প্রাথমিক শিক্ষক-পাঠদানই মুখ্য কাজ হোক by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনায় অসংখ্য কমিটি গঠিত হয়। ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক কমিটি, বাধ্যতামূলক ওয়ার্ড কমিটি, বিদ্যালয় কল্যাণ কমিটি। এসব কমিটির কাজকর্ম, রেজুলেশন ঠিক রাখতে একাধিক শিক্ষককে ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষকের শিক্ষাদান সংশ্লিষ্ট কাজগুলো চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রতিদিন পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, হোম ভিজিট, মডেল টেস্ট, সাপ্তাহিক, মাসিক, সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নেওয়া, সমাপনী পরীক্ষার স্বল্প সময়ে সব কাজ করা, বই বিতরণ, মাস্টাররোল করা, উপকরণ তৈরি শিক্ষকদের দৈনন্দিন কাজ
একটি জাতি সঠিক পথে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে কি-না তা বিচারের একটি পরিপূর্ণ অবস্থা হচ্ছে সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে যাচাই করা। স্বাধীনতার চার দশক পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জাতি যখন তার অগ্রগতির পথ ধরছে, তখন শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্রটা ভিন্ন। আর এ ক্ষেত্রে চরম অবহেলার শিকার এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। আর্থিক, সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করা হয় তা ক্রীতদাস প্রথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য দান এই শিক্ষক সমাজ। তাদের ওপর এক একটি স্তর রয়েছে কেবল তাদের কাজের পরিধি বাড়ানোর জন্য। অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তার চেয়ে তাদের অনেক বেশি কাজের বোঝা বহন করে চলতে হয়, যা ক্ষেত্রবিশেষে মূল কাজকে ছাপিয়ে যায়।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের শিশুদের স্কুলগামী করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কর্মসূচির সাফল্যে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে শিক্ষকদের ওপর অমানবিক কাজের চাপ ও বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড। অপরিসীম কাজের চাপ সহ্য করেও তারা মূল কাজ পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় শতভাগ শিশু ভর্তিসহ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীণ কার্যক্রমে প্রাথমিক শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর অভাবে শিক্ষকদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সমুদয় কাজ করতে হয়। অথচ উচ্চ বিদ্যালয়ের সব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য কর্মচারীর সমাহার। প্রয়োজনীয় দিক বিবেচনা করলে কচি মুখগুলোর তত্ত্বাবধানে লোকবল আরও বেশি হওয়া উচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনায় অসংখ্য কমিটি গঠিত হয়। ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক কমিটি, বাধ্যতামূলক ওয়ার্ড কমিটি, বিদ্যালয় কল্যাণ কমিটি। এসব কমিটির কাজকর্ম, রেজুলেশন ঠিক রাখতে একাধিক শিক্ষককে ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষকের শিক্ষাদান সংশ্লিষ্ট কাজগুলো চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, হোম ভিজিট, মডেল টেস্ট, সাপ্তাহিক, মাসিক, সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নেওয়া, সমাপনী পরীক্ষার স্বল্প সময়ে সব কাজ করা, বই বিতরণ, মাস্টাররোল করা, উপকরণ তৈরি শিক্ষকদের দৈনন্দিন কাজ।
এর বাইরেও তাদের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষকদের নানা সমস্যার জন্য অফিসে যাওয়া, সমস্যা নিরসনে অর্থ খরচ করা, আদমশুমারি, শিশু জরিপ, নির্বাচন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, কাঁচা-পাকা পায়খানার হিসাব, বিস্কুট বিতরণ ও হিসাব রাখা, উপবৃত্তির তালিকা প্রণয়ন, উপজেলা ও জেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান, উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন র্যালি করা। এ ছাড়াও রয়েছে থানা শিক্ষা অফিসে অগণিত তথ্যসহ মাসকাবার নামক আদি তথ্য পূরণ, উপকরণ মেলার জন্য পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়সহ অসংখ্য কাজ। প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদাহানিকর কাজ হচ্ছে সমাপনী পরীক্ষার খাতায় কোড নম্বর দেওয়া সত্ত্বেও তাদের দূরদূরান্তে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে খাতা দেখতে হয়। প্রধান পরীক্ষকদের যেতে হয় অন্য উপজেলায়। এ জন্য কোনো যাতায়াত ভাতা দূরে থাক, সামান্য সম্মানীও কমানো হয়েছে। যেমন ২০১০ সালের হল সুপারের সম্মানী ছিল ৯০৬ টাকা। ২০১১ সালে সেটি নেমে দাঁড়িয়েছে ৬৮০ টাকায়। ২০১১ সালে সহ-হল সুপার ৫১০ অথচ ২০১০-এ তা ছিল যথাক্রমে ৭৭৬ টাকা। নিরীক্ষক ২০১১ সালে পেয়েছেন ০.৫০ টাকা অথচ ২০১০ সালে পেয়েছেন এক টাকা। প্রধান পরীক্ষকদের ২০১০ সালে মোট খাতার ৫% ৫ টাকা হারে। ২০১১ সালে মোট খাতার ৫% ৩ টাকা হারে প্রদান করা হয়। জেএসসি পরীক্ষার সম্মানীর হারও অনেক বেশি। ২০১১ সালে তা আরও বৃদ্ধ করা হয়েছে। জেএসসির খাতা দেখার জন্য ভিন্ন স্থান বা অন্য থানায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাস্টার্স পাস নিয়োগ হয়ে পান প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা অথচ একই যোগ্যতা নিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পান এক জুনিয়র অফিস সহকারীর বেতন ও তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা। সরকারের এ বৈষম্য যেন রাজকর্মচারী তথা সাধারণ খেটে খাওয়া কামলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
