বিক্ষোভ দমন-তখনো পুলিশ এখনো পুলিশ by এ কে এম জাকারিয়া

আজকের দুনিয়ায় অধিকারের বিষয়টির মধ্যে একটি ভাগাভাগির ব্যাপার আছে। সবারই যেহেতু নানা অধিকার আছে, সুতরাং তা ভাগাভাগি না করে আর উপায় কী! সভ্যতার এই নিয়ম। বিক্ষোভের অধিকার যেমন আমরা মেনে নিয়েছি, আবার পুলিশ সেই বিক্ষোভ কীভাবে ঠেকাবে, তার কিছু নিয়ম বা বিধিবিধানও ঠিক করা আছে। এসব এক দিনে হয়নি।

বিক্ষোভ আর তা ঠেকাতে পুলিশ—নানা সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। নিয়মকানুন বা বিধিবিধানগুলোও গড়ে উঠেছে এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে।
ষাট ও সত্তরের দশকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পশ্চিমা সমাজের জেগে ওঠা মধ্যবিত্ত জনগণের নানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঘটনাগুলো আধুনিক যুগে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তখন সংঘাত ও সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, পরমাণু অস্ত্র বা বর্ণবাদের বিরোধিতা, আদিবাসীদের অধিকার, নারী অধিকার—এসব নিয়ে সহিংস বিক্ষোভের ঘটনাগুলোর পর সমাজে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে। কীভাবে বিক্ষোভ বা সহিংসতা দমন করা হবে, পুলিশের আচরণ কী হবে, সে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে থাকে। বিষয়টি এখন আর বিক্ষোভ দমন নয়, পুলিশের ভূমিকা বরং বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে সহায়তা করা। বিক্ষোভ যাতে কোনোভাবেই সহিংস হয়ে উঠতে না পারে, সে চেষ্টা করা, প্রয়োজনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নানা কৌশল নেওয়া ও যেকোনো উপায়ে সমঝোতার চেষ্টা করা। আর সব শেষ উপায় হচ্ছে শক্তি ব্যবহার করা। আর এ ক্ষেত্রে কতটা কম শক্তি ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, সেটাই হচ্ছে পুলিশের জন্য বড় পরীক্ষা।
বিক্ষোভ ও বিক্ষোভ দমন এবং পুলিশের ভূমিকা—এসব নিয়ে এত কথা বলার মূল বিষয়টি পাঠকদের কাছে নিশ্চয়ই পরিষ্কার। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা দুই দিনের হরতাল শুরুর দিনে পুলিশের নিষ্ঠুর লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। পুরো ঘটনার দৃশ্য বিভিন্ন টিভিতে দেখা গেছে। কোনো কোনো টিভি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে ঘটনার শুরুর পর্ব, যেখানে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের সঙ্গে পুলিশের তর্ক-বিতর্ক (গালিগালাজও বটে) ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো টিভি গুরুত্ব দিয়ে দেখিয়েছে পরের পর্বের ওপর, যেখানে পুলিশ বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়েছে অনেকটা গণপিটুনির মতো। আমাদের দেশে জনতা মাঝেমধ্যে যেভাবে অপরাধীদের পেটায়, অনেটা সেভাবে। যাঁরা বিভিন্ন টিভিতে দুটো পর্বই দেখেছেন, তাঁরা এটা মানবেন যে প্রথম পর্বের ঘটনা দ্বিতীয় পর্বকে কোনোভাবেই জায়েজ করে না। দ্বিতীয় পর্বে পুলিশ যে আচরণ করেছে তা প্রথম পর্বের প্রতিক্রিয়া, প্রতিহিংসার মার। পুলিশ কি এ ধরনের আচরণ করতে পারে?
একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রে সূচক হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। সাধারণভাবে বলা হয় যে উদার গণতন্ত্রে বিরোধী পক্ষকে অনেক সহনশীলভাবে মোকাবিলা করা হয় আর কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় বিরোধী পক্ষকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জয়নুল আবদিন ফারুকের প্রতি সেদিনের পুলিশের আচরণটি কি একজন অপরাধীর প্রতি পুলিশের যে আচরণ, অনেকটা সে রকম নয়? আর অপরাধীর প্রতি ক্ষুব্ধ জনগণ মাঝেমধ্যে গণপিটুনি বা এ ধরনের যে আচরণ করে, পুলিশ কি সেই একই কাজ করতে পারে? নিয়ন্ত্রণহীন জনগণ আর প্রশিক্ষিত পুলিশের মধ্যে তবে পার্থক্য থাকল কোথায়?
কোনো বিক্ষোভের ঘটনার সময় বিশেষ কাউকে বিপজ্জনক মনে হলে তাঁকে টার্গেট করা ও নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা বিক্ষোভ দমনের একটি স্বীকৃত পথ। আমরা যদি ধরে নিই সেদিন পুলিশের দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তিটি ছিলেন জয়নুল আবদিন ফারুক। তবে এভাবে পিটুনি না দিয়ে বা প্রতিহিংসার প্রকাশ না ঘটিয়ে তাঁকে সামাল দেওয়ার কোনো কৌশল বা পথ কি পুলিশের ছিল না? যদি সেটা না থাকে তবে পুলিশের দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফারুকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অ্যাকশনে যাওয়ার আগে পুলিশের এটা মনে রাখা উচিত ছিল যে, কোনো বিক্ষোভকারী যখন আইন ভাঙেন, তখনো তাঁর আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে, আর সেই সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ সেদিন আইন ভেঙেছেন—সরকার ও পুলিশের এই দাবি যদি আমরা মেনে নিই তবে বলতে হয় যে ‘আইন ভঙ্গকারী’ বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পুলিশ আইনের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০০৫ সালে পুলিশের একই ধরনের পিটুনির শিকার হয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট। এখন জয়নুল আবদিন ফারুককে যখন পেটানো হয়, তখন বিষয়টিকে কি আমরা শুধু পুলিশের ব্যর্থতা হিসেবে দেখব? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কি কোথাও কাজ করেনি? সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু পুলিশ নাকি বদলায় না। কীভাবে বদলাবে পুলিশ? সরকারের হয়ে ২০০৫ সালে যে কাজ করতে হয়েছিল, এখনো যে সেই একই কাজ করতে হচ্ছে। হায় পুলিশ!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.