অরণ্যে রোদন-তারপর থাকে শুধু অন্ধকার by আনিসুল হক
মহাজোট সরকার তার ক্ষমতারোহণের মাত্র আড়াই বছরের মাথায় উপর্যুপরি হরতাল ডেকে আনল কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি, কাজেই সরকার চাইলেই সময় নিতে পারত, সংবিধানের যে সংশোধনী সরকার এখন করেছে, সেটা তারা আরও দুই বছর পরও করতে পারত।
সে ক্ষেত্রে আজকের এই হরতাল-আন্দোলনের মুগুরাঘাত থেকে জনগণ অন্তত দুটো বছরের জন্য মুক্ত থাকত। এখন বিরোধীরা যে আন্দোলন শুরু করেছে, তা আগামী আড়াই বছর ধরেই চলবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সরকারের এই তাড়াহুড়োর কারণ কী? বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতার চেষ্টা না করে, জনগণকেও প্রস্তুত না করে হঠাৎ সংসদের বাজেট অধিবেশনেই কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হলো?
নীতিনির্ধারকদের মুখের কথা আমরা জানি, যেহেতু মহামান্য আদালত বলেই দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ, কাজেই অবৈধ জিনিসকে আর বয়ে বেড়ানো কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগে সংবিধানবহির্ভূত শক্তি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে, ১১ জানুয়ারির তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা দুজনকেই কারাবাসের অভিজ্ঞতা দিয়েছে এবং ব্যবসায়ীরাও ওই আমলে ভুগেছেন সবচেয়ে বেশি, কাজেই ওই ফাঁকটা যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, পূরণ করে দেওয়াই মঙ্গলজনক। এসব কথা আমরা এরই মধ্যে শুনে ফেলেছি। কিন্তু এর বাইরে আর কী কারণ থাকতে পারে যে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিনবদলের সরকার জনগণের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখবিষয়ক সমস্যাগুলোর চেয়ে আড়াই বছর পরের বিষয়টাকে এই মুহূর্তের যন্ত্রণা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিল?
এর কারণ আমরা খুঁজে দেখতে পারি। সে জন্য আমাদের ঘটনাবলির বিশ্লেষণে যেতে হবে। ১. ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ও প্রশাসনের উচ্চমহলের কেউ কেউ জড়িত, সর্বশেষ অভিযোগপত্রে সেটা প্রতিফলিত। ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলে দেওয়া চার্জশিটেও জজ মিয়া নাটককে একেবারেই প্রহসন হিসেবে উন্মোচিত করা হয় এবং বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের কারও কারও যোগাযোগের কথা চলে আসে। এখন শেখ হাসিনা যদি বিশ্বাস করেন, বিএনপি কেবল তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, তারা এমনই শত্রু যে তাঁকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বোমা হামলা পর্যন্ত করতে পারে, তাহলে শেখ হাসিনার পক্ষে কি সম্ভব বিএনপির সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতার চেষ্টা করা? ২. শেখ হাসিনা এ কথা একাধিকবার বলেছেন যে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন কেবল লুটপাট হয়; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়। লক্ষণ দেখে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভালোর জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। এবং হয়তো তিনি এই রকমও ভেবে থাকতে পারেন, জনগণ সব সময় আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়, কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে সব সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারে না। কাজেই তিনি সেই চক্রান্ত চিরকালের জন্য নস্যাৎ করতে চান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীকালে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতে নিরীহ মানুষকে স্কেপগোট করার যে কাহিনি এই প্রথম আলোতেই আমরা পড়েছি, তাতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একই টেবিলে বসার মতো পরিস্থিতি শেখ হাসিনার আছে বলে আর মনে হয় না। এ অবস্থায় বিএনপি নামের প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করা, অকার্যকর করা, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তৃতীয় কোনো শক্তিকে দাঁড় করানোর চিন্তা আওয়ামী লীগ বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে থাকতে পারে। সেই চিন্তা কার্যকর করার একটা উপায় হলো, বিএনপিকে আগামী সাধারণ নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা। সেই লক্ষ্যেই সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে বিএনপি এবং সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ কি তা-ই চায় যে বিএনপি আগামী নির্বাচনের বাইরে থাকুক? প্রশ্ন হলো, তাহলে কি সেই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? বিএনপি ও তার মিত্ররা কি রাজপথে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবে না? ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো সেটা একতরফা। সুতরাং অগ্রহণযোগ্য, ভঙ্গুর সরকারের জন্ম দেবে না? এই সওয়ালের মীমাংসার জন্যই সম্ভবত সরকার তাড়াহুড়ো করে এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়েছে। এখনকার সরকার তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বৈধ সরকার। তার কবজিতে জোর আছে, বুকে হিম্মত আছে। কাজেই এখন বিরোধী দলের আন্দোলনকে সে শক্তিমত্তার সঙ্গে দমন করতে পারবে। আগামী আড়াই বছর ধরে ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে বিএনপি, এই বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকারি নীতিনির্ধারকদের সন্দেহ আছে। আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে, সে জন্য তারা কঠোর দমননীতির আশ্রয় যে নিয়েছে, টেলিভিশনের পর্দায় হরতালকারীদের ওপর পুলিশের লাঠ্যৌষধি প্রয়োগের নমুনা দেখেই তা প্রতীয়মান। বাংলাদেশে হরতাল করে কোনো বৈধ নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা যায়নি, আওয়ামী লীগ পারেনি বিএনপি সরকারকে উৎখাত করতে, বিএনপিও পারবে না আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে। এই আড়াই বছরে তাদের আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয়, পরবর্তীকালে নির্বাচন বর্জন করার পরে যখন সংসদেও তাদের কোনো আসন থাকবে না, তখন তারা আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে পড়বে বলে হয়তো সরকারি নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন। এবং এর মধ্য দিয়ে হয়তো তাঁরা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দেশের দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পাবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকায় মহাজোট সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে না। ফলে ইয়াজউদ্দিন সরকারের মতো দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার আসবে না। ২০০৬ সালে লগি-বৈঠা আন্দোলনের সময় বিএনপির সামনে দিন কমে আসছিল, তারা ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য দিন গুনছিল, কার হাতে ক্ষমতা দেবে, এটা ছিল তাদের মাথাব্যথা। ২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের সামনে সেই দুশ্চিন্তা থাকবে না। তারা কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন সমাধা করে ফেলবে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলন সহ্য করার চেয়ে এ মুহূর্তে বৈধ ও শক্তিশালী মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে আপাতত দুর্বল হতশক্তি বিএনপিকে আন্দোলনে নামিয়ে দিয়ে তার শক্তিক্ষয় ও বিনাশই হয়তো আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য।
এর বাইরে আর দুটো কারণ থাকতে পারে। সরকার যখন ভারতের সঙ্গে কোনো লেনদেন বা চুক্তিতে যায়, তখন বিএনপি তথা বিরোধী দলকে অন্য কোনো ইস্যুতে ব্যতিব্যস্ত রাখে। বেগম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ কিংবা ঢাকা বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল কুমিরকে বোকা বানানো, কুমির যাতে পা বাদ দিয়ে শেয়ালের লাঠিটাকে কামড়ে ধরে। হয়তো সরকার শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কোনো সমঝোতায় যাবে, কিন্তু তার আগে তাকে একটু ব্যস্ত রাখল। অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন, এ নিয়ে যেন বিরোধীরা কথা বলার সুযোগ না পায়, সেই পরিস্থিতি তৈরি করল।
এতক্ষণ আমরা যা আলোচনা করলাম, তার সবই অনুমান; এ মুহূর্তে আন্দোলন-হরতাল ডেকে আনার সরকারি উদ্যোগের কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা। আমাদের অনুমান সঠিক হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, তা হলো, আগামী আড়াইটা বছর আমাদের এই রকম হরতাল-আন্দোলন-বিক্ষোভ দেখে যেতে হবে। রাজপথে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হবেন বিরোধী দলের প্রধান হুইপ। হরতালের আগের দিন অনেক গাড়ি পোড়ানো হবে। ট্রাকে আগুন দেওয়া হবে মাত্র ১০০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, আর সর্বশরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে বার্ন ইউনিটে কাতরাবেন কোনো নিরীহ শ্রমিক। আম পচবে, তরিতরকারি পচবে ট্রাকে ট্রাকে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় অপূরণীয় ক্ষতি হবে দোকানমালিকের, কর্মচারীর, অর্থনীতির। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। গোলযোগের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে বাংলাদেশ। আর সত্যি সত্যি যদি সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না আসে, এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন যদি একপক্ষীয় হয়, তাহলে এক মাঘে শীত যাবে না। আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল চলবেই। সেই ভবিষ্যৎটা ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে, চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।
অথচ সরকার কিন্তু সুশাসন দিয়ে দেশটাকে উন্নতির দিকে নিয়ে গিয়ে জনগণের মন জয় করেই মানুষের কাছে ভোটপ্রার্থী হতে পারত। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। যানজট সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রের ব্যাপারে অন্তত একটা সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে। শুধু দলীয়করণ আর দুর্নীতি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীদের বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই সরকার হতে পারত আমাদের ইতিহাসের সফলতম সরকার। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে রাজপথকে শান্ত রাখা গেলে অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে এগোতে বাধ্য। শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয় সামলে নিতে পদক্ষেপ জরুরি ছিল। কিন্তু সরকার সুশাসনের দিকে জোর না দিয়ে বিরোধী দলকে দমন করার পেছনে শক্তি ব্যয় করছে বেশি। এর পরিণতি কী হবে, তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের দেশের নিয়ম হলো, রাজপথে প্রথম দিকে লোক থাকে না, আন্দোলন চলতে থাকলে আস্তে আস্তে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। আর আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার যত কঠোর হয়, তার জনপ্রিয়তা তত কমতে থাকে এবং সরকারও ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সরকার একটার পর একটা দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়, আর তার জনপ্রিয়তায় একটার পর একটা ধস নামে। তখন কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পেশাজীবী সমাজের স্বাধীন মত ও সমাবেশের ওপরও সরকার চড়াও হয়। সেটা কেবল রুদ্ধশ্বাস অগণতান্ত্রিক পরিবেশই তৈরি করে। তা থেকে উত্তরণের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তখন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
আমরা ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি চাই না। দিনবদলের কথা বলে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সত্যিকারের দিনবদল চাই। যেসব কথা রূপকল্প ২০২১-এ লেখা আছে, তার বাস্তবায়ন চাই। দলীয়করণ চাই না। নির্মম পুলিশি রাষ্ট্র চাই না। আমাদের নেতারা দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের নেতা হয়ে উঠুন, হয়ে উঠুন রাষ্ট্রনায়ক, আমরা কায়মনোবাক্যে সেই প্রার্থনা করি সর্বদা। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে অন্ধকার, নিকষ কালো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
নীতিনির্ধারকদের মুখের কথা আমরা জানি, যেহেতু মহামান্য আদালত বলেই দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ, কাজেই অবৈধ জিনিসকে আর বয়ে বেড়ানো কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগে সংবিধানবহির্ভূত শক্তি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে, ১১ জানুয়ারির তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা দুজনকেই কারাবাসের অভিজ্ঞতা দিয়েছে এবং ব্যবসায়ীরাও ওই আমলে ভুগেছেন সবচেয়ে বেশি, কাজেই ওই ফাঁকটা যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, পূরণ করে দেওয়াই মঙ্গলজনক। এসব কথা আমরা এরই মধ্যে শুনে ফেলেছি। কিন্তু এর বাইরে আর কী কারণ থাকতে পারে যে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিনবদলের সরকার জনগণের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখবিষয়ক সমস্যাগুলোর চেয়ে আড়াই বছর পরের বিষয়টাকে এই মুহূর্তের যন্ত্রণা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিল?