শিক্ষার্থীর শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে যুগ যুগ ধরে প্রবর্তিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি সব মহলের নজর কেড়ে নিত, যা ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব। পাঠদান-পাঠ গ্রহণ প্রক্রিয়ার সহায়ক ছিল এই ছুটি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ছুটির তালিকায় ১০টি শুক্রবারকেও তালিকাভুক্ত ছুটি হিসেবে গণ্য করে ৭৫ দিন ধরা হয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর ছুটির তালিকায় শুক্রবারকে ০০ দিন ধরা হয়েছে, যা বৈষম্য বলে বিবেচিত। ভুলে গেলে চলবে না বিশ্রাম কাজেরই অঙ্গ। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিলে কাজে নবউদ্যম তৈরি হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কচি শিশুদের হৈহুল্লোড়ের মাঝে শিক্ষকদের প্রশান্তির জন্য ছুটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ঈদে মিলাদুন্নবী, জাতির জনকের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, জাতীয় শিক্ষা পক্ষ, বিজয় দিবস উদযাপনে শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয়। এ ছাড়াও মা দিবস, উঠান বৈঠক, ক্রীড়ানুষ্ঠান, শিশু জরিপ, বঙ্গবন্ধু ফুটবল প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে তাদের ছুটির দিনগুলোতে কাজ করতে হয়। ২০১১ সালের মতো ২০১২ সালের ছুটির তালিকায়ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে ছুটি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা দেখায় 'মুরগি খাওয়ায় জল' প্রবাদের মতো। বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি থাকে না বলেই বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে না। অন্যান্য সরকারি কর্মচারী সরকারি ছুটি ব্যতিরেকে সপ্তাহে দু'দিন ছুটি ভোগ করেন। হিসাবান্তে দেখা যায়, শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম ছুটি ভোগ করেন। কম ছুটি ভোগ করার পরও শিক্ষকদের ভ্যাকেশনাল বিভাগের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। অথচ সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া হয় নন-ভ্যাকেশনাল বিভাগের সুবিধা। প্রাথমিক শিক্ষকদের নন-ভ্যাকেশনাল সুবিধা প্রদান করার লক্ষ্যে জাতীয় দিবসগুলোকে ছুটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ছুটির তালিকা সংশোধন করা আবশ্যক। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যের মূলোৎপাটন করে, নন-ভ্যাকেশনাল সুবিধা প্রদান করার প্রত্যাশা করা কি অযৌক্তিক?
ব্রিটিশ আমলে সমাজে শিক্ষিত নাগরিক খুঁজে পাওয়া দুর্লভ ছিল। তাদের মাঝে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি দেখা যেত, তারা বিশেষভাবে কোনো গৃহে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদের পড়াতেন, সে থেকেই সম্ভবত একটি প্রবাদের শুরু। 'যার নেই কোনো গতি, সেই করে পণ্ডিতি'। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষকরা পেলেন সরকারি মর্যাদা, শুরু হলো বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সংস্কার। শিশুরা পেল বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক, দুধ, ছাতু, বিস্কুটসহ নানা শিক্ষা উপকরণ। ডক্টর কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গড়ে উঠল বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ। আজ বিজয়ের ৪০ বছর পরে ডিজিটাল বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ফেলে আসা কাজগুলো শুরু হতে দেখে প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে জাতিও আশান্বিত। অতীতে প্রাথমিক শিক্ষকরা শিক্ষাদান কাজেই নিজেদের ব্যাপৃত রাখতেন। ক্রমান্বয়ে কাজের ব্যাপকতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মূল কাজ শিক্ষকতা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর।
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিস্তর বৈষম্যের মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে শিক্ষকদের কাজ করার আগ্রহ। শিক্ষকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা তাদের মূল কাজ অর্থাৎ পাঠদানে মনোনিবেশের সুযোগ দেওয়া হোক, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দেখবেন এ প্রত্যাশায়।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান : শিক্ষক নেতা ও প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক গবেষক
No comments