প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে দুটি কথা by ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর শেষ করেছেন গত বুধবার। প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে নিজেই বলেছেন, এ সফর ‘সফল’ হয়েছে। এ সফর সফল হয়েছে কী ব্যর্থ হয়েছে, এ বিতর্কে আমি যাব না। এ দেশের মানুষই বিচার করবে এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সফলতা কতটুকু অর্জিত হলো।
সে জন্য আমাদের কিছুদিন অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। যেমনটি আমরা অপেক্ষা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে (সপ্তম জাতীয় সংসদ) আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। আর ওই বছরের ডিসেম্বরেই প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন নয়াদিল্লিতে, স্বাক্ষর করেছিলেন ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বলা হয়েছিল ওটা ছিল নাকি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন! সাফল্যের কথা ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে, ওই চুক্তি অনুযায়ী যে পানি পাওয়ার কথা তা আমরা পাচ্ছি না। গত কয়েক বছর কেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পরের বছর থেকেই আমরা পানি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বার বার বলা হচ্ছিল চুক্তির সাফল্যের কথা। এমনকি সাবেক বিতর্কিত ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও বলেছিলেন, চুক্তির চেয়েও অতিরিক্ত পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। হায়রে কূটনীতি! মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে যে বিভ্রান্ত করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন ভারতীয় ওই কূটনীতিক। পদ্মা এখন শুকিয়ে মরা খাল। পদ্মার বুকে শুধু ধু ধু বালুচর। প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে তার সফরের ‘সাফল্যের’ খবর যখন সবাইকে জানাচ্ছিলেন এবং যার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল (১৪ জানুয়ারি), ঠিক একই দিন দৈনিক আমার দেশ’র ১১নং পাতায় ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ ‘এবারও বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না’। একটি ছবিও আছে। তাতে বলা হয়েছে, পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পানি নেই। অথচ এই পানির জন্যই আমরা চুক্তি করেছিলাম। এবারও করলাম ৩টি চুক্তি ও দুটি সমঝোতা স্মারক এবং সেই সঙ্গে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকটি প্রতিশ্রুতির কথা। চুক্তি হতেই পারে। একটি দেশ অপর একটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চুক্তিটি করা হয় তখনই, যখন ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে। কিন্তু সেই স্বার্থ রক্ষিত হয়নি—আমরা পানি পাইনি। আজ আমরা আবারও চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রতিশ্রুতি দিলাম—আমাদের স্বার্থ কি রক্ষিত হবে? এ প্রশ্ন উঠেছে এরই মাঝে এবং আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা তিনটি চুক্তির বিনিময়ে অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছি ভারতের কাছ থেকে। যেমন ১. ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ দেয়া হবে, ২. মার্চে জেআরসির বৈঠক বসবে ও তিস্তা নিয়ে কথা হবে, ৩. ভারত নদী খননে ড্রেজার দেবে ও বেশ কয়েকটি নদী খননে সহায়তা করবে। এ খাতে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়া হবে, ৪. ফ্লাইওভার নির্মাণ করে দেয়া হবে ইত্যাদি।
২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ পেলে আমাদের জন্য ভালো, পরিমাণ যাই থাকুক না কেন। প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এর বিনিময়ে আমরা কী দিচ্ছি? কবে থেকে এ বিদ্যুত্ আসবে, এর দাম কী হবে, সঞ্চালন লাইন কে নির্মাণ করবে, যখন-তখন ভারত এ বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে কিনা—এসব প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠেছে। বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যাপারে যখন চুক্তি হবে, এসব বিষয় যেন বিবেচনায় নেয়া হয়। এ মুহূর্তে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর অন্য কোনো রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে দেয়ার সুযোগ নেই। নদীর নাব্যতা বাড়ানো, বন্দরের সম্প্রসারণ, অবকাঠামোগত সুবিধা ইত্যাদি না বাড়িয়ে ভারতকে এ বন্দর ব্যবহার করতে দিলে এখানে ‘কনটেইনার জট’ একটি মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করবে। এতে করে আমাদের রফতানি পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা অন্যদেশে চলে যাবে। আমরা ক্রেতা হারাবো। পরিণামে তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে সামাজিক সঙ্কট। এ ব্যাপারে অবিলম্বে তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমাদের রফতানির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। সে ক্ষেত্রে মংলা বন্দরের নাব্যতার কারণে যেহেতু বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না, সেহেতু ভরসা একমাত্র চট্টগ্রাম বন্দর। তাও যদি এখন ভারতীয় কনটেইনারে জট লেগে থাকে তাহলে আমাদের রফতানি ঝুঁকির মুখে থাকবেই। বিশ্বায়নের নামে দ্বিতীয় কোনো দেশকে আমরা আমাদের বন্দর উন্মুক্ত করে দিতে পারি না। আমাদের দেখতে হবে আমাদের স্বার্থ।
