানে অনীহ। এরাই চরম দুর্ভোগের শিকার। আমাদের সমাজে এখনও ষাটোর্ধ্ব অনেক মৌলিক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাদের রচনাসংগ্রহ বা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশকদের আনুকূল্যে প্রকাশিত হয়নি। অথচ দেখা যায়, মৃত্যুর পর হঠাত্ করেই তাদের বই প্রকাশে কিছু কিছু প্রকাশক উত্সাহী হয়ে ওঠেন। আমাদের একজন প্রতিভাবান ষাটোর্ধ্ব কবি সানাউল হক খানের কাব্যসমগ্র এখনও কোনো প্রকাশক প্রকাশ করার আগ্রহ দেখাননি বলে জেনেছি। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি দেয়া যাবে। স্বীকার্য, প্রকাশক নিশ্চিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কোনো বই প্রকাশ করবেন না। আমাদের অধিকাংশ প্রকাশকরা তাত্ক্ষণিক কাউন্টার বিক্রি ছাড়া উন্নততর পরিবেশনা প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষিত নন। ফলে নতুন বা অজনপ্রিয় মৌলিক লেখকের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা অনাগ্রহী। তবে ব্যতিক্রম আছেন ঐতিহ্যবাহী প্রকাশকরা। তাদের ভেতর আদর্শস্থানীয় ব্যক্তির নাম স্বর্গত চিত্তরঞ্জন সাহা বা মহিউদ্দিন আহমদ, যারা তাদের প্রতিটি প্রকাশনার জন্য সংশ্লিষ্ট লেখকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের আরও অনেকের নাম করা যেতে পারে, যারা মেধাস্বত্ব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে বই মেধাস্বত্ব মেনে লেখা হয়নি সেটি যেমন পাইরেটেড বই, তেমনি যে বই মেধাস্বত্বের সংশ্লিষ্ট বিধান মেনে প্রকাশিত হয়নি সেটিও পাইরেটেড বই। প্রথম ক্ষেত্রে দায়ী স্বয়ং লেখক, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রধানত প্রকাশক। বাংলা একাডেমী আয়োজিত আমাদের সৃষ্টিশীলতার এই মহান মিলনমেলাকে পাইরেসি বা মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের দায় থেকে মুক্ত করতে হলে লেখককে লিখতে হবে তার মৌলিক বই আর প্রকাশককে প্রকাশ করতে হবে লিখিতভাবে সম্পাদিত চুক্তিভিত্তিক বই। সেই চুক্তির ভারসাম্যময় শর্ত কী হবে তা নির্ধারণ করবেন সংশ্লিষ্ট লেখক-প্রকাশক। ভারসাম্যহীন একপাক্ষিক চুক্তিও আইনের চোখে নিপীড়নমূলক বিধায় অগ্রহণীয়। চুক্তির নমুনাও বাংলা একাডেমী থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমাদের প্রকাশনা শিল্পের কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের এই সন্ধিক্ষণে প্রকাশনাকে আনুষ্ঠানিক শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে লেখক প্রকাশক সুষম চুক্তিসম্পাদনের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে করি না। আমাদের জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে সজাগ বলেই জানি। তাই এবারের বইমেলায় পাইরেসিবিরোধী টাস্কফোর্স সক্রিয় থাকুক আর লেখক-প্রকাশক ভারসাম্যময় সম্পর্কের মাধ্যমে মেলা একটি দৃষ্টান্তশীল ও মেধাস্বত্ববান মেলা হয়ে উঠুক।

লেখক : কবি; প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব

No comments

Powered by Blogger.