এর কারণ আমরা খুঁজে দেখতে পারি। সে জন্য আমাদের ঘটনাবলির বিশ্লেষণে যেতে হবে। ১. ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ও প্রশাসনের উচ্চমহলের কেউ কেউ জড়িত, সর্বশেষ অভিযোগপত্রে সেটা প্রতিফলিত। ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলে দেওয়া চার্জশিটেও জজ মিয়া নাটককে একেবারেই প্রহসন হিসেবে উন্মোচিত করা হয় এবং বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের কারও কারও যোগাযোগের কথা চলে আসে। এখন শেখ হাসিনা যদি বিশ্বাস করেন, বিএনপি কেবল তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, তারা এমনই শত্রু যে তাঁকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বোমা হামলা পর্যন্ত করতে পারে, তাহলে শেখ হাসিনার পক্ষে কি সম্ভব বিএনপির সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতার চেষ্টা করা? ২. শেখ হাসিনা এ কথা একাধিকবার বলেছেন যে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন কেবল লুটপাট হয়; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়। লক্ষণ দেখে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভালোর জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। এবং হয়তো তিনি এই রকমও ভেবে থাকতে পারেন, জনগণ সব সময় আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়, কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে সব সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারে না। কাজেই তিনি সেই চক্রান্ত চিরকালের জন্য নস্যাৎ করতে চান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীকালে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতে নিরীহ মানুষকে স্কেপগোট করার যে কাহিনি এই প্রথম আলোতেই আমরা পড়েছি, তাতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একই টেবিলে বসার মতো পরিস্থিতি শেখ হাসিনার আছে বলে আর মনে হয় না। এ অবস্থায় বিএনপি নামের প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করা, অকার্যকর করা, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তৃতীয় কোনো শক্তিকে দাঁড় করানোর চিন্তা আওয়ামী লীগ বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে থাকতে পারে। সেই চিন্তা কার্যকর করার একটা উপায় হলো, বিএনপিকে আগামী সাধারণ নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা। সেই লক্ষ্যেই সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে বিএনপি এবং সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ কি তা-ই চায় যে বিএনপি আগামী নির্বাচনের বাইরে থাকুক? প্রশ্ন হলো, তাহলে কি সেই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? বিএনপি ও তার মিত্ররা কি রাজপথে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবে না? ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো সেটা একতরফা। সুতরাং অগ্রহণযোগ্য, ভঙ্গুর সরকারের জন্ম দেবে না? এই সওয়ালের মীমাংসার জন্যই সম্ভবত সরকার তাড়াহুড়ো করে এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়েছে। এখনকার সরকার তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বৈধ সরকার। তার কবজিতে জোর আছে, বুকে হিম্মত আছে। কাজেই এখন বিরোধী দলের আন্দোলনকে সে শক্তিমত্তার সঙ্গে দমন করতে পারবে। আগামী আড়াই বছর ধরে ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে বিএনপি, এই বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকারি নীতিনির্ধারকদের সন্দেহ আছে। আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে, সে জন্য তারা কঠোর দমননীতির আশ্রয় যে নিয়েছে, টেলিভিশনের পর্দায় হরতালকারীদের ওপর পুলিশের লাঠ্যৌষধি প্রয়োগের নমুনা দেখেই তা প্রতীয়মান। বাংলাদেশে হরতাল করে কোনো বৈধ নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা যায়নি, আওয়ামী লীগ পারেনি বিএনপি সরকারকে উৎখাত করতে, বিএনপিও পারবে না আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে। এই আড়াই বছরে তাদের আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয়, পরবর্তীকালে নির্বাচন বর্জন করার পরে যখন সংসদেও তাদের কোনো আসন থাকবে না, তখন তারা আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে পড়বে বলে হয়তো সরকারি নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন। এবং এর মধ্য দিয়ে হয়তো তাঁরা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দেশের দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পাবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকায় মহাজোট সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে না। ফলে ইয়াজউদ্দিন সরকারের মতো দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার আসবে না। ২০০৬ সালে লগি-বৈঠা আন্দোলনের সময় বিএনপির সামনে দিন কমে আসছিল, তারা ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য দিন গুনছিল, কার হাতে ক্ষমতা দেবে, এটা ছিল তাদের মাথাব্যথা। ২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের সামনে সেই দুশ্চিন্তা থাকবে না। তারা কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন সমাধা করে ফেলবে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলন সহ্য করার চেয়ে এ মুহূর্তে বৈধ ও শক্তিশালী মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে আপাতত দুর্বল হতশক্তি বিএনপিকে আন্দোলনে নামিয়ে দিয়ে তার শক্তিক্ষয় ও বিনাশই হয়তো আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য।