তিস্তার পানিবন্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য জরুরি ছিল। কিন্তু দুই প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো কথা বললেন না। তিস্তার পানিবণ্টন আমাদের জন্য খুবই জরুরি। তিস্তার পানি প্রবাহ এ যাবত্কালের সবনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন ১০ হাজার কিউসেক পানি, সেখানে শুধু ব্যারাজ এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪৫০ থেকে ২ হাজার ৭০০ কিউসেক। সংবাদপত্রগুলোই আমাদের জানাচ্ছে, মরে যাচ্ছে তিস্তা। গজলডোবায় ভারত বাঁধ নির্মাণ করে (১৯৭৭) পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। একটি সংবাদপত্র আমাদের জানাচ্ছে, গজলডোবা ব্যারাজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেয়া হয়, তা যখন প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে পৌঁছে, তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে (কালের কণ্ঠ, ১০ জানুয়ারি, ২০১০)। প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই জাতীয় স্বার্থের কথা বলেন। তিস্তার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে, এটাই আশা করি। শুধু ‘ফটো সেশন’র জন্যই মার্চে জেআরসির সভা হবে, আমরা তা চাই না। আমরা চাই, ভারতের আন্তরিকতা। এ আন্তরিকতার বড় অভাব ভারতের। ভারত তার নিজের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। ৮০ লাখ পিস শার্ট কিনবে বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন। সে কথা ভারত রাখেনি। ভারত কথা দিয়েছিল বিএসএফ আর সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করবে না। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন নয়াদিল্লিতে তখন বেনাপোল সীমান্তে মারা গেল আরও একজন বাংলাদেশী। ভারত এবারও তার কথা রাখেনি।
শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমাবে বলে ভারত বার বার বলে আসছে। কিন্তু সে বাধা কমানোর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে বাণিজ্যিক ব্যবধান বাড়াচ্ছে, যাতে করে এ ব্যবধানকে দেশটি তার ‘রাজনৈতিক স্বার্থে’ ব্যবহার করতে পারে। আমাদের জীবনমরণ সমস্যা টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়ে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কি বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন? তিনি তো তা দেননি। তাহলে? ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কি কালক্ষেপণ নয়? সমুদ্রসীমা, মুহুরীর চর, লাঠিটিলা ও দইখাদা সীমান্ত সমস্যা নিয়েও কোনো কথা শুনলাম না ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে। ৫১ ছিটমহল নিয়েও কোনো কথা হলো না। কথা হয়নি তালপট্টি নিয়েও। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেননি? এসব প্রতিটি বিষয় আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এতে করে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে, আমাদের স্বার্থ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হলো না। বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করা হলো না। এমনকি বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেয়া হলো না। এখন যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং যেসব সমঝোতা ও প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি, তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হোক। এর চুলচেরা বিশ্লেষণ হোক। আমরা চাই, বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে তাদের মতামত রাখুক। কারণ, আমরা মনে করি জাতীয় সংসদই সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এ কথাই বলে। এখন জাতীয় সংসদকে উপেক্ষা করে চুক্তি করা, নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। ভারতের সঙ্গে শুধু সম্পর্কই নয়, আমাদের বন্ধুত্বও দরকার। কিন্তু এ বন্ধুত্ব যেন ‘একপক্ষীয়’ না হয়। আমরা যেন আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভুলে না যাই। তাই জাতীয় সংসদে চুক্তি নিয়ে আলোচনা ও ডিবেট হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারি দল যদি এ কাজটি করে, তাতে করে শুধু বিরোধী দলকে সংসদে ফিরে আসতেই তা সাহায্য করবে না; বরং সরকারের স্বচ্ছতাও নিশ্চিত হবে।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল: tsrahmanbd@yahoo.com
No comments