এর বাইরে আর দুটো কারণ থাকতে পারে। সরকার যখন ভারতের সঙ্গে কোনো লেনদেন বা চুক্তিতে যায়, তখন বিএনপি তথা বিরোধী দলকে অন্য কোনো ইস্যুতে ব্যতিব্যস্ত রাখে। বেগম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ কিংবা ঢাকা বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল কুমিরকে বোকা বানানো, কুমির যাতে পা বাদ দিয়ে শেয়ালের লাঠিটাকে কামড়ে ধরে। হয়তো সরকার শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কোনো সমঝোতায় যাবে, কিন্তু তার আগে তাকে একটু ব্যস্ত রাখল। অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন, এ নিয়ে যেন বিরোধীরা কথা বলার সুযোগ না পায়, সেই পরিস্থিতি তৈরি করল।
এতক্ষণ আমরা যা আলোচনা করলাম, তার সবই অনুমান; এ মুহূর্তে আন্দোলন-হরতাল ডেকে আনার সরকারি উদ্যোগের কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা। আমাদের অনুমান সঠিক হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, তা হলো, আগামী আড়াইটা বছর আমাদের এই রকম হরতাল-আন্দোলন-বিক্ষোভ দেখে যেতে হবে। রাজপথে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হবেন বিরোধী দলের প্রধান হুইপ। হরতালের আগের দিন অনেক গাড়ি পোড়ানো হবে। ট্রাকে আগুন দেওয়া হবে মাত্র ১০০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, আর সর্বশরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে বার্ন ইউনিটে কাতরাবেন কোনো নিরীহ শ্রমিক। আম পচবে, তরিতরকারি পচবে ট্রাকে ট্রাকে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় অপূরণীয় ক্ষতি হবে দোকানমালিকের, কর্মচারীর, অর্থনীতির। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। গোলযোগের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে বাংলাদেশ। আর সত্যি সত্যি যদি সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না আসে, এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন যদি একপক্ষীয় হয়, তাহলে এক মাঘে শীত যাবে না। আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল চলবেই। সেই ভবিষ্যৎটা ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে, চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।
অথচ সরকার কিন্তু সুশাসন দিয়ে দেশটাকে উন্নতির দিকে নিয়ে গিয়ে জনগণের মন জয় করেই মানুষের কাছে ভোটপ্রার্থী হতে পারত। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। যানজট সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রের ব্যাপারে অন্তত একটা সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে। শুধু দলীয়করণ আর দুর্নীতি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীদের বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই সরকার হতে পারত আমাদের ইতিহাসের সফলতম সরকার। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে রাজপথকে শান্ত রাখা গেলে অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে এগোতে বাধ্য। শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয় সামলে নিতে পদক্ষেপ জরুরি ছিল। কিন্তু সরকার সুশাসনের দিকে জোর না দিয়ে বিরোধী দলকে দমন করার পেছনে শক্তি ব্যয় করছে বেশি। এর পরিণতি কী হবে, তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের দেশের নিয়ম হলো, রাজপথে প্রথম দিকে লোক থাকে না, আন্দোলন চলতে থাকলে আস্তে আস্তে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। আর আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার যত কঠোর হয়, তার জনপ্রিয়তা তত কমতে থাকে এবং সরকারও ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সরকার একটার পর একটা দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়, আর তার জনপ্রিয়তায় একটার পর একটা ধস নামে। তখন কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পেশাজীবী সমাজের স্বাধীন মত ও সমাবেশের ওপরও সরকার চড়াও হয়। সেটা কেবল রুদ্ধশ্বাস অগণতান্ত্রিক পরিবেশই তৈরি করে। তা থেকে উত্তরণের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তখন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
আমরা ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি চাই না। দিনবদলের কথা বলে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সত্যিকারের দিনবদল চাই। যেসব কথা রূপকল্প ২০২১-এ লেখা আছে, তার বাস্তবায়ন চাই। দলীয়করণ চাই না। নির্মম পুলিশি রাষ্ট্র চাই না। আমাদের নেতারা দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের নেতা হয়ে উঠুন, হয়ে উঠুন রাষ্ট্রনায়ক, আমরা কায়মনোবাক্যে সেই প্রার্থনা করি সর্বদা। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে অন্ধকার, নিকষ কালো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments